
পর্ণশবরীর কথকতা পর্ব-১ প্রাপ্তি চক্রবর্তী
আজকাল চেষ্টা করি এই ছোটো জীবনের সাদামাটা সহজ কথাগুলি লিখে রাখতে। জীবন অনিশ্চিত এবং সংকীর্ণ। সংকীর্ণ এবং স্থানাভাবের কারণে জটিলও। এরই মধ্যে খুঁজে কাগজের যেসব কোণে এখনও দাগ পড়েনি সেসব কুড়িয়ে ঝোলায় পুরে রাখি। শেষ পর্যন্ত সম্বল হয়ে থাকে সেগুলিই।
জীবন একখান সাদা কাগজের মতোই শুরু হয় না কি? ক্রমে ক্রমে নানান দাগ পড়তে থাকে। কেউ বলেন অভিজ্ঞতা, কেউ ভাবেন কালিমা- আমি বলি ক্ষেত্র বিশেষে দুই-ই। আমি ভাবি, মনকে যতটা সম্ভব নির্মল রাখা যায় তাতেই মনের শান্তি, তাতেই তার স্থিরতা।
আজকাল প্রায়ই একটা অদ্ভুত কথা শুনি, ভালো -মন্দ সবই নাকি আপেক্ষিক! থিয়োরি অফ রিলেটিভিটিতে জল এবং কাদা দুই-ই মিশিয়ে অল্পবিদ্যে, ফাঁকি এবং লোভে পূর্ণ অনৈতিক মানুষের অজুহাত এই সস্তার ‘আপেক্ষিকতা’। আমার কাছে সবজি ভালো, মাছ খারাপের বিষয়টা আপেক্ষিক হতে পারে কিন্তু এই যে দিল্লিতে প্রেমিকাকে কুঁচি করে কেটে ফ্রিজে রেখে দেওয়া কিংবা লজেন্স দেওয়ার নামে বালিকা কন্যার ধর্ষণ, এদের যদি ‘আপেক্ষিক’ বলে বিচার দেওয়া হয় তাহলে পরিণতি কী হতে পারে সে ভাবার মানসিক জোর আমি গড়তে পারিনি৷ ভালো-খারাপ, ঠিক-ভুল, নৈতিক-অনৈতিক সবকিছুকেই আপেক্ষিকতার সূত্রে ফেলে চায়ের কাপে ঝড় তোলা আসলে ভীরু মনের দুর্বল বর্ম। ভীরু, কারণ আমি স্বাভাবিকভাবে যা তাই নিয়ে সমাজে চলার সাহস রাখি না, আমার সবসময় একটা বর্মের আবরণ প্রয়োজন। ব্যক্তিবিশেষে যে বর্ম যৌবন, ধন কিংবা প্রাণ- এর কোনো একটিতে টান পড়লেই ধ্বসে যেতে বাধ্য।
আমি কীভাবে আমার জীবনকে চালোনা করব, আমার প্রয়োজনের মাত্রাকে কতদূর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করব, প্রয়োজন এবং চাহিদা, চাহিদা এবং লালসার মধ্যে সীমারেখা টানতে শিখব কি না, নিজেকে কতটা ‘আরো ভালো’র অভিমুখে যাত্রা করাতে পারলাম কিংবা নিজের নৈতিকতায় কতটা জল মেশালাম সেইটে আসল। শেষ পর্যন্ত অন্তত৷
এবার প্রশ্ন আসে, পথের শেষ কোথায়? আমি সে শেষ দেখি নিজের অন্তরে – নিজের প্রতিবিম্বে। একটা জীবন সৎ-ভাবে যাপন করলে, ক্লেদাক্ত রাজনীতি কিংবা অর্থ-কাম-লোভের নাগপাশ থেকে স্ব-ইচ্ছেয় নিজেকে আলগা রাখতে পারলে রাতের ঘুমে শান্তি থাকে, সন্তানের মুখে ঈশ্বরকে দেখা যায়, গাছের নতুন পাতায় মঙ্গলময়ের আশীর্বাদ অনুভূত হয়।
পদ্মের চারপাশে জল আর নীচে পাঁক থাকলেও সূর্যের অভিমুখে তার যে যাত্রা তা শূচিতায় পূর্ণ, তার শত-দল আর কোরক থাকে শেষ পর্যন্ত শুষ্ক। আমাদের চেষ্টা ওটুকুই; আলো, পূর্ণতা আর সত্যের অভিমুখে নিবিষ্ট যাত্রার। এ যাত্রা সম্পূর্ণ হয় কিনা জানা নেই, তবু উদ্দেশ্যটাই আসল।
ক্ষুদ্র মন যাত্রা শুরু করে গুনগুনিয়ে পাঠ করে চলে, “আমায় অসত্যের থেকে সত্যে এবং আঁধার থেকে আলোকের অভিসারে নিয়ে চলো..”
(ক্রমশ)