
মঙ্গলেশ ডবরালের কবিতা পরিচিতি ও অনুবাদ-শ্যামাশিস জানা
মঙ্গলেশ ডবরাল (১৯৪৮-২০২০) ছিলেন হিন্দি সাহিত্যের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি ও সাংবাদিক। তিনি ১৯৪৮ সালে ১৬ই মে উত্তরাখণ্ডে টিহরি গড়হওয়ালের কাফলপানি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় দেরাদুনে, তারপর ১৯৬০-এর দশকে দিল্লি এসেছিলেন। তিনি ‘प्रतिपक्ष’(প্রতিপক্ষ) ও ‘आसपास'(আসপাস) পত্রিকায় সাংবাদিকতা শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে সাংবাদিকতা করেছেন ‘जनसत्ता’(জনসত্তা), ‘प्रतीक’(প্রতীক), ও ‘नयापथ’(নয়াপথ)-এর মতো পত্রিকায়। এছাড়াও ‘जनसत्ता’-র রবিবারের সাহিত্য ম্যাগাজিন ‘রবিবার’-এর সম্পাদক ছিলেন। 'पहाड़ पर लालटेन'(পাহাড় পর লালটেন), 'घर का रास्ता'(ঘর কা রাস্তা), ‘हम जो देखते हैं’(হম জো দেখতে হ্যায়) ,'आवाज़ भी एक जगह है'(আওয়াজ ভি এক জায়গা হ্যায়), 'नए युग में शत्रु:'(নয়ে যুগ মে শত্রু) প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থে তিনি মানুষের জীবন, স্মৃতি, নিঃসঙ্গতা ও সমাজ-রাজনীতির দ্বন্দ্ব ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বুকার পুরস্কার বিজয়ী অরুন্ধতী রায়ের 'The Ministry of Utmost Happiness' হিন্দিতে অনুবাদ করেন ('অপার খুশি কা ঘরানা')। তাঁর ‘হম জো দেখতে হ্যায়' সংকলনের জন্য ২০০০ সালে তিনি সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পান। ২০১৫ সালে ভারতের বুদ্ধিজীবী ও সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘটে চলা ক্রমবর্ধমান হিংসার প্রতিবাদে তিনি পুরস্কারটি ফেরত দেন । ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর দিল্লিতে COVID-19 সংক্রমণের কারণে তাঁর মৃত্যু হয় । তাঁর কবিতায় আধুনিক জীবনের বেদনা, শহুরে জীবনের বিচ্ছিন্নতা ও রাজনৈতিক প্রতিবাদ গভীরভাবে উঠে এসেছে। লেখার মাধ্যমে সর্বদা মৃদু অথচ দৃঢ় কণ্ঠে তিনি অন্যায় ও ক্ষমতার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। তাঁর কবিতা পাঠককে ভাবায়, প্রতিবাদ করতে শেখায় এবং আত্মসন্ধানের দিকে ঠেলে দেয়। কবি মঙ্গলেশ ডবরালের কয়েকটি কবিতার অনুবাদ বাংলা কবিতাপ্রেমীদের উদ্দেশ্যে এখানে দেওয়া হল। কবিতাগুলি নেওয়া হয়েছে মূলত 'হম জো দেখতে হ্যায়', 'আওয়াজ ভি এক জায়গা হ্যায়', 'ঘর কা রাস্তা', 'পাহাড় পর লালটেন' গ্রন্থগুলি থেকে।
বর্ণমালা
একটি ভাষায় অ, আ লিখতে চাই
অ থেকে অন্ন অথবা অঙ্গীকার
আ থেকে আম অথবা আনারস
কিন্তু লিখতে শুরু করি-
অ থেকে অনর্থ এবং অত্যাচার
আ থেকে আক্রোশ এবং আঁধার
ভীষণ চেষ্টা করি
ক থেকে লিখি কলম কিংবা করুণা
কিন্তু লিখতে শুরু করি কুটিলতা এবং কান্না
এতদিন অবধি খ থেকে খরগোশ, খুশী ইত্যাদি লিখে এসেছি
কিন্তু খ থেকে এখন অগণিত মানুষের খিদের আভাস ভেসে আসে
মনে মনে ভাবতাম
ফ দিয়ে বুঝি ফুলই লেখা যায়
অযুত ফুলের দল মনের বাইরে ও ভেতরে-
মানুষের অন্তরাত্মাকে সাজিয়ে তোলে,
কিন্তু দেখলাম-
অজস্র ফুলের মালা গাঁথা হচ্ছে-
হত্যাকারীদের গলায় পারানোর জন্য !
কেউ হঠাৎ আমার হাত চেপে ধরে আদেশ দেয়-
ভ থেকে লেখো ভয়
যা এখন সর্বত্রই ছড়িয়ে গেছে…
এখন দ হল দমন আর প হল পতনের প্রতীক
অদৃশ্য আততায়ীদের দ্বারা লুণ্ঠিত হয় সমগ্র বর্ণমালা
অচিরে মিশে যায় ভাষাগত ও সামাজিক হিংসা !
ওই দেখো-
ওরা হ কে হত্যার জন্যই সংরক্ষিত করে ফেলেছে
যতই হ থেকে হৃদয় অথবা হরিণ লিখতে চাই
ওরা চিরকাল হ থেকে লিখতে চেয়েছে হত্যা
ওরা কি চিরকাল হ থেকে লিখে যাবে হত্যা ?
আমার বাবার স্মরণে
ওষুধের শিশিগুলো খালি হয়ে গিয়েছে,
ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে খামগুলো,
সমস্ত চিঠি পড়ে ফেলা হয়েছে।
তুমি আর বসে থাকো না দোরগোড়ায়,
হেলান দিয়ে শুয়ে থাকো না সেই খাটের এক কোণে,
আর খুব ভোরে উঠে বাড়ির দরজাগুলো খুলে দাও না।
তুমি এখন হাওয়া, জল আর ধুলোর অদৃশ্য দরজাগুলো খুলে
চলে গেছো কোনো এক পাহাড়ের দিকে,
নদীর দিকে কিংবা নক্ষত্রের কাছে,
নিজেই হয়ে উঠেছো একটি পাহাড়, একটি নদী, একটি নক্ষত্র
কত সহজেই তুমি শব্দের ভেতরে বাস করতে পারতে।
তোমার শুকিয়ে যাওয়া পাতলা শরীর
খুব ভাল করে চিনত এই অন্তহীন যন্ত্রণাকে,
তবুও কি আশা ভরসায় পূর্ণ ছিলে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।
ধীরে ধীরে ভাঙতে থাকা দেওয়ালগুলোর মধ্যে
তুমি খুঁজে পেতে পাথরের অমরত্ব।
খালি কৌটো, ছেঁড়া বই আর
ঘুণপোকায় ভরা জিনিসগুলোর ভেতরেও
যেটুকু জীবন অবশিষ্ট থাকে,
তাতেই তুমি বিশ্বাস রাখতে।
আমি যখনই ফিরতাম,
তোমার সমস্ত কষ্ট লুকিয়ে রাখতে
সেইসব জিনিসের ভেতর।
সব যুদ্ধ তুমিই লড়াই করতে,
আর জয় হত শুধুই আমার!
নৈরাশ্যের কবিতা
অনেক কিছু করার পর
যখন মনে হয়
আমরা কিছুই করতে পারিনি—
তখন তাকে বলে নৈরাশ্য।
নিরাশ মানুষকে লোকজন দূর থেকে
সেলাম জানায়
আমরা আমাদের নৈরাশ্যকে পাহারা দিই
যেন এটাই আমাদের একমাত্র মহান সুখ।
চোখের সামনেই পৃথিবীর ওপর
এক ধুলোর স্তর পড়ে।
চড়ুইদের ওড়াউড়ি আজ ছেঁড়া পাতার মতন দেখায়
এমনকি সঙ্গীতও আর আমাদের মহৎ বানায় না।
আমরা শুনতে থাকি এক বিরতিহীন কর্কশ শব্দ।
নানান রঙের মধ্যে দেখি রক্তের দাগ,
জেগে ওঠে হত্যা পরবর্তী দৃশ্যগুলি।
শব্দ আমাদের আর বশবর্তী নয়,
ভালোবাসা যেন মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে।
নৈরাশ্যের মধ্যে আমরা বলি—
“নৈরাশ্য, আমাদের রুটি দাও,
দুটো-পা এগোনোর শক্তি দাও।”
শব্দগুলি
একটু থেমে শুরু হবে শব্দগুলি—
কাছাকাছি কোথাও ডেকে উঠবে একটি কুকুর
বস্তির ওপার থেকে ভেসে আসবে হ্রেষাধ্বনি
একটি শৃগাল ডেকে উঠবে
এই সব কিছুর মাঝখানে কোথাও
ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাবে,
সমস্ত পথ জুড়ে থাকবে
পাতার কম্পন
আর কেউ একজন হেঁটে যাবে একাকী
এইসব কিছুর বাইরে
আমার গ্রামে শোনা যাবে
একটি বাঘের গর্জন।
কবিতা
একটি কবিতা ক্লান্তির মতো ছেয়ে ছিল সারাটা দিন,
আর রাতের বেলায় ঘুমের মতো—
সে সকালে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করত:
“তুমি কি গত রাতে কিছু খেয়েছিলে?”
বাড়িটি
এই বাড়িটি লুকিয়ে রেখেছে সবকিছু
তার অন্ধকারের গভীরে এক নারীকে
নারীর স্বপ্ন
নারীর সন্তান
নারীর মৃত্যু
একটি সম্ভাবনা
আমি চেয়েছিলাম সেখানে থাকুক একটি গাছ,
হাওয়া আর রাত্রি
আমি চেয়েছিলাম সেখানে থাকুক একটি নদী,
একজন মানুষ
যে নিজের সমস্ত ক্লান্তি দূর করছে
হাত-পা ধুয়ে ধুয়ে।
নিখোঁজ
শহরের প্রস্রাবাগার ও অন্যান্য সর্বজনীন জায়গায়
সাঁটানো রয়েছে নিখোঁজ শিশুদের মর্মস্পর্শী পোস্টার
ওদের মায়েরা কান্নায় ভেঙে পড়ছেন…
কেউ সঠিক তথ্য দিলে মিলবে উপযুক্ত পুরস্কার
পোষ্টারের নীচে এমন এক অস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি।
এখন যেন সেই শিশুরা রয়েছে অন্য কোনো জগতে,
তারা মুছে গেছে এই দৃশ্যমান পৃথিবী থেকে।
এইখানেই ছিল সেই নদী
সে সেখানে তাড়াহুড়ো করে যেতে চাইত
যেখানে তার জলে এক পুরুষ যাচ্ছিল স্নান করতে
একটি নৌকা অপেক্ষা করছিল যাত্রীদের জন্য
আর এক সারি পাখি-
উড়ে আসছিল তার জলের খোঁজে।
আমাদের শৈশবের সেই নদীতে
দেখতাম আমাদের মুখ ভেসে যাচ্ছে
তার তীরে ছিল আমাদের ঘরবাড়ি
চিরকাল প্লাবিত
সে ভালোবাসত তার দ্বীপ আর পাথরগুলোকে
আমাদের দিন শুরু হতো সেই নদী থেকেই
তার শব্দ
শোনা যেত বাড়ির সমস্ত জানালায়
তার ঢেউ কড়া নাড়ত দরজায়
আমাদের ডাক দিত বারবার।
আমাদের স্মৃতি জুড়ে সে আজও বয়ে যায়—
এই বালির ভেতরেই ছিল সেই নদী
এইখানেই ভেসে গিয়েছিল আমাদের মুখ
এইখানেই বাঁধা ছিল সেই অপেক্ষমাণ নৌকাটি।
এখন আর কিছুই নেই
শুধু মাঝরাতে, যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে,
তখন মাঝে মাঝে
এই বালির গভীর থেকে
একটি কণ্ঠস্বর শোনা যায়
অনুবাদ: শ্যামাশিস জানা

