
জীবনানন্দ ক্রোড়পত্র -পার্টি-পলিটিক্স, ভ্রান্তিবিলাস আর জীবনানন্দ
সরোজ দরবার
পার্টি-পলিটিক্স, ভ্রান্তিবিলাস আর জীবনানন্দ
দল-রাজনীতি আর অরাজনীতির রাজনীতি– দুই-ই নতুন আলোচ্য নয়। তবু নতুন করে আলোচনায় ফিরেছে, বিশেষত এই চব্বিশ-পঁচিশ সময়কালে, বিশেষ ঘটনার সূত্রেই। অথচ দলীয় রাজনীতি নিজস্ব চরিত্রের কারণেই সমালোচিত হয়েছে আগেও। দলের দাপট বাড়লে সে-সমালোচনার স্বর অবশ্যই ক্ষীণ হয়ে আসে। তাতে দলেরই ভিতে ভাঙন ধরে। ভারতবর্ষ এর সাক্ষী থেকেছে বারবার। যে সব দলকে এক কালে অপরাজেয়, অমর, শ্বাশ্বত বলে মনে হয়েছে, সে সব অপাঙক্তেয় হয়ে গিয়েছে কালক্রমে। আর অরাজনীতি বলে যে-রাজনীতি চলে তা আসলে মানুষকে দেওয়া মানুষের শ্রেষ্ঠ ফাঁকি। আদতে এরকম কিছু হয় বলে মনে হয় না। স্বাধীন ভারতবর্ষ তার অর্জিত গণতন্ত্র নিয়ে ভোটের হেলাফেলা করতে করতে এমন জায়গায় পৌঁছে গিয়েছে যে, কোনও দলই আর স্পষ্ট গ্রহণযোগ্যতা দাবি করতে পারে না, যা একদা এক-একটি রাজনৈতিক দলের মূল অবলম্বনের জায়গা ছিল। এই ফোকর গলেই আর একরকমের রাজনীতি বাড়তে থাকে, যার গায়ে ‘অরাজনীতির’ তকমা লেগে যায়। ভোট বাদ দিলে যদি রাজনীতির আর কোনও ভূমিকা না থাকে, তাহলে তা অরাজনীতিই বটে! অন্যথায় এই সমস্ত রাজনৈতিক মানুষকে, যাঁরা দলভুক্ত না হতে পেরেও দলবদ্ধ তাঁদের কী বলা যায় বা কোন থাকে ফেলা যায় তা নিয়ে চেনা রাজনীতি অনবরত প্যাঁচ কষে যায়। ফলত এক সহজ বাইনারির জন্ম হয়। এই দলের নক্ক্যারজনক কাজের বিরোধিতা মানেই কেউ একজন ওই দলে। আবার ওই দলকে তার নক্ক্যারজনক স্মৃতি-সত্তার জন্য যদি সমর্থন না করতে পারে সেই ব্যক্তি, তাহলে তিনি প্রকারন্তরে প্রথম দলেরই। অথবা সহজ সমাধান বাতলে দিয়ে কেউ কেউ বলে থাকেন, এই শ্রেণিচরিত্র নিয়ে যাঁরা বেঁচে থাকতে চান, তাঁদের বলা যায় সুবিধাবাদের দল। যাঁরা কোনও দলেরই দায় নেন না, অথচ দলীয় পরিশ্রমের সুবিধাটুকু নিতে চান। সময়ের দায়ও যে তাঁরা নিচ্ছেন না, এ ব্যাপারে প্রত্যেক দলীয় মতবাদই মোটামুটি নিশ্চিত। এই যে দাগিয়ে দেওয়া বা চিহ্নিত করে দেওয়ার প্রক্রিয়া, তা আসলে একটি রাজনৈতিক অবস্থারই পরিচায়ক। বোঝা যায়, রাজনীতি এমন একটি জটিল জায়গায় এসে পৌঁছেছে যেখানে এক রকমের সংশয়-ব্যূহ তৈরি হয়েছে, যা চক্রাকারে ঘিরে রেখেছে এই সময়টাকে। দল কিংবা দলের বাইরে সকলেই সেই একই আবর্তনে। এতে বিশ্বাস ভাঙে, অবিশ্বাস বাড়ে। এই সময়ে সে-ক্যানসার স্পষ্ট। মতপার্থক্য বলে কোনওরকম শ্রূশুষাই আর অবশিষ্ট নেই। দলীয় রাজনীতির সমালোচনা বা সমর্থনের প্রসঙ্গটি সরিয়ে রেখে, যদি দেখার চেষ্টা করা হয় যে, এই যে শিবিরহীন মানুষ, তাঁদের কি আদৌ কোনও অতীত ছিল? নাকি তাঁরা ভুইঁফোড়! আর এখানেই, আশ্চর্য, যেন স্মিত হাসেন জীবনানন্দ দাশ।
বাসমতীর উপাখ্যান-এ প্রায় আলগোছেই কথাবার্তা এগোতে এগোতে একেবারে হতচকিত হবেন পাঠক এরকম একটি লাইন পেয়ে- ‘আমাদের দেশে কাজ মানে পলিটিক্স।’ দেশ তখন স্বাধীন হবে হবে করছে। এবং একধরনের আশা কাজ করছে যে স্বাধীন হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। সময়টার সূত্রে জীবনানন্দের ভাবনাজগতের হদিশ দিয়েছেন দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়— “জীবনানন্দের চিত্তে ওকাকুরা কাকুজোর এসিয়ার ঐকাত্ম্য কিংবা রবীন্দ্রনাথের ‘জাপানযাত্রী’ বা ‘ধ্যানী জাপানে’র কোনও স্মৃতিরেশ আর নেই, তিনি বিরূপ হয়ে উঠেছেন জাপানের উপরে। … আশ্বাসপ্রদ বরং চীন বা রুশ: ‘সৌরকরময় চীন, রুশের হৃদয়।’ চীনে তখনও মাও যে দঙ প্রধান হয়ে ওঠেননি। কাজেই বিশেষ প্রত্যাশা তাঁর রুশের কাছে। চৈত্য ও ক্রুশের মতোই মানুষের পরম ভরসা-আশ্রয় সোভিয়েট শ্রুতি-প্রতিশ্রুতি। শুধু তাই নয়। অনেক রাজনীতিবিদ্ চিন্তাবিদের পাশে তাঁর স্বাভাবিক যে আস্থা প্রাক্-মেশিন পর্বের সহজ নিয়োলিথিক কৃষিসমাজের উপরে, আশা করছেন ‘তৃতীয় চতুর্থ– আরো সব/আন্তর্জাতিক গ’ড়ে ভেঙে গ’ড়ে দীপ্তিমান কৃষিজাত মানবে’র সেই কল্যাণময় ভবিষ্যৎ তারই হাতে রচিত হবে। … সে সময়কার অনেকাংশ শিক্ষিত বাঙালির মতোই জীবনানন্দেরও বিশেষ ক’রে সোভিয়েত প্রতিশ্রুতিতে যত ভরসা, ইঙ্গমার্কিন প্রতিশ্রুতিতে ততই অবিশ্বাস।”
এক দিকে এই বিশ্বাস, অন্যদিকে তাঁকে ভাবাচ্ছিল দেশের ভিতরকার ‘সাম্প্রদায়িক রূঢ়তা ও মনের রুগ্নতা।’ কিন্তু সোভিয়েত প্রতিশ্রুতিতে তাঁর ভরসা ঝুঁকেছিল বলেই কি তিনি নিজেকে আটকে ফেললেন একমাত্রিকতায়? মনে হয় না। বরং সময়ের ভিতর ঘনিইয়ে ওঠা সংলাপ থেকেই, ডিস্কোর্স থেকেই তিনি সময়ের রক্ত-মাংস চিনে নেওয়া ও চিনিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এখান থেকেই আবার ফিরে যাওয়া যায় বাসমতীর উপাখ্যানে, যেখানে পাওয়া গেল, কাজ মানেই পলিটিক্স, এবং তার সঙ্গে দু-এক লাইন পরেই জুড়ে দিলেন, ‘আর পলিটিক্স মানে পার্টি।’ এর পরে যত কথোপকথন এগোতে থাকে মনে হয় যেন চরিত্র নয়, সময় স্বয়ং কথা বলছে তার বিবিধ চরিত্রবৈশিষ্ট নিয়ে—
‘আর পার্টি মানে?’
‘ওই কমিউনিস্ট পার্টিটা আর কি।’ বলে রমার দিকে উৎফুল্ল আগুনের মতো দপ করে তাকিয়ে মেয়েটির কাছে নিজের সিদ্ধান্তের অনুকূলে ষোলআনা সায় আদায় করতে পারেছেন মনে করে ঝা করে বেরিয়ে গেলেন।’
জীবনানন্দের সময় যেন আরও খানিক কথা বলে উঠতে চায়, অতএব কথোপকথন এগোয়—
রমা তাকিয়ে দেখল রাজীববাবু মাথা চেয়ারের কাঁধের উপর কাত করে ঝিমিয়ে পড়েছেন।
‘সুমিতা কমিউনিজম নিয়ে আছে। ওর সঙ্গে মতে বনে না আমার।’
‘আমি ভেবেছিলুম তুমিও কমিউনিস্ট।’
‘সেটা ভুল ভেবেছিলেন।’
‘তুমি কংগ্রেসের?’
‘না।’
‘আমি ভুলে গিয়েছিলাম’, প্রিন্সিপাল খানিকক্ষণ পরে বললেন, যেন কংগ্রেস-কমিউনিজম ছাড়া আর পৃথিবী নেই।
এইখানে এসে আমাদের আশ্চর্য হয়ে যেতে হয়। মানুষ যে মানুষকে রাজনৈতিক বিশ্বাসে বাইনারিতেই ভাগ করে ফেলে, তা যেন বহুযুগের হেঁয়ালি। জীবনানন্দ তা চিনিয়ে দিতে ভুল করেন না। তবে, এরকম পৃথিবীর প্রতীতিও তাঁর আছে। তাই এরপরেই চরিত্রের মুখে সংলাপ আসে—
‘আছে, সেখানে পলিটিক্সও আছে হয়তো– কিন্তু আজকালকার চারদিককার সব চালু পলিটিক্স সেখানে নেই।’
রমার মুখে কথাটা শোনা অবধি ভাবছিলেন তিনি; এইরকম কথাই খুব সম্ভব যুক্তি ও কামনার মিলনভূমিতে প্রায় কুড়ি বছর আগে শুনতে চেয়েছিলেন। যাক শোনা হল। পলিটিক্স অবশ্য পলিটিক্স, তা থাকবে, মানুষ যা তাতে দরকারও রয়েছে তার। কিন্তু সে সব স্বীকার করেও, হয়তো স্বীকার করেই, রমার ওই কথাটা একটা অপূর্ব নির্দেশ।
পার্টি-পলিটিক্স বাইনারি করতে করতে করতেই চরিত্রদের হাত ধরে জীবনানন্দ পাঠককে পৌঁছে দিলেন একটা অপূর্ব নির্দেশে। একটা পৃথিবী আছে, যেখানে দলীয় বাইনারি নেই। পলিটিক্স সেখানেও আছে সম্ভবত, তবে, তার রূপ-চরিত্র কী? সম্ভবত সেটাই মানুষের খোঁজ। দল বা দলের পলিটিক্স অস্বীকার নয়। তবে দলীয়তার ঊর্ধ্বে ওঠা মানুষের পক্ষেই সম্ভব। সে পলিটিক্স মানুষকে খুঁজে যেতে হয় বইকি- তাই ‘অপূর্ব নির্দেশ’ তোলা থাকল। স্বাধীনতাকেই অমৃত করে বসে থাকলে যে কাজের কাজ কিছু হওয়ার নয়, সে কথাও বলা ছিল। আর চিহ্নিত করে দেওয়া ছিল এই সাম্প্রদায়িকতার বিপদ। গরু হারিয়েছে, তা খুঁজতে মুসলমান কসাইপাড়ায় যাওয়া হয়েছে, সেখানে আছে এই নির্দেশ—
সিদ্ধার্থ বললে, ‘হিন্দু মহাসভার শরৎ ভৌমিকের সঙ্গে পথে দেখা, মহাসভার লোকেরাই দেখেছি এক আধটা কিনারা বাতলে দিতে পারেন, শরৎবাবু বললেন, শালিখডাঙার ক্রিশ্চান মিশন তো এই বসেছে, ওরা এখনই অতবড় একটা গাই দিয়ে কী করবে, বেঁধে রেখে দুধ খাওয়া ছাড়া? তা তো খাচ্ছে না, রজনী তো নিজের চোখে দেখে এল। গোরুটা জিরানডাঙার মোহলমানরাই বেহাত করেছে, মেরেছেও হয়তো, মাংস খাওয়ার জন্য ওরা দুধেল গরুও মানকচু থোড়ের মতো খেয়ে ফেলে, ওখানে কুড়ি বাইশ ঘর কশাই আছে, চামড়ার ব্যবসার করে।’
এই উস্কানির পরই গোলমালের উপক্রম। অর্থাৎ বাসমতীতে যে ভারতবর্ষের কথা তিনি বলছেন, যে ভারতবর্ষ স্বাধীন হতে চলেছে সে ভারতবর্ষের প্রধান দুটি অসুখ হল এই মনের রুগ্নতা। পার্টি-পলিটিক্স-বাইনারি তারই পরিচায়ক। নেশন স্টেট যে রুগ্নতাকে ঢাকা দিতে পারে না। তার বিপদ অজানা ছিল না। এবং এই সাম্প্রদায়িক বিষ। দুয়ে মিলে ভারতবর্ষ কোন জায়গায় যেতে পারে? আমরা সাক্ষী থাকছি। ফলত এই স্বাধীনতা এবং পলিটিক্সকে সন্দেহের চোখেই দেখছিল ‘জলপাইহাটি’র হারীত। একটা নতুন কংগ্রেসের কথা ওঠে— ‘নতুন যা, তা নতুন। তার ভিতর এ সবের কিছু ছায়া কিছু ছকটক থাকতে পারে, কিন্তু তবুও তো আলাদা জিনিশ। দিন বদলাচ্ছে, দেশ বদলাচ্ছে, মানুষ বদলাচ্ছে…’। এর একটু পরেই আসবে সেই সংলাপ—
‘কী চায় হারীত?’
‘আবার পলিটিকস করছে।’
‘কীরকম পলিটিকস? রিভলবার ধরবে?’
‘কী জানি। স্বাধীন হয়েও শান্তি নেই। ছেলেমেয়েগুলোর এই দশা…’
অর্থাৎ এই যে পলিটিক্সের অলাতচক্র, এ থেকে যেন প্রশান্তির কোনও গন্তব্য নেই। দিকনির্দেশ নেই। ভবিষ্যৎ নেই। ১৯৩৮ থেকে ’৪৩-এর সাতটি তারার তিমির রচনাপর্বেই এই রাজনৈতিক বীক্ষা, যার কাছে পাঠককে ডেকে নিতে চেয়েছিলেন জীবনানন্দ। তাই বলেন,
কোনো এক তনুবাত শিখরের প্রশান্তির পথে
মানুষের ভবিষ্যৎ নেই– এই জ্ঞান
পেয়ে গেছে; চারিদিকে পৃথিবীর বিভিন্ন নেশন পড়ে আছে:
সময় কাটায়ে গেছে মোহ ঘোচাবার
আসা নিয়ে মঞ্জুভাষা, ডোরিয়ান গ্রীস,
চীনের দেওয়াল, পীঠ, পেপিরাস, কারারা-পেপার।
তাহারা মরে নি তবু– ফেনশীর্ষ সাগরের ডুবুরির মতো
চোখ বুজে অন্ধকার থেকে কথা-কাহিনীর দেশে উঠে আসে;
যত যুগ কেটে যায় দেখে সাগরের নীল মরুভূমি
মিশে আছে নীলিমার সীমাহীন ভ্রান্তিবিলাসে।
প্রতীতি – সাতটি তারার তিমির-এর এই কবিতাটির দিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। জীবনানন্দের নন্দনগ্রন্থির আভাস, জটিলতা বোঝাতে গিয়েই এই কবিতার আপাত দুর্বোধ্যতা অতিক্রম করতে বারবার পাঠের কথা বলেন তিনি। এই যে চারিদিকে পৃথিবীর নেশন পড়ে আছে, অলোকরঞ্জন বলছেন, ‘কেন তারা নিমজ্জিত হয়েও ফেনশীর্ষ সাগরের ডুবুরির মতো/ চোখ বুঝে অন্ধকার থেকে কথা-কাহিনীর দেশে উঠে আসে, এবং পরিশেষে কেনই বা, সেই সব ডুবে-যাওয়া মহাদেশে নীলিমার কাছে সমুদ্রের নীল মরুভূমি-র প্রাতিভাসিক সমর্পণের দৃশ্যটি, অর্ধেক সন্দেহে, অর্ধেক প্রত্যয়ে। এক কথায় দ্বিধান্বিত প্রতীতির মাধ্যমে চেয়ে দেখছে। এতদূর পর্যন্ত কিন্তু মনে হয় কবিতাটির মর্মে আমরা নীত হতে পারছি না, সে আমাদের ভ্রান্তিবিলাসের ঘোরে ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে মারছে। আমরা এমন-কি কবিতাটির পৌনঃপুনিক পাঠের পরেও, ঠিক যেন বুঝে উঠতে পারি না,সত্যিই অবলুপ্ত মহাদেশগুলিই এই পর্যবেক্ষণ করছে কিনা, নাকি কবিতাটির শুরুতেই উদ্বোধিত ‘বাতাবিলেবুর পাতা’, অথবা এক হিসেবে মধ্যভাগে আচম্বিতে উল্লিখিত ‘কামাতুর ব্যক্তিরা’ই ওই নিরিক্ষণের কর্তা।’ আমাদের মনে হতে পারে, বাতাবিলেবুর পাতা যেন জীবনানন্দের গোড়ার দিকের গ্রামকল্পেরই প্রতিনিধি। যে পর্বে তিনি নির্জনতম আখ্যা পাচ্ছেন বুদ্ধেদেবের কাছে। এবং পরবর্তী পর্যায়, যখন মহাপৃথিবীর দিকে নিজের ভাবনাকে সংহত করছেন, বুদ্ধদেব যে সময়ে তাঁর চেনা জীবনানন্দকে না-পেয়েও ইতিহাসচেতনার উল্লেখ করে দিচ্ছেন তাঁর কাব্যের সুর হিসাবে। সেই ইতিহাসচেতনা তাকিয়ে আছে আদি কৃষিসভ্যতার দিকেই। রবীন্দ্রনাথ, গান্ধীর মতো জীবনানন্দও আদি কৃষিসভ্যতার দিকেই মুখ ফিরিয়েছিলেন। অতচ রাজনীতির পথে পথে এই যে ভ্রান্তিবিলাসের ঘোর, এ কি আমাদের রাজনীতিরই ভুল নয়! নইলে ‘নেশন’ শব্দটিরই উল্লেখ কেন? এই নেশনজন্ম যে কী বিপদ ডেকে আনতে পারে, রবীন্দ্রনাথ তা মনে করিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। জীবনানন্দ সেই নেশনের পরিণতি দেখিয়েই যখন ভ্রান্তিবিলাস অব্দি পৌঁছে দিচ্ছেন, আমরা টের পাই এক ধরনের হেঁয়ালি। ঠিক পরের পঙক্তিতেই পেয়ে যাব এই শব্দটিকে— ক্ষতবিক্ষত জীব মর্মস্পর্শে এলে গেলে– তবুও হেঁয়ালি; হয়তো ডুবে যাওয়া মহাদেশ বা গ্রামকল্পের আদি জীবনই তা দেখছে। দেখছে তার ভিতর আমাদের দারুণ ঘুরে মরা। এই হেঁয়ালির ভিতরই আমাদের হেঁটে যাওয়া, তবুও প্রতীতি, এ কবিতার শিরোনাম শুধু নয়, বেঁচে থাকার ইতিহাসেরই শিরোনাম কিংবা সুর। জীবনানন্দ তাহলে আমাদের কোন দিকনির্দেশ ইঙ্গিত করছিলেন? তাঁর প্রবন্ধে এর উল্লেখ আছে। যখন জাতিবিদ্বেষ, নেশনজন্ম, যুদ্ধ ইতিহাসকে ক্রমাগত অশুদ্ধ করছে, মানুষ যন্ত্রের হাতে পরাভূত হচ্ছে, তখন জীবনানন্দ ভাবছিলেন, ‘সকল জাতিকে নিয়ে যার যার ব্যক্তি স্বাধীনতা ও জাতিস্বকীয়তা সত্ত্বেও শান্তি ও মৈত্রীর হেতুভূমিতে এক অবিচ্ছিন্ন মানবপরিমণ্ডল গঠন করবার ইচ্ছা ও আয়োজন অসঙ্গত মনে করা যেতে পারত কি?’ এ-প্রশ্ন তো ইতিহাসেরই। এই কি তবে সেই অন্য পৃথিবী!
ইতিহাস আমাদের ঘুরিয়ে মারে। পলিটিক্স থেকে পলিটিক্সে। ডুবে যাওয়া নেশনেরা দেখে আমাদের চলমান হেঁয়ালি, দেখে আদি গ্রামসভ্যতাও। কোন পলিটিক্সে তবে সেই পৃথিবীতে পৌঁছনো যাইয় যেখানে আজও স্থির বিশ্বাসে এ কথা উপলব্ধি করা যায় যে, ‘মহত্তর সূর্য কোথাও অদৃশ্য থেকে সেবা করে যাচ্ছে, সুধা দিচ্ছে, অমেয়, শালীন আলোক দান করে চলেছে।’ শুভজাতক পৃথিবীরাষ্ট্রের আশা– যা জীবনানন্দের শেষ অবধি, যেহেতু মানব থেকে যায়– কি এই শতাব্দেও আমাদের পলিটিক্স হতে পারে না! পার্টি-পলিটিক্স-বাইনারি হাতে অনেক তো দিন পেরোল, বাজার-বিস্তারি এই প্রলোভনের পৃথিবীতে বিপ্রতীপে দাঁড়ানোর মতো আমাদের আর আছে কী! প্রতীতি ছাড়া!