
তমোঘ্ন মুখোপাধ্যায়-এর কবিতাগুচ্ছ
মোহতন্ত্র
১
জল, অনুভব, ঘোর। পিতৃপুরুষদের ঊর্ধ্বগতি এই তিন চক্রে
ছুটে শেষ। একা-একা বালি তুললে নিভে যাচ্ছে গৃহময় হাত।
আসঙ্গ বলি দেওয়ার আগে সূর্যাস্তের প্রতি
তোমরা প্রণাম ভুলেছিলে। ধাতু ও ক্ষয় পরিবারের বাইরে যেতে দিতে নেই।
পিতৃ ও মাতৃ উভয় ঝরনার পতন সম্মুখে রেখে, এসো,
শিকার ছাড়াই। যে-কোনো গোলাপী মাংসের আঁচ
আমাদের স্বাস্থ্যে উর্বরতা পুঁতে রাখে।
কে কত তর্পণ দিল, কে কত অন্ন ছড়াল— আত্মহনন
কিচ্ছু মনে রাখে না।
জল, অনুভব, ঘোর…
পিতৃপুরুষদের গতি এই তিন চক্রে বদ্ধ, ম্লান।
সূর্যাস্তে প্রণাম দিই।
অথচ প্রত্যেক বলি শেষে
মুঠো ভর্তি মাটি তুললে
ঝরে যাচ্ছে ঘাসের সন্ন্যাস।
২
পশুটি লুটিয়ে গেছে। ধর্মাধর্ম জ্যান্ত নেই আর।
আমাদের নখগুলি হাড় ও মাংসের সখ্য কেটে
পৃথক ঝুলিয়ে দিল।
অজস্র যুবক আসে, দ্যাখে।
এসো, সে-নন্দন হয়ে, রতিক্রিয়ারত বাবা-মাকে
চোখের কুয়োয় ফেলে যে ছুটেছে ভয় কাঁধে নিয়ে।
পশু ও তোমার দেহ যে-মুহূর্তে মিলেছে হুবহু,
সে-মুহূর্তে বিদ্যা নাও; হাড় ও মাংসের সখ্য ভেঙে
পৃথক ঝুলিয়ে রাখো।
মাটির গতরে রক্ত পড়ে।
ধর্ম কিছু ছিল আগে? নাকি স্রেফ পশুদেহ ধ্রুব?
ঘুমন্ত বাবার পিঠে চুমোর প্রপঞ্চ ধীরে ফেলে
পরিতৃপ্ত মাতৃমুখ ডুবে গেছে সন্তানের হ্রদে…
৩
অবশেষে ঘাড় থেকে নেমে গেছে ঈশ্বরের হাত।
এমন একাকী হলে, কাছে যত বন্ধুমুখ ঘোরে, ফেরে,
কথা গিলে নেয়,
সমস্ত শরীরী লাগে।
অথচ মায়ার বেশি অন্য কোনো বোধ জেগে নেই।
কত হাঁস জল ছেড়ে উঠে গেছে প্রতিটি বিকেলে।
অল্পই নির্বাণ পাবে। বাকিদের ফের জলে আসা।
পালকের খাঁজে জরা;
ঠোঁট শুধু ছুঁতে পারে। শুশ্রূষা যায় না অতদূর।
পুরোনো শরীর থেকে উঠে গেছে ঈশ্বরের দাগ।
এমন জন্মের কোনো শোক নেই, স্বস্ত্যয়ন আছে।
৪
এখানে ফের দুর্বিপাক, এখানে ফের না-চাইতেই জল।
ভেসে যাচ্ছে কাঠামো, শব, বীজমন্ত্র, গৃহপালিত শোক।
কত হরিৎ যন্ত্রমুখে অযুত ফেনা হু-হু শব্দে ঘোরে
হিসাব নেই। ভাণ্ড ফেটে বাচ্চা কার বেরিয়ে গেল আজ?
বাঁচাও, জলে মা আর শিশু হারিয়ে গেলে কাদের লোভে ঘর
বানিয়ে ফের দিনাতিপাত; না-চাইতেই জলের শিরা ফোলে।
উপরে মেঘ হস্তিনীর গর্ভ (ঘন শ্যামবরণ); দিন
হাঁ-মুখ তুলে গিলতে চায়, মুখের খাঁজে পাতাল জেগে ওঠে।
পাতালে যাই, জলের চাপ হাড়-পাঁজর ফাটিয়ে দিতে দিতে
মনে পড়ায় লেখার ঘর, মনে পড়ায় মৈথুনের স্বেদ।
পোয়াতি পাতা, শিথিল হাত, খোলসহীন কুলকুণ্ডলিনী।
এখানে তবু দুর্বিপাক, এখানে জল প্রবল, অযাচিত।
ভেসে যাচ্ছে ঘর-দুয়ার, গাভীর খড়, গৃহপালিত গাছ।
লেখার ভ্রমে লেখার হাত শরীর ছেড়ে তলিয়ে গেল। একা…
৫
কথা নেই।
টের পেলে
শিশুমাংস ঠোঁটে তুলে দূরে যাবে
বুভুক্ষু গৃধিনী।
কথা নেই। সারারাত
ইশারা বুনন ক’রে এ-ওকে বুঝিয়ে দিই—
আগে যত নিরাপদ
ছিল ঘর, ছিল পথ, মাঠ ছিল হাসিমুখে রাঙা,
এখন সমস্ত দিনে
তত তীক্ষ্ণ শবগন্ধ… রোজ…
যে-যার স্তব্ধতা দিয়ে উঠোন, বাথান, সুখ
ঢেকে রাখি।
পাখি শীর্ষে ওড়ে।
(ওদের বাঁচাও, যারা পূতিগন্ধ পার ক’রে
মধ্যরাতে ফেরে গান কাঁধে।)
ভয়ের ফণাটি যেই নেমে গেল শোকের প্রকোপে,
গোটা তৃণভোজী গ্রাম পেতে চায় আমিষের স্বাদ।
বিশাল উনুন ঘিরে বসে আছে অজস্র শরীর।
পাখির মরণ তুমি
স্থির করো, মূক ভগবান!
ভালো লাগল