ধারাবাহিক উপন্যাস <br /> কেদার ( অষ্টম পর্ব) <br /> শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

ধারাবাহিক উপন্যাস
কেদার ( অষ্টম পর্ব)
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

পূর্বের ৭টি পর্ব পড়তে ক্লিক করুন– প্রথম ৭টি পর্ব

“দাবোষ্ণখরবাতোঽয়ং শ্বাসবদ্ ভাতি পশ্যত/ তদ্দগ্ধসত্ত্বদুর্গন্ধোঽপ্যন্তরামিষগন্ধবৎ //২৩//১০(১)//”
(অঘাসুরের মুখগহ্বর থেকে দাবানলের মতো শ্বাস, আর তার ভুক্ত প্রাণীদের দগ্ধ মাংসের দুর্গন্ধ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে।)

এ তীব্র দাবদাহ। যেন প্রকৃতির প্রতিটি বিন্দু পরমাণু থমকে আছে। গাছের একটি পাতাও নড়ছে না। গোকুলঘরিয়ার প্রতিটি অবলা প্রাণী নিঃশব্দে কোনও নিবিড় ছায়াঘন আশ্রয় খুঁজে চলেছে। গোকুলিয়া নদীর জলস্তর নেমে গেছে কবে। শুষ্ক বৃদ্ধা যোনির মতো সে যেন শেষটুকু জলকুণ্ড আঁকড়ে কোনও মতে শ্বাস নিচ্ছে। জল নামতেই নিরুপায় গ্রামবাসী বিকল্প পথ খুঁজে নিচ্ছে। গোকুলিয়া এপার ওপার করতে আর জল লাগছে না পায়ে। অত্যুৎসাহী প্রশাসক খানিকটা মাটি ফেলে দিলেন চলাচলের সুবিদার্থে। এতে সেতুনির্মাণের বড় দায়ভার থেকে সহজে নিষ্কৃতি পাওয়া গেল। নতুন মাটির পথ নদীর বুকে লোহার শিকলির মতো দগদগে হয়ে চেপে বসছে। খোকুলিয়ার রক্তক্ষরণ মানুষ দেখেও দেখছে না, তার গুমড়িয়ে ওঠা কান্না মানুষ শুনেও শুনছে না। গোকুলিয়া বুকের উপর দিয়ে এপার ওপার হচ্ছে ভ্যান রিক্সা, টোটো, ছোট মারুতি ভ্যান। নদীটিকে আর নদী বলে চেনা যায় না। যেন ডুকরে কেঁদে ওঠা বিরহী রাধারাণী সে। তার মৃত্যুর পথ নেই। অথচ জীবনের তরঙ্গও হারিয়ে গিয়েছে।
গোকুলিয়ার উপর দিয়ে মানুষের চলাচল দেখে অলোকানন্দা। আজকাল আর টিউবকলে তেমন ঝলকে ঝলকে জল উঠে আসে না। গোকুলিয়ার মজে যাওয়া দেখে মাথার ঘাম মোছে সে। মুরগিছানাগুলোকে তীব্র রোদ্দুর থেকে বাঁচাতে ভিজে চট পেতে দিয়েছে সে উপরে।নতুন মাস পড়ে গেল। রণজয় সেন আসবে যে কোনও দিন। মুরগিদের ভিটামিন গুঁড়ো দিতে দিতে তাদের ছোট ছোট ঠোঁটের স্পর্শ নিজের হাতের আঙুলে অনুভব করে অলোকানন্দা। ওই গোকুলিয়ার মতোই তার জীবন। তার মরা সোঁতার উপর পথ বানিয়ে কৃষ্ণেন্দু শহরে চলে গেছে বেশ কিছুদিন। ফোনে জিজ্ঞেস করলে বলে কলেজের অ্যাসাইনমেন্ট। কিন্তু অলোকানন্দার মায়ের মন। সে যে সর্বত্রগামী। অলোকানন্দা বুঝতে পারে। কৃষ্ণেন্দু বড় হচ্ছে। তার নিজস্ব জগত, নিজস্ব গোকুলঘরিয়া গড়ে উঠেছে। সেই জগতে কতো না বৈভব। ওই শহরের মেয়েটি। কী যেন নাম? সহেলী! কোনওদিন তাকে দেখেনি সে। গোকুলিয়া শুকিয়ে যেতেই লোকে বলাবলি শুরু করেছে। একদিন ইছামতীও এভাবেই শুকিয়ে যাবে। দেশের সমস্ত নদী এক এক করে শুকিয়ে যাবে। অলোকানন্দা দিন গোণে। মনে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ হয়। মনে মনে না দেখা না চেনা নতুন নতুন গেরামের সহেলীকে অভিসম্পাত দেয় অলোকানন্দা। বিড়বিড় করে বলে, “তুইও গোকুলিয়া নদী হবি। দেখে নে। তুইও হবি।” কেন এই অভিসম্পাত কে জানে। অলোকানন্দার মন গ্রীষ্মের দাবদাহর মতো নির্মম হয়ে ওঠে। ভিতরের সেই দহন প্রশমিত করতে সে স্নানঘরে ঢোকে।স্নান সেরে সামান্য পূজাপাঠ। খানিকটা শীতল লাগছিল ভিতর ভিতর অলোকানন্দার। শাশুড়িকে জল মুড়ি খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে সে আধসেলাই করা কাঁথাগুলো নিয়ে বসল। কতোদিন সুকুমারী আসে না এইপথে। মনের ভিতর হুহু করে। কৃষ্ণেন্দুর দেওয়া মোবাইলে সুকুমারীর নম্বর ডায়াল করলেই বলে ‘স্যুইচ অফ’। সুকুমারীর বাড়ি পাশের গ্রাম রাজনগরে। একদিন গিয়েছিল সে রোদ পড়তে পড়তে। দরজায় তালা দেখে চলে এল। প্রতিবেশীকে জিজ্ঞেস করতে বলল, অদ্বৈত গোঁসাইদের সঙ্গে হঠাৎ নাকি বৃন্দাবন গেছে। কী এমন জরুরি বিষয় ছিল যে এই হঠকারিতা করতে হল তাকে? একবারটিও তাকে কি বলে যাওয়া যেত না? মনের ভিতরটা হু হু করছিল অলোকানন্দার। ভাবতে ভাবতে দু দুবার আঙুলে সূঁচ ফুটে গেল তার। কাপড়ের উপর উদুখল নিয়ে ছোট্ট গোপালঠাকুর হামাগুড়ি দিতে গিয়ে আটকে গেছে। সেলাই করতে করতে অলোকানন্দা দেখে আকাশের কোণে ঘন কালো মেঘ। তবে কি আজ বৃষ্টি হবে? হোক। ঘাম গড়িয়ে পড়ছে তার সর্বাঙ্গ থেকে। এখনও তার শরীরে এতো স্রোত বেঁচে আছে কে জানত। আকাশের সূর্যর তেজ দেখে বুঝতে পারে অলোকানন্দা। এটা কেষ্ণেন্দুর টিফিন খাবার সময়। কী খেল ছেলেটা? একা একা সব পারছে? গতকাল রাতে একবির ফোন করেছিল। তার কথা, ঠাম্মার কথা জিজ্ঞেস করল। নিজের কথা কিছুই বলল না। জিজ্ঞেস করার আগেই ফোন কেটে দিল। মনে মনে বুঝতে পারে অলোকানন্দা। ছেলে তার অভিমানী। সহজে তার মন বুঝবার নয়। বেশ। করুক অভিমান। একদম চুপিসারে মরে যাবে সে। কারোকে জানতে দেবে না। তখন বুঝবে হয়তো। কে জানে!
বিকেলের দিকে একা একাই একবার গোঁসাইদের আখড়ায় গেল অলোকানন্দা। অদ্বৈত গোঁসাই বা শচীমাতা না থাকায় আখড়া খাঁ খাঁ করছে। মৃদঙ্গ বাজাচ্ছে নতুন একটি ছেলে। আর কীর্তন করছে মাধব। মাধব অদ্বৈতর ধর্ম ছেলে। তাঁর অবর্তমানে এই আশ্রমের সব দেখভাল সেইই একাহাতে সামলাচ্ছে। দাওয়ায় বসে পড়ল অলোকানন্দা। অদূরে ঘোমটার আড়ালে এক চেনামুখ দেখতে পেল সে। রণজয় সেনের পত্নী সুলোচনা। কীর্তনের তালে তালে মৃদু দুলে উঠছে সে। ঠোঁটে বিড়বিড় করছে। “হরিবোল মুগধা বোলরে। যাহে নাহি হয় শমন ভয় রে।।” মাধবের গলা বড় পুরুষালি। সে যেন বিভোরে গেয়ে চলেছে, ‘তুয়া চরণে মন লাগহুঁ রে।’ নিজের অজান্তেই দুই হাত জোর করে দুলে ওঠে অলোকানন্দা। তার দুই চোখ দিয়ে অঝোরধারায় জল গড়িয়ে পড়ে। যেন গোকুলিয়া নদীর বুকে বান এসে গেল। সকলেই ছেড়ে যাচ্ছে তাকে একে একে। অরিন্দম, কৃষ্ণেন্দু, সুকুমারী। কেন? কেন গোপীনাথ? মনকে মনেই প্রশ্ন করে অলোকানন্দা। মনে মনে বলে, ‘তুমি তো সকলই পারো গোপীনাথ। তুমি তো সকলই পারো।’
মাধবের কীর্তন শুনতে শুনতে বেলা গড়িয়ে গেল। কৃষ্ণেন্দু ফোন করল নি একবারও। ভাবতে ভাবতে অলোকানন্দা দেখল সূর্য দিগন্ত পার করে গেছে। বাড়ি ফিরতে হবে। এখানে কেউ তেমন সুকুমারীর কথা বলতেই পারল না। উঠৈ চলে আসার সময় অলোকানন্দা দেখল সুলোচনা বিস্ফারিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কিছু কি বলতে চায় মেয়েটা? কে জানে! ফিরতি পথে গোধুলির আলোআঁধারিতে বুকের ভিতর ঢিবঢিব করছিল তার। দেড়শ পা হাঁটলেই আমবাগান শুরু হবে। এই পথে সুকুমারী ছাড়া একা একা সে কখনও আসেনি। আকাশের ঈশান কোণ ঘন কালো করে আছে। তার আড়াল থেকে অস্তমিত সুর্যের রক্তাভ আভা এক কাপালিকের তিলকের মতো আকাশে লেগে রয়েছে। আমবাগান দিয়ে যেতে যেতে মনে হল কেউ যেন তার পিছু নিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পিছনে ঘুরে তাকালো অলোকানন্দা। নাহ। কেউ তো নেই! তবে। আবার সে হাঁটতে থাকে। আবার সেই অদৃশ্য অশরীরী তার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটতে থাকে। চোয়াল শক্ত করে সে। মুখোমুখি হতে হবে।
-কে রে তুই? পিছু নিস?
অলোকানন্দার কথাগুলো আমবাগানের গাছগুলোতে ধাক্কা খেয়ে ফিরে ফিরে আসল। অলোকানন্দা বুঝতে পারল তার বুকের ভিতর হৃদস্পন্দন আরও দ্রত হয়ে গেছে। আলুথালু তড়িঘড়ি হাঁটতে থাকে সে। ঈশানের ঘনকালো মেঘ যেন আকাশের অনেকটাই গ্রাস করে ফেলেছে। আসন্ন ঝড়ের আশঙ্কায় রাস্তা শুনশান। অলোকানন্দা মনে প্রাণে চায়, একবার তার কৃষ্ণেন্দুর দেওয়া ফোনটা বেজে উঠুক। অথবা একবার অন্তত কোনও টোটো আসুক এই পথে। ভাবতে ভাবতে অলোকানন্দা দেখল, আমবিগানে গাছগুলির পাতা নড়ছে সড়সড় শব্দে। সে শব্দ যেন অরিন্দমের ঘুমন্ত শ্বাসপ্রশ্বাসের মতো। নুইয়ে আসা আমবাগানের ডালে ডালে যেন অজস্র চোখ অলোকানন্দাকে দেখছে। সর্বনাশ! হঠাৎ মনে পড়ল অলোকানন্দার। বাড়ি থেকে বেরোবার সময় সে মুরগিখাঁচার চাবি দিতে ভুলে গেছে। এবার যদি মুরগিছানাগুলো পালিয়ে যায় ।যাক। বেশ হবে। কাল রণজয় সেন ওদের নিয়ে যাবে শহরের বাবুসাহেবদের পাতে কিমা হবার জন্য। তার আগে পালাক ওরা। ওদের ঠোঁট ছুঁয়েছে অলোকানন্দা। সেই স্পর্শ তার ভিতরে মায়ের মন জাগিয়ে তুলেছে। সেই কথা শুনে আমবাগানের অন্ধকার থেকে ‘হিহিহিহি’ শব্দ ভেসে এল বাতাসে।
-কে বলবি? হারামজাদি? ভয় দেখাস?
-হিহিহিহি।
-তবে রে! দেখাচ্ছি মজা।
-কেমন আছো অলোকা?
-অরিন্দম তুমি!
-হ্যাঁ। কতোদিন দেখিনি তোমাকে। কেমন রুগ্ন হয়ে গেছ।
-কী করব? কেউ নেই পাশে। একা একা সব…
-জানি। বুঝি।
-বোঝো? তাহলে আসো না কেন?
-জানো আমার সে উপায় নেই…
আবার পাতার আড়াল থেকে ‘হিহি’ শব্দে হেসে ওঠে কেউ। অলোকানন্দার এবার বুক ধড়ফড় করতে থাকে। সে মাথা নীচু করে কোনও মতে আমবাগান পার হতে লাগল।
ছায়ার মতো আমবাগান থেকে বেরিয়ে এসে অলোকানন্দা দেখল চারপাশে দমবন্ধ অন্ধকারের ভিতরেই তার ঘরের আলো জ্বলছে। মনে মনে সে ভাবছিল। শাশুড়ির ঘরের আলো কি সে জ্বালিয়ে বেরিয়েছিল? ভাবতে ভাবতে সে হেঁটে গেল মুরগিখাঁচার দিকে। আর ঠিক তখনই দিনের সর্বশেষ ক্ষীণতম আলোয় হঠাৎ আকাশে চমকে উঠল বিদ্যুৎ। আর তখনই সে আবিষ্কার করল, তার পথ আগলে রয়েছে এক ছায়ামূর্তি। রণজয় সেন। এক তীব্র গন্ধে তার মনে পড়ে গেল অরিন্দমের কথা। রণজয় মদ্যপান করেছে। এ সন্ধ্যায় কী চায় সে?
-কোথায় গিয়েছিলে সোনা?
-ভদ্রভাবে কথা বলুন। কী দরকার বলুন।
-দেখতে এলাম।
-কী?
-মুরগিছানাদের। কাল নিতে আসব তো। তাই।
রণজয়ের অট্টহাস্যে দমকা বাতাসের মতো ঝড় উঠল। অলোকানন্দা সেই আকস্মিকতায় দৌড়ে গেল খাঁচার দিকে। রণজয় তার পিছনে ধাওয়া করল। অলোকানন্দার মনে হল, যেন অগাসুর তার প্রকাণ্ড অজগরের গ্রাস নিয়ে তার দিয়ে এগিয়ে আসছে। এই বুঝি গিলে ফেলবে তাকে। হা কৃষ্ণ। সে যে একা। ভাবতে ভাবতেই এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটল। আকাশে আরও একবার বিদ্যুৎ ঝলকে উঠতেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নেমে এল। আর খাঁচা থেকে পিল পিল করে মুরগিছানারা বেরিয়ে এল বাইরে। রণজয় সেন জলে ভেজা হাতে অলোকানন্দাকে স্পর্শ করতে গিয়েই ‘উফ’ করে সরিয়ে নিল হাত। পাথরের মতো অজস্র শিলা পড়ছে। সেই শিলায় অজস্র মুক্ত প্রাণীর ভিতর নিথর দেবীমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে অলোকানন্দা। সে আর নড়ছে না। শিলার আঘাতে তার কপাল ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তবু সে স্থির। অলোকানন্দা হাসছে। হো হো করে হাসছে। সেই হাসি বড়ো বিষম। সেই হাসির ভিতর এক ভয়ানক অলৌকিকতা লুকিয়ে। রণজয় সেন সে হাসি আর সহ্য করতে পারল না। দু হাতে তার দুচোখ ঢেকে দৌড়ে সেখান থেকে সরে গেল।

(ক্রমশ)

লেখাটি যদি ভালো লাগে, আবহমানে নিজের ইচ্ছেমতো ফোন পের মাধ্যমে
অবদান রাখতে পারেন, এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে। ফোন পে করুন 9051781537
অথবা স্ক্যান করুন পেমেন্টের লিংক

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes