
ধানসিড়িটির তীরে
বর্ণালী কোলে
(১)
পুবের জানালায় রোদ।গাছের পাতারা শান্তিতে বিশ্রাম নিচ্ছে। কলেজের
সামনে দিয়ে যাওয়া রাস্তায় অগণিত জীবন।দূর থেকে মাঝে মাঝে উদাস
তাকাচ্ছি। সামান্য হাওয়ায় পাতারা দুলে উঠছে। ব্যথা কমে আসছে
।আরোগ্য লাভ করছে ক্লান্ত চোখ।জীবনকে জোর করে
বেঁধে রাখা যায় না। জীবনকে জোর করে পাওয়া যায় না।ছেড়ে দাও।
বহমান মানব সভ্যতা।
বহমান প্রেম।
তার মধ্যে কতটুকু আমরা।
হৃদয়ে অজানা কোনও নদীর ছলাৎ ছলাৎ
জলের স্পর্শে পবিত্র হৃদয়
বাঁচবে আর একবার ধানসিড়িটির তীরে?
ভালোবাসায়?
(২)
অনেকদিন পর স্বপ্নের আবছায়া ।বুকের মধ্যে
আঘাত রাখার ছোটো ছোটো ঘর।জমা হয় অভিমান।জীবন এগিয়ে
চলে।ব্যথা নিয়ে।ভালোবাসা নিয়ে। বিষন্নতার বীজ ছড়ানো চরাচরে ।
এই পৃথিবী এক মৃত্যু স্তুপ।মানুষের দুটি হাত মোবাইল ফোন ধরার
কাজে ব্যবহৃত হয়।দুটি চোখ সর্বদা হিসেব করে।
বিদ্যাচর্চার স্পৃহা নেই। জানবার আকাঙ্ক্ষা নেই।একটি সার্বিক নিস্পৃহতা।
ধর্ম ও রাজনীতি ছাড়া কোনও উন্মাদনা নেই।তুমি যদি বাঁচতে চাও,তোমার
বাঁচার প্রতি এদের কোনও সহমর্মিতা নেই।
যতই কষ্ট পাও,ধারণ করো।মুখ ফুটে বলো না
কাউকে একটিও কথা।চিৎকার, চেঁচামেচি কোনও পথ নয়।শান্ত ভাব-ই
আসল ভাব।
(৩)
আজ আকাশ মেঘলা।আজ পুরোনো দিনের বৃষ্টি। শহরের
গায়ে প্রাচীনতা ।আমাদের ফ্ল্যাটের জানালা থেকে এতদিন
দেখা যেত একটি ভাঙা স্কুলবাড়ি।স্কুলবাড়ির ইঁট ফুঁড়ে একটি
বটবৃক্ষ। তার পাতার নানা রং দেখেছি।বর্ষাকালে বিরহী নারীর
মতো ভরা যৌবন নিয়ে সেই বৃক্ষ আকুল চেয়ে থাকত।কখনও দেখতাম
ভাঙা স্কুল ভবনের পরিত্যক্ত দুটি হাইবেঞ্চ। জীর্ণ বোর্ড।কত শিশুর কাকলি
ছিল এখানে একদিন।
এখন বাড়িটা ভাঙা হয়েছে।বটবৃক্ষ কাটা হয়েছে।যদিও তার গুঁড়িকে কেন্দ্র
করে অনেক সবুজপাতা । নবজলধারায় বিহ্বল। আজই দু’জন মানুষ এসে
গুঁড়ির একদিকে কোপ দিয়ে গেছে।কয়েকদিন পর তার অস্তিত্বও মাটির সঙ্গে
মিশে যাবে।গাড়ি করে সেইসব বর্জ্য নিয়ে যাবেন চালক।
এখন বৃষ্টি। বিকেল।কেবল পুরোনো যুগের গল্প।ঠাকুমা,দিদিমা-ছেলেবেলার
বন্ধু। সজনে গাছের পাশে দাঁড়িয়ে সেই ঝগড়া। আমি রেগে যেতাম।আর সে
আমার রাগ দেখে আনন্দে আটখানা।
ফ্ল্যাটের জানালায় দাঁড়িয়ে রয়েছি ।একটি মধ্য বয়স্ক ভদ্রলোক ছোট ছোট পাত্রে
রাস্তার কুকুরদের ভাত দিচ্ছেন।সামনের বাড়ির যুবকটি ঘুমাল?দিনরাত সে
ব্যস্ত।মুখে তার সতেজ তারুণ্য। একটু আগে আ্যম্বুলেন্স গোঙাতে গোঙাতে
চলে গেছে।তার আগে এই রাস্তা দিয়ে গেছে হরি ধ্বনি ।বাঁশের কাঠামো।
মৃত শরীর।এখন রাস্তায় তরুন-তরুণী। তরুণীটির লাল টপ,জিনস ।দুজনেই
হেঁটে হেঁটে যাচ্ছে। দুজনই উচ্ছ্বল । মাস্ক তাদের হাতে!কথার স্রোতে ঈষৎ
সতর্ক বড় বড় ফ্ল্যাট বাড়ি ।
জানালায় দাঁড়িয়ে রইলাম আরো কিছুক্ষণ। বিভোর।উল্টোদিকের
বারান্দায় ফুল বাগান।একটি বারান্দা থেকে একটি মেয়ে ঝুঁকে
কিছুক্ষণ দেখল আমাকে,আমিও কিছুক্ষণ। বৃষ্টি শুরু হলো আবার।
ঘোড়ায় চড়ে রাজপুত্র বেরোল,এই তো কিছুক্ষণ..
(৪)
এলোমেলো হাওয়া।কোন দূর দেশ থেকে যেন সন্ধের গন্ধ আসছে।
ট্রেনে আমরা কন্যাকুমারী থেকে চেন্নাই ফিরছিলাম।এমনি বৃষ্টিভেজা
সন্ধে।এমন-ই হাওয়া।ট্রেন লাইনের পাশে পাশে মাঠ।দূরে পোড়ো
বাড়ি।সেখান থেকে ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে ওপরের দিকে
উঠছে।বিস্তৃত আকাশ,বাতাস । যেন আপন মনের মধ্যে
পূর্ণতায় বিরাজ করছে।তেমনি আমি আজ।এই ঝোড়ো হাওয়া,পুকুর পাড়ের
চারদিকে গাছের মাথা দোলানো..অন্ধকারে ওদের সঙ্গে এক হয়ে দাঁড়ানো
যায়?ইচ্ছে করছে সন্ধেতে যেন গাছ-ই হয়ে যায়!মাঝেমাঝে মানুষেরা
এসে পাতা, ফুল, ফল ছিঁড়বে।কখনও কেটে ফেলবে হয়তো।তবুও তাদের
আঘাত মানুষের দেওয়া বেদনার থেকে কম।
(৫)
মন বন্ধ্যা ।ঈর্ষা দেখতে দেখতে স্থবির।মানুষের নিষ্ঠুরতায়,হিংস্রতায়
স্তম্ভিত।কী হয়েছিল কিছু মনে নেই।ঝড়ে ওলটপালট। ভাঙা ঘর।পাখির
বাসা। ধ্বংসের চিহ্ন।মানুষেরা এসে এইসব তান্ডব করছে।মানুষের প্রতি
আসক্তি চলে গেছে।জানালা দিয়ে মাঝেমাঝে তাকাই বেদনাতুর।ঝলমলে
আবহাওয়ার মধ্যে বোদলেয়ারের চোখ মনে পড়ে।আগুন দৃষ্টি। চিরকালীন।
যাপনে,মননে।
কলেজের মেয়েটি বলেছিল,“নো এন্ট্রি’ দেখতে।ইচ্ছে করছে না আজ,ফিল্ম।
দিন ফুরিয়ে আসছে।কাজের দিদি আসবে একই নিয়মে।গল্প নিয়ে তার ছেলেমেয়ের।
কলেজের উল্টোদিকে ফুচকার স্টল চলে যাচ্ছে ধীরে ধীরে ।
পড়ন্ত বিকেলের নিঃশ্বাসে চৈত্রদিন
(৬)
মাঝেমাঝে মনে পড়ে স্বপ্নে দেখা অথচ বাস্তবে কোনও স্মৃতি না থাকা কিছু মাটি,
কিছু আকাশ, কিছু রজনী,কিছু স্টেশন।গভীর রাত্রিতে বাস থেকে নেমে তুমি চলেছ।
মাথায় ছাউনি নেই কোনও। উন্মীলিত চোখে মহাকাশের বিস্ময়।
জ্যোৎস্না,নিস্তব্ধ প্রান্তর ছুঁয়ে দিচ্ছে অশোক ফুল।ঘুমন্ত শিরীষ।জননীর মতো স্মিত হাসিতে
ভরা ধানের মাঠ।তোমাদের পুরোনো বাড়ির বড় উঠোনে জ্যোৎস্না।টিনের চালে লুটিয়ে
আমের দীর্ঘ পল্লব।
ছুঁয়ে দিচ্ছ অচেনা স্টেশন।ট্রেনের জন্য অপেক্ষারত প্ল্যাটফর্ম।সবাই শাড়ি।লম্বা
বিনুনি । সবার মুখ যেন সকাল।জলে ধোয়া দিন।হারমোনিয়াম। রেওয়াজ।
বারান্দায় মাদুর।
চলো,আকাশের দিকে চলো এবার।সেই বাড়ি। জনমানব নেই।
ভাঙা জলসাঘর। ঝাড় লণ্ঠন।।
(৭)
আমার মৃত্যু হোক পূর্ণিমায়।আমার মৃত্যু হোক হেমন্তের আঙিনায়
নবান্নের ঘ্রাণে।আমার দীর্ঘ বাহুতে বিশ্রাম নিক পাখপাখালি । মৃত্যুর
পর কবিতার উপত্যকায় আমি শুয়ে।ঝরনা বয়ছে।
মৃত্যুর পর তোমরা আমার মাথার পাশে খাতা কলম রেখো।যদি
জেগে উঠি,কবিতা লিখব।ছাপতে পাঠাব,জ্যোৎস্নায়!

