ভারতের রাম-পাব্বণ শ্রী হিং টিং ছটেন্দ্র বাজিকর
সৌভিক গুহসরকার
শ্রী হুতোম প্যাঁচা যে কথাটা বলেচিলেন কলকেতা সম্পক্কে, সে-কতাই আজ ভারত সম্পক্কে প্রযোজ্জ।
‘হেতা নিত্য নতুন নতুন হুজুক, সকল গুলিই সৃষ্টি ছাড়া ও আজগুব!’ এক্কেরে মোক্ষম কতা! বলচি যে কাণ্ড দেকেচেন! কী হুজুক রে বাপ! চারদিকে ভারী পাব্বণ পাব্বণ ভাব। বাঁদরের দাড়ি কামানো হচ্চে, রাস্তার গোঁফ ছাঁটা হচ্ছে! অযোধ্যায় রামলালার প্রাণ-পতিষ্ঠে হচ্চে! ইনি কিন্তু ছোট্ট রাম! অথচো টিভির লোক, খবরের লোক মাইক হাতে হিকহিক করে চেঁচিয়ে-মেচিয়ে বলচে, ৫০০ বছর বনবাসের পর ফিরচেন রামচন্দ্র! তাই দেশে ‘ধরার খুশি ধরে না আজ’! এদিকে ইজরায়েলে হরিয়ানা থেকে শ্রমিকরা গিয়ে ভিড় কচ্চে। বলচে, এই যুদ্ধুর দ্যাশেই থেকে যাব। মরি তো বাপু বোম খেয়ে দোম হয়ে মর্বো! হাতে চাকরি নিয়ে মর্বো! বেকার তো মরতে হবে না। দেশে চাকরি নেই। বলি কদ্দিন বেকার হয়ে থাকব! আমরা মুখে লাড্ডু ঠুসে ‘রাম রাম’ করতে করতে বলি, খোকনা, দেশে চাকরি নেই তো কী, আধা-খ্যাচড়া মন্দির তো আচে। রাম-লালার ফিরে আসা আচে। গ্যাসের দাম আছে। মণিপুরে আগুন আচে। এতকিছু আচে, তোমরা কি কানামুচি হে ছ্যামড়া! দেকতে পাওনা কিচু? খালি তোমাদের চাই চাই। ছাই! দেশকে কিচু দিতে পেরচ কখনো? তোমাদের সহ্য করার ক্ষ্যামতা নেই? চাকরি নেই তো নেই। খাবার নেই তো নেই। লোক মরছে তো মরুক। সহ্য করার ক্ষ্যামতা নেই! দেশোপ্রেম দেশোপ্রীতি বগবগ করছে না রক্তের ভেতর? যদি সহ্য করার ক্ষ্যামতা না থাকে তো তুমি দেশোপ্রেমী নও চাঁদু। তুমি দেশোদ্রোহী। তুমি দেশ বিরোধী, চক্রান্তকারী, ভূতের হাড়ি, ভোরের তাড়ি, নকশালবাড়ি, দ্রৌপদীর শাড়ি—! রোসো হে রোসো, চুপ করে বোসো। বড় বিপজ্জনক সময় হে, বড় খিটকেল সময় . . .
এখন কতা হল কী যে, কেন? কেন একটা আধা-খ্যাঁচড়া মন্দির ঢাক ঢোল পিটিয়ে খোলা হচ্ছে? বছর কয়েক পরে, পুরো মন্দির তৈরি হয়ে গেলে খোলাখুলি করলে হত না? আবার পোশ্ন! আবার পাকামো! টু মাচ হয়ে যাচ্চে! এইবার ১০ বছরের জন্যে জেলে পাঠিয়ে চোর-মন্ত্রীদের পা-টেপাব। আরে বাবা, খোলসা করে বলচি, বুঝে নাও। এত কতা এত সহজে কেউ বলেনি। কতাটা কী?
মোগলরাজাটি তিনি, নামটি বাবর
কেটেছেন এ-ভারতে গভীর জাবর।।
পানিপথে জয় তাঁর, ইব্রাহিম লোদী
তাহাঁকে সরিয়ে তিনি, কাড়িলেন গদি।।
গদি পেয়ে গদগদ, মন উড়ু উড়ু
সেই থেকে এই দেশে মোগলাই শুরু।।
একদিন সাধ হল, সেইদিন শীত
রামের জনমস্থানে গড়ি মসজিদ।।
এইবার পোশ্ন হল, বাবর কী জানতেন যে রাম কে? তিনি সমরখন্দ থেকে আসা পাব্লিক। ইব্রাহিম লোদীকে পানিপথে তুমুল ঠ্যাঙানি দিয়ে সোজা দিল্লি! এইবার নাকি ১৫২৮-২৯ সালে মীর বাকি নামের বাবরের একজন সেনাপতি তুরতুর করে মন্দির ভেঙে মসজিদ কল্লো। এর কয়েক দিনের মদ্দেই অসম্ভব প্রতিভাবান এই বাবর রাজা মারা গেলেন ১৫৩০-এ! এর পর কী ঘটল? তুলসীদাস এলেন। ‘রামচরিতমানস’ লিখলেন বাবরের মৃত্যুর অনেক পরে। বাল্মীকির রাম ফিরলেন তুলসীদাসের হাত দিয়ে। ‘রামলালা’ তো বাল্মীকি রামায়ণে নেই সেভাবে! কেষ্ট ঠাকুরের শৈশব যত বিখ্যাত, রামচন্দ্রের শৈশব তত বিখ্যাত ছিল না। কিষণ-কানহাইয়ার মতো তুলসীদাসের অসামান্য হাতে রামলালা জাগ্ৰত হলেন। তাহলে হলটা কী! মূল রামায়ণে যা নেই, সেই জিনিস নতুন করে রামায়ণে ঢুকল। উত্তরভারতের একটা বিরাট অংশে সেই থেকে রামলালার প্রতি ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ল। এর ফলে রামলালার জন্মভূমি নিয়ে ভাবনা চিন্তা শুরু হল রামভক্তদের ভেতর। বাবরের সময় এটা অত প্রকট ছিল না। যদি প্রকট থাকত তবে সেই সময়েই মন্দির ভাঙা নিয়ে একটা খণ্ডযুদ্ধু লেগে যেত। এইখেনে মশাইরা একটা কথা বুজে নিতে হবে কিন্তু। সব হিন্দু রামভক্ত নয়। কৃষ্ণভক্ত। কালীভক্ত। দুর্গাভক্ত। শিবভক্ত। বিষ্ণুভক্ত—এরকম হিন্দুদের মদ্যে চিরকাল ছিল। এখনও তাই। অদ্বৈতবাদী বৈদান্তিকেরা নিরাকার ব্রহ্মে বিশ্বাস করে। তারাও হিন্দু। সুতরাং রামজন্মভূমি নিয়ে চিন্তা কেবলমাত্র রামভক্তদের ছিল। সব হিন্দুদের ছিল না। হিন্দু মানেই রামভক্ত নয়। আবার এই যে-রামের প্রতি ভক্তি দেকাচ্চে জনতা, ইনি কিন্তু বাল্মীকির আমিষভোজী বিরহতাড়িত রাম নন। ইনি তুলসীদাসী নিরামিষাশী রঘুপতি রাঘব রাজা রাম। তাহলে ঘটনাটা কী ঘটছে—শুধুমাত্র রামভক্তদের দাবীতেই এই মন্দির। আর যেহেতু আমাদের বড় সরকার নিজেরাও রামভক্ত (তাঁরা শিবভক্ত হলে কী হত জানা নেই) সেহেতু এই পুরো বিষয়টিকে তাঁরা জাতীয় স্তরে তুলে নিয়ে গেচেন।
তা যাইহোক, অবশেষে সেই বাবরি মসজিদ ভেঙে এখন রামলালার মন্দির হল। মাটি খুঁড়ে মসজিদের তলায় মন্দিরের অনেক অংশ যে পাওয়া গেচে, এ তো ঘোর সত্য। মন্দির হওয়াটা ঠিক কী ভুল, সে তো মশাই, প্রত্যেকের নিজস্ব মতামত রয়েচে। আর সুপ্রিম কোর্ট তার রায় পরিষ্কার দিয়েচে।
কিন্তু সমস্যা, অন্যখেনে।
সমস্যা হল, এই মন্দির উদ্বোধন নিয়ে এত ঢাকঢোল ডুমডুমাডুম কেন? রাজনীতির লোকের মন্দিরে কী কাজ? এই পোশ্ন করলেই সাতদিনের ফাঁসি!
সারা দেশ নাচছে, লাড্ডু তৈরি কচ্চে, গান গাইচে, অযোধ্যায় জমি কিনচে।
খবরে খবরে তক্কাতক্কি ধাক্কাধাক্কি বক্কাবক্কি: কোন শঙ্করাচার্যরা যাচ্চে না, কে কে মন্দিরের টিকিট পাচ্চে না, কোন অভিনেতা যাবে, কে নেমন্তন্ন পায়নি—এই নিয়ে বাজার গর-গরম! হাতদল বলচে—উপোস, ন্যাতা-হাতে-মন্দির পোরিষ্কার—যতসব নাটক! পদ্মদল বলচে, তোমাদের নেতারা এদ্দিন বসে করচিলোটা কী? তোমরা তো বাপু বাগড়া দিচ্চিলে! তোমরা রামকে অশোধ্ধা করোচো! এইবারে ছক্কা সামলাও! পুরো টি-টোয়েন্টি খেলে দোবো।
ওদিকে ছুটি-ছুটি রব ওঠে অঙ্গন মাঝে।
একটি মন্দির খোলার জন্য ফুল-ছুটি, হাফ-ছুটি, এমনকি শেয়ার বাজার পর্যন্ত ছুটি। ‘আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে’। কিন্তু একটা দেশে একটা মন্দির খোলার জন্য সব ছুটি কেন? একি স্বাধীনতা দিবস নাকি? প্রজাতন্ত্র দিবস? একটা মন্দির খোলা হচ্চে, তার জন্য এত হুড়ুং-মুড়ুং ভ্যাবলু ভুড়ুং দেখে জনগণ ট্যাঁ হয়ে গেচে। সে বুঝতে পাচ্চে না কী করবে। গুলিয়ে যাচ্চে সব। এর মদ্দেই একজন বিরাট অভিনেতা চটাস করে অযোধ্যায় জমি কিনে নিলেন! দেখুন ঘটনা। দেশ জুড়ে ঘন্টা বাজচে ঢঢাং ঢং ঢঢাং ঢং।
এদিকে ধম্মের বিরুদ্ধে গর্জে উটেচে ধম্ম।
আমাদের এখেনে পুজো হবে কালীঘাটে। মিছিল বেরুবে। সবমিলিয়ে রামমন্দির, জমে ক্ষীর! আমিও তো খাচ্চি। আপনিও তো খাচ্চেন। ভেতরে ভেতরে উত্তেজনায় নাচছেন! এই সময়ে রামমোহন রায় থাকলে কী হত? বিদ্যেসাগর থাকলে কী বলতেন?
আধা-খ্যাঁচড়া মন্দির কেন সাত তাড়াতাড়ি খোলা হচ্চে, তা তো আপনি আমি সকলেই জানি। হালে চাই পানি। তাই রামকে ধরে টানাটানি। ইংরেজরা ওদিকে বলচে, ‘হিন্দু ভ্যাটিকান’, আমেরিকা কইছে ‘হোলি ল্যান্ড’! এদিকে ঘংঘঙে কাশি হচ্চে আমাদের।
একবার হলে সারতে বহুদিন সময় লেগে যাচ্চে। জঘন্য হাওয়া। দূষণের চূড়-চূড়ান্ত। দূর-দূরান্তে এ থেকে মুক্তি নেই। উল্টোপাল্টা বাঁধ দেওয়ার ফলে নদীর জল শুকিয়ে যাচ্চে, গুলমার্গে বরফ পড়চে না, জোশীমঠ ধসে যাচ্চে, গায়ের জোরে তৈরি করা ভুলভাল পাহাড়ি টানেল ভেঙে যাচ্চে, দেশ জোড়া আর্বজনার স্তূপ, যমুনা এসে রাজধানী ভাসাচ্চে, মণিপুর দাউদাউ, তবু আমাদের পাব্বণ চাই।
তাই রাম-পাব্বণ হল আমাদের নতুন মাঘোৎসব! এইখান থেকে একটা বাতাস উঠবে।
সেই বাতাসে ভারতের আগামী কয়েক বছরের ভাগ্য কী হবে তা পোরিষ্কার হয়ে যাবে! দাও ঢাকে কাঠি ‘ও আমার দেশের মাটি’—খেলা হচ্চে জমাটি!
যারা বলচে এসব ফ্যাসীবাদ, তাদের বলি, নাকে নস্যি দিয়ে ঘুমিয়ে নিন! চিল্লিয়ে মিল্লিয়ে সভাসমিতি করে সিঙাড়া আলুর চপের পর গরম চা খান। এই শীতকালে ভালো লাগবে। জানেন তো ভারতের লোক এসব বোঝে না। অথবা সব বোঝে কিন্তু চুপ করে থাকে। যতক্ষণ না ভাতের থালায় চামচিকে পড়বে, ততক্ষণ এ গণতন্ত্রটি নড়বে না। আর তাছাড়া, এ দেশের লোক এই মুহূত্তে নড়তে চাইলেই বা যাবে কোতায়? কোন দিকে? কোন পথে পালাবেন শ্রীমান? এ দেশে বিকল্প নেই, শুধু প্রকল্প রয়েছে। গণ্ডাগণ্ডা প্রকল্প। এ দিয়ে কেনা হয়েছে গেছে মানুষকে। বিক্রীত মানুষের আবার বিদ্রোহ! ওসব করলে করে খেতে হবে না আর।
বুদ্ধি করে সাঁকো পেরোতে হবে। নাহলেই জলে পড়ে নিমুনিয়া! একথা তো মানবেন কাকা, আপনি অযোধ্যা যেতে চান না চান, অযোধ্যা আপনার ঘরে চলে এসেছে! তা চলেই যখন এসেছে, তখন আর কী, টিভিতে হরির লুঠ দেখুন!
টীকা: রামমন্দিরের উদ্বোধন হবে। সারা দেশে এমনকি পৃথিবীতে হৈচৈ পড়ে গেছে। এসবের মধ্যে হঠাৎ এল বাড়িতে উড়ো চিঠি। এখনকার দিনে কে আর চিঠি পাঠাবে? তবু চিঠি এসেছে। খুলে দেখলুম এক ভদ্রলোক পাঠিয়েছেন। পড়ে দেখলুম এ তো চিঠি নয়, গোটা একটা রচনা। পড়ে মনে হল লোকটি মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। কিন্তু একেবারে ফেলে দেওয়ার আগে ভাবলুম লেখাটি পাঠকের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন। যাই হোক, সকলে ভালো থাকুন। ভারতবর্ষ ভালো থাকুক। নদী গিরি গাছপালা সকলেই ভালো থাকুক। মন্দির মসজিদ গির্জা বৌদ্ধস্তূপ ভালো থাকুক। চপ মোমো কাটলেট ঘুগনি ও ভাঁড়ের চা ভালো থাকুক। অলমিতি।