
সুদীপ বসুর ‘কবিতাসংগ্রহ’- এক গোপন কুয়াশায় ঢাকা অপরিচিত বাসস্টপ
কবিতাসংগ্রহ/সুদীপ বসু/সপ্তর্ষি প্রকাশন ৩৫০টাকা
নয়ের দশকের অন্যতম প্রধান কবি সুদীপ বসু। ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অনিন্দিতা বাসস্টপ’। একজন কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থেই নিজের কাব্যভাষা খুঁজে পাওয়া এক বিরল বিষয়। খুব কম কবির ক্ষেত্রেই আমরা দেখেছি তিনি নিজের কাব্যভাষা নিজের প্রথম গ্রন্থেই তীব্র ও প্রখর করে তুলেছেন। “কবরখানায় দাঁড়ালেই আমি একটা তীব্র হত্যাদৃশ্য দেখতে পাই” -এর মতো কাব্যপংক্তি দিয়ে শুরু হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের অভিযাত্রা। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আত্মগত সংলাপে কবি লিখে চলেন তাঁর অভিজ্ঞতাগুলি। যেন কাউকে কিছু বলার দায় নেই। যেন তিনি নির্মোহ ভাবে নিজের জীবনকেই লিখে চলেছেন। মৃত্যু, যৌনতা এক অধিবাস্তবিক প্রেক্ষাপটকে তৈরি করে তাঁর কবিতায়। যেন তিনি এমন এক ন্যারেটিভের মধ্যে রয়েছেন বলে মনে হয়, যে ন্যারেটিভের মধ্যে আমরা ঠিক নেই। কিন্তু সেই ন্যারেটিভের মধ্যে তিনি নিজে বসবাস করেন। এ যেন অনেকটা উত্তর কলকাতায় বসে লাতিন আমেরিকান চলচ্চিত্র দেখার মতো। কিন্তু মুহূর্তে মনে হতে পারে, তিনি যে বাস্তবতা তৈরি করছেন, তা ভিন্ন। আবার পরমুহূর্তেই মনে হতে পারে, সেই ভিন্ন বাস্তবতা আমাদের পরিচিত বাস্তবতারই এক ভিন্ন তল। মাল্টিভার্সের, বহুমাত্রিকতার এক বহুস্বর সুদীপ বসুর কবিতার ব্রহ্মাস্ত্র। আর, তিনি নিজে নানা ন্যারেটিভ তৈরি করলেও, হীরে ধীরে অনুভূতিমালার নানাবিধ প্রকাশে ন্যারেটিভের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এলেও, কবিতার এই যে আত্মা, তার থেকে তিনি কখনোই বেরোননি। একজন প্রকৃত সৎ কবির মতোই তিনি নয়ের দশক থেকেই এখনো পর্যন্ত নিজের স্বাতন্ত্র্য ধরে রেখেছেন।
‘অনিন্দিতা বাসস্টপ’-এর ‘ ‘নার্সিংহোম’, ‘ ছুরি, ‘অন্ধ’ সুদীপ বসুর কবিতার অন্তরাত্মাকে ধারণ করে আছে। তিনি এমন এক ব্যক্তিত্বপূর্ণ স্বরে কথা বলেছেন, যা একেবারেই অপিরিচিত আমাদের কাছে। যার ভাষ্য ভিন্ন, ভাবনা ভিন্ন এবং যার যাপন ভিন্ন। কেমন এক নিয়তিতাড়িত-এর মতো সুদীপ বসু একের পর এক কবিতা লিখে গেছেন। ‘অনিন্দিতা বাসস্টপ’-এর মতোই ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত ‘অন্ধদের বিউটিপার্লার’ আরও একটি মাইলস্টোন বলা যেতে পারে বাংলা কবিতার। এই কাব্যগ্রন্থে সুদীপ বিভিন্ন সময়ের ফ্রেমে যাতায়াত করেছেন। তাঁর কাব্যভাষা অনেক বেশি পরাবাস্তবকে প্রতিফলিত করছে, এক মাত্রা থেকে আরেক মাত্রায় চলে যাচ্ছে। কিন্তু তিনি বিষয়ে যেমন অনেক বেশি সংকটকে ধারণ করছেন, তেমন আঙ্গিকে হয়ে উঠেছেন অভিনব। যেমন, ব্লাইন্ড স্কুলের চিঠি শীর্ষক কবিতাতে তিনি লিখছেন ” বিষণ্ণতা একটা রাগি কুকুরের মতো/ তাড়া করে ফিরছে আমাদের সোনালি জুতো’। তিনি লিখছেন ‘ সেগুন কাঠের সামান্য বাড়ি, তাতে বাবা আর আমি’। কাফকার মতো বাবাকে নিয়ে সুদীপ বসুরও এক রহস্যময় যাপন আছে। এক ইতিহাস আছে। তা তাঁর কবিতায় ধরা পড়ে। বাবা, মা ফিরে আসে তাঁর কবিতায় বারবার। এক পোড়া দগ্ধ শৈশব চলে আসে। স্মৃতি চলে আসে। নাইটভিশনে দেখা পৃথিবীর মতো সুদীপ বসুর কবিতার চিত্রকল্পগুলি আমাদের মনের মধ্যে ঢুকে পড়ে। ” মৃত্যুর আগে কোনো এক দর্জির নোংরা বিছানায় শেষবার জেগে উঠেছিল মা” বা ” বাবার শরীরে রান্নাঘরে আজ পিস্তলের ভেতরে অন্ধকার”-এর মতো এক একটি পংক্তি আমাদের ন্যারেটিভের থেকে বের করে নিয়ে যায় অধিবাস্তবিক এক ন্যারেটিভের দিকে।
এখানে যে কথাটি বলতে ইচ্ছে হয়, তা হল কবিতার মধ্যে খুব সচেতন ভাবেই তিনি আপাত যে যুক্তি পারম্পর্যের রেখা, তাকে ভেঙে দেন। যুক্তি পারম্পর্যের যে চেনা কাঠামো বা ছক আমাদের সামনে আসে, সুদীপ বসুর কবিতায় সেই ছকটার কোনও অস্তিত্ব নেই। কিন্তু আবার এই ন্যারেটিভকে ভেঙে ফেলার ফলে ন্যারেটিভবিহীন কোনও লেখাও তিনি লিখছেন না। বরং তিনি এমন এক ন্যারেটিভ লিখছেন, যা আমাদের তথাকথিত বাস্তবকেই আরও বেশি প্রকট করে তুলছে। একে কি আমরা ইমপ্রেশনিস্ট কবিতা বলব না উত্তরাধুনিক কবিতা -সে বিষয়ে চর্চা করুন না হয় পরবর্তী কালের কাব্যসমালোচকরা, কিন্তু আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই, সুদীপ বসুর কবিতায় এক ভিন্ন ধরনের বাংলা কবিতার ভুবন জেগে উঠছে। একইরকম ভাবে ২০০২ সালের বিপাশা খাতুন, ২০০৯ সালের ‘লিরিল সাবানের আত্মা’, ২০১৪-র ‘মাধবী ও অন্ধকার’, ০১৫ সালের ‘আবার বিপাশা খাতুন’, ২০১৬ সালের ‘নীল গয়নার মতো বাড়ি;, ‘ বাপ্পাদিত্য’, ২০১৮-র ‘সবুজ কাঠের পার্টিশন’ এবং ২০২১-এর ‘মৃত্যু ও ময়ূর’ আমাদের দেখায় ক্রম পরিবর্তনশীল এক ভাবনাবিশ্বে সুদীপ বসুর কাব্যচর্চার ভিন্নমাত্রায় এবং বহুস্বরে অবস্থান।
কবি হিসেবে যদি আমরা সুদীপ বসুর আত্মবয়নকে এভাবে দেখি, তাহলে মনে হয়, তাঁর কাব্যব্যক্তিত্বকে কিছুটা বুঝতে পারব। ১৯৯৪ থেকে ২০২১ পর্যন্ত এই কাব্যগ্রন্থগুলি একটি গ্রন্থে সন্নিবিষ্ট হয়েছে। সপ্তর্ষি প্রকাশন থেকে প্রকাশিত ‘কবিতাসংগ্রহ’ -র ভূমিকায় তিনি লিখছেন, ” আজো অনেক বছর পর সে ভেবে দেখবে কোন মরিয়া মায়া আজন্ম ঘুরিয়ে মারল তাকে। ঘুরে ফিরে পাঁচটি শব্দই মনে পড়বে তার- খিদে, তাড়না, খিদে, তাড়না, অন্ধকার।”
আর আমরা যদি তাঁর ট্র্যাপিজ কবিতাটিকে ধরি, তাহলে বলতে হয়, এই কবিতাতে আমরা কবি সুদীপ বসুকে কিছুটা হলেও ধরতে পারি হয়তো। তিনি লিখছেন, ” একটা অস্পষ্ট কেউ আমার সঙ্গে খেলতে চায়/ একটা অসম্ভব কেউ আমার সঙ্গে খেলতে চায়/ আমি না বলে দিয়েছি”।
শোভন পাত্রর প্রচ্ছদ, সপ্তর্ষি প্রকাশনের প্রোডাকশন যথাযথ।
হিন্দোল ভট্টাচার্য