
অজিত সিং বনাম অজিত সিং
২৩ তম পর্ব
তৃষ্ণা বসাক
অজিত সিং বনাম অজিত সিং দ্বাবিংশতি পর্ব তৃষ্ণা বসাক অজিত সিং প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। প্রকাশিত হল উপন্যাসের ২৩ তম পর্ব। এই উপন্যাসের সব চরিত্র কাল্পনিক।
২৩
দিন চারেকের এই ছোট্ট ট্রিপটা দরকার ছিল তার। আগে থেকে কিছুই ঠিক ছিল না, কোন কথাই ছিল না যাবার। তার কি পুচু মুনু, ঝুংকুমুনু বৌ বাচ্চার ফেমিলি যে মাঝে মাঝেই ব্যাংকক, পাটায়া, বা মরিশাস, নিদেনপক্ষে গোয়া, কোভালাম, তাও না হলে দিপুদা ছুটিতে যেতে পারবে? পৃথিবীসুদ্ধু লোক যেখানে ছুটি কাটাতে যেতে পারে, সেখানে তার মতো লোকের যাওয়া চলে না। ওই যে যত সেলিব্রিটিরা সব ইন্টারভিউতে ন্যাকামি করে বলে না, ‘আগের মতো আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে ফুচকা খেতে পারি না, মবড হয়ে যাই’? মার্কেজও সেলিব্রিটি সেই হিসেবে। সেও সব জায়গায় ইচ্ছে করলেই যেতে পারে না, মবড তো না, তার ভয় কপড হবার। হা হা কপড। দিয়ে গেলাম একটা শব্দ, একদম ফ্রিতে। দুনিয়াতে কেই বা ফ্রিতে কিছু দ্যায়?
কিন্তু তাকেও ছুটিতে যেতে হল, হাইকম্যান্ড ফোন করে বলল, ‘তোমাকে কয়েকদিন আন্ডারগ্রাউন্ড চলে যেতে হবে’। চক চৌধুরীতলার কেসটায় ওরা একটু ছড়িয়ে ফেলেছে। একটা ছেলে, কাল কা যোগী যাকে বলে, বাজারে নতুন উঠেছে আর উঠেই ক্যান্টার করে দিচ্ছে একেবারে, ভাবটা যে আমি কী হনু, ইদানীং খুব জাল বিছোচ্ছিল চক-চৌধুরী তলার দিকটায়, ওখানকার সব জমি বাড়ির দালালি, প্রোমোটারি সে একা করবে, হাইকম্যান্ডকে কিছু না ঠেকিয়েই সে একা খাবে সবটা। নিরীহ, লিকলিকে চেহারার, ছাতি ২২ ইঞ্চির হবে, ওদের নেটওয়ার্কে কোন ট্রেস নেই, মার্কেজের ডেটাবেসে যত প্রোফাইল আছে, কারো সঙ্গেই ম্যাচ করে না মালটার।মার্কেজ একটা ল্যাপটপে সবার ডেটা রাখে, কলকাতায় কাজ করে খাচ্ছে যারা এই লাইনে, সবার হাঁড়ির খবর পাওয়া যাবে সেখানে, তা এই মালটা একেবারেই ভুঁইফোঁড়, শুধু কয়েকটা ইনফর্মেশন জোগাড় করতে পেরেছিল। এই নয়া চিড়িয়া, যার নাম হচ্ছে বুকো, ভালো নাম বিবস্বান ভটচাজ, শালা বামুনের ছেলে, হরিনাভির দিকে মুরারীপুকুরে গ্রামের বাড়ি। মস্ত পণ্ডিত বংশ, বাপ ভালোবেসে কায়েতের মেয়ে বিয়ে করায় বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দ্যায়, সেরকম রোজগারপাতি ছিল না, বইপত্র নিয়ে থাকত, ওর মা-ই একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়িয়ে টানত সংসার, তা সেই বাপটাও ফুট করে মরে গেল আর বিবস্বান ভটচায ইস্কুল ছেড়ে হয়ে উঠল এলাকার ত্রাস বুকো। বুকোর ডেটা মনে করে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায় মার্কেজ। তারও একপিস মা ছিল, সেও স্কুলে পড়াত আর বুকোর মার মতো সেও ছেলেকে অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে চেয়েছিল। সেই মা বছর তিনেক আগে মরে গেল না? কে যেন জানিয়েছিল, না, না দাদারা, দিদিরা কেউ না, কোথা থেকে একটা খবর উড়ে এসেছিল, নাকি কেউই খবর দেয়নি, একদিন অ্যাকশন সেরে এসে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিতে দিতে বাথরুমের আয়নায় ফুটে উঠতে দেখেছিল মা নেই, মা চলে গেছে, মা আর কোনদিন বলবে না, ‘ফিরে আয় যোগী। আমার পেনসন আছে, দেশের বাড়িটায় চলে যাব দুজনে, তোর দাদা, দিদিরা সবাই বাইরে সেটল করেছে, খানাকুলে কেউ যাবে না, তুই আমি থাকব, কেউ জানবে না কিছু, সবাই ভাববে চাকরি বাকরির সুবিধে করতে পারিস নি তুই, তাই দেশে চাষবাস করে খাস’ মা কত সরল করে ভাবতে পারে। খানাকুল যেন পৃথিবীর বাইরে, ইন্টারনেটের দৌলতে ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরেও এখন সব খবর গরমগরম পৌঁছে যাচ্ছে, তাই মার্কেজ জগা কে, সেটা দুদিনেই জেনে যাবে গ্রামের মানুষ, তখন তার যাই হোক গে, মাকে কেউ ছাড়বে না। ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে লোকে, সেটা মানতে পারবে না সে। যোগী, কতদিন পরে এই ডাকটাও মনে পড়ল তার। একটা মানুষ চলে যাওয়া মানে তো একটা ডাকও চলে যাওয়া।কত ডাক এরকম হারিয়ে গেছে। এক জেঠা ছিলেন, ওকে ডাকতেন ‘এই হারামজাদা’ বলে।ও যে লাইনে এসেছে, তাতে খুব স্বাভাবিক কথাবার্তাতেই তো দু অক্ষর, চার অক্ষরের ছড়াছড়ি।যদিও ও পারতপক্ষে কাউকে কোন গালাগাল দ্যায় না, গালাগাল কেন, সামান্য হুঁ হা ছাড়া কোন কথাই বলতে চায় না। তারও মাঝে মাঝে জেঠার এই হারামজাদা ডাকটার কথা মনে পড়ে। আর, আর একজন তাকে ডাকত আনন্দ বলে। তাদের পাড়াতেই কয়েকটা বাড়ি পরে থাকত রূপারা। রূপা খুব পড়ুয়া মেয়ে ছিল, কখনো সখনও দেখা হত, বিজয়া বা দোল পূর্ণিমার পুজোয় আসত বাড়িতে। একবার দোলের দিন ফেরার সময় মা বলল ওকে পৌঁছে দিয়ে আসতে বাড়িতে। সেদিন একটা অসহ্য রকমের চাঁদ ছিল আকাশে। যেন রুপোর পাত দিয়ে তৈরি হাতবোমা। সেই চাঁদ তীব্র আক্রোশে ফেটে পড়তে চাইছিল। রাস্তা এত অল্প কেন? কোন কোন রাস্তা এত তাড়াতাড়ি ফুরোয় কেন? বাড়ির সামনে এসে রূপা বলেছিল ‘আর আসতে হবে না আনন্দদা, আসি আমি’ জোছনার মধ্যে ওর শরীর যেন ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মিশে গেল।বাড়ির গেট ঠেলে রূপা উঠোন পেরোচ্ছে, উঠোন মানে আসলে বেশ অনেকটা বড় বাগান, নামেই বাগান, ঝোপঝাড় অযত্নে ভরা, নয়নতারা, টগর আর জবা ফুল, আর একটা গাছ ছিল, আর কখনো কোথাও দেখেনি সে গাছ, মোরগঝুঁটি ফুলের গাছ, অদ্ভুত রঙ ফুলটার, রক্তের মতো। সেইসময় অবশ্য রক্তের কথা মনে হয়নি। রূপা যখন জ্যোৎস্নার নিচ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল, তখন তার ডানপাশে দাঁড়ানো গাছের ফুলগুলোও জোছনা রঙের হয়ে গেছিল। সেদিন তীব্র একটা ইচ্ছে ওকে পেড়ে ফেলেছিল। যদি রূপাকে কোনভাবে আটকানো যায়, যদি আবার ওকে নিয়ে এই চাঁদের নিচ দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফেরা যায়। আরও অনেক কিছুর মতো সেদিনও মার্কেজ সেটা করতে পারেনি।
মা তাকে যোগী বলে ডেকে এসেছে ছোট থেকেই। তার নাম তো যোগানন্দ, অথচ সার্কিটে সবাই সেটা করে দিয়েছে জগা, যেন তার নাম জগবন্ধু কিংবা জগন্নাথ। অবশ্য নাম একটা কুসংস্কার ছাড়া কি? যাকে সারাবছর লুকিয়ে বাঁচতে হয়, তার নাম কোন কাজেই বা লাগে? এক এক সময় তার একেক নাম। তাই মনেই থাকে না তার কী নাম ছিল আসলে। মনে না থাকলেই ভালো। স্মৃতিকে সে ঘেন্না করে। এরই জন্যে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকতে বিচ্ছিরি লাগে তার। সব, সব কিছু মনে পড়ে যায়। কিন্তু সব মনে পড়লেও মা মরে গেছে না বেঁচে আছে, এই মুহূর্তে মনে করতে পারল না সে। মরুক গে, যাকগে। সেই বুকো তাকে এই ঝামেলায় ফেলে দিয়ে গেছে। বড্ড বাড় বেড়েছিল। অজ্ঞাতকুলশীল, সব স্বঘোষিত মাস্তান, মুরারীপুকুরে করে খেতিস, তা নয়, তোর সাধ হল চকচৌধুরীতলা দখল করবি, যেটা নাকি বসের এলাকা। কে না জানে এখানেই একটা ফ্ল্যাটে ফি শনিবার বস জুড়োতে আসে, একটা দেবী দেবী টাইপ মহিলার সঙ্গে। বুকোকে ওয়ার্নিং দেওয়া হয়েছিল দু দুবার, শোনেনি, ঠিক হল ওকে একটু কড়কে দিতে হবে, আর হঠাৎই সন্ধের দিকে ওর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল রানাভূতিয়ার ঝিলপাড়ে। রানাভূতিয়া চকচৌধুরীতলার মধ্যেই পড়ে। জায়গাটা খুব সুন্দর। শীতকালে অনেকে পাখির ছবি তুলতে আসে। সেদিনও ওদের মাথার ওপর দিয়ে এক ঝাঁক টিয়া উড়ে গেছিল ট্যাঁ ট্যাঁ করতে করতে। তারপর আচমকা স্তব্ধতা নেমে এল। চারপাশ শুনশান। দু কিলোমিটারের আগে কোন জনবসতি নেই, একটা চায়ের ঝুপড়ি আছে, তাও এক কিলোমিটার এখান থেকে। এই শান্ত নির্জনতা বুকে চেপে বসছিল মার্কেজের।
যেন মহাজাগতিক কোন সংগীতের মূর্ছনা ছড়িয়ে পড়ছে বাতাসে। যেন কেউ ফিসফিস করে বলছে, কেউ নেই চারপাশে, মারো, মারো, মারো। কী নিঃসীম শান্তি চারদিকে। ভালো খুনী মানে তো একজন ভালো শিল্পীও বটে। একজন কবি বা গায়ক বা চিত্রকরের যেমন ভালো পরিবেশ লাগে, মনের মতো পরিবেশ পেলে সে আরো ভালো কবিতা লেখে, গান গায় বা ছবি আঁকে, আরও বেশি করে ডুবিয়ে দ্যায় নিজেকে শিল্পের মধ্যে। একজন খুনীও কি তাই নয়? আর ভেবে দেখলে প্রায় সব খুনই তো মার্সি কিলিং। বেশিরভাগ লোকই তো ধুঁকতে ধুঁকতে বেঁচে আছে। এ জিনা কোয়ি জিনা হ্যাঁয় লাল্লু? রোজই তারা বলে আমার কেন মরণ হয় না? আমাকে তুলে নাও হে ঈশ্বর। সে যদি সেই পবিত্র কাজটা করে দ্যায়, তবে তো আসলে একটা যন্ত্রণাকাতর জীবনেরই অবসান ঘটাল সে। সেই মানুষটা এবং জগতেরও মঙ্গল করল আসলে। ঈশ্বর যে কে, সেই মালটাকে চেনে না মার্কেজ, কিন্তু ঈশ্বরের যে কাজটা করা উচিত ছিল, করেনি, সেই কাজটাই তো সে করল। সে-ই তো ঈশ্বর। সেই শান্ত, নির্জন সন্ধ্যায় বুকোর সামনে দাঁড়িয়ে তার মনে এক অদ্ভুত আনন্দ হল। শরীর মনে কোথাও কোন উত্তেজনা নেই। ধ্যানমগ্ন যোগীর মতো ও দুই ভুরুর মাঝখানে নিজের চেতনাকে সংহত করেছিল। তারপর যেন চোখ মেলে ও হঠাৎই বুকোকে দেখতে পেল, আর দেখে ওর মন করুণায় ভরে উঠল। কী জীবন অপেক্ষা করে আছে তোর জন্যে, ওরে অর্বাচীন বালক? সারাজীবন পুলিশের ভয়ে ইঁদুরের মতো এ গর্ত থেকে ও গর্তে লুকিয়ে থাকবি, নয়তো, রাস্তার অন্য দলের ছেলেদের হাতে খুন হয়ে পড়ে থাকবি, তার চেয়ে আয়, তোর সব যন্ত্রণার ইতি টেনে দিই, কলকাতায় এত সুন্দর মরার জায়গা আর পাবি না, টিয়াপাখি ট্যাঁ ট্যাঁ করে ডেকে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে, চিরুনির মতো চুল আঁচড়ে দিচ্ছে ঠান্ডা হাওয়া। বুকের ওপর ঝরে ঝরে পড়ছে জারুল ফুল। মৃত্যু এখানে প্রেমের মতো মায়াময়, সাধুর ধ্যানের মতো নিবিষ্ট, ফকিরের মতো উদাসীন। গাধা বুকোটা তেরিয়া গলায় তর্ক করছিল, অনেক সময় দিয়েছিল মার্কেজ, শুনল না, তখন তার সঙ্গী দুজন গিয়ে অতর্কিতে পেছন থেকে বাঁধল, চোখেও গামছা মুড়ে দিল, আর মার্কেজ চোখের পলকে গুলি করল, টিয়াগুলো যেমন উড়ে গেছিল, তেমনি বুকোর প্রাণপাখিও উড়ে গেল আকাশে। যা শালা মুক্তি দিলাম তোকে, বেঁচে থেকে কীই বা ছিঁড়তিস আর কীই বা শান্তি পেতিস। কোথায় কোন নর্দমায়, পচা খালে মরে পড়ে থাকতিস আজ নাহয় কাল, আর আমি তোকে কত সুন্দর একটা জায়গা দিলাম মরার, রানাভূতিয়ার গভীর জলে সবুজ লতাগুল্মের নিচে তুই পড়ে থাক শান্তিতে, হয়তো তোর বুকের ওপর দিয়ে ভেসে যাবে কত মাছ, তোর জামার পকেটে ঢুকে যাবে কোন কিশোরীর হারানো নূপুর। বুকো মরে যত না শান্তি পেয়েছিল, ওকে মেরে তার থেকে বেশি শান্তি পেয়েছিল মার্কেজ। এত তৃপ্তি সে কোনদিন পায়নি খুন করে। যেন কোন মহৎ কাজ করেছে এমন আনন্দ নিয়ে ফিরে এসেছিল, সে রাতে অনেক বছর পর গভীর ঘুম হয়েছিল তার, তার পরে কোন ভাই থাকলে হয়তো বুকোর মতোই হত বয়স, নিজের ভাইকে এত ইঁদুরের মত বাঁচতে দেখলে কি কোন দাদার ভাল লাগে?সে তো দাদার কর্তব্যই নিভিয়েছে (হায় তার বাংলাও হিন্দি সিনেমার আগ্রাসন ঠেকাতে পারল না!), তাই সে রাতে ভারি সুখনিদ্রা হল তার, যেন পাখির পালকের তৈরি একখানি লেপ মা শেষরাতে গায়ে দিয়ে গেছে। এত আরাম লাগছিল। শুধু সেদিন অদ্ভুত ভাবে ওর সেই বহু বছর আগের জোছনা রাতের কথা মনে পড়েছিল, রূপার কথা, ওদের বাগানের মোরগঝুঁটি ফুলের কথা। সেদিন ওর প্রথম মনে হয়েছিল মোরগঝুঁটি ফুলের রঙ একদম রক্তের মতো, যে রক্ত বাইরে ঝরে সে রক্ত নয়, মানুষকে চিরে ফেললে ভেতরে তার হৃপিণ্ড ফুসফুস যকৃত অন্ত্রে যে রক্তের রঙ দেখা যায়, সেই রক্ত। আর এতদিন পরে সেই ফুলের প্রকৃত রঙ জানতে পেরে তার কোন আনন্দ হয়নি, বরং খুন করার আনন্দ ঢেকে দিয়েছিল মিহি জোছনার মতো বিষাদ। রূপাকে যে পাওয়া হয়নি, আর এত বছর পর রূপা যদি ফিরেও আসে(কী অসম্ভব এই ভাবনা!), তাও তাকে এই জীবনে গ্রহণ করা সম্ভব নয়, এই নিরুপায়তা তার ভেতরটাকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে দিচ্ছিল।মনে হচ্ছিল, সারাজীবন সে যা জমিয়েছে, তা শুধুই রক্ত, হাড়, অভিশাপ। সে একটুও জোছনা জমাতে পারেনি, সে একটা রাতের নিট ঘুম জমাতে পারে নি, তার চারদিকে শুধু মৃত পচা গলা লাশ, একটা জ্যান্ত লোক নেই তার পাশে। ওর হঠাৎ মনে হল এই যে বস শনিবার, শনিবার দেবী দেবী টাইপ একটা মহিলা নিয়ে একটু ফূর্তিফার্তা করে, ওরাও কেউ জ্যান্ত না, সব মরে হেজে গেছে কবে। এই রাজ্যটাও মরে গেছে।অনন্ত কাল অশৌচ চলছে যেন।অবশ্য এই বিষাদ মুহূর্তের জন্যে। পরক্ষণেই ফিরে এসেছিল প্রশান্ত আনন্দ।
কিন্তু কে জানত উল্টোদিকের ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে শরীরের খেলায় মেতে উঠেছিল এক জোড়া পায়রা, তারা যদিও গিয়ে লাগাবার সাহস পায়নি পুলিশকে, কিন্তু ফিসফিস করে ছড়িয়ে দিয়েছিল, খালের জলে লাশ পড়ে আছে। আর তোলা হয়েছিল সেই লাশ অবাক করা তৎপরতার সঙ্গে। যে বুকোকে মনে হয়েছিল ভুঁইফোড়, তার মা যে এইরকম লড়াকু মহিলা কে জানত? জাস্টিস চেয়ে মাগী ওপর থেকে নিচ তোলপাড় করে দিচ্ছে, অতএব আন্ডারগ্রাউন্ড। ব্যাপারটা ভয়ানক বোরিং লাগে। হয় ঠাকুরপুকুর ছাড়িয়ে কোন হোটেলের একটা ঘরে বন্দি থাকো, সেখানে আরাম যথেষ্ট, এসি থেকে নরম বিছানা, জানলা দিয়ে চোখ বাড়ালে সবুজ লন কিংবা পুকুরে হাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে। চারবেলা খাবার, বেল বাজালে যখন ইচ্ছে কফি চা, কিন্তু সারাদিন বেয়ারা ছাড়া কারো মুখ দেখতে পাবে না। এমনকি নিজের মোবাইল পর্যন্ত সুইচ অফ করে রেখে জমা করে আসতে হয় চন্দনের কাছে। তার বদলে একটা টেপা ফোন দ্যায়, যেটায় শুধু ফোন করা যায় আর ফোন আসতে পারে। ইন্টারনেট আসলে যে একটা ফাঁদ তা মার্কেজের থেকে বেশি কে জানে!কত ছেলে অ্যাকশন সেরে এসে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা অবস্থায় ধরা পড়ে গেছে, স্রেফ এই সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য। প্রাণ আঁকুপাঁকু করছিল ফেসবুকে সেলফি পোস্ট করার জন্যে। ব্যস, পুলিশ ক্যাচ কট কট করে ফেলেছে। এমনি সাধারণ লোকেই কেমন নেটের জালে পড়ে যায়, লোকে বুঝতেই পারে না, তার পছন্দের গানের খোঁজ, পছন্দের পোশাকের খোঁজ, পছন্দের বেড়ানো-সব তার এইটুকু মোবাইল জানল কী করে? মানুষ নিজের অজান্তেই এই জালে জড়িয়ে যায়। তার সব ব্যক্তিগত তথ্য আর গোপন থাকছে না। কি মারাত্মক।
আরেকটা আন্ডারগ্রাউন্ড আছে সোনারপুরে চাঁদমারি ছাড়িয়ে বড় বিবিমা তলার পেছনে একটা গ্রামে। সে এক অদ্ভুত গ্রাম, রাস্তা থেকে বোঝাই যায় না এখানে এমন একটা গ্রাম আছে। আর সেই গ্রামের মানুষগুলোও খুব অদ্ভুত। যেন ওরা সত্যি সত্যিই গ্রামের বাসিন্দাই নয়, কোন নাটকের সেটে গ্রামবাসীর চরিত্রে অভিনয় করছে। এই যে মার্কেজ যাবে, থাকবে, সেই নিয়ে কারো কোন কৌতূহলই নেই, এরাও কি সব আন্ডারগ্রাউন্ডে আছে নাকি? এরকম মনে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারণ প্রথমত একটা গ্রাম এখন এই সময়ে এত খাঁটি গ্রামের মতো, ভাবা যায় না। সবার মুখে হাসি, খেতে ফসল, রাজনীতির র নেই। দ্বিতীয়ত, মোট তিনবার গিয়েছে সে, কিন্তু কোনবার গিয়েই এক লোককে দেখেনি, প্রতিবার নতুন লোক, আর কেউ তাকে চিনতে পেরে ছুটেও আসেনি, বলেনি ‘ও দাদা কেমন আছেন?’ তার মানে এটা কোন গ্রামই নয়, একটা অলীক জায়গা, যার মধ্যে সে কোন কোনবার সেঁদিয়ে যায়, কিন্তু বেরিয়ে আসার পর যার আর কোন অস্তিত্বই থাকে না।
তবু তো রিসর্ট বা গ্রাম থাকার পক্ষে ভালো, যতই বোরিং হোক। কতবার তো খালপাড়ে জঘন্য বস্তির ঘরে থাকতে হয়, কিছু করার থাকে না।
এবার তাই সে ইচ্ছে করেই এই ট্রিপে বেরিয়ে গেল। পুরুলিয়া। পটার গাড়িতে। পটার নম্বর তাদের এক জনের কাছে লেখা আছে। কবে যেন একসঙ্গে জেল খেটেছিল।ভাগ্যিস পটা সেই টাইপের লোক নয়, যারা মুহূর্মুহু নম্বর পালটায়। বছরের পর বছর ধরে একই নম্বর। আর সেই মান্ধাতার টেপা ফোন, যাতে শুধু ফোন করা যায় আর ফোন ধরা যায়।তবে পটার নম্বরে ফোন করে সাহুর নম্বর নিতে হয়েছে। যা কথাবার্তা সাহুর সঙ্গেই হয়েছে। গাড়িতে তার কো প্যাসেঞ্জার ছিল দুটো ফেমিলি। কথায় বার্তায় বুঝেছে দুজনেই সেক্টর ফাইভে আই টি তে আছে, এক কোম্পানি নয়, আলাদা, তবে পাশাপাশি, লাঞ্চ সারতে গিয়ে দেখা ও বন্ধুত্ব। তারপর দেখা গেছে দুজনের ছেলেমেয়েই দক্ষিণ কলকাতার একই স্কুলে পড়ে, একই ক্লাস, সেকশন আলাদা। এর পর থেকে ওরা একসঙ্গে বেড়াতে যায়। কারণ এদের চাকরিতে ছুটিছাটা কম, অনেক আগে ফ্লাইটের টিকিট বুক করে রাখা সম্ভব না, কারণ দুজনের বাড়িতেই বয়স্ক ও অসুস্থ বাবা মা, কখন কী হয়ে যায়, তাই উইকএন্ড কাটাতে এই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়াই ভরসা। দুজনেরই গাড়ি আছে, ড্রাইভও করতে পারে, কিন্তু বেড়াতে গিয়ে ড্রাইভ করলে ঠিক মজা আসে না।
এদের গাড়িতে সে একটা উটকো লোক, ঢুকে পড়ল কী করে? সেটা বস আর চন্দনের কেরামতি। পটার মালিককে টাকা বেশি দিয়ে কিংবা হুমকি দিয়ে, কে জানে কী করে মালিকের শালা বলে গুঁজে দিয়েছে, ব্যস কেস পুরো খাপে খাপ পঞ্চুর বাপ। একটাই সমস্যা, বাচ্চা কাচ্চা, তাদের বাপ, মা বড় চেল্লামিল্লি করে। এটা আন্দাজ করেই মার্কেজ খানিকটা তুলো নিয়ে গেছিল, দরকার মনে করলেই কানে গুঁজে দিয়েছে। সারা টুরে মালগুলো দৌড়ে মরল স্পট দেখে আর বউয়ের সঙ্গে সেলফি তুলে। মার্কেজ শুধু গাড়ি থেকে নামত হাত পা ছাড়াবে বলে। এইরকম একটা জায়গায় নেমেছে, খুব সুন্দর লেক, মেয়েছেলেরা ঘাটে চান করছে সাবানের বাক্স নিয়ে। কী নাম যেন মুরুগামা না কী। হঠাৎ একজনকে দেখে তার নিঃশ্বাস আটকে গেল। লাল টপ আর জিনস, খোলা চুল, সানগ্লাস মাথায় তোলা, ছবি তুলছে। এ মুখ তো ভোলার নয়। রোদের নিচেও জোছনাকে চেনা যায়। রূপা!