উঁকিঝুঁকি, আয়না ও দু’চারটে দিন পঞ্চম পর্ব   <br /> কৃষ্ণালক্ষ্মী সেন

উঁকিঝুঁকি, আয়না ও দু’চারটে দিন পঞ্চম পর্ব
কৃষ্ণালক্ষ্মী সেন


বাড়ি থেকে একবার বেরিয়ে পড়তে পারলে এই খাওয়াদাওয়ার ঝঞ্ঝাট থেকে মুক্তি। ঝঞ্ঝাট বলে ঝঞ্ঝাট! ‘রাজার অসুখ’-এর সেই গাছতলার ফকিরের কথা ধার করে বলতে ইচ্ছে হয়, ‘বরং যেদিন খাওয়া হয়, সেদিনই হাঙ্গামা বেশি। ভাত মাখোর, গ্রাস তোলরে, মুখের মধ্যে ঢোকাওরে, চিবোওরে, গেলোরে— তারপর জল খাওরে, আঁচাওরে, হাত মুখ মোছরে! কত রকম কাণ্ড!’ ফকির তো শুধু এটুকু বলেই চুপ করেছেন। আর কথা? মাসের তিরিশ দিনে চারবেলা কী খাওয়া হবে, রান্না হবে, কাটা হবে, ধোওয়া হবে, বাটা হবে— এসব ঠিক করতে করতে মগজের যে পরিমাণ খাটুনি হয়, তার অর্ধেক খাটুনি দিয়েই কালিদাস তাঁর পরম কাব্য ও মহৎ নাটকগুলি লিখে ফেলতে পেরেছিলেন। ‘চিনি খান যিনি, যোগান চিন্তামণি’— বাইরে বেড়াতে বেরিয়ে খুব খানিকটা ব্যোম ব্যোম করে ঘুরে, ফেরার পথে কোনও এক চিন্তামণির খাবার ঠেক-এ (হতে পারে তা কোনও হোটেল, রেস্তোরাঁ অথবা রাস্তার ধারের দোকান।) ঢুঁ মেরে পেট ভর্তি খেয়ে নিলেই ব্যাপারটা একরকম চুকে যায়। কিন্তু সংসারের ভিতর এ তত্ত্ব খাটে না। সেখানে চিন্তামণির যাবতীয় চিন্তাভার মাথায় নিয়ে মেয়েরা পরিপাটি চিনির ধারাবাহিক যোগান দিতে দিতে জীবনের অর্ধেক মিষ্টত্ব হারিয়ে ফেলে। সংসার বড় বিচিত্র এক জায়গা। পেট বড় বালাই।
আমি খাবার ঘরে ঢুকতেই একজন মাঝ বয়সী ভারী চেহারার লোক শালপাতার প্লেট নিয়ে এগিয়ে এসে একটি চেয়ার দেখিয়ে বললেন, ‘এখানে বসুন দিদি।‘
পরমুহূর্তেই আমার শালপাতায় মুড়ি ঘুগনি এসে পড়ল। সঙ্গে একটি গাঢ় সবুজ কাঁচালঙ্কা। খাসা খাবার। চেটেপুটে খেলুম।
খেতে খেতেই হঠাৎ ঘরের কোণে যেখানে খাবারদাবার সব রাখা আছে, সেখানে চেয়ারে বসে থাকা একটি মেয়ের দিকে চোখ গেল। এই ঘরের সাদামাটা সমস্তকিছুর ভিতরে মেয়েটি আলাদা করে চোখ টানে। ছিপছিপে দোহারা চেহারা, মুখটা একটু লম্বাটে ধাঁচের, টিকালো নাক, চোখে মোটা কালো ফ্রেমের চশমা। বয়স পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশি নয়। বাঁ হাতে একটি ঘড়ি এবং ডানহাতে মোবাইল। একবার চোখ পড়লেই বোঝা যায় মেয়েটি এখানকার নয়। ওর সৌন্দর্যে গ্রামীণ, আটপৌরে, এলোমেলো ভাবটিই নেই, উলটে বরং একটা ছিমছাম নাগরিক পরিপাটি ব্যাপার ওর উপস্থিতিতে, শরীরে, পা থেকে মাথা পর্যন্ত। মেয়েটি সামনের জানালা দিয়ে বাইরে একমনে তাকিয়ে আছে। কিছুই দেখছে না সম্ভবত, ভাবছে হয়তো কিছু। অতিথি হিসাবে এখানে যারা এসেছেন, তাদের সকলেরই প্রায় খাওয়া হয়ে গেছে বোধহয়, কেবল আমি এবং আরও দুজন— একটি পুরুষ ও একটি মহিলা নিঃশব্দে নিজেদের মতো খাচ্ছি। এই তিনটি প্রাণীর এই খাবার ঘরে উপস্থিতি এবং তাদের মুড়ি চিবোনোর কচমচ আওয়াজ— সবটুকুকেই উপেক্ষা করে মেয়েটি তাকিয়ে আছে। বাইরের দিকে। আনমনা। চোখে ওর কিছু দুঃখ লেগে আছে। কেন দুঃখ? কে মেয়েটি? স্কুলের ছাত্রী তো নয়। শিক্ষিকা? হতে পারে। গেস্ট? তাও হতে পারে।
খাওয়া শেষ করে দেওয়ালে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি হাতে এখন অনেকটা সময় আছে। দুপুরের স্নান খাওয়া ঢের পরের কাজ। অতএব কম্পাউন্ডের ভিতরেই এদিকে ওদিকে সেদিকে একটা ফাল্গুনী চক্কর দেওয়া যেতে পারে মন ভরে।
ঘুরতে বেরিয়ে আমার ঘুরতেই ভালো লাগে, দৌড়তে নয়। দু’দণ্ড সময় নিয়ে নিজের মর্জি মতো নাড়াচাড়া ও নড়াচড়া করে, খানিকটা আলসেমি করে যা কিছু দৃশ্যমান ও উপভোগ্য সেসবের সঙ্গে ঝিমঝিমিয়ে মিলেমিশে মুহূর্ত কাটাতে পারলে তবেই ঘুরতে বেরোনোর ঠিকঠাক স্বাদটুকু পাই এবং নিজেকে মানুষ বলে মনে হয়। না হলে ঘোরানোর নাম করে ট্যুর কোম্পানিগুলো টিকি ধরে যে পরিমাণ ছুটিয়ে মারে, তাতে নিজের সঙ্গে রেসের মাঠের ঘোড়ার বিশেষ তফাত করা যায় না। এক খাবলা দৃশ্য থেকে খানিক পরেই আর এক খাবলা দৃশ্যে গিয়ে পড়তে না পারলে তাদেরও ব্যবসা চলে না, ভ্রমণপিপাসুদেরও পয়সা উসুল হয় না। আমি এমন মাপে মাপে কেটে রাখা ভ্রমণের বাইরের মানুষ। আমি ঘুরতে বেরবো এবং আমার উপর ঘড়ির কাঁটা রোজদিনের সেই একই টিক টিকে ছড়ি ঘোরাবে, এ আমার বিলকুল না-পসন্দ।
অফিসবিল্ডিং থেকে বেরিয়ে বড় বড় গাছ আর সেসব গাছের পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে গলে আসা রোদের আলো ছায়া ঠেলে হাঁটতে হাঁটতে খোলা এক মাঠের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বেশ, বেশ বড় মাঠ। মাঠের ঘাস যত্ন করে ছাঁটা। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এ মাঠে খেলাধুলো হয়। মাঠটাকে ডাইনে রেখে পায়ে চলার একটা সরু পথ ধরে আরও কিছুটা এগোতেই দেখলাম একটা পুকুর। তাতে জল খুব বেশি নেই, তবে কাকের চোখের মতো সে জল যেন বড় একখানা আয়না। পুকুরের চারধার গাছগাছালিতে ভরা, তারই আবছায়া পরিবেশটাকে অদ্ভুত, অপরূপ নির্জন করেছে। হাওয়ার একটা মৃদু শব্দ ও পোকা পতঙ্গের চাপা গুঞ্জন ছাড়া আর কিছু কানে আসে না। শুনশান, চুপচাপ চারপাশ। খুব শান্তভাবে এখানে একটা মুহূর্ত যায়, অন্য একটা মুহূর্ত আসে, এই যাওয়া আসার মাঝখানে নির্জনতাকে জড়িয়ে আমি দাঁড়িয়ে থাকি। গাছ থেকে শেষের হলুদ পাতাটি নাচতে নাচতে জলে এসে পড়ে। প্রতিটি মুহূর্ত আশ্চর্য নিবিড়, নিশ্চুপ। এই নির্জনতা আমি ভালোবাসি। এই প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা আমাকে নিয়ে খেলা করে— আমাকে আমার বর্তমান থেকে টেনে টেনে নিয়ে যেতে থাকে কোন এক দূর অতীতে অথবা প্রাগৈতিহাসিক কোনও এক পর্বে যেখানে কেউ নেই— যেখানে মানুষ নেই, আমার কোনও পূর্বসূরি নেই, নেই পিতামহী, প্রপিতামহীর দল। শুধু গভীর গহীন অরণ্যানী সূর্যে-চাঁদে, দিন-রাতে তার রহস্যময় যাবতীয় ডালপালা মেলে পৃথিবীর ভিতরে ভিতরে চারিয়ে পড়ে, পৃথিবীর বুকে, মাটিতে শিকড় ছড়িয়ে চালাতে থাকে তার লীলাখেলা।
বসন্তের কচি পাতার আড়াল আবডাল দিয়ে জলের উপর এসে পড়েছে জাফরিকাটা রোদ, টুকরো টুকরো ঝকঝকে নীল আকাশ আর বলিষ্ঠ গাছেদের প্রতিচ্ছবি। ঘাটের সিঁড়ি থেকে ঝুঁকে মুখ বাড়িয়ে দেখছি জলের আয়নায়— আমার আমি। তবে জলের মৃদু কাঁপনের তালে তালে কোনও প্রতিচ্ছবিই স্থির নয়— সবই ভেঙে ভেঙে দূরে সরে যাচ্ছে। আমার আমিও।
এখানে থেকেই আচমকা চোখে পড়ল একটা ধোঁয়ার কুণ্ডলী। দূরে। বেশ খানিকটা দূরে। পাক খেয়ে খেয়ে আকাশে উঠছে ধোঁয়া। ঈশাণ কোণ বরাবর। ওখানে ধূম আছে অতএব দর্শনে বহ্নিও আছে। কিন্তু ব্যাপারটা কী?— ফাগুনে এত ধোঁয়া কেন? ফাগুনে আগুন কেন?
ধোঁয়ার কুণ্ডলীকে নিশানায় রেখে হাঁটতে শুরু করলাম। বেশ খানিকটা হাঁটার পর দেখি কয়েকশো মিটার দূরে এই বিদ্যাসাগর ফাউন্ডেশনের কম্পাউন্ড শেষ হয়েছে এবং চোখে পড়ল পুরুলিয়ার প্রাচীর। একটা ইটের গাঁথুনির দেওয়াল এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত অনেকখানি দৈর্ঘ্যে দাঁড়িয়ে আছে। এই দেওয়ালই এপারের শেষ সীমানা। তারও পরে আরও বিস্তীর্ণ মাঠের সারি, তালগাছের সারি, উঁচু-নিচু আলপথ, বাবুইপাখির ঘর নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে টামনা। সেসব অন্য ঠিকানা। এপারে যেখানে দেওয়াল উঠেছে তার খুব কাছেই দেখি দুটো বড় বড় উনুন জ্বলছে। ও! ধোঁয়ার উৎস তবে এই। সেই উনুনের উপর দুটো অতিকায় হাঁড়ি চাপানো। কী তৈরি হচ্ছে?— খাবার কিছু? হঠাৎ অনেক পুরোনো হয়ে যাওয়া ছোটবেলার একটা চেনা গন্ধ নাকে এসে লাগল। ধান সেদ্ধ হলে এমন গন্ধ ওঠে— সোদা সোদা ভারি অদ্ভুত গন্ধটা— খানিকটা ভাত-গন্ধ মেশানো— অনেকদূর পর্যন্ত চারিয়ে যায়।
উনুন দুটো মাঠের উপরেই মাটি দিয়ে তৈরি। মেঠো হাওয়ার হাত থেকে আগুন বাঁচানোর জন্যে উনুনের চারপাশ, অনেকটা জায়গা জুড়ে ত্রিপল, চটের বস্তা দিয়ে ঘেরা। দেখি, উনুনের সামনে বসে এক মহিলা খড়ের আঁটি এক ঝটকায় ছিঁড়ে ফেলে একগোছা একগোছা খড় ভাঁজ করে উনুনে ভরে দিচ্ছে। জ্বালানি পেয়ে উনুনের ভিতরকার আগুন দপ করে জ্বলে শিখায় শিখায় নেচে উঠছে। সঙ্গে ভুসভুসিয়ে ধোঁয়া। খড়ের জ্বাল বলে ধোঁয়া বেশি। ধোঁয়া লেগেই বোধহয় মহিলার চোখ থেকে জল বেরিয়ে আসছে আর থেকে থেকে সে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছছে।
তারই পাশে মাঠের অনেকখানি জায়গা গোবর-মাটি লেপে তকতকে, পরিষ্কার করে সেদ্ধ ধান ঢেলে রোদে মেলে দেওয়া রয়েছে। এক বয়স্ক লোক, হাঁটুর উপর খাটো ধুতি কোঁচা মেরে পরে সেই ধানগুলি পায়ে করে একদিক থেকে আর একদিকে টেনে নিয়ে গিয়ে ওলট পালট করে নেড়ে চেড়ে দিচ্ছে। মাথার উপর রোদ এখন আগের চেয়ে অনেক ঝাঁঝালো। মানভূমে রুখু মাটির দেশে রোদের আমেজ এমনই— যত তার রং, তত তার তাপ। চারদিক গাঢ় সোনালি রঙে ভরে গেছে। মেলে দেওয়া ধানের গায়ে রোদের ছিটে লেগে সেই সোনালি রং যেন আরও জমকালো, আরও উজ্জ্বল হয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে, অযোধ্যা পাহাড়ের কোল ঘেঁষে থাকা কোনও এক অজানা সোনার খনি থেকে ঝুড়ি ঝুড়ি সোনা তুলে এনে ওই বুড়ো লোকটা মানভূমের মাটিতে মেলে দিয়েছে। তারপর খেয়াল খুশিতে গান গাইতে গাইতে সে পাহারা দিচ্ছে তার যত সোনার সম্পদ—

ঝিঙা ফুল বলেরে ভাই ঝাঁটি ধারে বাসা
মাইয়্যা ছ্যালা তুলতে গেলে লাগে বড় আশা
ভাই হে বিদেশি বন্ধু
ঝিঙা ফুল ছুঁইও না ছুঁইও না ভাই হে বিদেশি বন্ধু।
সজনা ফুল বলে বর ভাই সকল ফুলের হেলা
আমাকে আকারে ভাই টানাটানির বেলা—
হে বিদেশি বন্ধু…।।

লোকটা খোলা মাঠে নিজের মনের আনন্দে গলা ছেড়ে গাইছে। আমি কান পেতে তার গান শুনতে শুনতে রাশিকৃত সোনার ধানের একদম কাছে পৌঁছে গেছি। হঠাৎ আমাকে দেখতে পেয়ে গায়ক গান থামিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
লোকটার বয়স ষাট, হ্যাঁ ষাটের কাছাকাছি তো হবেই। তবে শরীরটা তার খুব মজবুত, ভাঙনের কোনও চিহ্ন নেই। মাথার চুলে বেশ পাক রং ধরেছে বটে, কিন্তু বুকের ছাতি ও পেশিবহুল হাত পা দেখে বোঝা যায় লোকটা এখনও দারুণ কর্মক্ষম।
নিস্তব্ধতা ভেঙে আমিই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘এখানে কি তোমরা ধান সেদ্ধ করছ?’
মানুষটা আমার দিকে দু’এক পা এগিয়ে এসে উত্তর দিল, ‘হ, ধান ভাপাইচি, চাল হবে। তা তুমি কে বটে? আগে তো দেখি লাই। ইস্কুলের লতুন দিদিমুনি?’
আমি বললাম, ‘না, এখানে ঘুরতে এসেছি, চারপাশটাকে দেখতে এসেছি। কাল এখানে সকলের সঙ্গে বসন্তোৎসব পালন করব।‘
এবার সে লোক একটু হেসে ঘাড়টাকে সামনে বার দুয়েক দুলিয়ে বলল, ‘হ, হ… কাল কাল। বড় মান্‌ষে, ছোট মান্‌ষে কত্ত ফাগ উড়াইব। ইস্কুলের বিটিগুলান সাজব খুব, চুলে ফুল পিঁদব — ই পলাশ ফুল, কত্ত নাচব, গাইব সব।‘ — বলে, হো হো করে ছেলেমানুষের মতো হেসে উঠল।
আমিও খানিকটা মুচকি হেসে বেশ উৎসাহ প্রকাশ করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি এখানে অনেকদিন আছ?’
‘তা হবে বটেক পনের বচ্ছর।‘ এই বলেই লোকটি তার দুই পায়ে লেগে থাকা ধান কাঁধের গামছা দিয়ে ঝেড়ে নিল ফট ফট শব্দ তুলে। খানিক পরে আমার দিকে তাকিয়ে আবার বলতে শুরু করল, ‘সেই যে বচ্ছর জেলের দারোগা আস্যা কইলি, বিশুয়া হাঁসদা, তুকে আর মুরলীকে এবার খাল্যাস দিলি। তুদের ছুটি। তারপরেই এখানে দুজনে আসিছিলি, সেই অব্দি আছি।‘ কথাগুলো শেষ করেই লোকটা এবার উনুনের সামনে বসে থাকা স্ত্রীলোকটির দিকে তাকাল।
মহিলা তখনও সেই একই ভঙ্গিতে উনুনে খড়ের জ্বাল দিয়ে চলেছে। তবে তার সবটুকু নজর ও মনোযোগ এখন আমাদের দিকে। বিশুয়া হাঁসদা তাকে দেখার পর আমিও যখন তার দিকে ঘুরে তাকালাম, তখন সে একটা কিছু ভেবে অনেকটা খড় উনুনের মুখে গুঁজে দিয়ে, আমরা যেখানটায় দাঁড়িয়েছিলাম, মাঠের সেদিকটায় এগিয়ে এলো। খানিকটা ভিতু ভিতু ভঙ্গিতে একেবারে লোকটার বাঁ পাশে গিয়ে দাঁড়াল।
কলকাতার এক মিউজিয়ামে একবার পুতুলের সংগ্রহ দেখেছিলাম। বিভিন্ন রাজ্যের ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির, ভিন্ন ভিন্ন পেশার মানুষের সব পুতুল পুতুল রূপ। সেই সংগ্রহ যেমন রঙিন, তেমনই বৈচিত্র্যময়। আজ এই খোলা আকাশের নিচে প্রখর উজ্জ্বল বসন্তে জমজমাটি রোদের ভিতর দুপুরবেলায় মানভূমের রুক্ষ শুষ্ক উত্তপ্ত মাটিতে দাঁড়িয়ে এই দুই মানুষের মধ্যে— মহানগরের সেই মিউজিয়ামে দরিদ্র, অশিক্ষিত, পরাজিত অনার্যজাতির নারী-পুরুষের যে পুতুলমূর্তি দেখেছিলাম, তেমনই— এক অনার্য যুগল-মূর্তির জীবন্ত রূপ আমি প্রত্যক্ষ করছি। বিশুয়া হাঁসদা আর মুরলী যেন আমার সেই আদিম ভারতবর্ষ, যেখানে অনার্য জাতির ইতিহাস খোদিত আছে তাদের কালো কালো সবল চেহারার, পেশীতে, পোশাকের অনাড়ম্বরতায়, পারিপাট্যহীন অগোছালো জীবনবাসে এবং অদ্ভুত সরলতায়।
কী আশ্চর্য! দেশের আদি আদিম মানুষেরাই তাদের নিজস্ব ভূমিতে উপেক্ষিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত। আকাশচুম্বী বাসস্থান এবং আধুনিকতা নিয়ে দর্পিত আর্যের দল একুশ শতকেও তাদের অনগ্রসরশ্রেণির বন্ধনীভুক্ত করে কেবল বিজয়ের ইতিহাসকেই টিকিয়ে রাখতে চায়। অথচ এই অনার্যজাতির মানুষগুলিকে নিয়েই ভারতবর্ষের কত কত ইতিহাস: বীরত্বের ইতিহাস, বিদ্রোহের ইতিহাস, বিপ্লবের ইতিহাস,
তবু কী এক পরিহাসে অনার্যজাতির ইতিহাস ভারতবর্ষের মূল অধ্যায়ে আজও সংযোজিত হল না।
আমি আন্দাজ করেইছিলাম, বিশুয়াও মুরলীকে দেখিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলল, ‘দিদিমুনি, ও মুরলী, আমার মাইয়্যামানুষ বটে।‘
কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে থাকলে এই রকম পরিচয় পর্বে পোশাকি ঢঙে হয়তো একটা রাজকীয় নমস্কার করতাম। কিন্তু এখানে তা, এই মানুষ দুটির সামনে এতই বেমানান যে, সে সবের ধারপাশ দিয়ে যেতে ইচ্ছে করল না। বরং মুরলীর বাহুমূলের কাছে হাত রেখে বললাম, ‘আমাকে একটু জল খাওয়াবে মুরলী? তোমার কাছে জল আছে? খুব তেষ্টা পেয়েছে।‘
সূর্য এখন ঠিক মাথার ওপরে। এবার যেন সে তার আলোর আগল পুরোপুরি খুলে দিয়েছে এবং হুড়মুড়িয়ে রোদ এসে পড়ছে পুরুল্যের মাটির উপর। রুখু পাথুরে দেশে মাটি তেতে উঠছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বসন্তের কোমলতাগুলি প্রকৃতির শরীর থেকে সরে যাচ্ছে একটু একটু করে। কঠিন হচ্ছে রূপ। গোটা সাঁওতাল পরগনা জুড়ে গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহের যে করাল ভৈরবী মূর্তি জেগে ওঠে— খোলা মাঠের মাঝে দাঁড়িয়ে এখন থেকেই যেন তার একটা আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
আমার কথা শুনে মুরলী কোনও উত্তর না দিয়ে আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল।
উলটে বিশুয়া বেশ খানিকটা ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলে উঠল, ‘হ দিদিমুনি, ঘরকে চল। জল দিব। খাবে। মুরলী তো গুঙা, কিছু কইতে পারে না।‘
বুঝলাম, মুরলী ভালো শুনতেও পায় না।
বিশুয়া তাকে আকারে ইঙ্গিতে ব্যাপারটি বুঝিয়ে দিতেই প্রৌঢ়া সাঁওতাল রমণী প্রথমেই বুঝি তার ইন্দ্রিয়ের অপারগতায় খানিকটা লজ্জিত হল। তারপরেই সে একটু চঞ্চল হয়ে উঠল নিজের মধ্যে, যেন সে অতিথি আপ্যায়নের জন্যে এখনই খানিক আয়োজন করতে চায়। খানিকটা দূরে একটা মাটির ঘরের দিকে আঙুলের নির্দেশে মুরলী বোঝাল সেটাই তার ঘরদুয়ার। আমার হাত ধরে টান দিল সে।
বুঝলাম, এখন আমার সেখানেই নিমন্ত্রণ।
আমরা তিনজনেই মাঠ ছেড়ে ঘরের দিকে পা বাড়ালাম।

(ক্রমশ)

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes