
তিরন্দাজির পথে, জেন
অন্তিম পর্ব
পার্থজিৎ চন্দ
'জেন’- শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে চলা রহস্যময়, মিস্টিক এক সাধনপদ্ধতি; প্রাচ্যের সুগভীর দর্শনের একটি ধারা, যে ধারার মধ্যে মিশে রয়েছে পারমিতার ছায়া, ‘না-জানা’র মধ্য দিয়ে জানার গূঢ় পদ্ধতি। একটি সুবিখ্যাত জেন-কবিতায় পাওয়া যায়, ‘Sitting quietly, doing nothing / Spring comes, and the grass grows itself’। এই ‘কিছুই না-করা’র পদ্ধতি অর্জন করতে হয় দীর্ঘ অনুশীলনের মাধ্যমে। আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের এই ধারার সঙ্গে তিরন্দাজির মতো একটি শৌর্যময় বিষয়ের কি কোনও সংযোগ থাকতে পারে? তিরন্দাজি কি শিল্প? এই শিল্পের মধ্যে দিয়ে কি প্রবেশ করা সম্ভব জেন-এর মিস্টিক পৃথিবীতে? আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল অয়গেন হেরিগেল-এর ‘Zen in the Art of Archery’। ব্যক্তি-অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ এ কাহিনি যেন এক রোমাঞ্চকর শান্ত থ্রিলার, ইউরোপের চোখে ‘জেন’ দর্শন অথবা ভিন্নধারার ডিসকোর্স।
টাকুয়ান বলছেন চরম শূন্যতার বোধ থেকেই ‘কর্ম’ সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান জন্ম নেয়।
তিরন্দাজি, তলোয়ার চালনার ক্ষেত্রে যা সত্য শিল্পের অপরাপর শাখায়’ও তা সত্য। জাপানে ইঙ্ক-পেন্টিং-এর বিশেষ কদর রয়েছে, এ শিল্পের চরম উৎকর্ষতা তখনই অর্জন করা সম্ভব হয় যখন শিল্পীর হাত শিল্পীর মানসচক্ষে দেখা বিষয়গুলিকে এঁকে চলে। শিল্পীর দেখা আর চিত্রিত করার প্রক্রিয়া এক যোগে হতে থাকে, দুটির মধ্যে এক-চুলের ফাঁক থাকে না। অঙ্কন তখন স্বতঃস্ফূর্ত ক্যালিগ্রাফি শিল্প হয়ে ওঠে। এখানেও শিল্পীর প্রতি গুরুজিদের একটিই নির্দেশ থাকে – বাঁশবনের ছবি আঁকার আগে অন্তত দশ-বছর তার দিকে চেয়ে থাকো, বাঁশবনের একটি অংশ হিসাবে নিজেকে ভাবতে শেখো, তারপর ছবি এঁকো।
অসিচালনার একজন গুরু’র সঙ্গে শিষ্যের তেমন কোনও পার্থক্য নেই আপাতভাবে। তিনিও শিক্ষার্থীর মতো প্রথম প্রথম একই আচরণ করেন। পার্থক্য শুধু একটি জায়গায় – গুরুজি তিনিই যিনি তাঁর শিক্ষার প্রথমদিকে হারিয়ে ফেলা মানসিক শান্তি আর স্থিতি-কে পরের দিকে আবার ফিরে পাবার ক্ষমতা রাখেন। শিক্ষার্থীর মতো তিনি কিছুই প্রমাণ করতে চান না, কিছু দেখাতে চান না; নিজেকে সংযত আর শান্ত রাখতে পারেন। শিক্ষার্থী থেকে গুরুজি হয়ে ওঠার দীর্ঘ পথে থাকে অদম্য অনুশীলন পর্ব। জেন-এর সান্নিধ্যে এসে তাঁর দক্ষতার সঙ্গে মিশে যায় আধ্যাত্মিকতা, তিনি নিজেও ধীরে ধীরে আরও বেশি মুক্ত হয়ে ওঠেন। এখন তরবারি তাঁর ‘আত্মা’, তিনি কিংখাবে সেটিকে ভরে রাখেন। অপরিহার্য না-হলে তিনি সেটিকে উন্মুক্ত করেন না। এমনকি একটা সময়ের পর, তাঁর প্রতিপক্ষ হয়ে উঠতে গেলেও যোগ্যতার দরকার হয়। শুধুমাত্র শারীরিক শক্তিতে বলিয়ান কেউ এখন তার প্রতিপক্ষ হবার যোগ্য নয়। তেমন কেউ তাঁর সঙ্গে লড়াইয়ের ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি হাসি মুখে এড়িয়ে যান। তিনি লড়াই করতে পছন্দ করেন এমন কোনও প্রতিপক্ষের সঙ্গে যাকে তিনি মৃত্যুর গৌরব দান করতে পারেন। জাপানে সামুরাই যোদ্ধাদের দর্শন এটিই। সব কিছুর থেকে ঊর্ধ্বে, খ্যাতি-অখ্যাতির ঊর্ধ্বে, এমনকি জীবন-মৃত্যুর ঊর্ধ্বে দাঁড়িয়ে থাকে সত্যের তরবারি। এটিই তাকে চালনা করে, এটিই তার চরিত্র নির্ণয় করে।
যে কোনও শিক্ষার্থীর মতো গুরুজি’ও একদিন ভয়শূন্য ছিলেন; কিন্তু তিনি ধীরে ধীরে ভয়ের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করার কৌশল রপ্ত করেছেন। বছরের পর বছর ধ্যাণ তাকে শিখিয়ে দেয় জীবন-মৃত্যু আসলে একই মুদ্রার এ-পিঠ ও-পিঠ। দুটোর ভেতর খেলা করছে একই রূপ; দুটিই একটি নদীর স্রোতের মতো প্রবাহিত। তিনি ধীরে ধীরে ভুলে যেতে শুরু করেন জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে লুকিয়ে থাকা আপাত-ভয়’কে।
গুরুজি এই পৃথিবীর আলো-ছায়া মেখে বাস করেন, তিনি জীবনের সমস্ত রস-রূপ শুষে নিতে থাকেন; অথচ নিজেকে এমন এক স্তরে রাখেন যেখান থেকে তিনি অনায়াসে বিন্দুমাত্র বিচলিত ও ভয়ার্ত না-হয়ে এই পৃথিবী ছেড়ে চলেও যেতে পারেন। জেনের শিক্ষা এমনই।
সামুরাই’দের প্রতীক ঝরে পড়া চেরিফুল; এটা বেছে নেবার পেছনে বড় একটা কারণ রয়েছে। যেভাবে চেরিফুল সকালের স্নিগ্ধ সূর্যের আলোয় ঝরে পড়ে, ঝরে পড়ে ভাসতে থাকে পৃথিবীর আলো-বাতাসের মধ্যে ঠিক একইভাবে একজন সামুরাই যোদ্ধা নীরবে জীবন থেকে নিজেকে বিচ্যুত করে নেন।
এখানে আরেকটি কথাও বলার আছে; মৃত্যু-ভয় থেকে নিজেকে মুক্ত করার অর্থ কিন্তু এটা নয় যে একজন মানুষ জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে মৃত্যুর মুখে আনখশির কেঁপে উঠবেন না। বরং এক ধাপ এগিয়ে বলা যায়, যিনি জীবন-মৃত্যু’র ভয় থেকে নিজেকে মুক্ত করেছেন তাঁর পক্ষে বোঝা অসম্ভব ভয়ের অনুভূতি কেমন হতে পারে। তীব্র ধ্যান ও মনসংযোগের বিষয়টি যারা জানে না তাদের পক্ষে বুঝে ওঠা মুশকিল ঠিক কীভাবে এই আত্ম-বিজয় সম্ভব হয়। একজন প্রকৃত গুরু তাঁর ভয়শূন্য অবস্থার প্রকাশ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রেখে যান, শুধু কথায় নয়, কাজেও তিনি প্রকাশ করেন সেটি। তাঁর দিকে তাকিয়ে শুধু বুঝে নিতে হয় বাকিটা। খুব কম মানুষের পক্ষেই বুঝে ওঠা সম্ভব হয় চূড়ান্ত ভয়শূন্যতা আসলে কী। এর সপক্ষে আমি এখানে হাগাকুরে’র লেখা থেকে কিছুটা অংশ উদ্ধৃত করব; এ লেখাটি সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি লেখা হয়েছিল, ‘ইয়াগু তাকজিমা-নো-কামি ছিলেন একজন মহা-অসিচালক। তিনি তোকুগাওয়া ইয়েমিৎসু’র সময়ে শোগান’কে অসিচালনা শেখাতে শুরু করেন। একদিন শোগানের একজন দেহরক্ষী তাঁর কাছে অসিচালনা শিখতে এসেছিল। কামি বলেছিলেন, আমি লক্ষ করেছি তুমি নিজেই অসিচালনার একজন গুরুজি। আমাকে আগে বল তুমি কোন গুরুজির কাছে শিক্ষা করেছ; তারপর আমি তোমাকে শিষ্য হিসাবে বরণ করে নেব।’
দেহরক্ষী বলেছিল, ‘আমার সংকোচ হচ্ছে; কিন্তু আমি বলতে বাধ্য, আমি জীবনে কোনও দিন কারও কাছে অসিচালনা শিক্ষা করিনি।’
গুরুজি বলেছিলেন, ‘তুমি কি আমাকে বোকা ভাবছ? আমি শোগানের গুরু; আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়।’
‘আমি যদি তেমন কিছু করে থাকি তো আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি; কিন্তু সত্যি সত্যিই আমি কারও কাছে অসিচালনা শিখিনি’, দেহরক্ষী বলেছিল।
দেহরক্ষীর এই স্পষ্ট উচ্চারণ গুরুজিকে বেশ দ্বন্দ্বে ফেলে দিয়েছিল; তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করেছিলেন। তারপর বলেছিলেন, ‘তুমি যখন এতটা জোর দিয়ে বলছ আমি মানতে বাধ্য। কিন্তু আমি নিশ্চিত তোমার মধ্যে এক গুরু বাস করছেন। আমি তাঁর স্বরূপ ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না…।’
‘আপনি যদি জোর করেন তো আমি শুধু একটা কথাই বলতে পারি; একটা ক্ষেত্রে আমি সত্যি সত্যিই গুরু। ছোটবেলা থেকে ভাবতাম জীবনে কোনও দিন আমি মৃত্যু নিয়ে ভয় পাব না; সেক্ষেত্রে আমার আদর্শ ছিলেন সামুরাই যোদ্ধারা। দিনের পর দিন এটা ভাবতে ভাবতে আমার মৃত্যুভয় দূর হয়ে গেছে। আপনি হয়তো সেদিকেই নির্দেশ করছেন…,’ দেহরক্ষী সংকোচের সঙ্গে কথাগুলি বলেছিল।
‘এই তো আমার উত্তর আমি পেয়ে গেছি,’ উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন তাজিমা-নো-কামি, ‘আমি এটাই বোঝাতে চাইছিলাম এতক্ষণ ধরে। আমার ভাবনা আর দেখায় কোনও ভুল হয়নি। অসিচালনার মূল কথাই হচ্ছে ধীরে ধীরে এই মৃত্যুভয়কে দূর করে দেওয়া। তাকে অতিক্রম করে যাওয়া। জীবনে আমি হাজার হাজার ছাত্রকে এ শিক্ষা দিয়েছি; কিন্তু তাদের কেউই হয়তো পুরোপুরি শিক্ষাগ্রহণ করতে পারেনি। তোমার আর কোনও শিক্ষার প্রয়োজন নেই; তুমি ইতিমধ্যে শীর্ষে পৌঁছে গেছ।’
আগেকার দিনে যে বিরাট হল-ঘরে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণ করত সে হলটিকে বলা হত ‘জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র’।
জেনের পথ অনুসরণ করা প্রত্যেক গুরুজি সর্বস্ব ছেয়ে থাকা, সর্বত্র বিরাজমান সত্যের থেকে নেমে আসা বিদ্যুৎঝলকের মতো। তাঁর সত্তার দ্বিধাহীন চরাচরে এই সত্য বিরাজ করে, তিনি নিজের নামহীন অস্তিত্বকে সেই ‘তাঁর’ মধ্যে আবিষ্কার করেন, খুঁজে পান। এই অনুভূতির কাছে বারবার ফিরে ফিরে আসেন যাতে তিনি নিজে ‘সত্য’ হয়ে উঠতে পারেন, প্রকৃতির হাজার হাজার বস্তু ও বিষয়ের মধ্যে সত্যকে খুঁজে পান।
তিনি নিজেকে শান্তভাবে জেনের পথ সঁপে দেন, কিন্তু জেনের পথ আরও সুদূরে চলে গেছে, তার প্রভা ছড়িয়ে রয়েছে আরও দূর পর্যন্ত। জেন-সাধক তা বুঝতে পারেন, তিনি জীবনের প্রতিটি কাজের মধ্যে জেন পথের সন্ধান করে চলেন, যাতে জীবনের ‘মধুর’ প্রহরগুলি আরও মধুর হয়ে ওঠে। তিনি কিন্তু তা বলে চরম মুক্তির কথা ভাবেন না সে সময়ে। যদি একবার সে মুক্তির কথা ভাবেন ও সে পথে চলতে শুরু করেন তবে তিনি আবার প্রথম থেকে শুরু করেন। ‘শিল্পহীন শিল্প’র সাধনা আবার শুরু হয়। সৃষ্টির নাভিমূলের দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তির সন্ধান করার থেকেও তিনি তখন সত্যের মধ্যে সত্য-যাপন করতে বেশি মগ্ন থাকেন। ‘তাঁর’ সঙ্গে এ পথ ধরে একাত্ম হয়ে ওঠাই তাঁর লক্ষ্য। বারবার তিনি শিক্ষার্থী হয়ে ওঠেন, আবার শুরু করেন প্রথম থেকে, যে পথ কঠিন ও কঠোর তার শেষ ধাপটুকু পার হবার জন্য প্রাণপাত করেন। নতুনভাবে নিজেকে আবিষ্কার করেন, আবিষ্কার করেন নতুন রূপে। এ কঠোর পরিশ্রম সহ্য করবার পরই তিনি সাধনায় সিদ্ধি লাভ করেন; খণ্ডিত নয়, পূর্ণ সত্যের সন্ধান পান। সমস্ত ‘সত্যের’ পর জেগে থাকে সে সত্য। আদি-অনন্ত সৃষ্টির সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার সন্ধান পান, তার কোনও আকার নেই। সেই শূন্যতাই সমগ্র-পূর্ণ করে রয়েছে।
জেন সাধক তার মধ্যে বিলিন হয়ে যান; আবার জন্মান।