
মহম্মদ সামিমের কবিতাগুচ্ছ
অশ্রুলিখন
লিখি ক্ষত, পাণ্ডুলিপির উপর বিছিয়ে দিই ক্লান্ত ডানা
জ্যোৎস্নাজন্মে সমস্ত অসুখ নদীর স্রোতে শুশ্রূষা
লিখি জল, অপেক্ষার কাছে আজও একা নতজানু
নিজেকে ছাপিয়ে, ছায়ার আড়ালে লুকিয়ে রাখি আগুন
ধূসর পালকের নৌকো ভেসে যায় স্মৃতির প্রশ্রয়ে
অক্ষরফুল ঝরে সবুজ মাটিতে, শস্যসাঁকো হয়ে ওঠে দিগন্ত
আলো এসে ধুয়ে দেয় নীরব ফসলের চোখ, দেখি, স্নান
লিখি মন্দ্রঢেউ, গভীর প্রসারিত, লিখি চিরদুঃখী গ্রাম
পাণ্ডুলিপি ভেসে যায়, কলম জড়িয়ে কেঁদে ওঠে জীবন।
অভিসার
এইমাত্র ফুটে উঠলাম নিঃসঙ্গ পলাশফুল হয়ে
শিরীষের গন্ধ হয়ে ভোরের বাতাসে মিশে গেলাম
নশ্বর আমি পেরিয়ে যাচ্ছি গৃহদাহ, ঠিক তখনই
বাবুই পাখিটি এসে আমাকে খড়কুটো ভেবে
নিয়ে গেল গাছের পাতার আড়ালে, নিজের বাসায়।
তখনও কেউ শিশিরে মুখ ডুবিয়ে খুঁজে চলেছে হারানো চুম্বন
মনে পড়ে, চোখের পলকে হারিয়ে যাওয়া বিদায়সন্ধ্যা
কেমন করে চিরতরে একটি শব্দ ‘বেদনা’ মিশে গেল এপিটাফে
বসন্ত বড় বেশি বিরহের। মুগ্ধতা নয়, বিচ্ছেদে সুপ্রভা
কীসের মৌতাতে অন্তর্লীন হলে অকাল বৃষ্টিতে?
এইমাত্র ছায়া হয়ে নিজেকে সাজিয়ে দিলাম তোমার যাত্রাপথে।
একা
শব্দের আঘাতে পৃথিবী অন্ধ হয়েছে
কাটা মুণ্ডুর উপর শকুনের বিশ্রাম
চোখ থেকে গড়িয়ে নামে রক্ত ও রাত্রি
চাঁদের আলো নেমে এসেছে বুকের গর্তে
পাশাপাশি জড়িয়ে আছে তসবি ও ত্রিশূল
দেখি, আঙুলে লেগে ঝলমলে ভাতের দানা
আকাশে পাখি নেই, পথের ছায়া দাউদাউ
নিকষ ধোঁয়া, উঁচু সিংহাসন আর পতাকাদণ্ড
ছাইচাপা নাভির দিকে হাওয়া এসে ধীর
এই সম্যক অভিঘাত, মহাজাগতিক শূন্য
অন্ধ পৃথিবীতে এখন কারা জেগে আছে?
বিজিতের ভিড়ে একা বিজয়ী খোঁজে নিজের মৃতদেহ।
শ্রাবণ বড় অদ্ভুত
সম্পৃক্ত হয়ে আছি অবয়বহীন
নিজের ভিতর স্থাপন করি দীর্ঘ সেতু
তুমি এসে অতিক্রম করো ব্যর্থতা
উপড়ে নাও আমার ভিতর বেড়ে ওঠা সমস্ত শিকড়
গ্রহণ করার দায় ছিল, হৃদয়ের নাগাল পাইনি
দিনান্তে সাজিয়ে রাখি সমস্ত অপমান
তোমার বেহালার করুণায় বেজে উঠি,
আকণ্ঠ আর্তনাদ নিয়ে চোরাবালি খুঁজি
জীবনকে ঘনিষ্ঠ মেহনে দেখেছি বারবার
বুঝেছি, অবহেলা আত্মার অলঙ্কার,
না-পাওয়াগুলিই আসলে ঘুরে দাঁড়ানোর দলিল
তারপর
ঘুমের সরণিতে গোপন শ্রাবণ ফিরে আসে
নিজেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র করে ভালবাসার সামনে দাঁড়াই।
জাগরী
বহু প্রাচীন একটি হলুদ চিঠির ভাঁজ খুলে বসেছ
এত মনোযোগ দিয়ে কী পড়ছ দেবস্মিতা?
দমদম জংশন থেকে নর্থ ক্যারোলিনা
মাঝে কত সিঁড়িভাঙা, মিত্র ক্যাফে, আমিনিয়া, মুক্তোহার…
আঙুলে লেগে আছে নীল মেঘের কুচি
গোধূলির রিক্সা চেপে, পেরিয়ে যাচ্ছি নাগের বাজার
এই চিঠি আজ না-বলা কথাদের ঠোঁট
অস্পষ্ট তবু কাতর, নিঃসঙ্গ তবু নির্ঝর
উতলা সন্ধ্যা জানে, একদিন কত জলোচ্ছ্বাস ছিল বুকের ঝিলে
কত নিবিড় জোনাকি এসে বসত সেখানে
নেপথ্যচারিণী হয়ে বহুধা বয়ে নিয়ে গেছ সোনাঝুরিদেশ
মিথ্যে ছিল না সান্দ্রতায়, তবু বিবর্ণ হয়েছে চোখের চাহনি
কী খুঁজছ এই ম্যাপলসজ্জিত জানালা খুলে?
সময়ের সাথে সম্পর্কও কেটে গেছে
হলুদ চিঠির ভাঁজে ভাঁজে।
ভালো লাগলো