
সনন্ত তাঁতির একগুচ্ছ কবিতা মূল অসমিয়া থেকে বাংলা অনুবাদ-বাসুদেব দাস
অসমিয়া সাহিত্যের অন্যতম কবি, সাহিত্য আকাদেমি, অসম ভ্যালি পুরস্কার বিজেতা জনপ্রিয় কবি ১৯৫২ সনে অসমের করিমগঞ্জের কালিনগর চা বাগানে জন্মগ্রহণ করেন। ২০১৭ সনে অসম ভ্যালি লিটারেরি এওয়ার্ড এবং ২০১৮ সনে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। কাব্যগ্রন্থগুলি যথাক্রমে ‘মই মানুহর অমল উৎসব’, ’নিজর বিরুদ্ধে শেষ প্রস্তাব’, ’শব্দত অথবা শব্দহীনতাত’, মৃত্যুর আগর স্টপেজত’, ’কাইলৈ্র দিনটো আমার হব’, ’দীর্ণ বসন্তর সৌ্রভ ইত্যাদি। ২৫ নভেম্বর ২০২১ সনে এই মহান কবির মৃত্যু হয়।
মৃত্যুর আগের স্টপেজে
মৃত্যুর আগের স্টপেজে নেমে
আমি খুঁজেছিলাম তোমাকে।
বড়ো ক্লান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম কাউকে
এখান থেকে ফিরে যাবার কোনো
যাতায়াত কারী বাস পাওয়া যাবে কি?
অথবা এখান থেকে ফিরতে না পারলে
রাত কাটানোর জন্য কোনো আশ্রয় পাওয়া যাবে কি?
বড়ো ক্লান্ত হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম
যদি পানাসক্ত হয়ে থাকতে পারা যায় কিছুদিন।
জীবনের নাম পরিবর্তন করে হয়তো
রাখতে পারতাম অন্য কোনো নাম।
মৃত্যুর আগের স্টপেজে নেমে
আমি খুঁজেছিলাম তোমাকে।
তোমার ঘরের কলিং বেল টিপে
আমি ডেকেছিলাম তোমাকে।
তোমার বাড়ির উঠোনে
আমার জীবনের ছয়টি মাস ছড়িয়ে দিয়ে
তোমার জন্য উদগ্রীব হয়ে
অপেক্ষা করেছিলাম।
মৃত্যুর আগের স্টপেজ থেকে
আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম আমার শৈশবের
সোনালি দিনগুলি।
জ্বলে পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়া আমার হাড় মজ্জা
মৃত্যুর আগের স্টপেজে নেমে
আমি খুঁজেছিলাম তোমাকে।
তোমার ঘরের সংগীত হয়ে উঠা বাতাসে কান পেতে
তোমার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম
দীর্ঘ সময়।
বাঁশির সুরে মোহময় বাতাসে
স্বপ্নে দুলে উঠা মেঘে
ফুলের চঞ্চলতায় সুরভিত হওয়া
তোমার উঠানে ঘুরে বেড়ানো পরীগুলির
লাস্যময়তায় আমি খুলে ফেলেছিলাম
মলিন অন্তর্বাস।
স্বেদ এবং ক্লান্তিকে ধুয়ে ফেলেছিলাম
জ্যোৎস্নার আলোতে।
মৃত্যুর আগের স্টপেজে নেমে
আমি পরিবর্তিত করেছিলাম আমার নাম ধাম পদবী।
ভুলে গিয়েছিলাম প্রেমের ঠিকানা।
হৃদয় বিষয়ক ঘটনাবলী থেকে
মাঝেমধ্যে সরে এসেছিলাম।
জীবন থেকে সংগৃহীত সমস্ত শব্দকে
ধুয়ে- মুছে উজ্জ্বল করেছিলাম।
আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম নিজেকে
মৃত্যুর আগের স্টপেজে।
মৃত্যুর আগের স্টপেজে নেমে
আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম একজন নিরীহ আততায়ীকে
এখান থেকে ফিরে যেতে হলে
পুনরায় জীবনের দিকে
যেতে হবে কি?
মাঝেমধ্যে অন্য হয়ে যাই
মাঝে মধ্যে অন্য হয়ে যাই।
হাতড়ে বেড়াই স্বাভাবিক ক্ষুধা।
কখনও দুর্বৃত্তের মতো তোমার বুকের
দরজায় কড়া নাড়ি। দাবি করি তোমার
হৃদয়ের সেফটি লকারের চাবি।
কখনও বা তোমার চোখের ওপরে
আমার চোখ দুটি রেখে আহরণ করি প্রেমের
সুখ। শীতল পানীয়ে বুক ভিজিয়ে
অচেতন হয়ে থাকি কয়েক সপ্তাহ।
তখনই সম্বিত পাই শোষণের কামড়ে
নিঃসার হয়ে পড়া আমার শরীরের বাহির
এবং ভেতর। রক্তপাতে ভিজে থাকা
আমার কলিজায় হাত রাখে প্রব্রজনকারী নৃশংস
শোষক। আমি জর্জরিত হয়ে পড়ি দুঃখগুলিতে।
স্থিমিত হয়ে পড়ে নিঃশ্বাসের স্বাভাবিক
গতি। বন্ধ হয়ে যায় আমার জীবনী শক্তির
জন্য প্রয়োজনীয় ইন্ধন।
তথাপি সন্তুষ্ট হয়ে থাকি। প্রতিবাদহীন
হয়ে থাকি। স্নানাহার করি। জীবনের জন্য
রত হই স্বাভাবিক সঙ্গমে। নিরীহ মানুষ হয়ে
উপভোগ করি টিভি-ভিসি আর।
খেলাধুলা। পন্য বিজ্ঞাপন।
ধীরে ধীরে আমার ভষ্মে উৎপন্ন হয় মুনাফার
ভোগ দ্রব্য। নিরূপিত হয় শুল্কের আধারে
মূল্যসূচি। আর আমি লিখে লিখে মৃত্যুর
প্রতিবেদন সমুদ্র বাতাসে নিশ্চিহ্ন হয়ে
উড়ে যাই একদিন।
তবে দ্বন্দ্বের প্রকৃত তথ্যে এখনও উদঘাটিত
হয়নি আমার জীবন। তাই আমি সুখী আছি।
নির্বিকার হয়ে আছি। আপাতত স্বাধীনতায় সহজ
হয়ে আছি। আমি আমার পাকস্থলী চেপে আজ্ঞাবহ
হয়ে আছি স্বৈরাচারিতার।
মাঝেমধ্যে অন্য হয়ে যাই।
নদীর মতো বিধ্বংসী হয়ে যাই।
জেগে উঠলে ধিক্কার দিই মনুষ্যত্বহীনতার।
সে
সে এখন আমার বুকে শুয়ে থাকে চব্বিশ
ঘন্টা। আমাকে শাসন করে। আমার শ্রমের ফসলে ভাগ
বসায়। আমার রক্তনালী থেকে স্নায়ুতন্ত্র পর্যন্ত
তার অবাধ বিচরণ। আমার ফুসফুসকে মাঝে মধ্যে
শূন্যতায় ছুঁড়ে দিয়ে সে মগ্ন হয় খেলায়। আমার
হৃদয় খামচে খামচে সে এখন যন্ত্রণার নদীর
দিকে আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়।
অহরহ আমার রক্ত–পানরত সে আমার ভেতরের
প্রেম বাইরের করুণ আবরণ।
কবিতা আমাকে অহরহ নিয়ে আসে
কবিতার জন্য আজও অনুরক্ত হয়ে থাকি তোমার
ভালোবাসায়। খুঁজে বেড়াই জীবনের শব্দগুলিকে।
ভিজে উঠা দিনগুলি নিয়ে নদী পারাপার হই।
শহীদ মিনারের পাদদেশে জীবনের প্রথম অংশ অর্পণ
করে ফিরে আসি শূন্য হয়ে। সংঘমিত্রার কাছে বসে
স্পর্শ করি একে ৪৭।
জন্ম দিই জীবনের জন্য অপরিহার্য কবিতার।
কবিতার জন্য আজও অনুভূত হয় আমার রক্তের ভেতরে
বয়ে চলা নদীটির অহরহ বিষাদ তীব্রতা। বুকের ওপর দিয়ে উঠে আসে
সেই নম্র শব্দ গুলি। আমাকে আলোকিত করে রেখে যায়
নদী। নদী থেকে একদিন আমি ভেসে এসেছিলাম একটি
স্বপ্নের মতো। বসতি স্থাপন করেছিলাম তোমার
কোলে।
এখন যেভাবে আছি ঠিক এভাবে ছিল না আমার
কোনো কাল। উদর জ্বলছিল। উদরের ভেতরে জ্বলছিল
হৃদয়। আরম্ভ হয়েছিল আমার আশেপাশে সংঘর্ষ এবং
আকাশ।
কবিতার প্রতি আজও অনুরক্ত হয়ে থাকি তোমার
ভালোবাসায়। তাই তোমার দুঃখে আমি দুঃখী হয়ে থাকি।
বুকের স্বপ্নগুলি ভেঙ্গে নিঃশেষিত হয়ে যায় জীবনের ক্ষুধা।
আরক্ত বুকে হাত ঢুকিয়ে কখনও ছুঁয়ে থাকি আগুন মাখানো
হৃদয়।
কবিতার জন্য গ্রন্থবিপনীর দরজার মুখে আমি ভিখারির মতো
দাঁড়িয়ে থাকি। টাইম পিসের আর্তনাদী কাঁটার শব্দে
ফোঁপাতে থাকে আমার হৃদয়। আমার রক্তগুলি সংক্রামিত হয়ে উঠে
উত্তেজনায়। স্নিগ্ধ সবল চোখ জোড়ার ভেতরে অহরহ যাতায়াত
করে মিলান কুন্দেরা অক্টাভিও পাজ।
বিশ্বাস কর তোমার সাবলীল ঠোঁটে লেগে থাকা ফুলে থাকা দুটি গাল
গোপনীয়তায় আমি স্নিগ্ধ হওয়ার জন্য
ফোঁপাতে থাকি
কখনও। রাত দুপুরে ছিন্নভিন্ন বিষন্ন হয়ে ছিটকে
পড়ি চারপাশে। আমার অবয়ব ভেঙ্গে বেরিয়ে আসি ভেতর
থেকে। শোকদগ্ধতায় খুঁজি নিজের সময়।
কবিতার জন্য আজও অনুরক্ত হয়ে থাকি তোমার
ভালোবাসায়। কবিতা আমাকে নিয়ে আসে অহরহ মৃত্যু থেকে
জীবনের দিকে।
অক্টাভিঅ’ পাজের স্মরণে
শ্রদ্ধেয় কবি অক্টাভিঅ’ পাজ
আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমি উন্মুক্ত বাতাসে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে
উঠেছিলাম।
দুপুরের বিয়াল্লিশ ডিগ্রির উত্তপ্ত রোদগুলি আহার করেছিলাম
ক্ষুধার্ত হয়ে। একনাগারে বাহাত্তর ঘণ্টা নিদ্রাহীন চোখ মেলে
তাকিয়ে ছিলাম আকাশের দিকে।
ভাইরাল ফিভারে দুর্বল হয়ে পড়া অস্থিমজ্জা কেঁপে উঠা হাঁটু জোড়ায়
নির্ভর করে দাঁড়িয়ে ছিলাম দশ ঘণ্টা।
নিজের অজান্তে আমার হাত দুটিতে উঠে এসেছিল বর্ম পরিহিত
একটি কবিতা। তাকে সুরক্ষিত করে রেখেছিলাম আপনার জন্য।
সে ছিল আমাদের তরুণ কবিদের মনোরম ভালোবাসার স্বাক্ষর।
হিয়ার ভেতরে আধফোঁটা কৃতজ্ঞতার একটি মানপত্র।
আপনার হাতে তুলে দেবার জন্য আমি তাকে গোলাপ জলে ভিজিয়ে আর্দ্র
করে রেখেছিলাম।
স্বপ্নে সাক্ষাৎ করা আপনার কোমল হাতটা আমার পিঠ
স্পর্শ করেছিল।আপনার শ্বেত আঙুলগুলি আমার দীর্ঘ
চুলগুলি
আঁচড়ে দিয়েছিল। আপনার কণ্ঠস্বর দ্রুত করে তুলছিল আমার
জীবনের
স্পন্দন। আপনার পাশে বসে আমি পান করেছিলাম পবিত্র
জ্যোৎস্না।
আপনার সঙ্গে দেখা করার জন্য আমি স্বপ্ন পুষে রেখেছিলাম।
কবি হিসেবে আমার জন্ম পরবর্তী স্বাধীন মধ্যরাত গুলি আলাদাভাবে
রেখে দিয়েছিলাম। মেক্সিকো থেকে বাতাসে উড়ে আসা আপনার শব্দের
সুগন্ধে আমি মাতাল হয়ে পড়েছিলাম। কে জানে হয়তো একটু দ্রুত পা চালালেই
আমি পেয়ে যেতাম আপনার মনোমুগ্ধকর স্পর্শ। সারা জীবন জুড়ে
আমি হয়তো অর্থবহ করে তুলতে পারতাম নিজেকে।
অনুবাদক- বাসুদেব দাস


