
অক্ষয় কুমার সামন্ত-র গল্প
মা
‘আজ সন্ধ্যায় শপিংমলে যাবো। রেডি হয়ে থাকবে।’
‘আজ? আবার?’
‘হুম।’
‘কেন? এইতো গত সপ্তাহে শপিংমল থেকে অনেক কেনাকাটা করে এলাম।’
‘আজ আবার যাবো, কিছু কিনবো।’
‘কি কিনবে?’
‘যখন যাবো তখন দেখা যাবে।’
‘আজ আমার যেতে ভালো লাগছে না। তুমি নিজে নিয়ে চলে এসো।’
‘না না, তোমাকে দরকার।’
‘আমাকে!’
‘হুম।’
‘কেন?’
‘তোমার পছন্দের রঙের জিনিসই দরকার।’
‘আমার পছন্দের রং তুমি কি জানো না?’
‘জানি।’
‘তাহলে?’
‘আমি তোমার পছন্দের রঙের একটা জিনিস কিনে আনলাম সেটা একরকম। আর তুমি নিজে হাতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে জিনিসগুলোর মধ্য থেকে একটা কিনে আনবে, তার অনুভূতি আলাদা।’
‘মানে!’ একটু অবাক হয়ে বলল অভিপ্সা।
‘মানে টানে কিছু না। তুমি রেডি হয়ে থাকবে। ব্যাস।’ এই কথা বলে ঈশান অফিসে বেরিয়ে গেল।
ঈশান অফিস যাওয়ার জন্য গড়িয়া থেকে একটা সাটেল ধরল। সকালবেলায় এই গড়িয়া থেকে সল্টলেকের দিকে যাওয়ার জন্য বাসগুলোতে খুব ভীড় হয়। রাস্তায় জ্যাম হয়ে যায়। হবে নাই বা কেন, প্রচুর ছেলেমেয়ে সল্টলেকের কলেজ যাওয়ার জন্য এখান থেকেই বাস ধরে। এখানকার বাস সার্ভিস বেশ ভালো। খুব কম টাইমে পৌঁছেও দেয়। তবে বাসে যদি কেউ একটু পেছনের দিকে চলে যায়, আর তাকে যদি চিংড়িঘাটা নামতে হয় তাহলে তখন তাকে চিড়ে চ্যাপ্টা হওয়ার মত খারাপ অবস্থার মুখোমুখি হতে হয়। বাসের ভেতর থেকে ঠেলে ঠুলে গেটের কাছে এসে নামাই দায়। চিংড়িঘাটা সল্টলেক নিউটাউন এইদিকে অনেকগুলো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। এই কলেজগুলোর স্টুডেন্টস্ও কম নয়। একবার তো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের একটা মেয়ে সম্ভবত ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। পিঠে কলেজের ব্যাগের সাথে সাথে টি স্কেল নিয়ে উঠেছে। নতুন নতুন তো, এই সময়ে বাসে যাওয়া আসার অভিজ্ঞতাও কম। বাসে ওঠার সময় বাসের পেছন দিকে সিট ফাঁকা বলে বসে পড়েছে। সে নামবে সল্টলেক স্বাস্থ্য ভবনের কাছে। বাসের ভেতর ভীড়ের দুঃসহ অবস্থা অনুমান করে চিংড়িঘাটা আসার অনেক আগে থেকেই সে উঠে পড়েছে। ঠেলে ঠেলে তাকে আসতে হবে গেটের দিকে। কিন্তু তার সব চেষ্টা ব্যর্থ হল। নিজে যদিও অন্যদের একটু সাইড দিতে বলে বলে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে কিন্তু তার টি স্কেল অন্যদের পিঠে বা সাইডে আটকে যায়। শেষমেষে নামতেই পারলো না। তাকে নামতে হলো কলেজ মোড়ে।
ঈশান যে কোম্পানিতে কাজ করে তারা একটা নতুন সাইট ধরেছে। ঝাড়খন্ডে। সে সাইটের স্পেশাল প্রজেক্টের জন্য তার ওপর দায়িত্ব পড়েছে। তাছাড়া অন্যান্য কর্মীদেরও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। যার প্রজেক্ট ভালো হবে কোম্পানি তারই প্রোজেক্ট একসেপ্ট করবে। তাতে দায়িত্ব যেমন পড়েছে তেমনি প্রমোশনের ব্যাপারটাও লেগে থাকে। ঈশান কয়েকদিন বাড়ি ফিরেও রাত জেগে সেই প্রজেক্টের জন্য কাজ করে চলেছে।
একদিন রাত তখন দুটো। হঠাৎ অভিপ্সার ঘুম ভাঙে। অভিপ্সার রুম অন্ধকার করে ঘুমানোর অভ্যাস। অন্ধকার ঘরে চোখের পাতা তাড়াতাড়ি ভারী হয়ে আসে। অভিপ্সা ঘুম চোখে পাশে হাত বাড়িয়ে ঈশানকে ছোঁয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু সে হাত এদিক ওদিক বাড়িয়ে বুঝতে পারল ঈশান বিছানায় নেই। সে দেখতে পায় পাশের ঘরের ড্রইং রুমে আলো জ্বলছে। ড্রয়িং রুম বলার কারণও আছে। ঈশান অফিস চলে গেলে মাঝে মাঝে অভিপ্সার বড্ড একা লাগে। ওই জন্য সে তার ছেলেবেলার নেশাটা আবার নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে। আর ঐ রুমে বসে আনমনে ছবি আঁকে। পাহাড় আঁকে। সবুজ গাছে ভরা পাহাড়ের মাঝে একটা বাড়ি আঁকে। খুব নির্জন বাড়ি। অভিপ্সার খুব ইচ্ছা হয় মাঝে মাঝে পাহাড়ে গিয়ে কোন নির্জন বাড়িতে কয়েকদিন কাটিয়ে আসার। সবুজ গাছপালায় ভরা পাহাড়ের নির্জন কোন জায়গায় থাকলে মাঝে মাঝে নিজেকেও খুঁজে পাওয়া যায়। আসলে মানুষের মন মাঝে মাঝে গাছ হতে চায়, আর আত্মা সেই নির্জনতায় তাকে জড়িয়ে থাকতে চায়। এখন মাঝে মাঝে অভিপ্সা তার সেই ড্রয়িং রুমের জানলা দিয়ে আকাশ দেখে। এই ছবিই তার জীবনের নতুন গান এনে দিয়েছে। অথচ একসময় সে যেন জীবন থেকে হারিয়ে যেতে বসেছিল। ওটাকে যে শুধু ড্রয়িং রুম বলা যায় তা নয়। ঈশান অফিস থেকে ফিরে মাঝে মাঝে গিটার নিয়ে বসে পড়ে। ঈশান যেমন কাজপাগল ছেলে, তেমনি আবার গান ভালোবাসে। ঝর্ণায় ভিজতে ভালোবাসে। রাতের আকাশের তারা দেখে তারাদের পথে ভাসতে ভালোবাসে। তা নাহলে এই বয়সে নতুন করে কেউ গিটার শেখে।
অভিপ্সা ঘুমোনোর আগে পর্যন্ত জানে ঈশান তার কাছেই শুয়ে আছে। হঠাৎ পাশ ফিরে হাত এদিক ওদিক বাড়িয়ে বুঝতে পারে, সে নেই। এদিকে পাশের ড্রয়িং রুমে আলো জ্বলছে। অভিপ্সা উঠে গিয়ে দেখল, ঈশান ল্যাপটপ খুলে কোন একটা কাজ করছে।
‘ঘুমাও নি?’
‘না।’
‘কেন?’
‘তুমি তো জানো আমার মাথায় কোন কাজের চাপ থাকলে যতক্ষণ না সেটা কমপ্লিট হচ্ছে আমার ঘুম আসতে চায় না।’
‘কি এত কাজের চাপ?’
‘আছে আছে।’
‘কই আমাকে তো কিছু বলোনি!’
‘কিছুটা বলেছিলাম কিন্তু পুরোটা বলিনি।’
‘কেন?’
‘যেটা আসল কাজ, টার্গেটেড এরিয়া, সেটার কথা বারবার বলে ফেললে সেই কাজটা কমপ্লিট করার জন্য যে এনথুজিয়াজমটা প্রয়োজন হয়, বারবার বললে সে এনার্জি লেবেল হালকা হয়ে যায়। ফোকাশটা অনেকটা এলোমেলো হয়ে যায়। তাই বলিনি।’
অভিপ্সা বললো, কিন্তু আমার তো মনে হয় পাশের মানুষদের সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করলে কাজটাকে আরো ভালোভাবে করা যায়।
‘অনেকের ক্ষেত্রে অনেকরকম হতে পারে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে আমি দেখেছি, স্বপ্নের কথাটা বারবার বলে ফেললে সে স্বপ্নটা অধরাই থেকে যায়! তারচেয়ে বরং স্বপ্ন সফল হওয়ার পর সেটা নিয়ে ডিসকাশ করা ভালো। তাই নয় কি?’
অভিপ্সা ঘুম ঘুম চোখে কিছু একটা ভাবতে যাবে, এমন সময় ঈশান বলল, তুমি যাও। আমার আর বেশি সময় লাগবে না। এই ধরো আধঘন্টা। আমি আসছি।
পর্ব ২
সন্ধ্যা ছ’টা। বাইপাসের ধারে খুব জ্যাম হয়ে গেছে। এটাতো এখানকার নিয়মিত ঘটনা। অফিস থেকে ফেরার সময় কলকাতার রাস্তায় জ্যাম হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবু ঈশানের মনটা আজ বেশ ফুরফুরে। তার প্রজেক্ট কোম্পানি একসেপ্ট করেছে। তার বস খুব প্রশংসা করেছেন। তার এই প্রজেক্ট যদি সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয় তাহলে ঝাড়খণ্ডের বুকে তাদের কোম্পানির এটা একটা মাইলস্টোন হয়ে থাকবে। ঝাড়খন্ডে এটাই তাদের প্রথম সাইট। উবের ধরে বাড়ি ফিরছে। গাড়িতে গান বাজছে, মায়াবন বিহারিনী হরিণী গহন স্বপন সঞ্চারিনী/ কেন তারে ধরিবারে করি পণ অকারণ মায়াবন বিহারিনী। জ্যামে আটকে আছে গাড়ি, আর গানের সুরে সুরে ঈশান কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। একটা বছর দশ বারোর বাচ্চা মেয়ে গাড়ির কাঁচের সামনে এসে বলছে, বাবু ফুল নেবে ফুল।
বেল ফুলের মালা। ঈশান বলল, ‘কত দেবো?’
মেয়েটি মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, ‘১০০ টাকা।’
ঈশান গাড়ির কাঁচটা আরো একটু নামিয়ে তার হাতে 200 টাকা দিয়ে বলল, এই নাও।
মেয়েটি বলল, আমার কাছে তো ১০০ টাকা ফেরত হবে না। সারাদিন বিক্রি হয়নি। এই সবেমাত্র হল।
‘ঠিক আছে, আর একদিন এরকম একটা ফুলের মালা নিয়ে নেব, তাহলে তো শোধ হয়ে যাবে।’
‘এই ভীড়ের মাঝে আর যদি দেখা না হয়?’
‘হয়ে যাবে দেখা কোন একদিন। কি নাম তোমার?’
‘হাসি।’
ক্রসিংয়ে সবুজ আলো জ্বলে উঠলো। গাড়ি গুলো একটু একটু করে চলা শুরু করল। ঈশান বলতে লাগলো, আর যদি দেখা না হয় তবে ভেবে নিও এই আঙ্কেল তোমার জন্মদিনে তোমাকে একটা কেক পাঠিয়েছে।
গাড়িগুলো পর পর চলে গেল। হাসি বাকি ফুলগুলো হাতে নিয়ে রাস্তার ধারে একটা চা দোকানের সামনে রাখা বেঞ্চে এসে বসল। বেঞ্চটা ফাঁকা। তখনো চা খেতে লোকের ভীড় জমেনি। হাসি মনে মনে ভাবতে লাগলো, আজ সারাদিন কোন মালি বিক্রি হয়নি। সেজন্য তার মনটা দুশ্চিন্তায় কাটছিল। কিন্তু সন্ধ্যার সময় একটি মালা বিক্রি করেই তার মন যেন আজ ভরপুর আনন্দে মেতে উঠলো। আর তার জন্মদিনের কথা মনে পড়তে ভাবতে লাগল, তার জন্মদিন পালন তো দূরের কথা, কেউ মনেও করায়নি!
সন্ধ্যা সাতটা। কলিং বেল বেজে উঠলো। দরজা খুলতেই ঈশান ঘরে ঢুকে বলল, সমস্ত ঘর গুলো অন্ধকার। আলো জ্বালানি কেন?
‘ছাদে একটু ছিলাম। মেঘ করলে মেঘেদের যাওয়া আসা দেখতে দেখতে ছাদে একা একা পায়চারি করতে বেশ ভালো লাগে।’
‘আজ তো মেঘ করেনি?’
‘আকাশে মেঘ করেনি, কিন্তু মনের ভেতর অনেক মেঘ জমেছিল। তাই ভাবলাম একটু ছাদে সময় কাটাই।’ এই কথা বলে অভিপ্সা বলল, তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও, তোমার জন্য চা আনছি।
‘তোমাকে আজ এত ব্যস্ত হতে হবে না। আমি ফ্রেশ হয়ে রেডি হচ্ছি। তুমি রেডি হয়ে নাও।’
‘কেন, তুমি তো রোজ এসে চা খাও। আজ নয় কেন? চা না খেলে তোমার মাথা ধরে থাকে।’
‘চলো আজ আমরা অন্য কোথাও একসাথে চা খাবো।’
কালো ব্লাউজের উপর হলুদ রঙের শাড়ি। অভিপ্সা ড্রেসিং টেবিলের সামনে নিজেকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে নিচ্ছে। এমন সময় ঈশান ঘরে ঢুকে পেছন থেকে তার খোঁপায় বেল ফুলের মালা পরিয়ে তার ডান কাঁধে থুতনি রেখে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, তোমার চোখের মায়ায় চুপিচুপি কথার নেশা। অভিপ্সার চোখ পড়লো আয়নায়। সত্যিই আজ যেন তাকে বেশ অন্যরকম লাগছে। আজ সারাদিন তার মনখারাপ ছিল। কিন্তু হঠাৎ যেন মনটা বেশ হালকা মনে হল। ঈশানের স্পর্শে আজ যেন অন্যরকম এক উষ্ণতা!
শপিংমলে গিয়ে ঈশান বলল, চলো ওই কর্নারে যেখানে বেবি গার্লদের ড্রেস আছে।
‘বেবি গার্ল?’
‘হুম।’
‘কার জন্য?’
‘আছে, নাও না।’
‘তার চেহারার কোন ডেসক্রিপশন না দিলে কিরকম ড্রেস নেব?’
‘ধরো এই বছর দুই আড়াই হবে।’
মাস তিনেক আগের ঘটনা। একদিন অফিস থেকে ফেরার সময় ঈশান বাইপাসের ধারে নেমে একটা চায়ের দোকানে চা খাচ্ছিল। চা খেতে খেতে দেখল সামান্য একটু দূরে এক বছর পঁয়ছট্টির এক মহিলা খুব কাঁদছে। আধ খাওয়া চায়ের কাপ খেলে ঈশান সেখানে গেল। সেই ভদ্রমহিলার কাছাকাছি আরো কয়েকজন জড়ো হয়েছে। কিন্তু তাদের প্রত্যেকের পোশাক পরিচ্ছদ দেখে মনে হচ্ছে তারা ঐ ফুটপাতের ধারেই ঝুপড়িতে থাকে। ঈশান বলল, ‘কি হয়েছে?’
দেখল, ময়লা কিছুটা ছেঁড়া কাপড় পড়া অবস্থায় এক বুড়িমা তার কোলে একটা বাচ্চা শিশুকে নিয়ে অঝোরে কেঁদেই চলছে। কথায় কথায় জানতে পারলো, ওই ঝুপড়িতে পাশেই একটা ছোট্ট ঘরে ওই শিশুকে নিয়ে তার মা থাকতো। বাচ্চাটার বাবা বছর দেড়েক হবে আর ফিরে আসেনি। যাওয়ার সময় বলেছিল, একটা কাজের সন্ধান পেয়েছি। মাস দুয়েকের জন্য যাচ্ছি। কিন্তু তারপর আর আসেনি। কোথায় গেছে কোন খবরও দিয়ে যায়নি। বেঁচে আছে নিশ্চয়ই। মারা গেলে বরং মানুষের খবর পাওয়া যায়। বেঁচে থাকা অবস্থায় কেউ দূরে যেতে চাইলে এমনভাবে আড়াল হয়ে যায় যে তার আর কোন খবর পাওয়াই যায় না। বড় বড় পরিবারে কেউ কারো দায়িত্ব নিতে চায় না, আর এ তো ঝুপড়িদের জীবন। এখানে না আছে জীবনের অস্তিত্ব, না আছে মান সম্মানের ভয়।
স্বামী ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বাচ্চাটার মা প্রথমে খুব অসহায় হয়ে পড়েছিল। এই দুধের শিশুকে নিয়ে সে কিভাবে দিন কাটাবে। তবুও এই পৃথিবীতে কারো জীবন কখনো থেমে থাকে না। তারও থেমে থাকেনি। মোড়ের মাথায় রাস্তার ধারে যে হোটেল চলে, সেখানে বাসন ধোয়া টেবিল মোছা এইসব করে মোটামুটি জীবনকে চালিয়ে নিচ্ছিল। আর বাচ্চা মেয়েটাকে সেই বুড়িমার কাছে রেখে যেত। সেই থেকে বাচ্চা মেয়েটার প্রতি ওই বুড়িমার বেশ মায়া পড়ে গেছে। কিন্তু করোনার সেকেন্ড ওয়েভ থেকে ওই বাচ্চাটার মা অসুস্থ হয়ে পড়ে। তবু কোনরকমে বেঁচে ছিল, দিন কয়েক আগে সেও মারা গেল।
ঈশানের চোখ পড়ল কোলে থাকা শিশুটির দিকে। শিশুটিও এক নিমেষে তাকিয়ে আছি ঈশানের দিকে। মা-বাবা নেই, একপ্রকার অনাথ, অথচ কি সুন্দর ভাবে এই মহিলার কোলে চুপচাপ শুয়ে তাকিয়ে আছে। যেন এদিক ওদিক খেলছে।
ঈশানের ইচ্ছে করলো শিশুটিকে তার কোলে নিয়ে আদর করতে। কিন্তু সে একটু থেমে গেল। তার যেন সাহসে ঘাটতি পড়ে গেল।
তারপর থেকে সপ্তাহে এক দু’বার ঈশান ওই বাইপাসে নেমে ওই বুড়িমা আর শিশুর জন্য কখনো রাতের খাবারের প্যাকেট, কখনো কিছু টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে আসতো।
পর্ব ৩
.
আজ রবিবার। ছুটির দিন। এই রবিবার গুলোতে ঈশান দেরি করেই ওঠে। আটটা সাড়ে আটটা হয়ে যায়। সারা সপ্তাহ খুব খাটুনি হয় তো, এই একটা ছুটির দিন পেলে একটু আরাম করতে কার না ইচ্ছে করে। কিন্তু আজ অভিপ্সা দেখল, ঈশান সকাল ছ’টায় উঠে পড়েছে। অভিপ্সা একটু চমকে গেল। বলল, ‘এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়লে যে?’
‘উঠে পড়লাম। কাজ আছে।’
‘কি কাজ?’
‘আছে। তোমারও কিছু কাজ আছে। বলছি দাঁড়াও।’
ঈশান ব্রাশ করে এসে বলল, ‘তোমার স্নান হয়ে গেছে?’
‘হুম। কেন?’
‘আমি বাথরুমে ঢুকবো। একেবারে স্নান করে বেরোবো। তাই যদি দেরি হয়।’ এই কথা বলে স্নানের ঘরে গিয়ে কোল্ড ওয়াটারের শাওয়ার চালিয়ে ঈশান তার নিচে দাঁড়ালো। সকালে ঠান্ডা জলে স্নান করলে তার অনেক বেনিফিট আছে। শরীরের টক্সিনগুলো পরিশ্রুত হয়ে সারা শরীর প্রাণবন্ত হয়ে উঠে।
শাওয়ারের জল তার মাথার চুল থেকে সারা শরীর স্পর্শ করে বয়ে যেতে লাগল। আজকের দিনটা তার কাছে একটা অন্যরকম দিন। সে যেন শাওয়ারের জলে গায়ে জমে থাকা ময়লা ধুয়ে পরিস্কার করার মত তার অতীতকে ধুয়ে ফেলতে চাইছে।
স্নান থেকে বেরিয়ে এসে আলমারি থেকে একটা কাপড় বের করে অভিপ্সাকে দিয়ে বলল, তুমি আজ এখন এই শাড়িটা পড়ো। বেশি দেরি করো না। গাড়ি বুক করে রেখেছি, আটটার সময় চলে আসবে। অভিপ্সা অবাক হল, কিন্তু এই সকালে কোন প্রশ্ন না করে তার কথামতো শাড়ি পড়তে তার রুমে চলে গেল। ঈশান নতুন পোশাক পরে চন্দন ঘেঁটে একটা কৌটোয় চন্দনের ফোঁটা নিয়ে রাখল। আর ব্যাগে নিল একটি মালা আর শপিংমল থেকে কেনা জামাটা।
তার রুমে গিয়ে শাড়িটা খুলতেই চমকে উঠলো। প্রায় বছর পাঁচেক আগের কথা। বেগুনি পাড় আর কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি। শাড়ির ভেতরের জমিটাতে দোয়েলের ছবি আঁকা। বিয়ের পর তারা যখন সিকিম বেড়াতে গিয়েছিল, সেখানে ঈশান এই শাড়িটা কিনে দিয়ে বলেছিল, যেদিন তুমি মা হবে তোমাকে এই শাড়িটা পরিয়ে হসপিটাল থেকে বাড়ি নিয়ে আসবো।
পাঁচ বছর হয়ে গেল সেই শাড়িটা আর কখনো বের করা হয়নি। আলমারিতেই থেকে গেছে। এক কোণে!
এই শাড়িটা পড়তে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে অভিপ্সার। তার বুকের ভেতর চেপে থাকা কান্না যেন ঢেউ হয়ে উঠে আসছে। কিছুতেই শাড়িটা ঠিক মতো করতে পারছে না। কিন্তু কান্নাকে কোন রকমে চেপে রেখে শাড়িটা পরে বেরিয়ে পড়ল।
সকাল সাড়ে আটটা। গাড়িটা থামল বাইপাসের ধারে। ঈশান গাড়ি থেকে নেমে অভিপ্সাকে বললো, ‘এসো।’
‘এখানে কোথায়?’
‘আরে আসবে তো।’
তখনও যেন অভিপ্সার ঘোর কাটেনি। কোথা থেকে যে কি হচ্ছে তার মাথায় কিছু ঢুকছে না। কিছু জিজ্ঞেস করলে ঈশান বলে, একটু অপেক্ষা করো, সব পরিস্কার হয়ে যাবে।
ঈশানকে দেখতে পেয়ে সেই বুড়িমা দুটো চেয়ার বের করে বসতে দিল। ঝুপড়িতে বাস করলেও মানুষকে কিভাবে আতিথেয়তা করতে হয়, সেটা কিন্তু এই অভাবের দিনেও ভুলে যায়নি। আসলে এটাই তো মানুষের কালচার।
ঘরের ভেতর বছর তিনেকের একটা ছোট্ট মেয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঈশানকে দেখতে পেয়ে তার কোলে এসে বসলো। অভিপ্সার বুকের ভেতরটাতে যেন ধক্ ধক্ করে উঠলো। আজ থেকে চার বছর আগে ঠিক এই দিনে তার জীবন যেন এক নিকষ কালো গভীর অন্ধকারে প্রবেশ করেছিল।
প্রেগনেন্ট হওয়ার পর অভিপ্সার দিনগুলো বেশ ভালোই কাটছিল। প্রত্যেক মেয়েই মা হতে চায়। মাতৃত্ব যে কি জিনিস যে মেয়ের মা হাওয়া ভাগ্যে জোটে না সেই একমাত্র তার মর্ম বোঝে!
প্রেগনেন্ট অবস্থায় প্রায় সাড়ে পাঁচ মাস মাস কেটে গেছে। একদিন হঠাৎ খুব অসুবিধা হতে অভিপ্সাকে ভর্তি করা হলো হাসপাতালে। তড়িঘড়ি ডপলার আলট্রাসনোগ্রাফি করে দেখা যায় বিরল প্লাসেন্টা অ্যাক্রিটা সিনড্রোমে আক্রান্ত অভিপ্সা। মাতৃজঠোরের ভ্রুনকে অক্সিজেন সরবরাহ করার কথা যার, সে ঢুকে পড়েছে মূত্রথলিতে! যার জন্য ইউরিনের সঙ্গে ক্রমাগত রক্তক্ষরণ। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে অভিপ্সাকে দিতে হয়েছে নাইন ব্যাগ রক্ত, পনেরো ব্যাগ প্রেস ফ্রোজেন প্লাজমা।
এই অবস্থায় দুটো পথ খোলা ছিল ঈশানের কাছে। ডাক্তার বাবু বললেন, স্ত্রীকে বাঁচাবেন নাকি মা আর সন্তান দুজনকেই মৃত্যুর মুখে দাঁড় করাবেন।
ঈশান সিদ্ধান্ত নিল, যেভাবেই হোক অভিপ্সাকে বাঁচাতে হবে।
ডক্টর দাশগুপ্ত ও ডক্টর মৈত্র অভিপ্সার নতুন জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট মাথা খাটাতে লাগলেন। অভিপ্সার ক্যান্সার ছিল না। কিন্তু এটা তার ভয়ংকর শারীরিক জটিলতা। শুধু অস্ত্রপ্রচারই নয়, রোগীকে সুস্থ করে তুলতে এই ডাক্তারবাবুর পরামর্শ মত রেডিওলজির সাহায্য নিয়ে কেমোথেরাপিও দেওয়া হয়।
ঈশান দেখল অভিপ্সার চোখের কোন ভিজে গেছে। বলল, ‘কি ভাবছো?’
আঙুল দিয়ে চোখ হালকা করে মুছে অভিপ্সা বলল, না না, কিছু না। কি আর ভাববো!
ঈশান বলল, রাশিকে নতুন জামা পরিয়ে কপালে চন্দন আর গলায় মালা পরিয়ে দাও। যে প্যাকেট গুলো এনেছি ওখান থেকে মিষ্টি থালায় সাজিয়ে তাকে আসনে বসাও। আজ তার জন্মদিন।
মনে পড়ে আজ থেকে চার বছর আগে তুমি যখন হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরে মুমূর্ষু হয়ে পড়েছিলে, আমি বলেছিলাম সময় হলে তুমি ঠিক মা ডাক শুনতে পাবে। রাশির তো মা-বাবা কেউ নেই! রাশি এখন খুব ছোট্ট বলে, মা-বাবাকে কাছে না পাওয়ার যে কি যন্ত্রনা তা এখন বুঝতে পারছে না। তুমি তাকে মায়ের মত আদরে দিও। তুমি তাকে ওই অভাবটা বুঝতে দিওনা কখনো।
পর্ব ৪
দু’বছর পর। ঈশান নামবে কলকাতা বিমানবন্দরে। কোম্পানির নতুন প্রজেক্টের জন্য তাকে পাঠিয়েছিল ইকিয়েডরে। গত বছর কয়েক দিনের ছুটিতে আসার কথা থাকলেও নতুন করে কাজের চাপ পড়ে যাওয়ায় আর আসা হয়নি।
ঈশান বিদেশে চলে যাওয়ায় অভিপ্সার মাঝে মাঝে খুব অবসাদ লাগতো। তাই সে একটা নার্সারি স্কুলে পড়াতে ঢুকেছে। সময়টাও কাটবে। আর কচিকাঁচাদের সঙ্গে থাকতে থাকতে মনটাও ভালো থাকবে। তাছাড়া তার যেহেতু পড়াশোনার নলেজ আছে সেটাকেও ব্যবহার করা ভালো। শুধু শুধু বাড়িতে বসে থাকলে মনের ভিতর আশঙ্কা চিন্তা বার বার ঘুরপাক করতে করতে বেঁচে থাকাটাই কঠিন করে তোলে। আর সেখান থেকেই জীবনের বিষাদময় মুহূর্তগুলো ফিরে আসে।
বিকেল পাঁচটা। ঈশান কলকাতা বিমানবন্দরে নামল। এক এক করে লোকজন এক্জিট গেট দিয়ে বেরোচ্ছেন। এদিকে অভিপ্সার চোখ অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে প্রিয় মানুষটাকে কাছে পাওয়ার জন্য।
মে মাসের বিকেল। হঠাৎ আকাশে খুব মেঘ করেছে। হয়তো কালবৈশাখী আসবে। গরমে কয়েকদিন ধরে সকলের নাজেহাল অবস্থা। দুপুরবেলা হিট স্ট্রোক ওয়েদার। বাড়ি থেকে বেরোনোই দায়। ঈশান এক্জিট গেট দিয়ে বেরোতে চোখে চোখ পড়ল অভিপ্সার। বাইরে তখন দমকা হাওয়া শুরু হয়েছে। আগে থেকেই গাড়ি বুক করে এসেছিল। ওই গাড়িতেই ফিরবে।
ঈশান দেখা মাত্র চমকে উঠল। অভিপ্সার পাশে কে? রাশি নাকি! দু বছরে দেখেনি তাকে। রাশি কিন্তু ঈশানকে চিনতে একটুও ভুল করেনি। চিনতে ভুল করবেই বা কেন। সে যেখানে ঘুমায় তার মাথার কাছে টেবিলে তার ছবি সুন্দর করে ফ্রেমে বাঁধা। রোজ ঘুম থেকে উঠে সে দেখতে পায়। সে চ্ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে তার কোলে উঠে পড়লো।
বাইরে তখন ঝড়ো বাতাসের সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। কয়েকদিনের দাবদাহ থেকে মানুষের কিছুটা স্বস্তি। কি আরামদায়ক শীতলতার স্পর্শ। আর ঝমঝম করে আসা বৃষ্টির শব্দ অভিপ্সার মনে যেন গানের সুর বয়ে আনছে।
বৃষ্টির দাপট কমতে গাড়ি কলকাতা বিমানবন্দর থেকে গড়িয়ার দিকে আসতে শুরু করল। রাস্তায় আলো জ্বলে উঠেছে। এইমাত্র বৃষ্টি হলো। বাইরে এখন বেশ ঠান্ডা হাওয়া বইছে। এই ঠান্ডা হাওয়ার সাথে সাথে গাড়ি চললে সেই ঠান্ডা হাওয়া যেন হৃদয়কে আরও স্পর্শ করে যায়। মনকে উতলা করে দিয়ে যায়।
রাশি অভিপ্সার বুকে মাথা হেলান দিয়ে কচি কচি মিষ্টি গলায় বলল, মা তুমি গান গাও। আমি শুনতে শুনতে ঘুমাবো। রাশির মুখে মা শব্দ শুনে ঈশান বেশ অবাক হল।
ঈশান রাশিকে তার কাছে টেনে নিয়ে বলল, তুমি কবে থেকে তোমার মাকে খুঁজে পেয়েছো?
‘অনেকদিন থেকে।’
‘অনেকদিন মানে?’
‘যখন থেকে তুমি যাওনি সেদিন থেকে।’
কথায় কথায় ঈশান জানতে পারল, অভিপ্সা মর্নিং স্কুল করার পর বাড়িতে রান্না করে টিফিন কৌটায় ভরে প্রায় রোজ রাশির কাছে আসতো। সে দুপুরে রাশিকে নিজের হাতে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে তার কপালে আদর দিয়ে সন্ধ্যা নামার আগে বাড়ি ফিরতো। অভিপ্সা রাশিকে কোলে নিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে বলতো, ছোট্ট মা আমার খেয়ে নাও।
কয়েকদিন এরকম বলার পর একদিন অভিপ্সা বুড়িমার বাড়ি গেছে। রাশি দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে নরম মিষ্টি সুরে আধো আধো গলায় বলল, মা তুমি তো রোজ আমাকে খাওয়াও। আজ আমি তোমাকে খাওয়াবো। সেই প্রথম অভিপ্সার জীবনে মা ডাক শোনা। তার জীবন যেন সেদিন পূর্ণ হয়ে গেল। চোখের জল আটকাতে পারছিল না! মনে মনে ভাবল, ঈশ্বর কারো জীবন থেকে কোন কিছু কেড়ে নেয় না। সবকিছুই ফিরিয়ে দেয়, হয়তো অন্যরকমভাবে অন্যসময়ে।
গত এপ্রিল মাস থেকে রাশি থাকে অভিপ্সার কাছে। তাকে ভর্তি করেছে তার নিজেরই স্কুলে। সকাল হলেই তাকে সুন্দর করে স্কুলের ড্রেস পরিয়ে তার নরম আঙ্গুল ধরে তাকে স্কুলে নিয়ে যায়। আবার ছুটির পর বাড়ি নিয়ে আসে।
গাড়ি গড়িয়ার প্রায় কাছাকাছি। ঈশান দেখল, অভিপ্সা তার বুকে রাশিকে নিয়ে তার পিঠে আদরের ঝাঁপি দিতে দিতে গুনগুন করে গান গাইছে।
একটু আগে ঝড়ের দাপট হয়ে যাওয়ার ফলে কোথাও কোথাও লোডশেডিং। ঘরে ঢুকলো। চারদিকটা অন্ধকার। কিন্তু ঈশান দেখল, মা আর মেয়ের পরস্পরের আদরের খুশির স্পর্শে তার অন্ধকার বাড়িটা যেন হঠাৎ আলোয় ঝলমল করে উঠল।