
চলে গেলেন বিকল্প ধারার আখ্যানকার অজিত রায়
রাহুল দাশগুপ্ত
বিকল্প ধারার আখ্যানকার অজিত রায় প্রয়াত হলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল, ষাট বছর। জন্ম ১৫ জানুয়ারি, ১৯৬২ সালে, বর্তমান ঝাড়খণ্ড রাজ্যের ধানবাদ জেলায়। বাংলা ছাড়া ইংরাজি এবং হিন্দিতেও লিখেছেন। অজিত মূলত ঔপন্যাসিক। তিনি নিজেকে ‘বাংলা গদ্যের চলমান ধারা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও ব্যতিক্রমী গদ্যপ্রযুক্তির প্রবর্তক’ হিসাবে চিহ্নিত করতে পছন্দ করতেন।
অজিতের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলির মধ্যে রয়েছে, ‘দোগলাচরিত'(১৯৮৮), ‘যোজন ভাইরাস’ (১৯৯৮), ‘মায়ামঘর’ (২০০২), ‘জোখিম কোরকাপ’ (২০০৩), ‘রতিসুখের একক উপপাদ্য’ (২০০৮), ‘ঘামলাঘাট’ (২০০৯), ‘হিরণ্যরেতা:’ (২০১১), ‘নিরুজের রক্ততৃষা’ (২০১৪), ‘দামুণ্ডাচরের কালিখপুরাণ’ (২০১৯) ইত্যাদি। এছাড়া প্রায় শ’খানেক গল্প লিখেছেন তিনি। তাঁর ‘বাছাই গল্প’ প্রকাশিত হয় ২০১৯ সালে। তাঁর গল্পগুলির মধ্যে রয়েছে, ‘তাঁইশ’, ‘মায়ের শ্রাদ্ধ’, ‘পলান মাদোড়ের রূপকথার প্যাকেজ গল্প’, ‘মাস্টর’, ‘অরন্তুদ’, ‘পরাভব’, ‘সন্ধিজীবক’, ‘একটি গোরুর গল্প”, ‘কয়লা সোনা, সোনা ম্যাডাম ও কালাসোনা’।
‘ধানবাদ ইতিবৃত্ত’ তাঁর ধানবাদের ইতিহাস নিয়ে লেখা এক দুঃসাহসী গবেষণাগ্রন্থ। এই গ্রন্থ লেখার দায়ে তাঁর জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। চাকরিও চলে যায়। ধানবাদ তথা ঝাড়খণ্ডের ইতিহাস, রাজনীতি নিয়ে তিনি দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করেছেন। ১৯৯৬ সাল থেকে তিনি পুরোপুরি সাহিত্যচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৯৭ সাল থেকে ‘শহর’ নামে একটি ভিন্ন ধারার কাগজ সম্পাদনা করতে শুরু করেন। তাঁর গবেষণার আর একটি বিষয়, স্ল্যাং। এ বিষয়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য দুটি বই হল, ‘বাংলা স্ল্যাং: সমুচয় ঠিকুজিকুষ্ঠি’ এবং ‘ছোটলোকের শব্দলোক’। তাঁর অন্যান্য গদ্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, ‘দ্রাক্ষাপ্লেটে জোনারদানা’ এবং ‘যৌনতা: সমুচয় তত্ত্বতালাশ’।
অজিত রায়ের লেখায় বিষয়ের থেকেও মুখ্য হয়ে উঠেছে ফর্ম এবং ভাষা। তাঁর ভাষা কলকাতা তথা বাংলা ভাষা–সংস্কৃতির কেন্দ্রটিকে বারবার আক্রমণ করতে চেয়েছে। এক বিকল্প ভাষার সন্ধান করেছেন তিনি। ভাষাকে নিজের মতো করে নির্মাণ করতে চেয়েছেন। তাঁর ভাষা নিছক ভাষা হয়েই থাকেনি, একে তিনি ‘ভাষাপ্রযুক্তি’ বলে অভিহিত করতে চেয়েছেন। আর এসেছে ডায়াস্পোরার কথা। তিনি বহির্বঙ্গে বসে লিখেছেন বসে তাঁর লেখায় ভাষার ‘তথাকথিত’ বিশুদ্ধতা বারবার প্রশ্নচিহ্নের সামনে পড়েছে।
তাঁর ভাষায় শুধু হিন্দি বা ইংরাজি নয়, মিশে গেছে দেশজ, কথ্য ভাষার নানা শব্দ। তাদের তিনি বাংলার ভাষা–কাঠামোর মধ্যে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন। ম্যাজিকের মতো ব্যবহার করেছেন তাদের। শুধু তাই নয়, লেখার মধ্যে তিনি অনায়াসে ‘স্ল্যাং’ ব্যবহার করেছেন। ভাষা বা শব্দ–র শুদ্ধতা নিয়ে কোনও সংস্কারকে তিনি গ্রাহ্য করেননি। তিনি দেখিয়েছেন, যে শব্দগুলিকে আমরা পরিহার করে চলি, সেগুলো একটা রচনাকে আরও তীক্ষ্ণ, আরো শক্তিশালী করে তুলতে পারে। সেগুলোকে বর্জন না করে বরং তিনি তাঁর প্রযুক্তি–ভাবনায় তাদের গুরুত্বকেই মান্যতা দিয়েছেন। আর এভাবেই গড়ে উঠেছে তাঁর ‘ডায়াস্পোরিক’ ভাষাপ্রযুক্তি, যা হয়ে উঠেছে তাঁর রচনাগুলির প্রধান অস্ত্র।
অজিত রায়ের উপন্যাসগুলিতে বিষয় হিসাবে বারবার এসেছে, যৌনতা। যৌনতা এবং সৃষ্টিশীলতা একাকার হয়ে গেছে তাঁর কাছে। যৌনতা অর্থাৎ সৃষ্টিশীলতার মধ্য দিয়েই তিনি সত্যের কাছে পৌঁছতে চেয়েছেন। মানুষের ভিতর লুকিয়ে থাকা এক আদিম, অন্ধকার, পাপবিদ্ধ অথচ সত্য জগৎকে তিনি টেনেহিঁচড়ে বার করে আনতে চেয়েছেন। শরীর তাঁর কাছে, ‘আত্মার বহির্বাস’, নারীশরীর, ‘অপরূপ, রহস্যঘন, সমুদ্রে’র মতো। তিনি জানেন, যেটাকে আমরা ‘অ্যাচিভমেন্ট’ বলি, সেখানেই রয়ে গেছে ‘বিশ্বমানের ফক্কা। অভাববোধ।’
‘যোজন ভাইরাস’ উপন্যাসে তিনি পুরুষের চোখ দিয়ে নর–নারী সম্পর্কের জটিলতাকে দেখেছেন। আবার ‘জোখিম কোরকাপ’ উপন্যাসে নারীর চোখ দিয়ে যৌন–সম্পর্ককে বুঝে নিতে চেয়েছেন। ‘ঘামলাঘাট’ উপন্যাসে স্ল্যাংই হয়ে উঠেছে একইসঙ্গে উপন্যাসের ফর্ম এবং কনটেন্ট। লেখালেখি আর আত্মরতি কীভাবে সমার্থক হয়ে ওঠে, তা তিনি দেখিয়েছেন, ‘রত্নিসুখের একক উপপাদ্য’ উপন্যাসে। ‘দামুণ্ডাচরের কালিখপুরাণ’ উপন্যাসে এসেছে জঙ্গলরাজ, আন্ডারওয়ার্ল্ড আর কয়লা মাফিয়াতন্ত্র।
‘যোজন ভাইরাস’ উপন্যাসের মুখ্য চরিত্র কমল বলেছিল, ‘যা কিছুই আমি লিখি সর্বান্তকরণ দিয়েই লিখি। আজ যে আমি লিখতে পারছি না, শুধু, এ জিনিস আর কেউ লেখেনি, আমিই প্রথম লিখছি, তাই। যেহেতু সত্য কী, তা আমি জানি না। অথচ, আমার মনে হচ্ছে, আমি সত্যের অনেক নাগালে।’ অজিত রায় তাঁর পরীক্ষামূলক উপন্যাসগুলিতে মানুষের সেই আত্মার কাছেই পৌঁছতে চেয়েছেন, যেখানে সে খাঁটি, যেখানে তার সত্যগুলি থাকে, যেখানে গেলে তাকে সম্পূর্ণ পাওয়া যায়। এই সত্য বিপজ্জনক, কিন্তু তাকে তিনি লুকিয়ে রাখতে চাননি। সারা জীবন ধরে নিজের লেখায় এভাবেই ঝুঁকি নিয়ে গিয়েছেন বিকল্প ধারার এই লেখক।