
পর্ণশবরীর কথকতা ১৯ প্রাপ্তি চক্রবর্তী
অলস দিনগুলোতে পায়ের তলার মেঝেকে বেশি শীতল লাগে। বন্ধ ঘরের চার দেওয়ালের থেকে বেরিয়ে ছাদের ‘পরে মাদুর বিছিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকি। খালি পায়ের পাতায় একজোড়া কালো পিঁপড়ে খেলা করে বেড়ায়। আমি আদিগন্ত নীল মহাশূন্যতার দিকে চোখ মেলে একটা নিরিবিলি বাজপাখির উড়ন্ত ভঙ্গিমা দেখে তাকে কামনা করে বসি।
এতদিনে আমি জেনে গিয়েছি প্রেম আসলে হয় দুই খেচড়ের, মানুষের হয় লেনদেন। আমি এই মধ্যবেলায় এই লাল মেঝের ‘পরে বিছানো একটা শীতল মাদুরে শুয়ে এক পাখি জীবন কামনা করি।
শীত আসে আমার পায়ের পাতা বেয়ে। ধীরে ধীরে সে উঠে আসতে চায় আমার মগজে; আমার হৃদয়কে একটি মাত্র আঘাতে বিচূর্ণ করে ফেলার লালসা তার চোখে আর ঠোঁটের কিনার ঘেঁষে বেয়ে পড়ে। সব বিবর্ণ লাগে। কালো কফিতে চুমুক দিয়েও উষ্ণতা খুঁজে পাই না৷ মন্থরগতি নিয়ে পাশ ফিরে শুই, দুই হাঁটু বুকের কাছাকাছি উঠে আসে। নিজেকে গুঁটিয়ে নিয়ে ছোট হতে হতে ফিরে যাই প্রথম কৈশোরকালে; হৃদয়ের লেনদেন যখন ছিল নৈবেদ্যের গন্ধ মাখানো৷
এই হৈমন্তিক মধ্যবেলা জাতিস্মরের মত আমায় সব ফিরিয়ে দিতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। এক আঙুলের শীতল স্পর্শে সমস্ত ফিরিয়ে দেবে সে। পায়ের আঙুলের ডগায় দাঁড়িয়ে উন্মুখ চোখে তাকায় সে আমার দিকে। উড়ন্ত বাজের দিকে আর একটিবার নিষ্পলক দৃষ্টি দিয়ে আমি আলিঙ্গন করি প্রথম শীতবেলাকে। ধীরে ধীরে সে আমার উরু, নাভিপদ্ম পেরিয়ে বুকের মাঝ বরাবর এসে কুন্ঠা ভরে একটি মাত্র আঘাতে আমার হৃদয় বিচূর্ণ করে আমায় সম্পূর্ণ শান্ত করে, বাসা গড়ে তোলে হৃদয়ের গহ্বরে।
অন্যমনস্ক হয়ে পায়ের দিকে চেয়ে দেখি খেলা করা জোড়া কালো পিঁপড়ে কখন পিষে গেছে আমারই পায়ের পাতায়। নীল মহাশূন্যতায় চোখ ফিরিয়ে দেখি সমস্ত খেচড় উড়ে গেছে উষ্ণতর আশ্রয়ের খোঁজ পেয়ে।
এই বাড়ির লালরঙা ছাদে এখন শুধু এক বোবা রমণী তার শীতলতম দিন মেলে শুয়ে আছে। তার হৃদয় গহ্বরে বাস জমাট নৈঃশব্দের।

