
ধারাবাহিক উপন্যাস স্রোত পর্ব -৭
যশোধরা রায়চৌধুরী
২০১৩-১৪। কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছেলেমেয়ে তৈরি করে একটা নতুন প্রবণতা। কয়েকটি মেয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিনকে পোস্টার হিসেবে ব্যবহার করে তোলপাড় তুলে দেয়৷ এরা সব কেমন মেয়ে? কী চাইছে এরা? এই সব নিয়ে ও বাঙালি মধ্যবিত্তের ভুবনায়িত মূল্যবোধ নিয়েই "স্রোত"৷ গ্রন্থাকারে 'স্রোত' নাম দিয়ে একটি অতি সীমিত প্রকাশনা প্রচেষ্টাও হয়েছিল। তবে প্রকাশক সব কপিশুদ্ধু গায়েব হয়ে যাওয়াতে, স্রোতকে পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত আকারে এবার আবহমানের পাঠকদের কাছে ধারাবাহিকভাবে হাজির করার প্রচেষ্টা । "সম্পূর্ণ ভাবে নারীর দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা এমন উপন্যাস আমি আগে পড়িনি। নারীবাদী লেখকের লেখা উপন্যাস পড়েছি। কিন্তু তাতে পুরুষের লোলুপতা কে কাঠগড়ায় দাঁড়করানো আর নারীকে শিকার প্রতিপন্ন করার চেষ্টায় প্রায়শই অবজেকট্ভিটি থাকেনি। এই উপন্যাসের শিকড় গেছে নারী জীবন যাপনের নানা স্তরে । এর মধ্যে আছে যে ভাষায় পুরুষতন্ত্র জীবনের ন্যারেটিভ এমনকি সাহিত্য ও রচনা করে , তার ইন্টারপ্রিটেশন। এতে স্পষ্ট কথা আছে, অভিমান আছে, হাস্যরস এবং অসহায়তাও আছে । এবং সর্বোপরি পুরুষকে নিজের জীবনে জড়িয়ে নেওয়ার আকাঙ্খা।..এখনকার ছেলে মেয়ে দের হাতে ই তুলে দেওয়া কাহিনীর ব্যাটন, এদের স্পস্ট করে দেখা, বলতে পারা ও অতীতের বোঝা নামিয়ে রেখে পথ চলার সাহস কে কুর্ণিশ জানিয়েছেন যশোধরা। মুক্তি এরাই আনবে। যৌনতার রহস্যময়তার আবরণ উন্মোচন করে তথ্যের নিরপেক্ষতার মধ্যে উত্তরণ।যশোধরার Clarity of perspective অতি তীক্ষ্ণ। সবমিলিয়ে উপন্যাস টি মনোভংগি ভাষা ও কাহিনী সর্ব অর্থে আধুনিক। একে বারে রিয়েল টাইমে দাঁড়িয়ে লেখা। দেশ কাল সময় ও ব্যক্তি সত্ত্বার বিশাল ব্যাপ্তিকে বিন্দুতে এনে কিভাবে প্রতিবাদের ভাষা নির্মান করেছেন যশোধরা। নির্য্যাস হয়ে মনে রয়ে যায়, পুরুষকে বিযুক্ত করার অভিপ্রায় নয়, তার সংগে আবার প্রথম থেকে পড়া জীবনের পাঠ।" ( অনিতা অগ্নিহোত্রী)
৭ টাচফোনে দিগ্দর্শন
ট্রেন থেকে নেমেই মানসীর নতুন ছোঁওয়া-মোবাইল ব্যাগের ভেতর বেজে উঠল। গেল মাসে এই ফোনটা কিনেছে মানসী। ছুঁলেই কথা বলা যায়। ইস্ক্রিনের ওপর ছোঁয়া দিতে হয় আঙুলের। ছেলেই কিনেছে, দেখে, বেছে, শখ করে। কিন্তু মাকে ভালবাসে, তাই নিজে না রেখে মাকে দিয়েছে। সারারাত ডিউটি করে মা, রেডিওতে গান শুনবে শুয়ে জেগে। নইলে ঘুম এসে যায়।
অমিত করেছে নিশ্চয়, ভাবল মানসী। ছেলেটা বড্ড তার একা হয়ে গেছে । এগারো বছর বয়স থেকে মা কাজে যায়। সারাদিন থাকে না। আয়ার কাজ করে ঘর পাকা করা হয়েছে বটে, মাঝে মাঝে মানসীর মনে হয় দিন আনি দিন খাই করে ঘরের ছাতে টালি দিতে দিতে আসলে অমিতের মাথার ওপরটাই ছাত পায়নি। ঘর বলতে যা বোঝায় তা আর পেল কই অমিত। বাবা বাউন্ডুলে, মা সারাদিন অন্য লোকের বাড়িতে কাজ করে। সেবা যত্ন সব অন্যের । এই করে করেই দিন গেল। শরীর শুকিয়ে আসছে। বুকে একটা ফোঁড়া। কোনদিন ফাটবে না কিন্তু সেই যেন প্রাণশক্তি সব শুষে নিচ্ছে। ডাক্তার দেখিয়ে মানসী জেনেছে, অপারেশান করাতে হতে পারে। নাঃ অপারেশান সে করাবে না কিছুতেই। প্রাণ গেলেও না। ছেলেটা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেলে আর কিচ্ছু চায়না মানসী। ছেলেটা আজো নিজে রেঁধে খেয়েছে। কাল দাড়ি কামাতে গিয়ে ব্লেড লেগে ঠোঁট কেটে গেসল। ব্যান্ডেজ করেনি, সারাদিনে খুব খারাপ হয়ে গেছিল জল খাবার লেগে। সন্ধেবেলা ফিরে ওর সীমিত একটু নার্সিং জ্ঞান নিয়ে দোকানে গিয়ে ভাল মলম নব্বই টাকা দিয়ে কিনে লাগিয়ে ছোট করে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে।
সীমিত জ্ঞান বলছে মানসী। তবে একদা ও ছিল বারাসাতের ডাক্তার করগুপ্তর নার্সিং হোমে অ্যাটাচড আয়া। সাদাতে সবুজ নরুনপাড় শাড়ি পরে রোজ ডে ডিউটি করত। দিনের ডিউটি আর রাতের ডিউটির আয়াদের মধ্যে রোজ খিটিমিটি লাগত। অটো না পেলে দিনে দেরি হত পৌঁছতে। আটটার জায়গায় সাড়ে আটটা বেজে গেলেই রাতের আয়ার ছটফটানি বাড়ত। পেশেন্টকে দাঁত মাজিয়ে স্নান করিয়ে হাগিয়ে মুতিয়ে তবে তার ছুটি। কিন্তু ব্রেকফাস্ট করানো তার কাজ না। পেশেন্ট ওষুধ খেয়ে ভোঁসভোঁসিয়ে ঘুমোচ্ছে হয়ত। রাতের আয়া সক্কাল সক্কাল তাকে ঠেলে তুলে দেবেই। উঠিয়ে মুখ ধোয়াবে মগ এনে। এদিকে সদ্য পোয়াতি মা। অপারেশন করে বাচ্চা হয়েছে। এখনো সেলাই শুকোয়নি। ক্যাথিটার লাগানো। সে চুলকুনি আছে। তারপর আবার ব্লিডিং ও আছে। নাক শিঁটকে তুলো পালটে দিয়েছে সকালে একবার। দ্বিতীয়বার আবার প্যাড পাল্টাবে নাকি সে! রামোঃ।
সারারাত একটা টুলে বসে , টুলের পায়ায় পা জড়িয়ে ঘুমনোর চেষ্টা। পেশেন্ট উহ আহ করলেই উঠে জো হুজুর হওয়া। এ নার্সিং হোমের মেট্রন হেবি কড়া । গোঁফওলা , মাথায় শিং এর মত উঠে থাকা কড়কড়ে মাড় দেওয়া নার্সের টুপি…উমাদি। তারই কি জীবন সুখের? সন্ধেবেলা স্বামী ছেলে শ্বশুর ভাসুর সবার রুটি ভাত দুটো তরকারি রান্না করে রেখে এসেছে। নিজের খাবার টিফিনে ভরেছে। যতই চাকরি কর, মুক্তি কি আছে মেয়েমানুষের রান্নাঘর থেকে? চাকরি করে তাই নিন্দের ভয় আরো।
সেই খিটখিটে মধ্য বয়সী উমাদি ঘুরে ঘুরে টহল দিত। রাতের আয়ারা ঘুমোচ্ছে দেখলেই হাঁকাড় ।
এখনো মনে করতে ফিকফিকিয়ে হাসি আসে মানসীর। সে ত কোনদিন নাইট করবে না। তবে গিয়ে ওই রাগে গজগজানোর নাইটের আয়াকে শান্ত করত। বলত আচ্ছা বাপু আচ্ছা , আজ সন্ধেবেলা না হয় আমি তোমার দুটো কাজ করে রেখে যাব। তুমি আজ ব্রেকফাস্ট খাইয়েছ। না হয় আজ আধঘন্টা পরে এস। আমি রাতের খাওয়া খাইয়ে দেব পেশেন্টকে।
পেশেন্ট একটা খুকিমত বউ হয়ত। বাচ্চা ধরতে শেখেনি। বুক থেকে কলোস্ট্রাম খাওয়াতে শেখাতে হবে। বাচ্চাকে দুধ টানাতে শেখাতে হবে।
দুপুরে সব বেডের আয়ারা গোল হয়ে বসে টিপিন করে। গুনগুন করে গল্প করে। নিজেদের মধ্যে পলিটিক্স হয়। কেউ হয়ত বাড়ির খাবার বেশি করে এনে অন্যদের দেয়। হাসাহাসি হয়। গা টেপাটেপি হয়। একেকজন আয়াদিদি আছে। বড্ড অশ্লীল কথা বলে । নতুন মা একটা টুকটুকে বউ -এর বর এসেছে হয়ত। গোঁফওলা। বেশ মিশটি চেহারা। সিনেমার পোসেনজিতের মত। তাকে সবাই ঘিরে ধরে মুর্গি করে। বলে ভাল শাড়ি দিতে হবে আয়াকে। পরশু ছুটি দেবে বলেছে ডাক্তার। ও দাদা, দাদা গো! তোমার ত একতলায় ঢোকা বন্ধ বল। দোতলায় নতুন ভাড়াটে এসে গেছে ত।
দাদাটা লজ্জায় লাল হয়ে পালায়। পরশু ভাল শাড়ি আনবে। রোলেক্সের জরি দেওয়া সিন্থেটিক । আর্ট সিল্ক। লাল। মানসীর এভাবে খানকয়েক শাড়ি জমেছিল। তবে ডক্টর করগুপ্তর নার্সিং হোমটাই উঠে গেল । বেআইনি কাজ করেছিল। ভ্রুণ -এর ছবি দেখে ছেলে না মেয়ে বলে দিত পেশেন্ট পার্টিকে। অতবড় গাইনি।অতবড় ব্যবসা। গুটিয়ে পাটিয়ে হাওয়া।
সকাল সাড়ে আটটা প্রায়। রোদ্দুর ঝাঁ ঝাঁ করছে আকাশে। মোবাইলে কার নাম উঠেছে দেখার ফুরসত পেল না। বাঁদিক থেকে ডানদিক আঙুল চালানো শিখিয়ে দিয়েছে ছেলে। ফুস করে হাত বোলালো, তারপর ফোনটা কানে দিতেই বুকের ভেতরটা কেন জানি ধক ধক করে উঠল।
স্বপন করেছে। এদিক ওদিক তাকাল ও। এমন মনে হল, যেন ওর কথা শুনেই আশপাশের সবাই বুঝতে পেরে গেছে কে ফোন করেছে। ওর সঙ্গী যারা নিত্যদিনের সেই সবিতা, চাঁপা, মালতীরা। কিন্তু সে ভয় নেই। ট্রেনে যারা এতক্ষণ লেডিজ কামরায় ওর পাশে বসেছিল তারা যে যার মত পাতলা হয়ে গেছে।
কে আর কার কড়ি ধারে। ও একপাশে সরে গেল । বিধাননগর স্টেশন থেকে এখন পাঁই পাঁই করে দৌড় লাগিয়ে সবাই যে যার মত অটো বাস এসব ধরে সময়মত কাজের জায়গায় পৌঁছবার তাল করছে।
তবু হঠাত এতদিন পর স্বপনের ফোনের ধাক্কাটা নেওয়ার জন্য ও ঠিক হাঁটা শুরু করার মত থই পেল না। একটু দাঁড়িয়ে গেল। খানিকটা লোহালক্কড় ফেলা আছে এদিকে। লোক নেই।
স্বপন খুব যে ফোন করে তা নয়। কিন্তু সেই যে ঘেঁষ ফেলার সময় ওর সঙ্গে দরকার হয়েছিল, তারপর থেকে কখনো সখনো ফোন করে। দরকারটা আর নেই, তাই অদরকারের ফোন। অকাজের কথা । এই অদরকারের কথাটাই কেমন যেন চাপা বুকভরা গন্ধের মত। ভাল লাগে মানসীর। ভয়ও করে। ও তো আবার ওর একরকমের দেওর হয়। এই লতায়পাতায় কী যেন একটা সম্পক্কো। বিধানের কেমন একরকমের ভাই।
কেন যে বুক দুরদুর। একটু একটু ভাল লাগাও আসে।
অথচ অমিতের কথা ভাবলে ভাল লাগা উড়ে যায়। ভয়ে প্রাণ একেবারে হাঁক পাক করে ওঠে।
খুব ছাড়া ছাড়া গলায় বলল ওঃ কী বলছ। বল।
-কেমন আছ কেমন? ওদিক থেকে বেশ একটা ভরাট গলা ভেসে এল। বুকের হাঁকপাক বেড়ে গেল।
আছি তো ভালই। খুবই যেন উদাসীন, এমনি ভাব করল মানসী। গরম লাগছে, হাঁটতে শুরু করল, এবার তাড়া এসে গেছে পায়ের পাতায়। কাজের বাড়ি যেতে হবে। ডিউটি ধরতে হবে।
বিধানদা ঠিক আছে তো?
আর কত খেজুরে করবে লোকটা? ওর কি সিমে ট্যাকা ভরতে লাগে না? এমনি এমনি চলে? রাগ হল মানসীর। চোখের সামনে একটা বাস বেরিয়ে গেল দেখল ডিউটিবাড়ির দিকের।
কী দরকার বলবে তো? কাজে যাচ্ছি। অধৈর্য হয়ে মানসী বলল।
নাঃ এমনি ভাবছিলাম তোমাদের বাড়ি যাব একবার। বিধানদা দিনের বেলা ঘরে থাকে? তুমি তো থাকো না, না? একটু হাসির আভাস স্বপনের গলায়। ভাবটা ভাল ঠেকল না ওর। স্বপনের দড়ির মত পাকানো কাঁধ, হাতের গুলি, আর ভরাট চওড়া বুকের কথা ভেবে মন যেটুকু নরম হয়ে এসেছিল মানসীর, আবার ধীরে ধীরে নেতিয়ে গেল । মনে সন্দেহ দানা বাঁধল। কী চায় স্বপন? কেন ফোন করছে এভাবে? গলায় কেমন দুষ্টামি ভরা আছে যেন।
নাঃ আমার কিছু ট্যাকা দরকার ছিল। তুমি বলেছিলে দরকার হলে বলতে। এখন হাতটা খালি যাচ্ছে। পারবে? বেশি না পাঁচ হাজার। নইলে বিধানদাকে বলি। আমার দাদা ফেরাবে না।
ও ট্যাকা কোতায় পাবে , শুনি? অনিচ্ছেতেও ঝেঁঝে উঠল মানসীর গলা।
তুমি পারবে না? হাসল খুক খুক করে স্বপন।
আমি ! রোজ মুখে রক্ত তুলে ডিউটি করি আটটা আটটার। এমনি এমনি মাগনা পয়সা দেয় আমায় কেউ?
সেবার তুমি কিন্তু আমার গুদোমে এসেছিলে মানসীবৌদি। ভুলে গেছ? বিধানদা জানলে… হেঁ হেঁ… না মানে তুমি তো ভদ্দরনোকের বউ, নীলষষ্ঠীর ব্রত, শিবরাত্রির ব্রত করা বউ, এখন নাকি বেহারি বস্তির বউগুলোর দেখাদেখি করবাচৌত না কি, সেসবও করো। বরের ভালটা দেখবে না? বিধানদা জানলে দুঃখু পাবে , বড্ড কষ্ট পাবে গো।

