সত্যজিৎ রায়: প্রাচ্যের সঙ্গীত <br /> বর্ণালি মৈত্র

সত্যজিৎ রায়: প্রাচ্যের সঙ্গীত
বর্ণালি মৈত্র

অন্ধকারের মধ্যে পাখোয়াজের দ্রিমি দ্রিমি আওয়াজ তুলে ‘পথের পাঁচালি’ শুরু হচ্ছে। আড়বাঁশির ডাক এসে মিশল তাতে একটু পরেই। আর সেতারের গৎ ক্রমাগত অপু-দুর্গার শৈশব ছুঁয়ে, সর্বজয়ার লড়াই ছুঁয়ে মিশে যেতে থাকল আকাশে। নিশ্চিন্দিপুরের বাতাসে আন্দোলিত হতে থাকে কখনও গৌড়সারং, কখনও বিলাবল। আমাদের দেশগাঁয়ের তারসানাই বেজে চলল পটদীপে দক্ষিণামোহন ঠাকুরের হাতে ছবির শেষটানে।

১.
“He was forever being discovered lying reading on his bed, while every evening he followed a routine of playing over and over again his classical music records on his old gramophone. Beethoven, Mozart and Bach were his favorites. He talked a great deal with the art student Koushik, a good flautist who later became an important painter. Satyajit knew a vast amount about western music but rather little about Indian which had left him vaguely disinterested.”
Marie Seton, The young Satyajit – Portrait of a Director, 2003, Page 45

ব্রিটিশ ফিল্মতাত্ত্বিক, সত্যজিৎ রায়ের প্রথম জীবনীকার মারি সিটন ওপরের এই ইংরেজি বাক্যগুলো লিখেছেন তার The young Satyajit – Portrait of a Director বইতে। আর “দেশ’ পত্রিকার ‘বিশেষ সত্যজিৎ সংখ্যা’ (১৯৯১)-এ এর অনুবাদ করা হয়েছে —
“সবসময় তাঁকে বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে বই পড়তে দেখা যেত। না হলে প্রায় প্রতি বিকেলেই মানিক তাঁর পুরনো গ্রামোফোনে বারবার গ্রুপদী সংগীতের রেকর্ডগুলি বাজিয়ে শুনতেন। বেটোফেন, মোসার্ট ও বাখ ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রিয়। শিল্পের ছাত্র দিনকর কৌশিকের সঙ্গে তার বহু কথা হত। পরে ইনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক শিল্পী হিসেবে বিবেচিত হন। পাশ্চাত্যের সঙ্গীত বিষয়ে সত্যজিৎ প্রচুর জানতেন কিন্তু ভারতীয় সঙ্গীত সম্পর্কে তার তেমন আগ্রহ ছিল না এবং তিনি জানতেনও কম।” (পৃ. ১৫)

লক্ষ করবেন, মূল পাঠে যেখানে বলা আছে ‘Vaguely disinterested’ তার বাংলা অনুবাদ হয়েছে “তেমন আগ্রহ ছিল না” দুটো কি এক? আগ্রহ না থাকা, আর নিরুৎসাহ হয়ে পড়া কি এক? সত্যজিৎ রায়ের মত মানুষ তো আগ্রহ তৈরী করতে হলে বইপত্র জোগাড় করে প্রয়োজনীয় পড়াশোনাটুকু করে নেবেন। কিন্ত ‘নিরুৎসাহ’ শব্দটার মধ্যে কোথাও একটা মুখ ফিরিয়ে নেবার মানসিকতা লুকিয়ে থাকে না?
২.
কিন্ত কেন?
সারাজীবন ধরে যে তার এই ‘নিরুৎসাহ’ বা ‘অনাগ্রহ’ থেকে যায়নি প্রাচ্য গানের ক্ষেত্রে তা আমরা সবাই জানি। তাঁর একের পর এক ছবিতে ধরা আছে ভারতীয় সংগীতের ঐতিহ্য। কখনো কণ্ঠে, কখনো আবার যন্ত্রে। রবীন্দ্রনাথের গান যখন এনেছেন – গাইয়েছেন অমিয়া ঠাকুর, শ্রমণা গুহঠাকুরতা, রুমা গুহঠাকুরতা — এঁদের দিয়ে। আবার বেনারস ঘরানার গজল গাইয়েছেন রেবা মুহরীকে দিয়ে। ‘অপুর সংসার’-এ ব্যবহার করেছেন ভাটিয়ালি – “ও বন্ধু রে, ঘরবাডি ছাডিলাম রে”। ‘সোনার কেল্লা’য় রাজস্থানী লোকয়ত গান। ‘কাঞ্চনজজ্ঘা’য় আমাদের বুক তোলপাড় করা তিব্বতী সুর। সত্যজিতের গুপীবাঘা তো গান গাইতে এলই খোদ বাংলাদেশ থেকে। ইন্দির ঠাকুরণের গলায় ফিকিরচাঁদি গান ‘হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল, পার করো আমারে’ — চিরদিন খণী হয়ে থাকব আমরা। ঋণী হয়ে থাকব আমরা ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’তে লক্ষ্ণৌ ঘরানায় অতুলপ্রসাদের গানের কাছেও।
শুধু কণ্ঠই নয়, যন্ত্রও পদে পদে আমাদের মাথায় মনে জানান দিয়েছে প্রাচ্যকে। ‘পথের পাঁচালী’-র মনকেমন করা থিম মিউজিকে আমরা শুনছি আড়বাঁশি আর সেতারের যুগলবন্দী। দুর্গার মৃত্যুর সময় সর্বজয়ার আকুল কান্না মিশে যাচ্ছে সানাইয়ের শব্দে। ‘দেবী’তে বেজেছে অষ্টাদশ শতাব্দীর ফসল ‘কালীকীর্তন’। ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ সশব্দে আমাদের ঐতিহ্যের মাটিতে পা ঠোকায় বাংলা ঢোল দিয়ে। ‘পথের পাঁচালী’তে সুব্রত মিত্রর বাজানো সেতারের গৎ দিয়ে। তবে কোনো ছবিতেই কোনো বিশেষ একটাই কেবলমাত্র বেজেছে তা নয়, রয়ে গেছে একাধিক যন্ত্রের সমন্বয়। কোনোটা জোরে, কোনোটা বা একেবারেই আস্তে। আবার একই ছবিতে কোনো যন্ত্র বাজছে আপার অকটেভে, কোনো যন্ত্র লোয়ার অকটেভে। অলোক রায়চৌধুরী ‘দেশ’ পত্রিকার বিশেষ সত্যজিৎ সংখ্যায় (১৯৯১) ‘দুই রূপকার’ শীর্ষক স্মৃতিচারণে লিখছেন যে, তিনি যখন অলোকনাথ দে-কে প্রশ্ন করেছিলেন সত্যজিতের যন্ত্র বিষয়ে পক্ষপাতিত্বের বিষয়ে, তখন উত্তর পেয়েছিলেন এইরকম, “দেখুন পাশ্চাত্যের সুরের যে বিবর্তন, সেটা সত্যজিৎবাবুর মানে অর্থাৎ স্ট্যান্ডার্ড-এ হয়তো অনেক নামডাকওয়ালা বিশেষজ্ঞও বোঝেন না। আবার দক্ষিণ ভারতীয় সঙ্গীতের প্রতিও তীব্র আকর্ষণ রয়েছে ওঁর। কিন্তু সে তো অনেক লে-ম্যানেরও থাকে । আসল ক্ষমতাটি হল ব্লেন্ডিং-এর। সে কাজে উনি সকলকে চমকে দিয়েছেন। সত্যি কথা বলতে কি, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর সুর শোনার আগে পর্যন্ত আমিও জানতাম না, আমার মধ্যে কুলোয়নি কত বড় সাঙ্গীতিক প্রতিভা, সুরকার সত্তা রয়েছে ওঁর মধ্যে।” এই ব্লেন্ডিংটা করছেন একজন পারফেকশনিষ্ট।
৩.
এবার তাহলে ফিরে যাই গোড়ার প্রশ্নে।
প্রশ্নটা ছিল প্রথম জীবনে কি সত্যজিৎ প্রাচ্য সঙ্গীতের প্রতি অনাগ্রহী অথবা নিরুৎসাহী ছিলেন? অথবা ছিলেন প্রাচ্য সংগীতের সামর্থ্যের প্রতি সংশয়ী?
একদম ছোটবেলায় গড়পারের বাড়ির স্মৃতিচারণের সময় সত্যজিৎ নিজে উল্লেখ করেছেন দোতলার দক্ষিণপূর্ব কোণের ঘরের লাগোয়া শানবাঁধানো বৈঠকখানার। কেন? না, সে ঘরের ইজ্জত হল তাঁর অতিপ্রিয় একখানা চোঙাওয়ালা গ্রামোফোন। নলিনী দাশের স্মৃতিচারণে (‘সত্যজিৎ রায়ের ছেলেবেলা’, নবকল্লোল, সত্যজিৎ রায় বিশেষ সংখ্যা, ১৯৯১) ‘কেরোসিনের গান’, ‘হনলুলু’ গান-এর উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের চর্চা যে ছিল না, তা পরিষ্কার। সুপ্রভা দেবীর আয়োজনে ব্রক্ষ্মসঙ্গীত বা অন্যান্য ভালো গান কোরাসে গাওয়া হত। সত্যজিৎ এই আসরে কিন্তু গায়ক নন, শ্রোতা নেহাতই। সদ্যশৈশবের সেই দিনগুলোতে ধ্রুবতারার মত জেগে আছে একটা ঘটনা । বাবার (সুকুমার রায়) বন্ধু প্রশান্তচন্দ্র মহালানবীশের ছোটভাই প্রফুল্লচন্দ্র মহলানবীশের একটা গ্রামোফোনের দোকান ছিল। চারবছরের ছোট্ট মানিককে তিনি একটা কিভিদো আর একটা গ্রামোফোন উপহার দেন। এর মধ্যে ছিল বেঠোভেনের ভায়োলিন কনচের্টোর শেষ মুভমেন্ট। তখন তারা মামারবাড়িতে, বকুলবাগানে কিংবা হয়তো দ্বিতীয় ভাড়াবাড়ি বেলতলায়। এই বেলতলার বাড়িতে আসতেন ক্ষিতিমোহন সেন। প্রত্যেক বছর। সুকুমার রায়ের জন্মদিনে আর মৃত্যুদিনে। প্রার্থনা হত, গানও হত। এরপর যখন রাসবিহারীতে বাড়ি করে গেলেন সত্যজিতের মামা প্রশান্তকুমার দাশ, তখন সেই বাড়ির একতলায় গোল একখানা ঘরে হত রিহার্সাল। রেডিও শোনা হত, রেকর্ড প্লেয়ারে রেকর্ড বাজানো হত। এখানেই সত্যজিতের মাসি কণক বিশ্বাসের পরিচালনায় চলত ‘গীতবিতান’-এর রিহার্সাল। প্রশান্তকুমার দাশের কন্যা রত্না দাশের একটি প্রবন্ধে (শিরোনাম: ‘আমাদের সবার বড়দা’) এই রিহার্সালের ছবি পাওয়া যায়, তিনি লিখছেন, “আমার পিসি, বড়দার মাসি কণক বিশ্বাসের পরিচালনায় চলতো সারাবছর ধরে রিহার্সাল। গানের দলে ছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন, অরুন্ধতী গুহঠাকুরতা, রাজেশ্বরী দত্ত। মাসের পর মাস এই বাড়িতে রিহার্সাল দিতে আসত। আর জর্জদা, দেবব্রত বিশ্বাস তো আমাদের বাড়ির লোক। বাবা গোল ঘরটা বানিয়েই ছিলেন ছোট পিসির রিহার্সালের জন্য। প্রায়ই আসতেন হিমাংশু দত্ত। একবার কয়েকমাস ধরে ‘মায়ার খেলা’-র রিহার্সাল হয়েছিল। আমরা বাইরের বারান্দায় বসে মহলা শুনতাম।”
অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের গানের পাঠে সত্যজিৎ সরাসরি অংশগ্রহণ না করলেও বাড়ির আবহাওয়া থাকত সুরে টইটম্বুর। সত্যজিতের গলায় তখন দু-খানা গান বাড়ির সবাই প্রায়ই শুনতে পেতেন – ‘অলি বার বার ফিরে যায়, অলি বারবার ফিরে আসে’ আর ‘ওকে বোঝা গেল না, চলে আয়, চলে আয়।’ কখনও গলায় গেয়ে, কখনও শিস দিয়ে গেয়ে সেই প্রিয় গানগুলোর সঙ্গে তিনি আছেন। বাড়িতে যে গানবাজনার আসর বসছে সেখানে আসছেন দিলীপ রায়, তারাপদ চক্রবর্তী, কে.এল. সায়গল। রেডিওতে বিবিসি আর ‘ভয়েস অব জার্মানী’ থেকে ভেসে আসা সুরে দিন কাটত একা সতাজিতের নয়, বাড়ির সকলেরই প্রায়। ডোভার লেনে, আশুতোষ কলেজে কিংবা দক্ষিণ কোলকাতার খোলা মাঠে প্যান্ডেল করেও তখন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের সারারাতব্যাপী অনুষ্ঠান হত। সত্যজিৎ এবং তার ভাইবোনের সেই অনুষ্ঠান শুনতেন বাউন্ডারির বাইরে মাঠে কাগজ পেতে বসে । কারণ টিকিটের দাম ছিল তাদের সাধ্যের অতীত।
কিন্তু খোলা মাঠে এভাবে কাগজ পেতে বসে টানা তিন-চারদিন সারারাত উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শোনার ধৈর্যকে কি ‘আনাগ্রহ’ কিংবা ‘নিরুৎসাহিতা’ আখ্যা দেওয়া যায়? বলে দেওয়া যায় যে, কেলমাত্র ওয়েস্টার্ন ক্লাসিকালেই তার ভরপুর আগ্রহ? ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে নয়?
১৯৩৬-এ সত্যজিৎ প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি নিয়ে পড়া শেষ করে ১৯৪০-এ শান্তিনিকেতনে যখন এলেন তখন তাঁর কাছের বন্ধু হলেন দিনকর কৌশিক এবং পৃথ্বীশ নিয়োগী। উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের বহু আলোচনা সত্যজিৎ এঁদের সঙ্গে বিশেষ করে দিনকর কৌশিকের সঙ্গে করতেন। শুধুমাত্র শোনা নয়, ঘরানা এবং গায়কী নিয়ে আলোচনাও চলত তাঁদের। কলাভবনের ছাত্রাবাসের সামনেই ছিল রামকিঙ্কর বেইজের মাটির বাড়ি। দরাজ গলায় শিল্পী গাইতেন রবীন্দ্রনাথের গান। সেই গান শুনতে শুনতে দুই বন্ধু মেতে উঠতেন রাগ নিয়ে গভীর আলোচনায়। সন্ধেবেলা হাতে রেকর্ডের অ্যালবাম নিয়ে তিনি যেতেন অ্যালেক্স আরানসনের বাড়ি। আর রেকর্ড শুনে আবার রেকর্ড নিয়ে ফিরতেন। এই সময়ই বিষ্ণুপুর ঘরানার অশেষ বন্দ্যোপাধ্যায় শান্তিনিকেতনে এসরাজ বাজাতেন। অসম্ভব পাণ্ডিত্য ছিল তাঁর এসরাজ এবং বিষ্ণুপুর ঘরানা বিষয়ে। শুধুমাত্র ঘরানা নয়, বিষ্ণুপুর রাজবংশের ইতিহাস, দুশ বছরের সংগীত চর্চা, বিষ্ণুপুর রাজাদের সংগীতাচার্যদের পৃষ্ঠপোষকতা – এইসব ছিল তাঁর বলার বিষয়। সত্যজিৎ তাঁর এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছেন,
“অশেষবাবু এসরাজ বাজাতেন। উনি বিষ্ণুপুর ঘরানার। ওনার ঘরে আড্ডা হত। বিষ্ণুপুর ঘরানা সম্পর্কে অনেককিছু জানতেন। অনেক রাগ বাজাতেন যেগুলো বিষ্ণুপুর ঘরানার সঙ্গে আাসোসিয়েটেড। কিন্তু নর্থ ইন্ডিয়ান মিউজিশিয়ানদের কেউ বাজায় না। ‘জলধরকেদারা’ বলে একটা রাগের কথা আমার এখনও পরিষ্কার মনে আছে।” (সাক্ষাৎকার – অভিজিৎ দাশগুপ্ত)
এই হল মোটামুটি ১৯৪১ সাল অবধি তাঁর এদেশের গান, ভারতবর্ষের গান নিয়ে নাড়াচাড়ার গল্প। যখন রাগ শুনে চিনতে পারাটাই তার কাছে একটা চ্যালেঞ্জের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হেমেন্দ্রলাল রায়ের ‘রাগনির্ণয়’ বইখানা তিনি তখন ভীষণ কাজে লাগিয়েছেন। পাগলের মত শুনছেন ফৈয়জ খাঁ, করিম খাঁ, পলুসকরের রেকর্ড। শুধু শুনছেনই না, ভারতীয় সংগীত সম্পর্কিত বই সংগ্রহ করছেন, ম্যাগাজিন পড়ছেন। স্বরলিপি উদ্ধার করতে শিখেছেন নিজেই, কারো সাহায্য নেননি।
কী বলব এইসব জলছবিকে আমরা? পাঠক বলুন।
8.
তবে হ্যাঁ।
কিছু কিছু ব্যাপারে একটু সংশয় বোধ করতেন। পারিবারিক সূত্রে গান রাক্তে থাকা সত্ত্বেও সর্বসমক্ষে গাইতে নার্ভাস বোধ করতেন। আথচ গাইতে যেমন পারতেন সহজে, শেখাতেও পারতেন। পাখোয়াজ শিখেছিলেন একবছর শিখেছিলেন তালও। কিন্তু সেইসমস্ত শেখাকে আত্মস্থ করার আর সময় হয়নি হয়তো পরপর এসে পড়া ব্যস্ততায়। তাই ‘নার্ভাস ‘ হবার ব্যাপারটা ‘কনফিডেন্স’ এ পরিণত হতে পারেনি। কিন্তু নার্ভাসনেসকে ঠিক ‘অনাগ্রহ’ বলা যায় না বোধহয়। পাশ্চাত্য সঙ্গীত ওঁর পরিবারের মধ্যে ভেসে বেড়ায়নি, সবার রক্তে আন্দোলিত হয়নি, তাই তাকে চর্চায়, অনুশীলনে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিতে হয়েছিল। এই চর্চা, এই অনুশীলনকেই কি মারি সিটন বোঝাতে চেয়েছিলেন ‘followed a routine of playing’ দিয়ে? আর জল হাওয়া রক্তের সঙ্গে মিশে থাকা প্রাচ্য সঙ্গীত তাই ‘rather little’ এর তালিকাভুক্ত?

৫.
সত্যজিতের প্রাচ্যের গানের প্রতি ‘অ-নিরুৎসাহীতা’র প্রসঙ্গ এখানেই শেষ করা যায়। কিন্তু ভারতবর্ষীয় সঙ্গীত এবং ভারতীয় যন্ত্র কিভাবে ভবিষ্যতে তার ছবিরও অপরিহার্য বিষয় হয়েছে, তা অল্প করে হলেও আর একবার না বলা অবধি যেন মন মানে না।
অন্ধকারের মধ্যে পাখোয়াজের দ্রিমি দ্রিমি আওয়াজ তুলে ‘পথের পাঁচালি’ শুরু হচ্ছে। আড়বাঁশির ডাক এসে মিশল তাতে একটু পরেই। আর সেতারের গৎ ক্রমাগত অপু-দুর্গার শৈশব ছুঁয়ে, সর্বজয়ার লড়াই ছুঁয়ে মিশে যেতে থাকল আকাশে। নিশ্চিন্দিপুরের বাতাসে আন্দোলিত হতে থাকে কখনও গৌড়সারং, কখনও বিলাবল। আমাদের দেশগাঁয়ের তার সানাই বেজে চলল পটদীপে দক্ষিণামোহন ঠাকুরের হাতে ছবির শেষটানে। যদিও এ ছবির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন রবিশঙ্কর, তবুও ভিন্ন প্রদেশের এই মানুষটিকে যে সত্যজিৎ ক্রমাগতই পরামর্শ দিয়ে গেছেন বাংলাদেশের যন্ত্র এবং সুর ব্যাবহারের, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
‘জলসাঘর’ সম্পর্কে কোনো বাক্য লেখার আগে ১৯৬৯ সালে মে মাস নাগাদ ‘কলকাতা’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সত্যজিতের নিজের বক্তব্যকে একবার দেখে নেওয়া যাক, “পথের পাঁচালী করলাম। আর ‘পথের পাঁচালী’র পর অটোমেটিক্যালি ‘অপরাজিত’টা এসে গেল। তারপর ‘অপরাজিত’ যখন মার খেল, তখন আই ওয়ান্টেড এ কনট্রাস্ট। এবং কী কনট্রাস্ট করা যায? আমার মনে হলো বাঙালিরা তো গান-বাজনা পছন্দ করে, ‘জলসাঘর’ করা যাক। ‘জলসাঘর’-এ কিন্তু গান-বাজনা ভয়ানক সিরিয়াস হয়ে গেল। ‘জলসাঘর’-এ যে ধরনের কনসেনট্রেটেড হাই কোয়ালিটি ক্লাসিকাল মিউজিক ছিল, সেটা তো সচরাচর থাকে না ।”
‘জলসাঘর’ এ ভারতীয় রাগসঙ্গীত ঠিক ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হয়ে থাকেনি। সামন্ত সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে, জমিদার বিশ্বম্ভরের অন্যতম নেশা হিসেবে সে যেন নিজেই আর একখানা চরিত্র এ ছবিতে। এই বাংলায় ‘জলসাঘর’-এর আগে ‘তানসেন’, ‘যদু ভট্ট’, ‘বিদ্যাপতি’, ‘মীরাবাঈ’, ‘কবি’, ‘উমরাওজান’ – ইত্যাদি ছবি ভারতীয় গানের ডকুমেন্টেশনের প্রমাণ রেখে গেছে। ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুমরী, গজল, ভজন – কী নেই? কিন্তু ‘জলসাঘর’-এ স্বয়ং বেগম আখতারকে করা হল বাঈজী – সালামত খাঁ বা রোশনকুমারীকেও কাজে লাগানো হল। অর্থাৎ মুজরোর দৃশ্য যাতে জীবন্ত হয়। জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই এই অরিজিনালিটি মানুষটিকে তাড়া করেছে। আর সেই তাড়নাই তাকে এগিয়ে দিল নিজের ছবির মিউজিক নিজেই করার সিদ্ধান্তে।
‘তিনকন্যা’ থেকে সত্যজিৎ নিজের হাতে তুলে নিলেন ছবির সংগীত পরিচালনার দায়িত্ব। গড়পারের বাড়িতে দোতলার বৈঠকখানায় যে গ্রামোফোনখানা ফেলে এসেছিলেন ‘সমাপ্তি’-তে সেখানা এনে বসিয়ে দিলেন অমূল্যর শোবার ঘরে। আবার ‘পোস্টমাস্টার’-এর রতনের গলায় গাওয়ালেন সেই অবিস্মরণীয় পুরাতনী গান…
আধো আধো স্বরে ডাকে বারে বারে
ভ্রমে শিশু বলে কারো নাহি দেখা পায়।
সেই শিশুকন্যাই আবার যখন মা বাবার মৃত্যুর কথা বলে তখন বেজে ওঠে বেহালা। ‘সমাপ্তি’তে বার কয়েক ফিরে ফিরে আসছে দ্বিজেন্দ্রলালের ‘ও কেন দেখা দিলো রে, না দেখা ছিলো ভালো’। এ ছবিতে যখন মৃণ্ময়ী বেরিয়ে পড়ে অর্ধেক রাতে এসে দোলনায় দোল খেতে লাগল, তখন বাজতে থাকল সেতার-সরোদ-কাড়া-নাকাড়া … আবার সব থামিয়ে দিয়ে শেষে সলঙ্জ মৃন্ময়ীর দৃশ্যে শুধু রইল কলের গানের রেকর্ডহীন হয়ে ঘুরে যাবার শব্দ। নিজের হাতে নেওয়া প্রথম ছবির আবহসংগীত। কী আছে তাতে? আছে ছোটবেলার গ্রামোফোন, আছেন দ্বিজেন্দ্রলাল, আছে সারিন্দা আর আছে কলের গান, রেকর্ডহীন। আছেন রবীন্দ্রনাথ বেলাশেষে রাজপুরীতে বাশি বাজানোর জন্য।
পরের বছরই ‘কাঞ্চনজজ্ঘা’ এবং ‘অভিযান’। আর তার পরের বছর অর্থাৎ ১৯৬৩ তে ‘মহানগর’।

‘চারুলতা’ ছবির মিউজিক সত্যজিৎকে বেশ আত্মতুষ্টি দেয়। “আজ অবধি ঘে কটা ছবিতে আমি নিজে সঙ্গীত রচনার দায়িত্ব নিয়েছি তার মধ্যে চারুলতার সঙ্গীত আমার কাছে অপেক্ষাকৃত সাবলীল ও সুপ্রযুক্ত বলে মনে হয়েছে। এর একটা কারণ অবশ্য অভিজ্ঞতা। আবহসঙ্গীতের কাজে অভিজ্ঞতার মূল্য অনেক। ছবির মেজাজ সম্বন্ধে একটা স্পষ্ট ধারণা থাকলেও কোন দৃশ্যে বা কোন্‌ কোন্‌ যস্ত্রে কোন্‌ সুর কোন্‌ লয়ে কোন্‌ তালে বাজালে এই মেজাজের সঙ্গে মিলবে, এ জ্ঞান সহজলভ্য নয়।” (বিষয় : চলচ্চিত্র)
ঠিক। সহজলভ্য নয়। চরুলতার একটা গান ‘আমি চিনি গো চিনি তোমারে’ – অমলের মুখে যেমন ছিল মোটামুটি তেমনই বসিয়ে দেওয়া হয়েছে শেষের চমকটুকু ছাড়া। কিন্তু ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’-র ক্ষেত্রে গানের বাণী বাদ দিয়ে শুধু সুরকে পটভূমি করে রেখে ছবির মোটিফ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এছাড়াও রামমোহনের ‘মনে করো শেষের সে দিন ভয়ঙ্কর’ যেমন এ ছবিতে ব্রাহ্মসংস্কৃতির প্রমাণ তেমনই পাশাপাশি নিধুবাবুর টপ্পা এসেছে বাবুকালচারের প্রতিনিধি হয়ে।
সহজলভ্য নয় যে জ্ঞান, আবহসঙ্গীতের জ্ঞান – সেই কঠিন বিষয়কে মেলে ধরার জন্য পদে পদে সত্যজিৎ ভারতবর্ষীয় সঙ্গীতকেই নির্বাচন করছেন। তিনি জানতেন, যে শব্দ হাওয়ার ভাইব্রেশন থেকে তৈরী হয় তাতে শরীরের নিঃশ্বাস আর প্রজ্ঞার আগুন মিশে থাকে। ‘Struck sound, is the stuff of man-made music. It is believed however to reflect the laws of the universe and results from the union of physical breath with the fire of intellect.’ (The Larousse Encyclopedia of Music)
সত্যজিতের ছবিতে, জীবনে, চিন্তায়, কাজে হাওয়ার মত, জলের মত মিশে আছে ভারতবর্ষীয় সঙ্গীত।

সহায়ক গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা
১. দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়, বিষ্ণুপুর ঘরানা, বুকল্যান্ড প্রাইভেট লিমিটেড, প্রকাশকাল উল্লেখহীন।
২. ধ্রুবজ্যোতি মণ্ডল সম্পাদিত, বৈশাখী, শতবর্ষে সত্যজিৎ রায় ও পন্ডিত রবিশঙ্কর-সংখ্যা, ২০২০-২১।
৩. মঞ্জিল সেন, অদ্বিতীয় সত্যজিৎ, বুকফার্ম, মে ২০২০।
৪. সত্যজিৎ রায়, বিষয়: চলচ্চিত্র, আনন্দ পাবলিশার্স, মার্চ ১৯৮৯।
৫. সন্দীপ রায় সম্পাদিত, সত্যজিৎ রায় সাক্ষাৎকার সমগ্র, পত্রভারতী, ফেব্রুয়ারি ২০২০।
৬. হরিহর প্রসাদ মণ্ডল সম্পাদিত, কলকাতা পুরশ্রী, শতবর্ষে সত্যজিৎ-সংখ্যা, কলকাতা পৌরসংস্থা, জানুয়ারি ২০২১।
৭. সাগরময় ঘোষ সম্পাদিত, দেশ, সত্যজিৎ রায় বিশেষ সংখ্যা, ১৯৯১
৮. Geoffrey Hindley Ed. The Larousse Encyclopedia of Music, Hamlyn,
৯. Marie Seton, Portrait of a Director Satyajit Ray, Penguin Books 2003.

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes