
জগাদার গবেষণাপাতা:প্রথম পর্ব
শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
'নুকোচুরি'তে নানান মুহূর্ত উঠে আসে সাধের কলকাতার।আমি নিজে পেশাগতভাবে এক পেচো ডাক্তার।তাই প্রথমেই প্রথম অধ্যায়ের "অসৎ কর্ম্মের প্রতি ফল" গদ্যের এই লাইনগুলি নজরে এল।"হুতোম প্যাচার নক্সা প্রচারের সময়েই ডাক্তর বেরেগ্নির হমিওপ্যাথির প্রাদুর্ভাব হইল,কি বড় কি ছোট সকলেই হমিওপ্যাথি শিখিতে আরম্ভ করিলেন;এবং দেশে জেলায় এই ঔষধ প্রচার হইয়া অ্যালোপ্যাথির কম পড়িল।এ বিষয়ে আমি অপারদক্ষ বলিয়া বিশেষ বিবেচনা করিতে পারি নাই..."।এরই মাঝে অলিতেগলিতে পরিচয় হল পামর বাবুর সভাপণ্ডিত গোপালরাম চূড়ামণির সঙ্গে।পামরবাবু একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলেন।'যদি পরস্ত্রী গমন করি,তাহাতে কি কোনো পাতক আছে?শাস্ত্রে কোনো দোষ না থাকলে আর নুকোচুরি করিনে।'মহাপাতক চূড়ামণি মাথা চুলকে বললেন,'মহাশয়!কি বলেন?পরস্ত্রী গমনে যদ্যপি পাতক হতো,তাহা হইলে ভগবান যশোদানন্দন আর ষোড়শ ব্রজগোপিনীর সহিত লীলা কোত্তেন না?দেবাদিদেব মহাদেবও কূচনী ক্রীড়ায় রত হতেন না?এ বিষয়ে কিছু মাত্র পাপ কি নুকোচুরি নাই!আজ কাল তো আপামর সাধারণে এ কাজ কোচ্চে।'পামরবাবু ইয়ং বেঙ্গল।তিনি "শকের প্রাণ গড়ের মাঠ" খড়দহে বৈষ্ণব,কালীঘাটে মাতৃভক্ত আর সুপাচক উইলসনের বাড়িতে সুপানাহারি।এই বাবুর মোসাহেব ক্ষেত্রনাথ মুখোপাধ্যায়।সেই ক্ষেত্রনাথ,পাঁচিধোবানির গলির পঞ্চানন তর্কলঙ্কার,বটতলার ব্রজ ন্যায়রত্ন,শিমুলার শ্যামাচরণ গোস্বামী,নিমতলার নিমচাঁদ বাবাজি,হাটখোলার হিদেরাম ঘোষাল প্রমুখ গুণী মানুষদের নিয়ে বৈঠক বসল।বিষয় 'নুকোচুরি'।বিবাহ,পরকীয়া,বিধবাবিবাহ।পামরবাবুর তারুণ্যে ফিকে হয়ে আসছিল প্রবীণদের প্রাজ্ঞতা।আর পুরস্কার স্বরূপ মঞ্চে 'কনে' অবতারে আবির্ভূতা হলেন মাজননী। শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তীর ধারাবাহিক। জগাদার গবেষণাপাতা। প্রথম পর্ব
কলিকাতার নীলেখেলা
প্রথমেই করজোড়ে বলে নিই।মারবেন না বাপু।এ নাম আমার দেওয়া নয়।টেকচাঁদ ঠাকুর জুনিয়ারের দেওয়া।লেখার আনুমানিক কাল ১৮৬৯।সবই না হয়ে বুঝলেন।কিন্তু ‘বুঝব বুঝব’ করেও যে সেই আমাকে মারতেই আসবেন সেকথা জানি।”নীলেখেলা” আবার কি?চ্যাঙরামো হচ্ছে?কলকাতা নিয়ে চ্যাঙরামো?যেখানে একটা ছোট ফ্ল্যাটের দাম তেরো কোটি,ব্যাঙ সামান্য রেচন করলেই দরজায় ভেনিস,আর মফসসলের যে তরুণ সম্পাদক ছেলেটা পোতিষ্ঠে পাবার ইচ্ছায় কলেজ স্ট্রিটে সুলভ শৌচালয়ের পাশের একচিলতে ঘরটাতে কোনওমতে সবুজ পাতা আঁকবার চেষ্টা করছে,সেই মহানগর নিয়ে রসিকতা?মা কালী বলছি,বারো আনার দিব্বি,এই কাম আমার নয়।প্রমাণস্বরূপ সেই বইটির প্রথম প্রচ্ছদটি আবহমানের প্রিয় সাহসী সম্পাদক দাদার হাতে থরহরিকম্পে তুলে দিলাম।
এই ‘নীলেখেলা’ যার থেকে ধার করা,সেই বই দিয়েই এই ধারাবাহিকের সূচনা করি।মূল বইটির নাম ‘কলিকাতার নুকোচুরি’।লেখক টেকচাঁদ ঠাকুর জুনিয়র।বিদ্যারত্ন প্রেস থেকে ১৮৬৯ সালে এ বই প্রকাশ করেন অরুণোদয় ঘোষ।এই লেখা পুনর্মুদ্রিত হয় শ্রী নির্মাল্য আচার্য সম্পাদিত ‘এক্ষণ’ পত্রিকার শারদীয় ১৩৮৭ সংখ্যায়।মনে রাখতে হবে এই পত্রিকাই কিন্তু আরও একটি কলকাতা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ লেখা প্রকাশিত করছিল ধারাবাহিকভাবে।তখনও সে লেখা গ্রন্থের আকার লাভ করেনি
সেই বইয়ের নাম ‘কলকাতা দর্পন’।রচয়িতা রাধারমণ মিত্র।
‘নুকোচুরি’তে নানান মুহূর্ত উঠে আসে সাধের কলকাতার।আমি নিজে পেশাগতভাবে এক পেচো ডাক্তার।তাই প্রথমেই প্রথম অধ্যায়ের “অসৎ কর্ম্মের প্রতি ফল” গদ্যের এই লাইনগুলি নজরে এল।”হুতোম প্যাচার নক্সা প্রচারের সময়েই ডাক্তর বেরেগ্নির হমিওপ্যাথির প্রাদুর্ভাব হইল,কি বড় কি ছোট সকলেই হমিওপ্যাথি শিখিতে আরম্ভ করিলেন;এবং দেশে জেলায় এই ঔষধ প্রচার হইয়া অ্যালোপ্যাথির কম পড়িল।এ বিষয়ে আমি অপারদক্ষ বলিয়া বিশেষ বিবেচনা করিতে পারি নাই…”।এরই মাঝে অলিতেগলিতে পরিচয় হল পামর বাবুর সভাপণ্ডিত গোপালরাম চূড়ামণির সঙ্গে।পামরবাবু একদিন তাকে জিজ্ঞেস করলেন।’যদি পরস্ত্রী গমন করি,তাহাতে কি কোনো পাতক আছে?শাস্ত্রে কোনো দোষ না থাকলে আর নুকোচুরি করিনে।’মহাপাতক চূড়ামণি মাথা চুলকে বললেন,’মহাশয়!কি বলেন?পরস্ত্রী গমনে যদ্যপি পাতক হতো,তাহা হইলে ভগবান যশোদানন্দন আর ষোড়শ ব্রজগোপিনীর সহিত লীলা কোত্তেন না?দেবাদিদেব মহাদেবও কূচনী ক্রীড়ায় রত হতেন না?এ বিষয়ে কিছু মাত্র পাপ কি নুকোচুরি নাই!আজ কাল তো আপামর সাধারণে এ কাজ কোচ্চে।’পামরবাবু ইয়ং বেঙ্গল।তিনি “শকের প্রাণ গড়ের মাঠ” খড়দহে বৈষ্ণব,কালীঘাটে মাতৃভক্ত আর সুপাচক উইলসনের বাড়িতে সুপানাহারি।এই বাবুর মোসাহেব ক্ষেত্রনাথ মুখোপাধ্যায়।সেই ক্ষেত্রনাথ,পাঁচিধোবানির গলির পঞ্চানন তর্কলঙ্কার,বটতলার ব্রজ ন্যায়রত্ন,শিমুলার শ্যামাচরণ গোস্বামী,নিমতলার নিমচাঁদ বাবাজি,হাটখোলার হিদেরাম ঘোষাল প্রমুখ গুণী মানুষদের নিয়ে বৈঠক বসল।বিষয় ‘নুকোচুরি’।বিবাহ,পরকীয়া,বিধবাবিবাহ।পামরবাবুর তারুণ্যে ফিকে হয়ে আসছিল প্রবীণদের প্রাজ্ঞতা।আর পুরস্কার স্বরূপ মঞ্চে ‘কনে’ অবতারে আবির্ভূতা হলেন মাজননী।
সেদিন রাতদুপুরে কলকেতে ফিরছি।বিরাট গাড়ির লাইন।কী হলো?নাকা চেকিং।এই ‘নাকা’ শব্দর ব্যুৎপত্তি নিয়ে আমার কৌতূহল জন্মেছে বিস্তর।’নাকা’ কি ‘নাঈআ’ পরানো?নাকি নাকের সামনে টিফিনের পয়সা তোলা?নাকি কাপড়খোলা প্রশাসনের ‘নাগা’ রূপের অপভ্রংশ রূপ।কিন্তু যারা ভাবছেন পুলিশের এই ‘নাকা’ রূপ কলকাতার নবতম সংস্করণ,সেই পাঠককে স্মরণ করিয়ে দিই চতুর্থ অধ্যায়ের ‘পুলিশ বিচার’এর এই লাইনগুলি।”পুলিশ জম করিতেছে,লোকে থই করিতেছে,দালাল উকীল এদিক ওদিক করিয়া বেড়াইতেছে,কেরানিরা বই হাতে করে এঘর ওঘর করিতেছে,সারজন,ইনস্পেক্টর সব দ্বারে বসিয়া আছে;ছোটলোকে পোরা,মামলার তদ্বিরে কৌশল চলিতেছে ও কেরানি মহলে রকমারি বকসিস চলিতেছে।”বকসিস শব্দটি যে একবিংশ শতাব্দীর আবিষ্কার নয় তার প্রমাণ এই উনিশ শতকের নথি।এই প্রসঙ্গে আমার জীবনের একটি ঘটনা বলি।আমার বড়মাসিমণি তখন ঘোর অসুস্থ।আরজিকরে ভর্তি।দুই মাসতুতো ভাই দিনরাত নিরলস পরিশ্রম করে চলেছে।তাদের শ্রান্তি নেই,ঘুম নেই।এরই মধ্যে বসন্তের কোকিলের মতোই একদিন বড়মাসিকে দেখতে গেলাম।আইসিইউতে।গতকাল এম আর আই হয়েছে।আজ রিপোর্ট দেবার কথা।আরজিকরে যেখানে রিপোর্ট দেয় সেখানে লাইন দিতে গেছে আমার মাসতুতো ছোটভাই কাবাই।পিছনপিছন আমিও।ঘরের বাইরে টুলের ওপর বসে একটি লোক চাঁদার রসিদ কাটছে।কীসের রসিদ?এটা তো মলমাস।তাছাড়া কোনও পীর পয়গম্বর ইফতারও নেই এমাসে।আমি জিজ্ঞেস করতে যেতেই আমার চেয়ে প্রায় সাত বছরের ছোট ভাই কাবাই আমার মুখ চেপে ধরল।ইশারা করল যেন কিছু না বলি।একটা পাঁচশো টাকা গুঁজে দিতে হল লোকটার হাতে।লোকটি বড়মাসির নাম বেড নম্বর লিখে নিল।ব্যাপার কি?আমি পেচো ডাক্তার আগেই বলেছি।গ্রামে গঞ্জে থাকি।সে থাকলেও আমার জন্ম,কৈশোর,যৌবন সবই কলকাতায়।আমি জানি সরকারি হাসপাতালে এম আর আই বিনামূল্যে হয়।তাহলে এই রসিদ কিসের?কাবাই ফিসফিস করে বলল,’মুনাইদা।কিছু বলো না।বললে কাউন্টার থেকে বলবে রিপোর্ট হারিয়ে গেছে।’কোন্নগরের ছেলে কাবাই।বড়মাসিমণির বাড়ির ভগ্নপ্রায় ঠাকুরদালানে কতো ক্রিকেট খেলেছি ছোটবেলায়।সেই কোন্নগরের কাবাই,মফসসলের কাবাই কেমন এক সপ্তাহে কলিকেতার নীলেখেলা বুঝে গিয়েছে ভাবতেই অবাক লাগল।আমি চুপ মেরে গেলাম।আমার সংগ্রাম অন্যদিনের জন্য তোলা থাক।আপাতত রিপোর্ট হাতে আসুক।এমনটাই ভাবলাম।
এসব আজ থাক।সবে বৌনী করছি।আর এই সব আলফাল লিখছি।তরুণ লিখিয়েদের এই সমস্যা।যখনতখন ব্যতিক্রম করে।আর বাটাম খায়।তারপর লাইনে চলে আসে।’ইউ হ্যাভ টু বি ইন দ্য সিসটেম টু চেঞ্জ দ্য সিসটেম’।আহা।এর চেয়ে বড় কোনও কথা হয় নাকি?সেই যে ‘বয়ল্ড ফ্রগ সিণ্ড্রোম’।মুসলমানের পরবরদিগারে আর হিন্দুর কৃষ্ণর ওপর ভরসা।সেই নিয়তির কপালে মাথা ঠুকেই তো সেইদিন আর কোনও প্রোইবাদ করিনি।লাইনে দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম কাবাইয়ের সঙ্গে।যদিও শেষমেশ মাসিমণিকে ঘরে ফেরানো যায়নি সেইবার।যাক সে কথা।ফিরে আসি ‘নুকোচুরি’তে।অষ্টম অধ্যায়।’মোসাহেবদের দুর্গোবিপত্তি’।সেই পুনরুচ্চারণে আপাতত বিজয়া জানাই।”আশ্বিন মাস,পূজার সময়, ঋতুর পরিবর্তন হইতেছে,হাট বাজার গুলজার হইয়াছে,রাস্তা ঘাটে লোক থই থই করিতেছে,দোকানি পশারিরা,পূবে ও ঢাকার বাঙ্গালদের পেয়ে বসেছে,তাহাদের নাবার খাবার সময় নাই,এক কোপে কাটছে।মহাজনেরা খেরে আদায় করছে,নূতন খাতার ও পূজার সময় দেনা পাওনা একরকম চুক্তি হিসাব হয়ে থাকে;সুতরাং সকলেই খাতা হাতে করে সাত্ করতে বেরিয়েছে।বড়বাজার চিনেবাজার অঞ্চলে যাওয়া ভার,একে তো বার মাস অতিশয় ভিড়,তায় পূজার সময়,দালাল রাস্তায় বেড়াচ্ছে,চোর,ছেঁচড়,গাঁটকাটা,ছোঁ করে ঘুরচে,সময় পেলে চিলের মতো ছোঁ করে টাকিটা,সিকেটা,নিয়ে যাচ্ছে।কোথায় বা ষষ্ঠ্যাদি কল্পের নহবত বাজিতেছে,কোথায় বা নাচ গান হচ্ছে,কোথায় বা ছেলেরা নতুন কাপড় চোপড় পরে নিমন্ত্রণ করতে বেরিয়েছে,কোথায় বা যাত্রার মহলা হইতেছে,চতুর্দ্দিকে গোলযোগ,কলিকাতায় ধূমের সীমা নাই!”এই ধূম কি আনন্দের ধূম,নাকি ধূম্রলোচন,এ বিচার আপনারা করুন।এমনিতেই যথেষ্ট রিস্ক নিয়ে এই লেখা লিখেছি।এ প্রসঙ্গে বলি,’এই জগাদা আমি নই।জগাদা অন্য কেউ।সে আমাকে ডিকটেশন দেয়।আর আমি লিখি।পাঠক রেগে যাবেন না।রাগ রক্তচাপ বাড়ায়।টেলমিসারটান,এমলোডিপিন,ক্লোরথ্যালিডন।অনেক ফ্যাচাঙ।তার চেয়ে জগাদার গবেষণাগারে বসে নীলেখেলা দেখুন।আর আনন্দ করুন।কারণ জগৎ সৎচিদানন্দ।জয় গুরু।
(ক্রমশ)