
এক পাঠকের বৈঠক
সব্যসাচী মজুমদার
আমাদের পড়াশোনা, পড়ে, জেনে যাওয়া — ভেতরে যে কত দুরূহ পথ, কত যে হাতছানি, ভেতর – বাহির ! কিভাবে পড়ব, কেমনভাবে পড়ব, আমার পড়ার ওপর কি টেক্সটের শৈলীর প্রবণতা বিবর্তিত হবে, নাকি আমিই বিবর্তিত হব ? নাকি, পাঠ ও পাঠকের দ্বন্দ্বে তৈরি হবে আরেকটি টেক্সট ! এহেন, বিবিধ প্রশ্ন একজন পাঠক হিসেবে প্রায়ই নিজেকে করতে হয়। অন্তত আমার তো বটেই। আরও আছে, একটা রচনা কখন একটা টেক্সট হয়ে উঠবে, অথবা উঠতে চেয়েও পারবে না ? কেন পারবে না ? অথবা কোন ধরণের রচনা আমার, আমার সময়ের কাছে আর প্রয়োজনীয় নয় ? তাও তো গদ্যে কিছুটা থই পাওয়া যায়। কিন্তু বাংলা কবিতা পড়তে গেলে থই মেলা খুবই দুস্কর। এত পরস্পর বিরোধী ও ঘরানাগত মত প্রচলিত যে আমাদের মতো নভিশ পাঠককে হিমসিম খেতে হয় পাঠক হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করতে। এখানেও একটা প্রশ্ন আসে, যে, পাঠক কী সমস্ত ক্ষেত্রেই নিজের একটি নির্দিষ্ট অবস্থান থেকেই দেখবেন পাঠ্য’কে ? নাকি পাঠ্যের বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাবে তার পাঠক হিসেবে অবস্থানটিও ?
এখন, এতো প্রশ্ন নিয়ে পড়া যায় নাকি ! তা কেন পড়ে অথবা পড়ার আগে যদি এই প্রশ্নগুলো যদি নিজেকে না করি মানবেতিহাসের সামান্য অংশেরও পাঠক হিসেবে দাবি করতে পারব কী ! আর যদি সেই দাবি না করতে পারি, তবে, পড়াশোনা বাদ দিয়ে বাসন মাজলে পৃথিবীর এবং নিজেরও অনেক বেশি লাভ। বস্তুত সাহিত্য পড়ে তো পার্থিব লাভ প্রত্যক্ষত খুব বেশি হয় না। না পড়েও সুখে শান্তিতে ঘরকন্না করে দিব্য সমাজে উচ্চ অবস্থান রেখেই মৃত্যু বরণ করা যায়।
এখন, আমরা যারা নব্বই দশকে মফসসলে বড় হয়েছি, আমাদের কাছে বিনোদনের একটি অন্যতম অংশ হিসেবে তখনও বই প্রাসঙ্গিক ছিল। মনে হয়, সেই শেষ। তারপরের দশক থেকে বই একটি গৌণ মাধ্যমে পরিণত হল।তার ফলে যে জ্ঞান বা বিদ্যাচর্চা কমেছে এমন দাবিটি করছি না। আমার মনে হয়, একই রয়েছে। কিংবা এই প্রবণতা শুভ নয় — এটাও আমার দাবি নয়। আমার বলতে চাওয়ার হল, ওই নব্বইয়ের অন্যতম স্বভাব হিসেবে বই পড়া আমাদের কারওর কারওর কাছে অনিবার্য হয়ে গিয়েছে। স্বভাবতই এই প্রশ্নগুলোও জরুরি হয়ে পড়ে, পাঠের কাছে আত্মসমর্পণকারী পাঠকের কাছে। এবার আরও একটি তর্ক আসে। আবিশ্বের বিবিধ গ্রন্থে ও প্রসঙ্গে বিষয়গুলো নিয়ে তুঙ্গ আলোচনার পরেও কেন এই প্রশ্নগুলির কাছে যাওয়া ! আসলে প্রত্যেক পাঠকের যেমন একটা সর্বজনীন সমস্যা থাকে, আবার প্রত্যেক পাঠকেরই একটা নিজস্ব সংকটও তৈরি হয়। সেই চিন্তা থেকেই এহেন চেষ্টায় এগনো।
এখন, এই প্রশ্নগুলিকে স্পর্শ করতে গেলে আমাদের প্রথমেই মনে রাখতে হবে, আমাদের পরস্পর বিরোধীতাগুলিকে। যেমন, বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে যদি আমরা লক্ষ্য করি, একটি ধারণা চালু আছে যে, কবির একটি নির্দিষ্ট স্বর বা পরিচিতি থাকবে। এবং তিনি সেই একধরনের রচনাকেই সারাজীবন তাঁর লেখার ভঙ্গি হিসেবে রেখে যাবেন। বাঙালি পাঠক আরও চান যে তিনি তাঁর বক্তব্য বিষয়ে অটল থাকবেন, যাতে তাঁর রচনাকে সহজে চিহ্নিত করা যায়। এখন, কবিতার পাঠক যদি এরকম চেয়ে থাকেন, তবে প্রাসঙ্গিক থাকার জন্য কবিকেও অনেক সময় প্যাটার্নের প্রেমে পড়তে হয় বলে দেখা যায় না যে তা নয়।
অর্থাৎ, একটি রচনা কৌশল পাঠক প্রিয়তা পেলে, দেখা যায়, কবি সেই কৌশলই অবলম্বন করে বারবার লিখে রাখতে চান তাঁর কথাকে, তাঁর বার্তাকে। অর্থাৎ আমরা এভাবে দেখতে পারি, একটা স্তর পর্যন্ত তপস্যা করে কবি অতঃপর একটি ইন্সটিটিউশন হলেন। এবং এই ইনস্টিটিউটের গণ্ডিকে অনতিক্রম্য হিসেবে সাব্যস্ত করলেন। তিনি নিজে যেমন সেই শিক্ষালয়ের ভেতরে বসে রইলেন, তেমন চাইলেন অন্যান্য স্বরও সেই আলয়ে মিশে যাক। একটি একটানা কোরাস তৈরি হোক। এটি অবশ্যই সু-আকাঙ্খা। এর ফলে দুটি বিষয় ঘটে থাকে। প্রথমত কবি জীবদ্দশায় কিছুটা পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারেন। দ্বিতীয়ত, তাঁর কবি জীবনের দীর্ঘীভবন ঘটে থাকে। অন্তত ঐতিহাসিক তাৎপর্যের কারণে তো বটেই। আমাদের এতটুকু পড়তে পড়তে নিঃসন্দেহে মনে পড়ে যাচ্ছে, বুদ্ধদেব বসু রচিত অতিখ্যাত প্রবন্ধ ‘ রবীন্দ্রনাথ ও তাঁর উত্তরসাধক ‘ রচনাটির কথা। সেখানে অবশ্য যে পর্বটি আলোচিত, রবীন্দ্রনাথ তখনও নিজে ইনস্টিটিউশন হয়ে ওঠেননি, কিন্তু তার আগেই বাংলার তৎকালীন কবিকুল কর্তৃক তাঁকে ইনস্টিটিউশন বানিয়ে দেওয়ার নিপুণ বর্ণনা আছে। সেটি কতটা রবীন্দ্রনাথের অনিচ্ছায় ঘটেছে তা বলা হয়নি অবশ্য, তবে ঘটেছিল। এবং সেক্ষেত্রে সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের মতো আশ্চর্য শক্তি সম্পন্ন কবিই কেবল স্বকীয়তা প্রদর্শনে সমর্থ হয়েছিলেন। নজরুলের মতো সম্পূর্ণ বিপরীত প্রেক্ষায় নয়, বরং, অনেক বেশি প্রচ্ছন্নে স্বতন্ত্র হয়েছেন সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। কিন্তু, যেখানে তাকাতে চাইছি, রবীন্দ্রনাথের মতো করে লেখার ফল বশত বুদ্ধদেব নির্দেশিত ‘ রবীন্দ্র অনুসারী কবি সমাজ ‘ সমকালীন পরিচিতি যেমন পেয়েছিলেন, পেয়েছেন উত্তরকালীন উল্লেখও। কিন্তু, প্রশ্ন থেকে যায়, এতে তাঁদের ব্যক্তিগত ক্ষতি কী ? কিছুমাত্র নয়। ক্ষতিটা টেক্সট এবং পাঠকের। এবং ক্ষতিটা দু’দিক থেকে। প্রথমত চিন্তা একটি নির্দিষ্ট অবস্থান নিয়ে তার প্রতিষ্ঠা ঘটাবে। যার ফলে, চিন্তার স্থবিরতা লক্ষ করব আমরা। প্রতিষ্ঠা বাসনা তো স্থবিরতার ঋত্বিক হিসেবে কাজ করে। দ্বিতীয়ত পাঠকের আকাঙ্খাও তীব্রভাবে সেই স্থির এবং অনতিক্রম্যমনা চিন্তাতেই নিষ্কৃতি লাভ করবে। যার ফলে গোটা পৃথিবীর চিন্তার অবস্থান আরও কেন্দ্রহীন বিমূর্ত হওয়ার পথে যাত্রা করলেও অনতিক্রম্যমনা একটি অত্যন্ত প্রাতিষ্ঠানিক ও শিক্ষালয় কেন্দ্রিক নির্দিষ্ট চিন্তার স্মারক হয়ে থাকবে আমার, আমাদের পড়াশোনা।
মধ্যযুগের কাব্যে আমরা দেখেছি, নির্দিষ্ট বিষয়কে ( প্রধানত দেবদেবী ) কেন্দ্র করে গড়ে উঠছে নির্দিষ্ট ছাঁদের কাব্য। সকলেই একই জিনিস লিখে চলেছেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ ভাষা এবং নিজস্ব কিছু সংযোজনার দৌলতে কখনও কখনও কবিত্বে কিংবা চ্বকিত কবিত্বে পাঠকের স্মরণে রয়েছেন। কিন্তু, এসব রচনাই মানুষ এবং দেবতার লৌকিক, অতিলৌকিক সম্পর্কের বিন্যাসের মধ্যেই ঘোরাফেরা করার চেষ্টা করত। মুকুন্দ চক্রবর্তীর মতো কেউ কেউ কিছু দৈনন্দিন প্রশ্ন তুলেছেন। অন্তত চর্যাপদের মতো করেও মধ্যযুগ মৌলিক প্রশ্নের দিকে বিশেষ এগোতে চায়নি। এক্ষেত্রে পার্থিব মৌলিক প্রশ্নকে মনে রাখতে চাইছি। অপার্থিব অস্তিত্বের মধ্যেই প্রবেশ করতে চেয়েছিল সম্ভবত মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য। কিন্তু, তাও একমুখীন। বলতে চাইছি না যে, আঠেরোশো খ্রিস্টাব্দ থেকেই বাংলা কবিতার প্রবণতা অন্যপথে এগোলো, কিন্তু, মোটামুটি করে ভারতীয় শিল্পবিপ্লবের পর এবং বর্তমানে বিশ্বায়নের পরে তো আরওই বাংলা কবিতার প্রবণতা সমাজ মনস্তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছে। এই সময়কালে প্রধানত বিশ্ব সাহিত্য – বিজ্ঞানের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপন ও স্বাধীনতা স্পৃহার উজ্জাগরণ, কমিউনিস্ট পার্টির আগমন এবং দেশভাগ, কমিউনিস্ট পার্টির ক্ষয়িষ্ণু দশার উৎপত্তি ( উনিশশো আশির দশকের শেষ ) এবং বিশ্বায়ন’কে যদি প্রধান চিহ্ন হিসেবে সাব্যস্ত করতে চাই, তাহলে, এই সময়কালের বাংলা কবিতার নিবিড় পাঠ নিলে আমরা বোধহয় একমত হব কবিতা আরও বিস্তৃত, কূট ও বহু বর্ণে বিচ্ছুরিত হয়েছে। বলতে চাইছি, জীবন অনেক বেশি তথ্য সমৃদ্ধ হয়েছে। তথ্যের সংরক্ষণ সম্ভব হয়েছে। এই পৃথিবীর প্রতিটি পরস্পর বিরোধী তথ্য আমাদের জ্ঞেয় হয়ে চলেছে। কেবল দু’ টি পক্ষের দ্বন্দ্ব নয়, তথ্য এখন বহুমুখী ও বহু পাক্ষিক দ্বন্দ্ব নির্মাণ করতে সক্ষম। এই বহু পাক্ষিক দ্বন্দ্বের কারণেই মানুষের দৃষ্টির … বিষয়কে দেখার দৃষ্টির অবস্থান বদলেছে। মানুষ ব্যতিরেকে সে অন্য প্রাণের সাপেক্ষে এই জায়মানকে দেখার চেষ্টা করেছে। এমনকি সে মানুষের সমাজের ও সমাজ চরিত্রের প্রত্যেকটি শেডকে ছুঁতে চেয়েছে। লিখতে চেয়েছে। বিষয়কে অতিক্রম করে আরও বিষয়হীনতার দিকে সফল পদক্ষেপ রেখেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ঋত্বিক নির্বাচন করে। এবং আমরা এও বুঝতে পারছি যে সত্যি বলে কিছু হয় না। অথবা, সবটাই সত্যি। ফলত একটি নির্দিষ্ট চিন্তাকে কেন্দ্র করে অন্যান্য চিন্তাকে ভ্রান্ত ভেবে বিষয়কে দেখাটা প্রাচীন না বলে পরিত্যাজ্য চিন্তা মনে করাই সম্ভবত শ্রেয়। এবং এই প্রবণতাকে অতিক্রম করতে পেরেছে বলেই বাংলা কবিতার ধারণ ক্ষমতাও বেড়েছে বহুগুণ।
আমরা এও জানি বিষয়হীনতার দিকে, বিমূর্তের দিকে বাংলা কবিতা যত এগোচ্ছে, ততই সে বহু এবং পরস্পর বিরোধী তথাকথিত সত্যকে গ্রহণ করেছে একযোগে। কেবল গ্রহণ নয় একই সঙ্গে বর্জনের ও সঙ্গে সঙ্গেই নতুন গ্রহণের প্রক্রিয়াটাও জারি রাখে। অর্থাৎ একটা পর্যায়ে পৌঁছে আবার সেই পর্যায়কে ভেঙে নতুন পর্যায়ের দিকে ক্রমাগত ধাবমান থাকাটাকেই বাংলা কবিতাও সাব্যস্ত করেছে কবিতারই স্বভাব প্ররোচিত হয়ে। কবিতাই তো সম্ভবত সদা অস্থির। সেই তো কবিকে একটি অবস্থানে পৌঁছিয়ে দিয়ে অসহিষ্ণু করে তোলে পরবর্তী পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার জন্য। এই স্বভাবটি সবচেয়ে ভাল বোঝা যায় রবীন্দ্রনাথ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং জয় গোস্বামীর মধ্যে। এরকম বহুল উদাহরণ রয়েছে বাংলা কবিতায়। স্পষ্ট বোঝা যায় যাঁদের সাহিত্য কর্মে, এক্ষেত্রে তাঁদের উদাহরণ নেওয়া হল মাত্র। এখন, তবুও, এই রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, উৎপল কুমার বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, রমেন্দ্রকুমার আচার্যচৌধুরী, দেবদাস আচার্য , জয় গোস্বামী, শ্যামলকান্তি দাশ, সুবোধ সরকার, মণীন্দ্র গুপ্ত, দেবারতি মিত্র, মল্লিকা সেনগুপ্ত, মৃদুল দাশগুপ্ত প্রমুখ যাঁরা আজীবন আত্মদ্বন্দ্বের ফসল লিখে গেলেন, রেখে গেলেন সেল্ফ কনট্রাডিকশনের বিপুল সম্পদ, তাঁদের লেখার পরেও আমাদের অনেকেরই স্থির বিশ্বাস যে একরকম লিখতে না পারলে কবির পরিচয় তৈরি হয় না। মনে রাখা ভাল, একরকম লিখেও কিন্তু, রামায়ণ বা মহাভারতে কেবল বাল্মীকি আর কৃষ্ণ দ্বৈপায়নই পরিচয় নির্মাণ করতে পেরেছিলেন।আর বাকি শয়ে শয়ে কবির পরিচয়কে কিন্তু ওই বাল্মীকি বা কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন গ্রাস করে নিয়েছেন। মানে বলতে চাইছি শতকের পর শতক একাধিক কবির সহস্রাধিক শ্লোকের সংযোগে গড়ে উঠেছে আজকের মুদ্রিত রামায়ণ বা মহাভারতের শরীর। তবুও ওই দুটি নামই সহস্রাধিক বছর ধরে সাব্যস্ত হয়ে আছে, বাকিরা সেই পরিচয়ের মধ্যেই অস্ত গিয়েছেন। কেননা তাঁরা আদি কবি প্রদত্ত সূত্র অনুসরণ করেছিলেন মাত্র।
সমসময়ের কবিদের মধ্যে যদি এই একরকম লিখে, অন্তত প্রভাবশালী কবির রচনা অনুসরণ করে লিখে পরিচিতির আলো পাওয়ার প্রবণতা থাকে, মনে হয়, তা কিন্তু আদৌ মন্দ হয়। এবং এতে ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলার পার্থিব জীবনের কিচ্ছু ক্ষতি হয় না। অপার্থিব জীবন বলে তো কিছু হয় না। ফলে সেখানেও কিছু ক্ষতি হয় না। পৃথিবীর ঘূর্ণনেও না। কিন্তু তিনি, যদি আশা করেন যে, তাঁর টেক্সটের জোরে বা টেক্সট বিক্রি করে তাঁর নাতিও পার্থিব জীবন বৈতরণী সুখে পার হোক; সেই ক্ষেত্রে, একমাত্র সেই দুরূহ সম্ভাবনার ক্ষেত্রেই বোধহয় কবি নিজেকে বিরোধীতা করেন। প্রতি মুহূর্তে ভাঙতে চান নিজেকে। অথবা কবি যদি ভাবেন, আমি উত্তর প্রজন্মের জন্য চিন্তা রেখে যেতে চাই। ভাবেন কী আদৌ !
এখানেই তাহলে একটি প্রশ্ন আসে। যিনি, প্রতি মুহূর্তে আত্মবিরোধীতার মাধ্যমে লিখে চলেছেন, যিনি সদর্পে ঘোষণা করে চলেছেন, ‘ do l contradict my self!/ Very well/ l contradict my self/ l contain multitude ‘ (হুইটম্যান) তাঁকে আমরা পরীক্ষা নির্ভর বলে সন্দেহে দেখতে চাইছি। আর যে কবিতা স্বস্থ হতে চাইছে পূর্বজের চরণচিহ্নে, তাকে আমরা , তার জনপ্রিয়তার চিহ্নগুলোকেই আমরা কবিত্বের নিদর্শন হিসেবে দেখতে চাইছি। তবে, কি আমাদের পাঠ প্রক্রিয়ার অভিমুখটি বিভ্রান্ত! নাকি আমরা কবিতাকে পেতে চাইছি নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে ? প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে নির্মাণ করতে চাইছি কবিতাকে ? বস্তুত, কবিতা সবসময় একটি নির্মাণ। কিন্তু, কিভাবে নির্মাণ করতে চাইছি তাকে ? পুনরাবৃত্তিই সব। তবুও সে আবৃত্তিকে নির্দিষ্ট না অনির্দিষ্টের কাছে রাখতে চাইছি — এটাই প্রশ্ন ।
তবে, এটাও ঠিক, আমাদের জীবন যাপনের প্রক্রিয়া আমাদের মনস্তত্ত্বের সঙ্গে সঙ্গে পাঠষ্ক্রিয়াকেও নিয়ন্ত্রণ করে বলে মনে হয়। ফলত আমাদের নিরাপত্তাকামী জীবন, নিরাপদে সামাজিক হয়ে থাকা পাঠক নিশ্চয়ই সুবিমল মিশ্র বা তুষার রায় অথবা ‘ উন্মাদের পাঠক্রম ‘ -এর সামনে স্বস্তি পাবেন না। তিনি নিশ্চয়ই চাইবেন এমন একটি টেক্সট যা তাঁর সামাজিক ফ্যান্টাসিকে তৃপ্ত করবে। তিনি নিঃসন্দেহে এমন শব্দ সঞ্চারের আশা করবেন , যে শব্দ সমূহ তাঁর চিন্তাকে উদ্বিগ্ন করে তুলবে না।সেই টেক্সটকেই তিনি নিঃসন্দেহে তাঁর শ্রমের অর্জন দিতে চাইবেন। ফলত উল্টো দিক থেকেও লেখক চাইবেন, তাঁর শ্রমেরও মূল্য পেতে। এবং সেই সূত্রে পাঠকের বাসনাকে মেনে নেবেন। এই মিথোষ্ক্রিয়া নিশ্চয়ই সেই টেক্সটের জন্ম দেবে, যে টেক্সট অবিকল প্রতিধ্বনিতে বিশ্বাস করে।
আমাদের পাঠ প্রক্রিয়ার আরেকটি বড় আত্মবিরোধীতা বোধহয় প্রতিনিয়ত পুঁজির নির্মাতা ও পুঁজির ধারক হয়েও আমরা পুঁজিকেই শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করি। কবিতার বাণিজ্যিকীকরণ আমাদের অপছন্দের একটি বিষয়। এখানেও বোধহয় একটি নির্দিষ্ট অভিমুখ তৈরি হয়ে যায়। একদা বুদ্ধদেব বসু প্রদত্ত একটি চেতাবনির কথা মনে পড়ে, নেশা সহজেই কেটে যায় , কিন্তু পেশা হলে তা ক্রমশ সাবালক হয় “।
একে তো তৃতীয় বিশ্বের দেশ, তার ওপরে অর্থনৈতিক সমবণ্টনের রেখা এখানে প্রায় বিলুপ্ত, ফলত অত্যন্ত সংগত কারণেই এদেশের মানুষ সামাজিক মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করে তবেই সাহিত্যের কাছে আসবে। তাও অধিকাংশ মানুষ আসবেন বিনোদনের জন্য। ফলত এডভেঞ্চার জাতীয় গদ্য তাঁদের পছন্দ হবে। এইসব পাঠকের, ধরা যাক বড়জোর পঞ্চাশ হাজার পাঠকের( পশ্চিমবঙ্গের নিরিখে) মধ্যে কয়েকজনের কৌতুহল গাঢ় হবে। তাঁরা অবশ্য আগে গল্প এবং উপন্যাসের কাছে যাবেন। অতঃপর কবিতা আর প্রবন্ধের বিষয় – আশয়। বড়জোর হাজার দুই থেকে তিনেক মানুষ, ধরা যাক পাঁচ হাজার বড়জোর এই দশ কোটির ( আনুমানিক) পশ্চিমবঙ্গে কবিতা আর প্রবন্ধের ক্রেতা। এই সামান্য সংখ্যক পাঠকের জন্য অন্তত দুশোটি শক্তিশালী কলম উপস্থিত। ফলত অত্যন্ত সাধারণীকরণেই অনুমান করা যায় বাঙালি কবিদের পকেটের অবস্থা। বাস্তবিকেই আমরা জানিও। এ কারণেই সম্ভবত বাঙালি কবিরা কবিতার ওপর নির্ভর করে দিন গুজরান করার সাহস দেখাতে পারেন না। দিনের শেষে সামাজিক বেঁচে থাকাটা জরুরি। যে দুই একজন পেরেছেন বা পারেন, একান্তই ব্যাতিক্রম হিসেবে বিবেচিত। এবং বেশ কিছু সম্ভাবনার সূত্রেই এমন জীবন সম্ভব হয়। কিন্তু, অন্যান্য পেশাকে নির্ভর করে তবে কবিতার কাজে প্রবেশ করতে পারেন বেশিরভাগ বাঙালি কবি। এরফলে হয়তো কবিতার প্রতি পেশা জনিত তাগিদটা থাকে না অনেকক্ষেত্রেই। তবে এটা একান্ত অর্থনৈতিক কারণেই ঘটেছে এ কথা বলা বাহুল্য।
এবং একই ক্রমে এ কথাটাও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে যে, ভারতবর্ষের ( এটা মানচিত্র নিরপেক্ষেই বলা যায়)অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছে টেক্সটকে। অর্থনীতি যে পরিস্থিতির বাবলটাকে ধরে রাখতে চাইছে, তাকেই প্রোপাগান্ডা করে টেক্সট গড়ে উঠছে বা উঠতে চাইছে। এটা গোটা পৃথিবীতেই উদাহরণ। এখন প্রশ্ন আসছে, তাহলে, তো বাজার বাড়লে তো নিয়ন্ত্রণও বাড়বে। হ্যাঁ বাড়বেই। কিন্তু, মনে রাখা দরকার একই সঙ্গে সমান্তরাল যে বাজারটি তৈরি হবে, তাও কিন্তু ছোটখাটো হবে না। একটা উদাহরণ সহজেই আমরা পেতে পারি। যেসময় আমেরিকান পুঁজিবাদ শীর্ষ শিখরে উঠছে, সে সময়েই গিনসবার্গের ‘ হাউল ‘ গোটা পৃথিবী জুড়ে লক্ষ লক্ষ কপি বিক্রি হল। আমরা তো জানি, যে, যখন কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তখন তার বিপরীতে আরেকটি সমান্তরাল সংখ্যাও থাকে, যে সংখ্যাটিও নেহাত কম হয় না। আর যেহেতু ইংরেজি ভাষার একটি আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা আছে, তাই সে ভাষায় রচিত বা অনূদিত টেক্সটের সুবিধা হচ্ছে, একটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো তাকে নিষিদ্ধ করলে তা অন্যান্য দেশে, বিশেষ করে বিপরীত রাজনীতির দেশে জনপ্রিয়তা অর্জনের সুবিধা পায়। কিন্তু, বাংলা ভাষায় এ বাজার প্রায় অসম্ভব। খুব সচেতন ও নিষ্ঠ অনুবাদের মাধ্যমে কিছুটা হতে পারে, কিন্তু ইংরেজির বাজার পাওয়া তো অসম্ভব। প্রসঙ্গে ফেরা যাক, এখন বাংলা বাজার একান্তই ছোট। ফলে তাকে তথাকথিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সহজে নিয়ন্ত্রণ ও নিয়ন্ত্রণকেই জনপ্রিয় করে রাখতে পারছে। কিন্তু বাজার বাড়লে, সমান্তরাল চিন্তার পরিধিটিও স্বাভাবিকভাবেই পুষ্ট হবে। হাউলের মতো না হলেও কিছুটা অর্থনৈতিক স্বাধীনতা পাবে সমান্তরাল ধারাটিও। পেশাগত নিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতা টেক্সটকেও তার অভিপ্সা অথবা স্বাধীনতা অথবা বিস্তার বা বহুমুখীতা দিতে পারে বলে মনে হয়। এখন , একই সঙ্গে এ কথাটিও সম্ভবত সাব্যস্ত হয় যে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রিত সাহিত্যের বিরোধীতা করা এক প্রকারের অসহায়তারই প্রকাশ। বিরোধীতার বদলে যদি প্রতিরোধ অর্থাৎ বাজার বৃদ্ধি করার পাশাপাশি অর্থনৈতিক স্বাধীনতার চেষ্টা দেখা যায়, সমান্তরাল বা বিকল্প চিন্তার ধারাটি আরও পুষ্টি পেতে পারে।
এখন, প্রশ্ন হল, বাংলা ভাষায়, ভারত আর বাংলাদেশ উভয় দেশের ভাষাতেই একমাত্র লিটল ম্যাগাজিন নামক একটি অতি সক্রিয় বিপরীত ধারার উপস্থিতি সত্ত্বেও কেন, এখনও সমান্তরাল ধারার কাছে পুঁজি নেই। এখনও কেন লিখে টাকা পাওয়া তো দূরস্থান, বরং কাগজ কিনে নিতে হয় এমনকি লেখা ছাপানর জন্য সম্পাদককে টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। কেন ? এর প্রধান কারণ বোধহয় লিটল ম্যাগাজিনগুলো বেশিরভাগই অদ্ভুত বিভ্রমে পেশাদারীত্বকে কেবল এড়িয়ে গেছে তাই নয়, পেশাদারীত্বকে ঘৃণা করেছে। যে দু- চারটি লিটল ম্যাগাজিন পেশাদার হতে চেষ্টা করেছে, তারাই ‘ ওরা তো আর লিটল ম্যাগাজিন নয় ‘ – এর আখ্যা পেয়েছে। এখন কে লিটল ম্যাগাজিন নয়, আর কেই বা লিটল ম্যাগাজিন এবং কাকে বলে লিটল ম্যাগাজিন — কে সাব্যস্ত করে ? এর সংজ্ঞা রয়েছে আদৌ ! আসলে এই লিটল ম্যাগাজিন ব্যাপারটাও একটা ধারণা। কবিতার মতনই হয়তো। এবং যতদিন ধারণা হিসেবে থাকবে, তার অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ঘটবে না সম্ভবত। আসলে তো বৃহৎ পুঁজির সমান্তরাল কিছু ছোট পুঁজি এই লিটল ম্যাগাজিন। অজানা কারণে এই বঙ্গে ‘ পুঁজি ‘ শব্দটির প্রতি বিশেষ ছুঁৎমার্গীতা রয়েছে ।’ পুঁজি বিরোধী ‘ শব্দটির মতো ধক যেন আর কিছুরই নেই। এটা কি পুঁজি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকার কারণে ? নাকি পুঁজির ব্যবহার না জানার কারণে ! তাই কিছু লিটল ম্যাগাজিন তার ‘ আদর্শ ‘ বলে কোনও কিছুকে আঁকড়ে ধরে কয়েক বছরের মধ্যেই লুপ্ত হয়ে গেল ? আর শতাধিক বছরের প্রতিষ্ঠানের সমালোচনা করে বাকি অবসর জীবনটা কাটাল। এই পরিস্থিতির বিপরীতে দাঁড়াতে পেরেছিল সম্ভবত ‘কৃত্তিবাস’। কৌরব পেরেছিল কিছুটা, ভাষাবন্ধন পেরেছিল, পেরেছিলেন সুবিমল মিশ্র, পেরেছিল কবি সম্মেলন।
আমাদের লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলনের আরও কিছু স্ববিরোধিতা লক্ষ করা যায়। সবচেয়ে করুণ দশাটা ধরা পড়ে পুজোর সময়। প্রাণপনে বাণিজ্যিক কাগজের ঔজ্জ্বল্যকে অনুকরণ করতে গিয়ে লিটল ম্যাগাজিন যেমন তার স্বভাবকে হারায়, তেমনই কিছুটা উদ্দেশ্যহীন হয়ে পড়ে। তার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়, প্রথমত কমার্শিয়াল ম্যাগাজিনের স্বভাবকে ধারণ করে অবাণিজ্যিক উপস্থাপন। দ্বিতীয়ত, নতুন স্বর বা তুলনামূলক অপঠিত কবিকে ছাপানর বদলে অধিকাংশ লিটল ম্যাগাজিন পরিচিত ও প্রভাবশালীকেই ছাপাতে অধিক তৎপর হয়ে থাকে। এর ফলে একটা বিপুল পরিমাণ সমান্তরাল কবিতা অঞ্চল আমাদের অপঠিত থেকে যায় কেবল নয়, টেক্সট অনেকটাই একমুখীন হয়ে ওঠে। তীব্রভাবে একমুখীন। কারণ, লিটল ম্যাগাজিনে স্থান পেতে গেলেও তখন কবিকে মেনে নিতে হচ্ছে অর্থনৈতিক চাহিদার ফলে জাত টেক্সটের শাসন। তাছাড়া অনেকক্ষেত্রে এটাও দেখা যায় যে, লিটল ম্যাগাজিনকে বা লিটল ম্যাগাজিন নামধারী একটি প্রকাশনাকে ব্যক্তিগত পরিচয় গড়ে তোলার কাজে ব্যবহার করেন সম্পাদক। এই সংখ্যাটা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। ফলত অনভ্যস্ত পাঠকের কাছে ছোট কাগজ পরিচিত হচ্ছে আরেকটি অভিধায়। যার সঙ্গে মূল অভীপ্সার কোনও সম্পর্ক নেই। মূল কথা, আন্দোলনটি ক্রমাগত সরে যাচ্ছে তার উদ্দেশ্য বিন্দু থেকে। যত সরবে বিকল্প স্বরের বা টেক্সটের সম্ভাবনাও তখন ক্ষীণ হয়ে আসবে।
একটি পারস্পরিক পরিস্থিতি যেমন আমাদের টেক্সটকে নির্দিষ্টিকৃত করে ফেলতে চাইছে, তেমনই আমরাও চাইছি, আমাদের পাঠ অভ্যাসের ধারাকে না ভাঙতে। আমরা চাইছি, আমাদের চেনা ও অভ্যস্ত টেক্সটকেই আবার পড়তে। এই পূণর্বিণ্যাস আমাদের চিন্তাকে কতটা সমকালীন করে তুলতে পারে, সে বিষয়ে সন্দেহ থাকে। সন্দেহ হয়, আদৌ কী আমাদের সাহিত্য মানুষের প্রবণতা ও বিবর্তিত অভ্যাসকে স্পর্শ করতে পারছে ?
একমুখীন রচনা ও প্রভাবিত রচনা যখন আমাদের পাঠ অভ্যাসকে গ্রাস করে ফেলতে চাইছে, আমরা সকলেই বিশ্বাস করছি এই বাস্তবতাকে। খতিয়ে দেখলে, এই স্বভাবের উৎস হিসেবে আমরা চিহ্নিত করতে পারব সেই অর্থনৈতিক দুর্বলতাকে। বলা ভাল, বেঁচে থাকার রসদ মানুষের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ ও নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ করছে। করবেও। কিন্তু, প্রশ্ন হল, এই নিয়ন্ত্রণের ধারণাটাই কি প্রচলিত থাকবে? বদলাবে না তার পরিকাঠামো ?
বিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এটা ঘটবেই। এই বিবর্তনের স্বাভাবিক গতিকে আমরা বাড়িয়ে দিতে চাইলে, বিপ্লব ঘটাই। যদিও এর ফল খুব সুদূরপ্রসারী হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। যাইহোক, বিবর্তন ঘটবে। নিয়ন্ত্রণেরও বিবর্তন ঘটবে। অনেক সম্ভাবনার মধ্যে সে হয়তো আমাদের অভিপ্সীত পথ ধরবে। কিন্তু, এর সবটাই সম্ভব অর্থনৈতিক বিবর্তনের ফলে। সম্পদের প্রাচুর্য শিল্পের ক্ষতি করে, এই আর্কেটাইপ ধারণাকে অতিক্রম করে আমরা যদি দেখি, তবে, আমরা খুশি হব, একথা ভেবে যে, খুব তাড়াতাড়ি আমরা অর্থাৎ ভারত মানচিত্রের মানুষ খুব বড় অর্থনৈতিক উন্নয়নের মুখোমুখি হব। চাঁদের সম্পদ এখন অনেকটাই মানুষের হাতে।
এখন অনেকেই প্রশ্ন তুলবেন, যখন সম্পাদক টাকা দেবেন, তিনিও চাইবেন তাঁর মনমতো লেখাটিকে, সোজা কথায় ফরমায়েশি লেখাটিকেই ছাপাতে। তাহলে তো সেই অর্থ এলেও লেখকের তথাকথিত স্বাধীনতা মিলছে না। তাকে তো সেই অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণেই থাকতে হচ্ছে। তাকে তো সম্পাদকীয় মডেলের ওপর নির্ভর করেই লিখতে হচ্ছে। না, এই সম্ভাবনা তো থাকবেই। কোনও কোনও ছোট কাগজ হঠাৎ করে কমার্শিয়াল স্বভাব ধারণ করবে। লিটল ম্যাগাজিনও তার স্বভাবের কিছুটা তো বদলাবেই। দেখুন, এখানে কল্প – বিজ্ঞান লিখতে চাইছি না। প্রত্যেকটা চলনের ভবিষ্যৎ অজস্র সম্ভাবনা দিয়ে তৈরি। ভবিষ্যত বলেও কী কিছু হয় এই অসীম আবর্তনে ? যা হোক, আপাতভাবে মানুষের আয়ুর সাপেক্ষে ভবিষ্যৎ বলতে যা বুঝি, সেই পর্বের অজস্র সম্ভাবনা থাকে। আমি এই অবকাশে তার একটিকে ধরতে চাইছি। আরও অনেক সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। এই সূত্রেই বলা যায়, আগামী ষাট বা সত্তর বছর পরে পৃথিবীর অর্থনৈতিক অবস্থা কেমন দাঁড়াবে, সমীকরণ কী হবে — আমরা জানি না। আমেরিকান অর্থনীতি যেমন আমাদের শিখিয়েছে সব কিছুই বিক্রয়যোগ্য। এই তো কবীর সুমন লিখেছিলেন, ” আশাটাও পণ্য এখন বাজারদরে / বিকোতে পারলে টাকা আসবে ঘরে/ আসবে ঘরে …” আমি বিষয়টিকে সম্পূর্ণ অসদর্থে ধরছি না। এখন, যদি ভারতীয় অর্থনীতিও সেদিকে মোড় নেয়, তবে, মনে হয় ,লিটল ম্যাগাজিন তার স্বভাবকে ধারণ করেই বাণিজ্য করতে পারবে। এবার ‘বাণিজ্য’ কথাটাকে বাণিজ্য সম্পর্কে আমাদের ধারণা অনুযায়ী আমরা নেব। যদিও দিনের শেষে বাণিজ্যিক সাফল্যই আমাদের নিরাপত্তা তৈরি করে।
যদি টাকা বাড়ে, পিরামিডের ওপর থেকে চুঁইয়ে নামবে নীচেও। সমস্ত স্তরেই, স্তরের চিন্তাই সেক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুবিধা পাবে। তবে, লেখকেরও সেক্ষেত্রে আত্ম – প্রশ্নের অবকাশ থেকে যায়। আমি লিখব আলোক সরকার, প্রণবেন্দু দাশগুপ্তের মতো কবিতা, আশা করব রবীন্দ্রনাথ , শক্তি, জয় গোস্বামী,সুবোধ সরকারের মতো জনপ্রিয়তা, ওটা সম্ভব নয়। কখনও নয়। সমকালীন জনপ্রিয়তার কিছু উপাদান থাকে কবিতার ক্ষেত্রে। আপনার রচনা শৈলীতে সেগুলিকে আপনি ধারণ করতেও পারেন, এড়িয়েও যেতে পারেন। এড়িয়ে গেলে বা ব্যবহার করলে তা যে খারাপ – ভালোর অশ্লীল ভেদ পর্দাটি নির্মাণ করছে এমনটি নয়, তবে সচেতন মানুষ হিসেবে আপনাকে সত্যিই বুঝে নিতে হবে — আপনার পাঠক মহল। সকলেই , সমস্ত পাঠকই এক ধরণের টেক্সট পছন্দ করবেন — এরকম ভাবাটা এক ধরনের স্বৈরাচার। ফলত, হয়তো সমীকরণে আপনার চিন্তা অজনপ্রিয়ই থাকতে পারে, কিন্তু সেই অজনপ্রিয়তাই আপনাকে সেই পরিমাণ অর্থ দিতে সক্ষম হবে, যার মাধ্যমে আপনি জীবন ধারণ ও( ‘স্বাধীন’ বললে ভুল হবে ) নিজের ‘ মুদ্রাদোষ ‘ অনুযায়ী চিন্তা করতে পারবেন।
২
এবার আরও কয়েকটি প্রশ্ন উঠে আসে। সম্পদের বাহুল্য, উপাদানের সম্ভার কী কবিতার ক্ষতি করবে না ? তার নির্জনতা, একাকীত্বকে, সহানুভূতিকে নষ্ট করবে না ? আর যদি টাকার আধিক্য ঘটেই তবেই, ধনী সম্পাদকেরা এ আইয়ের মাধ্যমে লিখিয়ে নেবে নিজেদের প্রোপাগান্ডাকে। লেখক তো সেক্ষেত্রে বাতিল একটা বিষয়।
দুটো ভাগ করে নেওয়া যাক। প্রথম ভাগে রাখব সম্পদের বাহুল্য এবং কবিতার ক্ষতির প্রসঙ্গ। এক্ষেত্রে মণীন্দ্র গুপ্তের একটি মতকে ব্যবহার করতে চাইছি,
“কবিতার কাছে যাবার জন্যে, কবিতাকে মহার্ঘ জানার জন্যে জীবনকে বস্তুবিরহিত করা দরকার। দামী বাড়িঘর, সাজসরঞ্জাম, টিভি, রেডিও, এমনকি মাত্রাতিরিক্ত বইও কবিতার পথে নানাভাবে উচ্চকিত এবং নীরব বাধা তৈরি করে। “( শিল্প পেরোনো শিল্প: মণীন্দ্র গুপ্ত )
ঠিক এখানেই উত্তরটি তৈরি হতে শুরু হয়। আমরা সবাই একটি বিষয়ে একমত হব যে মানুষের সমস্ত কর্মকাণ্ড আসলে একটি বায়োকেমিক্যাল নির্মাণ। কবিতাও। তাকে কখনওই একটি স্বভাবের ভেতর দিয়ে ধরা যায় না। এক্ষেত্রেও বোধহয় সেই ধরার চেষ্টাই করেছিলেন মণীন্দ্র গুপ্ত।একজন মানুষের অভ্যাস আর তার তৎকালীক হরমোন ক্ষরণের ফলাফলেই রচিত হয় তার অক্ষর। কবিতা তো কেবল দুঃখী মানুষের কথাই লেখে না। সম্পদের বাহুল্যের ভেতর, প্রতিটি নির্মাণের, চাহিদার, প্রাপ্তির ভেতরেই আছে একটি স্বতন্ত্র অস্তিত্ব, একটি স্বতন্ত্র অভিঘাত। তার ফলে মানুষের ভেতর হরমোন ক্ষরণ হতে থাকবেই। সে হয় কবিতায় বাহুল্যের প্রতি অনাস্থা জানাবে। জানিয়ে কবিতা লিখবে। অথবা এমনটাও তো হয় সেই সম্পদের, সেই কোলাহলের বিবিধ স্পন্দনই তার মধ্যে তরঙ্গ তুলবে। সে কবিতা লিখবে সাতচল্লিশ তলার ছাদে বসে মেঘ ছুঁয়ে ছুঁয়ে। সে লিখবে হয়তো তের তলার মানুষের জন্য অথবা সাতান্ন তলার মুখটি কী তাকে ব্যাথিত করতে পারবে না!
আর যদি কোলাহল – নির্জনতার প্রসঙ্গ হয় , তবে, সেটিও প্রশ্নের বাইরে যায় না। কবিতা তো কেবল সচেতন মনের কাজ নয়। আমাদের সমস্ত অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গই কবিতায় নিয়োজিত হয়। তবে বহিরঙ্গে কোলাহল, ব্যস্ততা থাকলেও অন্তর্গত নিস্তেজনা যদি কেউ সাধন করে লিখতে পারেন কবিতা — আপত্তি কী ! অমন নিরালাবাসী উচ্চারণের পরেও জীবনানন্দ কেন বারবার কলকাতায় ফিরে আসতেন ? বিনয়ের, ভাস্করের, উৎপলের, শক্তির, সুনীলের বেশিরভাগ শ্রেষ্ঠ কবিতাই বোধহয় নাগরিক কলরোলের ভেতর থেকেই গড়ে উঠেছে। সুভাষেরও। আবার উল্টো পক্ষে আপনি যদি তারাশঙ্কর অথবা প্রেমেন্দ্র মিত্রের উদাহরণ ব্যবহার করতে চান, সেক্ষেত্রেও বলা যেতে পারে যে, এক্ষেত্রে লেখকের বা একজনের অভিপ্রায় বড় হয়ে ওঠে। নির্জনতার প্রসঙ্গ সেখানে বোধহয় বড় হয়ে ওঠে না।কী করব — এই প্রশ্নটাই। রচনার প্রেক্ষিতে টাকা আসবে নাকি টাকার প্রেক্ষিতে লেখা ? অবশ্য তারাশঙ্কর কেন এখনও পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় ক্ষেত্রটাই অধিক তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা সেই টাকার অল্পতার প্রসঙ্গ। হয়তো বাস্তব বেঁচে থাকার আকাঙ্ক্ষায় দ্বিতীয় প্রসঙ্গের কাছে এক অর্থে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন অধিকাংশ বাঙালি লেখক। একজন সুবিমল মিশ্র, একজন অরুনেশ ঘোষ কেবল দেখিয়ে দেখিয়ে যান যে, আরেকটি সমান্তরাল বাস্তবতাও আছে। আর এই ফাটল গলেই আগামী সময়ে সমান্তরাল ধারণাটাই হয়তো স্বাভাবিক ভাবেই প্রধান হয়ে উঠতে পারবে। প্রসঙ্গে ফিরে বলা যায় যে, মানুষ খুব সুখি হয়ে উঠলে দুঃখের কাঙ্খায় সে লিখবেই। যেমন দুঃখি মানুষ বিপ্লবের কথা লেখেন সুখের কামনায়। কোলাহল বা নির্জনতা, বাহুল্য অথবা ধুলোবালিছাই — যেইই থাকুক না কেন, অরূপের সঙ্গে, অপরূপের সঙ্গে, অনুমানের সঙ্গে তার খেলা চলবেই।
এবার আসা যাক, দ্বিতীয় প্রসঙ্গে। অর্থাৎ এ আই প্রসঙ্গ। অনেকেই আশংকা করছেন, এই আই কবিতায় হস্তক্ষেপ করেছে, ফলে কবিদের সমস্যা হবেই। সংকটাপন্ন হবে কবিতা। কিন্তু এদিকেও খুব বেশি ভয়ের কারণ দেখি না। কারণ, মনে হয়, মানুষের কবিতা হল ত্রুটির খেলা। একটি কবিতা কখনও স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তার ভেতর রয়ে যায় সুর ও স্বরের উচ্চাবচতা। আলো – ছায়ার, স্পষ্ট – অস্পষ্টের তুলনাত্মকতা। এই তুলনামূলক খুঁত ও নিখুঁতের কোরাস কবিতায় নন্দনকে নির্মাণ করে বলেই মনে হয়। আর এ আই চায় নিখুঁত হতে। চাইবে স্বয়ং ঈশ্বর হতে। মানুষের স্বভাবজ খুঁতটুকুনিই বোধহয়, না পারাটাই, পারতে চাওয়াটাই তার কবিতাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কবিতাকে অতিক্রম করতে প্ররোচনা দেবে।
৩
এবার ইতি টানার প্রয়োজন। কয়েকটি চুম্বকে এ প্রস্তাবের বক্তব্য বলে রাখা যাক এই পর্যায়ে।
প্রথমত : আমাদের কবিতা পাঠ ও কবিতার অভিপ্রায়ের ভেতর একটি যোজন দূরত্ব বর্তমান।
দ্বিতীয়ত : আমাদের পশ্চিমবঙ্গের বাংলা কবিতার অর্থনৈতিক সংকট তাকে সংকীর্ণ অর্থনীতি নির্ভর করে তুলেছে।
তৃতীয়ত : আমরা মধ্যবিত্ত প্রবণতায় চাই এমন একটি টেক্সট যা আমাদের পাঠ অভ্যাসকে এবং ঔচিত্য বোধকে ব্যহত করবে না।
চতুর্থত : প্রান্তিক ভাষা হওয়ার কারণেই এই অর্থ নৈতিক সংকট এখনই বাংলা সাহিত্য থেকে মুছে যেতে পারবে না। ভারত মানচিত্রে অর্থের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এই সংকট মুছবে। তবে, তা, দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়া।
পঞ্চমত : অর্থনৈতিক সংকট কাটলে বিকল্প ধারারও স্বর স্পষ্ট হতে পারবে।
ষষ্ঠত : সম্পদ বাহুল্য বা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কবিতাকে ব্যহত করতে পারবে না মনে হয়। তার অভিমুখ, দৃষ্টি, ভাষাকে বদলে দিতে পারে। কিন্তু, সেই বিবর্তনের ভেতরেও শেষ পর্যন্ত হয়তো কবিতা রয়ে যাবে।
সপ্তমত : কোলাহল বা নির্জনতার ওপর নির্ভর করে কবিতা নির্মিত হয় না। কবিতা নির্মিত হয়, জায়মানতা ও মানুষের স্বভাবের সবটা মিলিয়ে। অর্থাৎ কোলাহলও কবিতার, নির্জনতাও।
অষ্টমত : উচ্চাবচতা, ত্রুটি – নিখুঁতের সংমিশ্রণ কবিতাকে তৈরি করে। ফলে নিখুঁত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্ভবত খুঁতের অভাবেই মানুষের কবিতার ভুবনে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারবে না।
এ রচনার প্রভুত ভিন্ন অবস্থান থাকতে পারে। প্রতিটি অবস্থানই এই আলোচকের কাছে স্বাগত। তাতে যদি এই মত ক’টি অতি প্রচ্ছন্ন হয়ে যায়, তারপরেও স্বাগত …