আমার শিক্ষক-  <br /> সৌম্য দাশগুপ্ত

আমার শিক্ষক-
সৌম্য দাশগুপ্ত

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গত মিলেনিয়ামের বিখ্যাত বাংলার অধ্যাপক সুকুমার সেন তাঁর আত্মজীবনী ‘দিনের পর দিন যে গেল’ বইয়ে তাঁর একেবারে ছোটবেলাকার শিক্ষকদের সম্বন্ধে অনেকটা অংশ লিখেছিলেন | সেইসব শিক্ষকদের নানারকম ব্যক্তিত্ব, পড়ানোর পদ্ধতি, ও ছাত্রদের সঙ্গে অম্লমধুর সম্পর্কের গল্প বলার পরে তিনি মন্তব্য করেন – ‘আজ সেই শিক্ষকদের চরণে শতকোটী প্রণাম নিবেদন করি’ | এই জায়গাটা পড়বার সময় মনে হয়, বাপরে এত মারধোর খেতেন, তারপরও ছাত্রদের কিকরে এত ভক্তি ! কিছু একটা নিশ্চয়ই ছিল, র‍্যাডিকাল সুকুমার সেন মশাই তো ফট করে এরকম লিখবেন না! সুকুমার বাবুর সম্পর্কে অনেক গল্প – তিনি এম এ ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের আপনি করে কথা বলতেন, আবার বকুনিও দিতেন – ‘আপনারা কেউ পড়াশোনা করেন না , আপনারা এক-একটি গাধা!’ জীবনের উপান্তে এসে পৌঁছোনার পর যখন তাঁর সাক্ষাতকার নেন এক সাংবাদিক, তখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয় তাঁর সেরা ছাত্র কে ? তিনি জানান ওরকম কেউ নেই | বিস্মিত সাংবাদিক পাল্টা প্রশ্ন করেন, সেকী, কেউ নেই, এতদিন কী করলেন তাহলে এত ছাত্র পড়িয়ে? সুকুমারবাবুর উত্তর, কি করেছি? ভস্মে ঘি ঢেলেছি !
এইরকম চাঁচাছোলা কথা-বলা পাবলিক ইমেজের মস্ত বড় পন্ডিত যখন তাঁর মাস্টারমশাইদের সম্পর্কে ঐরকম বিনম্র মন্তব্য করেন, তখন আমাদের মন আর্দ্র হয়ে ওঠে , স্বাভাবিক ভাবেই কৌতুহল হয় যে কী এমন প্রভাব সেই বিংশ শতাব্দীর দরিদ্র টোলপন্ডিতরা রেখেছিলেন বালক সুকুমারের ওপর যে তাঁর আজও এত শ্রদ্ধা জাগে | সুকুমারবাবুর গল্প তাঁর নিজের, আমি আমার অভিজ্ঞতার কথা বলে আমাদের শিক্ষকদের দিকে তাকিয়ে দেখতে চাই সেরকম শ্রদ্ধা জাগে কিনা | স্কুলের গল্পই আজ করব আরেকদিন লিখব প্রেসিডেন্সির কথা |
আমি একেবারে বাল্যকালে পড়েছিলাম দুর্গাপুর শহরে জেসুইট পাদ্রীদের চালানো সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে , যেখানে ক্লাস ফোর অবধি পড়ার পরে আমাকে দেওয়া হয় নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন আশ্রমে | তখন মাধ্যমিক–উচ্চমাধ্যমিকে নরেন্দ্রপুরের খুব ভাল রেজাল্ট হতো, আর হোস্টেলে কৃচ্ছ্রসাধনের বিধি থাকায় আমার বাবার (তিনিও সুকুমার সেনের ছাত্র) মনে হয়েছিল এতে আমার চরিত্র তৈরি হবে | কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্যে যেটা সবচেয়ে কষ্টের ছিল, সেটা হল আমাদের হোস্টেলের ঘরে ফ্যান ছিল না | দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ওই গুমোট গরম, চারপাশে ভয়ানক বাঁশবন , তার মধ্যে ফ্যান না থাকার সঙ্গে চরিত্রগঠনের কী সম্পর্ক জানি না , তবে আজকাল যে এ-সি ছাড়া থাকতে পারি না তাতে টের পাই যে ওসবে বিশেষ কাজ হয় না | ওদিকে আমরা স্কুল ছাড়ার পরপরই হোস্টেলেও ফ্যান এসে গেছে | নিজেদের ঘর পরিষ্কার রাখা, নিজের বাসন মাজা, কাপড় কাচা, এইসব কাজ সেই দশ বছর বয়েস থেকেই অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল |
আবাসিক স্কুলের শিক্ষকরা অনেকেই ছাত্রদের সঙ্গে হোস্টেলে থাকেন, তাঁদের তত্ত্বাবধানে থেকে তাঁদের সাহচর্যের নিরাপত্তার তুলনায় তাঁদের ভয়ই পেতাম বেশি ,সাতের দশকে আমাদের দেশে পিটুনির কোনও কার্পণ্য ছিল না | কিন্তু এইসবের পরেও আজ পিছনে ফিরে তাকিয়ে মনে হয় যে এই নিম্নমধ্যবিত্ত, উচ্চাশাহীন, নির্লোভ ছাত্রপ্রেমী মানুষগুলি সম্পূর্ণভাবে আত্মসুখবিসর্জন দিয়ে আমাদের তৈরি করার জন্য ব্রতধারণ না করলে আমাদের কিছু শেখা হতো না | এইরকম কয়েকজনের কথা আজ বলব | আমি নিশ্চিত যে আপনাদের সবারই এরকম শিক্ষক-কাহিনীর স্টক আছে, আমি শুরু করলেই আপনাদের কাছ থেকে আরো অনেক গল্প শুনতে পাব |

নরেন্দ্রপুরের সর্বকালের সবচেয়ে খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষক ছিলেন শ্রী অজিত সেনগুপ্ত | ইনি বায়োলজি পড়াতেন| এইখানেই দাঁড়ি দেওয়া যেত, কিন্তু এইখানে থামলে তিনি আরকি কি করতেন তার কিছুই বলা হয় না | অজিতদা (রামকৃষ্ণ মিশনে মাস্টারমশাইদের দাদা বলে ডাকার চল, শান্তিনিকেতনের মতই, পরে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে বা তারও পরে প্রেসিডেন্সি কলেজে গিয়ে স্যার বলে ডাকার রেওয়াজ আমাকে ফের রপ্ত করতে হয়েছিল ) বায়োলজি পড়াতেন, নাটক করাতেন, ফুটবলে কিক করা শেখাতেন ধুতি তুলে, পাঞ্জাবি ছেড়ে লাফ দিয়ে উঠে ভলিবলে চাপ মারতেন, সাঁতার কাটতেন, প্রেয়ারহলে গলা ছেড়ে আমাদের সঙ্গে গান করতেন, ধ্যান-নিমগ্ন হয়ে থাকতেন বহুক্ষণ, আবার ক্লাসে গিয়ে পড়ানোর সুত্রে আমাদের ভাষা শিক্ষাও দিতেন | ভাবতে পারেন, বায়োলজি ক্লাসে ভাষা শিক্ষা ! আমাদের সেকশনটি ছিল ইংলিশ মিডিয়াম, অন্যগুলি বাংলা । আমাদের সঙ্গে রাস্তাঘাটে, হোস্টেলে, অন্যান্য জায়গায় দেখা হলে বরিশালের এই সাদা ধবধবে ধুতি আর গিলে করা পাঞ্জাবি পরা নিপাট বাঙাল মানুষটি একদম কলকাতাইয়া বাংলাতেই কথা বলতেন, কিন্তু ক্লাসে ঢোকামাত্র সুইচ করে যেতেন একবারে কুইন্স ইংরেজিতে । তখন আমাদের কাছে নতুন নতুন সব শব্দ ব্যবহার করে আমাদের লাইফ সায়েন্সের ডিকটেশন দিতেন তিনি । সেল ডিভিশন হওয়ার সময় সেগুলো লম্বাটে হয়ে টানটান হয়ে যায়, বোঝাতে গিয়ে ব্যবহার করলেন ‘টঅট্ কন্ডিশন’ । তারপরে কারো একটা দিকে তাকিয়ে বলতেন ‘স্পেল ইট’ । বোর্ডে এই নতুন শেখা শব্দটি লিখতেন । বোঝাতেন, সায়েন্স পড়ো আর আর্টসই পড়ো, ভাষার ওপর প্রকৃত দখল তৈরি না করতে পারলে শিক্ষিত হতে পারবে না ।

অজিতদা সেকালের হিসেবে শৌখিন ছিলেন । অসম্ভব রোগা ছিলেন, একদম হাড়গোড় বার করা বলতে যা বোঝায়, আর গলার স্বর ছিল গমগমে । চুল পাটপাট করে ব্যাকব্রাশ করতেন, আর খশ সাবান মাখতেন । বহুদূর থেকে সেই খশ-এর সুগন্ধ পাওয়া যেত, আমরা বুঝতাম অজিতদা আশেপাশে আছেন । সেভেনে অজিতদাকে প্রথমে পাই, তারপর ফের নাইন-টেনে । ওই প্রবল ব্যক্তিত্ব, মোটা ফ্রেমের চশমার ভিতর দিয়ে মর্মভেদী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, আর মাঝেমাঝেই কোনো না কোনো পাকা ছেলের কাণ্ড লক্ষ্য করে এমন একেকটা তির্যক মন্তব্য করতেন যে অতি চালাকেরও বুদ্ধিভ্রংশ হয়ে যেত, একদম ছিন্নভিন্ন করে দিতেন | সুতরাং প্রয়োজন হলে অজিতদার জিভই ছিল প্রচণ্ড মারের মতন, তাঁর আর কারো ওপর হাত তোলার দরকার হত না । মাঝেমাঝেই আমাদের বলতেন, আমি পিতৃহীন মাতৃহীন অবস্থায় বড়ো হয়েছি, আমার কাছে স্নেহ দয়া মায়া প্রত্যাশা করিস না।

অথচ এই মানুষটির কাছে কী বিপুল পরিমানে আমরা পেয়েছি তা বলার নয় । ছয়ের দশক থেকে দশের দশক ব্যাপী পঞ্চাশ বছরে নরেন্দ্রপুর থেকে পাশ করা অন্তত চারশ জন বিখ্যাত ডাক্তারের মধ্যে প্রায় প্রতেকে এক বাক্যে বলবেন তাঁরা অজিতদার ক্লাস করে বায়োলজি ভালোবেসেছিলেন, আর সেই থেকে ডাক্তারির শখ । অথচ মজার কথা হলো যে অজিতদা ডাক্তারি আর ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াকে শিক্ষা লাভ করা বলতেন না । বলতেন এগুলো হলো পেশাদারী ট্রেনিং । বলতেন, সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক, ইতিহাস, দর্শন, নানান ভাষায় ব্যুৎপত্তি, এগুলো হলো প্রকৃত ‘শিক্ষা’, এবং পৃথিবীর সমস্ত কারিকুলামে এগুলি বাধ্যতামূলক করে দেওয়া উচিত, যাতে কিছু বিবেকবান, রুচিবান, হৃদয়বান প্রকৃত শিক্ষিত ব্যক্তি তৈরী হয়, তারা যাতে সমাজ গঠনের কাজে লাগে ।

অজিতদার কাছে সেই আটের দশকে যা শুনেছি, আজকে টের পাই তা কতো সত্য । এম আই টি-তে ইঞ্জিনীয়ারিং কারিকুলামে কবিতা পড়া বাধ্যতামূলক হয়ে গেছে, নতুন করে আন্দোলন উঠেছে যাতে প্রাইমারি বা মিডল স্কুল থেকে ছেলে মেয়েদের দর্শন পড়ানো হয়, ভাবতে শেখানো হয় ।

আমাদের যিনি ইতিহাস পড়াতেন, সেই সুভদ্র নীরব মানুষটিরও নাম ছিল অজিত দা, অজিত চট্টোপাধ্যায় । আমাদের শিক্ষকদের অনেকেই অন্যান্য স্কুলে হেডমাস্টার ছিলেন দীর্ঘদিন | হেডমাস্টারি করার পর রিটায়ার করলে নরেন্দ্রপুরে তাঁদের সসম্মানে নিয়ে আসা হতো, ইনি ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন । ইনিও ধুতি আর পাঞ্জাবি-শার্ট পরতেন, এঁরও শাদা চুল ব্যাক ব্রাশ করা, আর যখন যে ভাষায় কথা বলতেন তখন সেটার মধ্যে ভুলেও অন্য ভাষা ঢোকাতেন না । অর্গলহীন ভাবে মৃদুস্বরে টানা পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে ইতিহাসের এমন সুন্দর ইংরেজিতে লেকচার দিতেন যে মনে হতো যেন হীরেন মুখোপাধ্যায়ের ‘তরী হতে তীর’ পড়ছি, যেখানে বিখ্যাত সব ইতিহাসের ছাত্রদের গল্প শুনেছি, যাঁদের এম এ পরীক্ষার উত্তর পড়ে সেকালের ইংরেজ শিক্ষক মন্তব্য করেছিলেন, ‘দ্য এক্জামিনী ইজ বেটার ইনফরম্ড দ্যান দ্য একজামিনর, হেন্স ইট ইজ পয়েন্টলেস টু অ্যাসাইন এ মার্ক অন দিস এক্সেম্প্লারি পেপার’ ।

একদিন এই ইতিহাসের অজিতদা প্রশ্ন করেছেন, ‘হু ডু য়ু কনসিডার টু বি দ্য আশারার অব রেনেসাঁ ইন বেঙ্গল?’ সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সহপাঠী বোঁদে (বর্তমানে বস্টনের অর্থনীতিবিদ ডক্টর রাজীব রঞ্জন ভট্টাচার্য) সব-প্রশ্নের-উত্তর-জানি গোছের একটা স্মার্টনেস নিয়ে উৎসাহের সঙ্গে হাত তুলে কায়দা মেরে বলতে শুরু করলো, আই কনসিডার পান্ডিট ঈশওয়ার চন্ড্রা ভিড্যাসাগর টু বি দ্য আশারার…’ কথা শেষ না হতেই আমাদের সদা শান্তশিষ্ট অজিতদা গর্জন করে উঠলেন, একে বারে শম্ভু মিত্রের কণ্ঠে ক্রেয়নের প্রতি অয়দিপাউসের ক্রুদ্ধ ডায়ালগের মত, ‘য়্যান্ড আআই কনসিডার য়ু টু বি এ ফুউউল….. সিট ডাউন!!’ আরেক দিন উনি আমাদের কোনো একটা ব্যাপারে হাসাহাসি করতে দেখে খেপে গিয়ে বললেন ‘হোয়াই আর ইউ ঈডিয়টস লাফিং? হ্যাভ ইউ রেড ল’ স্ত্রেঞ্জ (দ্য আউটসাইডার), অর ফ্রান্ৎজ কাফকাজ মেটামরফসিস? ইজন্ট ইট রিডিক্যুলস দ্যাট ইউ অর ইন ক্লাস টেন, ইয়েট ইউ অর সো গ্রোসলি ইমবেসাইল দ্যাট ইউ হ্যাভনট রেড দিজ বেসিক বুকস ?’ ব্যাস – সেই লজ্জায় পরের দিন লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখি সব কটা কাম্যু-কাফকা সেদিনই চেক আউট হয়ে গেছে !

রেগে গিয়ে গালি দিয়েও কিভাবে ছাত্রদের শিক্ষিত করা যায়, সেদিন বুঝিয়ে দিলেন ইতিহাসের অজিতদা ।

বাংলার শিক্ষক বেণু সান্যাল ছিলেন বেশ হৃষ্টপুষ্ট গোলগাল, ইনিও ধুতিবংশীয় । মুক্তোর মত হাতের লেখায় ছাত্রদের খাতার ওপর যেসব মন্তব্য লিখতেন, সেগুলো পড়ে মনে হতো যে আমরা আসলে অনেক কিছুই জানি, কিন্তু লেখার সময় উল্লেখ করতে ভুলে গেছি । জয়াশিসের খাতায় লিখলেন, ‘আজকাল ওই যে কথা উঠেছে শোননি যে বিভূতিভূষণ নাকি পলায়নবাদী ছিলেন, তাই যদি হবে তো আর্ট ফর আর্টস সেক -এর যুক্তিই এক লবটুলিয়া দেখিয়ে খারিজ করে দিতে হয় ! কেন সর্বজয়ার কথা কি হারানো মানুষের কথা নয় ? – ‘জয়াশিস পলায়নবাদ বা এসকেপিজম শব্দগুলি ওই প্রথম শুনলো । আমরাও তাই । কিন্তু এমন ভাবে বেণুদা লিখেছিলেন, যেন ওঁর ধারণা আমরা সবাই এগুলো জানি, অন্তত জানার কথা তো বটেই । তখন তো উইকিপিডিয়া, গুগল, আর য়াহু সার্চ ছিল না, আস্ত একটা কম্পুটারই কেউ চোখে দেখেনি, তাই আমাদের চট করে সার্চ করারও উপায় ছিল না । অগত্যা বেণুদার কাছেই গিয়ে বললাম, বেণুদা, পলায়নবাদ কি জিনিস । যত্ন করে বুঝিয়ে দিলেন ।

অংকের শিক্ষক নীলাচল সামন্ত আমাদের সহপাঠি শুভ্রকান্তি লোধ-এর টেরিকাটা চুল দেখে একদিন বললেন, ওরে, টেরি আরও ভালো করে কাট, আমার ভাইয়ের ছবিতে তোকে হিরো করে নেবে । নীলাচলদার ভাই ছিলেন শক্তি সামন্ত, আর তাঁর ছবির বাজার আটের দশকে রমরমা, অনুসন্ধান সবে হিট করেছে । এই নীলাচলদা আরেক বিস্ময় । একজন অংকের শিক্ষক যে স্রেফ বিপুল স্নেহ আর ভালবাসায় ছাত্রদের ভরিয়ে দিয়ে তাদের অংকভীতি দূর করতে পারেন, সেটা তাঁকে না দেখলে বিশ্বাস হতো না । অংক নিয়ে বেশি বকবক করতেন না, কেবল ভালবাসতেন, আমাদের সঙ্গে সুখদুঃখের গল্প করতেন । অন্য ক্লাসঘরে কোনো শিক্ষক মারধোর করলে উঠে গিয়ে তাঁকে নিরস্ত করতেন । আর এতেই আমাদের তাঁর প্রতি এমন একটা শ্রদ্ধা আর ভালবাসা তৈরি হয়েছিল যে কেবল তাঁর মুখ রাখতে হবে বলেই আমরা আরো মন দিয়ে ওঁর পড়া শুনতাম, আর সেইভাবে একদিন অংক শিখে গেলাম সবাই । রবীন্দ্রনাথ পালধি কেমিস্ট্রিতে বি এস সি করেছিলেন, বাংলার ক্লাসে কেমিস্ট্রিও পড়াতেন, বাংলাও । সবচেয়ে মজার কাণ্ড ছিল যে উনি কেমিস্ট্রির ধাতু আর এসিডের সংমিশ্রনে তৈরি কম্পাউন্ড-এর ফর্মুলা উদাহরণ দিয়ে বাংলা ব্যাকরণের ধাতু ও প্রত্যয় শেখাতেন । বলতেন সংস্কৃত ভাষাটা কি সায়েন্টিফিক দেখ, কেমিস্ট্রি বুঝলে সংস্কৃত ব্যাকরণটাও বুঝবি, আর সেটা শিখলে বাংলায় শব্দ তৈরি করতে পারবি ইচ্ছেমতো ! ব্যাকরণ পড়াতে পড়াতে গম্ভীর মুখে এমন সব মজার কথা বলে হাসাতেন যে আমাদের ব্যাকরণ-ভয় কেটে যেত !

আরেকজন রবিনদা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ দত্ত। ইনি ক্লাসে কারো অমনোযোগ দেখলে বাঁ হাত দিয়ে পিছনে বোর্ডের দিকে না তাকিয়ে তার ওপরে একটি নিটোল ছড়া বা লিমেরিক লিখে দিতেন । তার দু একটি মনে পড়ে আজও, এই তিরিশ বছর পরেও:

“অনুপ কুমার সাহা/ সত্যি নাকি তাহা/ চেয়ার থেকে পড়লে সবাই/ বলে, ‘আহা , আহা !”
কিংবা
“বাংলা দেশের ছেলে/ গঙ্গাপ্রসাদ নাম/ হুল্লোড় আর করে হৈ চৈ/ কী আছে তার দাম ?”

রবীনদা ক্লাসে একটা চমৎকার গল্প বলে একজন ডাক্তার ঔপন্যাসিকের প্রতি আমাদের উৎসাহ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন । এই লেখক যখন স্কুলে পড়তেন, তখন ক্লাসে গোরুর রচনা লিখতে দেওয়া হয়েছিল । সবাই যেমন লেখে, সেরকম না লিখে তিনি একটি ছড়া লিখেছিলেন । শিক্ষক তাঁকে ফুল মার্কস দিয়েছিলেন । তার কয়েকটা লাইন এই রকম (তিরিশ বছরের পুরানো সেই ক্লাসের স্মৃতি থেকে লিখছি, পাঠক ভুল হলে ক্ষমা করবেন):

‘মানুষ তোমায় বেজায় খাটায়, টানায় তোমায় লাঙল গাড়ি
একটু যদি ভুল করেছো, পড়বে পিঠে লাঠির বাড়ি
মানুষ তোমার মাংস খাবে, অস্থি দেবে জমির সারে
চামড়া দিয়ে পরবে জুতো, বারণ কে তায় করতে পারে !
তোমার ওপর এ-অত্যাচার, হে মরতের কল্পতরু
কারণ, নহ সিংহ কী বাঘ, কারণ তুমি নেহাত গোরু !’

এই লেখকের নাম ডাক্তার বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, ওরফে বনফুল!

যেসব শিক্ষক এইভাবে আমাদের প্রকৃত শিক্ষিত করার চেষ্টা করে গেছিলেন, এঁদের প্রায় কেউই আজ নেই । আজ এই মহানুভব, আত্মত্যাগী, পরার্থপর ছাত্রদরদী শিক্ষকদের কথা মনে করে তাঁদের পায়ে শতকোটি প্রণাম নিবেদন করি ।

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes