
স্বর্ণেন্দু ঘোষের কবিতা
হে অন্ধ
কেন যে এমন হয়! আমার অন্ধ স্বপ্নটিকে অতিক্রম করে চলে যায় উড়ন্ত জোকারের দল। তাদের লাল-কালো টুপিগুলো খসে খসে পড়ে নির্বিকার দর্শকের মাথায়। আমার টানটান স্নায়ুর ওপর হেঁটে চলে যায় যে নীল বাঘ, তার থাবার তলায় হেমন্তের বাতাস আর হলুদ পাতারা জমাট বেঁধেছে বহুকাল। কে যে এমন করে বিন বাজায় সারারাত! আমার কুণ্ডলিনী সর্প ক্রোধে হিস্ হিস্ করতে থাকে।
প্রতিবার এমনই হয়, চন্দনের বনে হারিয়ে যায় নির্বাচিত জোকারের দল। অনন্তের পথে পড়ে থাকে লাল-কালো টুপিগুলো। হে আদিভিক্ষু, হে অন্ধ, হে পরম দর্শক, এই হরির লুঠ, এই পরিত্যক্ত প্রাচীন সার্কাস একান্তই তোমার। তোমার প্রতীক্ষিত জাদুকর বৈকুণ্ঠে বাহান্নটি লাসের তলায় শীতঘুম দিচ্ছে। হেমন্তের বাতাস বইছে দেখ। কে যে এমন করে বিন বাজায়! তোমাদের কি ক্রোধে জ্বলে উঠতে ইচ্ছে করে না?
সৌরঝড় ও রাক্ষসীদের সুপ্ত সোনালী ডিম
জীবনের এই সূক্ষ্ম তীব্র ঘোর। কিছুদিন আরও হলুদ জীর্ণ অশ্বত্থের মত থেকে যাওয়া যায়। বৃদ্ধ বৌদ্ধ শ্রমণের মত অতি ধীরে হেঁটে যাওয়া যায় শুকনো ঝরে যাওয়া পাতাদের সাথে। এই পথ শ্যামাঙ্গী নদীটির মত। দেখ, কতবার ডুবে গেছে হীরের নৌকাখানি। এর কোনও অনুবাদ হয়? সহস্র স্খলিত ধূমকেতু, নৌকা ছেড়ে কবে যে চলে গেছে রাক্ষসীদের সুপ্ত সোনালী ডিমের খোঁজে… সে কোন সুদূর অতীতের কথা! এই দৃশ্যটুকু বল কোথায় ধারণ করি? কোথায় রাখি?
সে এক স্বপ্নদৈত্য বা কোনও চণ্ডাশোক বারবার ফিরে আসে। আমার সামনে মেলে ধরে অনন্ত আয়না। ঠিক তখনই সৌরঝড় ওঠে। ত্রস্ত পাখিরা হলুদ জীর্ণ অশ্বত্থের শাখা থেকে উড়ে দিগন্তের নীলে মিলিয়ে যায় আর শরীর থেকে স্খলিত ধূমকেতুরা ঝাঁকে ঝাঁকে ডুবে যায় সুগভীর অন্ধকার আয়নায়। এই সূক্ষ্ম তীব্র ঘোর। শরীরে আরও ঘন হয়ে ওঠে।
এ দৃশ্য
এ অনন্ত দৃশ্য কোথায় লুকাব? আমি তো তেমন সৌভিক নই। গহীন রক্তচন্দনের বনে তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে যে দৈত্য, জীয়ন-কাঠি হারিয়ে ফেলেছে সে। এক নভশ্চর বেড়ালের পায়ে মাথা কুটে মরছে হতভাগা।
অনাদরের নৌকাখানি
সেই সুদূরকে আজ হেমকান্তি দুপুর মনে হয়। যে হাতের মুঠোয় নীল স্তন, অন্য মুঠোয় মুথাঘাস, ঘাসের সবুজ শরীর, সে হাত আলগা হলে বন্ধ ঘড়ির থেকে ঝরে পড়া শ্যামকান্তা গভীর অসুখ সে। যে মাঝি মৃত্যুর আগে ফেলে গেছে ছিন্নপাল অনাদরের নৌকাখানি, আমি তার দাঁড় হই, সে ময়ূরপঙ্খী হয়ে গভীর বর্ষায় প্রবেশ করে।
এই পৃথিবীর কাছে আমি স্তব্ধ পালকের কথা বলি। পরিত্যক্ত কবিতার খাতার ওপর পড়ে থাকা ধুলো। বিভূতির মত। স্মৃতিরাক্ষসেরা ভোরের স্বপ্নে ভিড় করে। কবিতার খাতা খুলে পড়ে প্রলাপমন্ত্র। সুদূর অতীতের সেই মুথাঘাসগন্ধময়ী এক ময়ূরকণ্ঠী শরীর ও পালকের কথা পড়ে কামনায় ওদের জিভ লক্ লক্ করে। আমি বিভূতি ছুঁড়ে মেরে ওদের ভস্ম করে দিই ভোরের আলো ফোটার আগে।
পাহাড়ের ওপারে
স্থির কুয়াশায় ডুবে থাকা দিগন্ত বিস্তৃত নীল মাঠে শূন্য চেয়ারগুলো। পাহাড়ের ওপারে ভ্রম ও দেবতাদের মহাসম্মেলনে খাবার পরিবেশন এবার। তিন ডাইনী সুবৃহৎ এক কড়াইয়ে রান্না করছে লক্ষ মেরুদণ্ডহীন মানুষের পরাবাস্তব হৃদয়। ফেরেশতারা দূর থেকে লক্ষ্য রাখছে এই প্রলাপ দৃশ্য।
কতকাল যাইনি তো তোমাদের মেহফিলে! কতকাল দেবতার আসন শূন্য। দেখ, আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে শূন্য চেয়ারগুলো। কেউ নেই! শুধু স্মৃতিরা বসে আছে।
বিপরীতে
আমরা প্রতিভাষা হারিয়ে ফেলেছি ক্রমশ নরম হয়ে আসা সূর্যালোকে। হাসনুহানার সুগন্ধ আমাকে পূর্বাশ্রমের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। একটি সন্ধ্যাকে আমি হাহাকারের মধ্যে খসে পড়তে দেখেছি। এখন এক অন্তর্মুখী জ্যোৎস্না আমার হারানো বাগান আলোকিত করে আছে।
ওই দেখ, কাতারে কাতারে মানুষ গাধার পিঠে চড়ে তেপান্তর পেরোচ্ছে। আমি একটা ডুমুর গাছের ডালে বসে এইসব ফুল ফোটা লক্ষ্য রাখছি।
দু’য়েক বৌদ্ধ শ্রমণ আলোর মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে।
অ্যালবিনো ময়ূর
জিব্রাইলের হাত থেকে উড়ে গেল বিবর্ণ ময়ূর। তারপর বরফে বরফে মোড়া ধানক্ষেত। একটা নীল ঘোড়া। সাদা ধানক্ষেতে একা। আমাদের দুঃখগুলো জমা যার কাছে। একটা ক্ষীণ হ্রেষা। হয়তো শোনা যায়। হয়তো সে ক্ষীণতা উড়ে যাবে দুর্ধর্ষ ঝড়ো হাওয়ায়।
খুরের নিচে তুষার। জমাট। আমাদের দুঃখগুলো আরও নীল ও অসহায়। জিব্রাইলের ময়ূর তখনও উড়ছে আকাশে।
অপূর্ব কবিতাগুলি পড়লাম। মুগ্ধ হলাম।
ধন্যবাদ দিদি…