
সুমিত নাগ-এর গল্প
নদী ও পাহাড়ের গল্প
প্রথম প্রেমের দিনগুলিতে ওরা দু’জন এক অসীম সূর্যাস্তের দেশে গিয়েছিল। এক নুড়ি-খলখলে খরস্রোতা নদী তাদের সামনে বয়ে চলেছিল। দূরে, নদীর ওপারে, পটে-আঁকা গ্রামগুলি পেরিয়ে, ধোঁয়ার মতো দেখা যাচ্ছিল প্যাস্টেল-রঙা মেরুন পাহাড়। সেই পাহাড়ের বুকে ঘন, আর্দ্র, সবুজ, নিভৃত এক বৃষ্টি-স্নাত অরণ্য।
প্রথম প্রেমের দিনগুলিতে তারা একে-অপরকে চোখে হারায়। নদীর চরে, চিকচিকে মিহি বালুর সমুদ্রে বসে প্রেমিক, প্রেমিকার আঙুলগুলি নিয়ে খেলা করতে করতে বলেছিল, “তোমাকে এত ভালবাসি যে, এমন কিছু দিতে চাই তোমায়, যা কেউ কাউকে দিতে পারে না, কখনও পারবে না। সে আমার ভালবাসার প্রতীক হয়ে থাকত।”
প্রেমিকা তার প্রেমিকের এই পাগলামি অনেক দেখেছে। সে ঠোঁট-কামড়ে, হাসি চেপে বলল, “শুধু বললেই হবে? দাও কিছু। একটা তাজমহলই বরং বানিয়ে দাও।”
প্রেমিক উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকল। তারপর বলল, “কী আর আছে আমার দেবার মতো? বেকার যুবক, টোটো কোম্পানি। তাজমহল কোথায় পাব? বরং এই নদীটা তোমাকে দিলাম। এই স্বচ্ছতোয়া নদী, তোমার প্রতি আমার প্রেমের মতোই নির্মল। আমার ভালোবাসা যেমন তোমার জন্য চিরন্তন, এই নদীও তেমনই থাকবে।”
প্রেমিকা গভীর ও উজ্জ্বল চোখে তাকাল। গাঢ় কণ্ঠে বলল, “বেশ। নদীটা আমার থাকল।”
প্রেমিক জিজ্ঞেস করল, “আমাকে কিছু দেবে না?”
“উঁ, ওই দূরের পাহাড়টা তোমাকে দিলাম। পাহাড়ের জঙ্গলটাও। খুশি?”
“খুশি!”
তারা দু’জন ঘনিষ্ঠ হল। আশ্চর্য নৈসর্গিক আলোয়, নদীর জল জাদুকরী-পাথরের মতো জ্বলছিল এবং পাহাড়ের শরীর বেয়ে চুইয়ে নামছিল বন্য-প্রেমের লালাভ উত্তাপ।
*****************************
তারপর, বহু দিন কেটে গেছে। বহু বছর। সেই নদীতে শুরু হবে এক গ্র্যান্ড প্রজেক্ট—সুবিশাল বাঁধ-নির্মাণ। পাশের গ্রামগুলি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, বাস্তুহারা হবে হাজার-হাজার, পুনর্বাসনের যথেষ্ট উদ্যোগ নেই—দীর্ঘ সময়-ব্যাপী প্রতিবাদ চলছিলই। তবে, রাষ্ট্রের সর্বময়কর্তা কারো কথা শোনেননি। তিনি সেসব শোনেন না—কারো প্রতিবাদ, কারো আবেদন, কারো অশ্রু—মূল্যহীন তাঁর কাছে। সেসব অগ্রাহ্য করে, যথাসময়ে, বাঁধ-নির্মাণ প্রকল্প শুরু হয়েছিল।
অথচ অভাবিত বিপত্তি এল। পরপর দু’বছর, অভূতপূর্ব বন্যায় বন্ধ হয়ে গেল কাজ। তারপর, নির্মাণ শুরু হতেই, ভূকম্পে ধ্বসে গেল, মিশে গেল জলের তলায় নব-নির্মীয়মাণ বাঁধটি। পরের বছর আবারও বন্যা হল। রটে গেল কী করে যেন—অভিশাপ আছে, অভিশাপ আছে নিশ্চয়—হাজারও গৃহহারা ও ছিন্নমূলের।
তখন প্রেমিকের মনে পড়ল, সেই হারানো সূর্যাস্তের স্মৃতি। মনে পড়ল, তার প্রেমিকাকে। তারা এখন প্রাক্তন। প্রেমিক খুঁজতে থাকল তাকে। কোথায় আছে সে? কার ঘরণী? আদৌ জীবিত আছে তো?
সন্ধান মিলল। অনেক খোঁজাখুঁজির পর, অজস্র ফাইলপত্তর ঘাঁটাঘাঁটির পর, অমিত তল্লাশির পর। অবশেষে।
প্রেমিক চলল প্রেমিকার সঙ্গে দেখা করতে—আজ এত দিন বাদে। শহরের প্রান্তে, নির্জন স্থানে প্রেমিকা একাই থাকে। অবিবাহিতা, একাকিনী।
“চিনতে পারছ আমাকে?” প্রেমিক প্রশ্ন করেছিল দীর্ঘ বিরতির পর প্রথম সাক্ষাৎ-এ। প্রৌঢ় হয়েছে তারা দু’জনেই। বহুদিনের বিচ্ছেদ তবু দু’জনের চোখের কোণে লেগে আছে পূর্ব-স্মৃতির স্বেদচিহ্ন। একে-অপরের দিকে তাকিয়ে তারা পড়ে নিতে পারল সেটুকু। এক নিহিত ইতিহাস এসে, অজান্তেই, দাঁড়িয়ে ছিল দু’জনের মাঝে।
“তোমাকে চিনতে পারব না? আমি তো ভাবছি, তুমিই বরং চিনতে পারলে কী করে!” প্রেমিকা ম্লান হেসে বলল, “তা আজ এসেছ কেন? মনে পড়ল হঠাৎ? এত দিন পর?”
প্রেমিক উদাস চোখে তাকিয়ে থাকল জানলার বাইরে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল—এত কিছু কি ভাবছিল সে? বিকেল-শেষের আকাশে আগুন লেগে গেছে—পুরনো সেই সূর্যাস্ত-বেলার মতো, জানলার কাচে বিচ্ছুরিত হয়ে, তা ছড়িয়ে পড়েছিল সারা ঘরে—জন্মান্তর উগড়ে দেওয়া ময়ূরের পালক। কোনও এক বিষণ্ণ কুবো পাখি ডাকছিল দূর অতীত থেকে। নাকি কাঁদছিল?
“নদীটা আমায় ফিরিয়ে দাও,” প্রেমিক নিস্তব্ধতা ভেঙে বলে উঠল।
প্রেমিকা স্থির-চোখে তাকাল প্রেমিকের দিকে। অপলক দৃষ্টিতে।
‘আমি জানতাম,” বড় শ্বাস টেনে বলল সে, “আমি জানতাম, তুমি এই জন্য এসেছ। কিন্তু, তোমার ভালোবাসার দান ফিরিয়ে নেবে?” শেষ উচ্চারণে তার স্বর কেঁপে উঠল।
“ওটা আমার দরকার। ভীষণ দরকার,” কণ্ঠে সুতীব্র আর্তির ছোঁয়া মিশেছিল।
“না, আমি ফিরিয়ে দেব না,” দৃঢ় স্বরে উত্তর এল।
“প্লিজ, তুমি বুঝছ না,” ভেঙে পড়ল প্রেমিক, “ওটার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করছে। প্লিজ, ফিরিয়ে দাও।”
“তা হয় না। ভালোবেসে একবার যা দিয়েছ, তা ফিরিয়ে নেবে কী করে?” একটু থামল প্রেমিকা। তারপর স্পষ্ট উচ্চারণে বলল, “আর এত মানুষের ক্ষতি দেখেও আমি চুপ থাকতে পারি না। ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না।”
“যাবে না? হুম,” প্রেমিক চুপ করে গেল। মাথা নিচু করে ভাবতে থাকল কিছু। ভুরু কুঁচকে থাকল। তারপর, সে মুখ তুলে, প্রেমিকার দিকে তাকাল, চোখে-চোখ রাখল।
“কিন্তু, নদীটা তো বিক্রি করে ফেলেছি। ওটা তো পেতে হবেই। মনে রেখো, পাহাড়টা এখনও আমার, জঙ্গলটাও,” প্রেমিক সর্বময়কর্তা হয়ে উঠল, “নদীটা না-পেলে ওগুলো ধ্বংস করে ফেলব আমি। যা কিছু আছে। তাই কি তুমি চাও?”
“এমনিও কি করবে না?”
“নদীটা পেলে হয়ত, না। কে বলতে পারে?” প্রেমিক মুচকি হাসল, “এবার তোমার যা ইচ্ছে। আসি?”
প্রেমিকা স্তব্ধ হয়ে থাকল। উদাসী যে-প্রেমিককে সে চিনত, সে কোথায় হারিয়ে গেল? যে কিনা তাকে নদী উপহার দিতে পারত।
কয়েকদিন পর প্রেমিকের কাছে একটি চিঠি এল। সে চিঠি খুলে দেখল, প্রেমিকা লিখেছে, “নদীটা তোমাকে ফিরিয়ে দেব, তুমিও পাহাড়টা ফিরিয়ে দিও। তবে, একটা শর্তে। সেদিনের সমস্ত ভালোবাসা—যে-ভালোবাসা তুমি আমাকে দিয়েছিলে, সে-ও ফিরিয়ে নিতে হবে। রাজি?”
প্রেমিক ভুরু কুঁচকে ভাবল, এ আবার কেমন ছেলেমানুষি? যাই হোক, নদীটা তার চাই-ই। বাঁকা-হাসি হেসে সে লিখে দিল, “রাজি। আমার সব ভালোবাসা আমি ফিরিয়ে নিলাম।”
পরদিন এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেল। এমন বিস্ময়কর ঘটনা আগে, কেউ কোনোদিন দেখেনি-শোনেনি। শোরগোল সারা দেশে। সেই নদীটা, নদীর পাশে পাহাড়টা—উধাও, স্রেফ উধাও হয়ে গেছে। চিহ্ন-মাত্র নেই। পড়ে আছে, শুকনো নদীখাত, মরা-মাছ আর ঘোলাটে পাথর কাঁড়ি-কাঁড়ি। একদা বৃষ্টি-স্নাত অরণ্য-ঘেরা পাহাড়ের জায়গায়, বিস্তীর্ণ, রুক্ষ, পাথুরে জমি ধুধু।
আবারও প্রেমিকার চিঠি পেল প্রেমিক, সে লিখেছে, “আশা করি, এবার তুমি খুশি হয়েছে। বিক্রি করার মতো আর কিছুই তোমার নেই। ভালোবাসাটুকুও না।”
ভালো লাগল – গল্পের চূড়ান্তটুকু এবং বর্ণনাগুলোও।
সুদীপ বসুর নদী ও হত্যাকারী গল্পের যথেয় ছায়া আছে এই গল্পে। অতিরিক্ত অনুপ্রেরণাকে ভালো বাংলায় প্ল্যাজিয়ারিজম বলে।
যথেষ্ট*