
শ্যামাশীষ জানা-র কবিতাগুচ্ছ
করুণা
করুণার ছায়া কেন ভাসিয়ে দাও না এই বাতাসে বাতাসে
যেভাবে নরম তুলোর ভেতর শিমুল শূন্যের দিকে ছড়িয়ে দেয় বীজ
আয়ু কাঁধে নিয়ে এক কালপুরুষ হেঁটে যায় ম্রিয়মাণ ছায়াপথে
নিঃসঙ্গতাকে খুঁড়ে খুঁড়ে অবিরাম খুঁজে চলে আত্মশুদ্ধির চোরাস্রোত
অবচেতনে কেউ রং-ঝুমুর নৃত্য করে চলে যায় দুঃখহরণের দিকে
জীবনের চেয়ে বেশী বড় কেউ নয় এই সংসার নাট্যমেলায়
তোমার হঠাৎ ছেড়ে যাওয়া দেখে মনে হয়, চলে যাই বিপ্রতীপ কোনে
সময়কে দেখব বলে নগ্ন দাঁড়িয়েছি নিঃশব্দ আয়নার সামনে
আজ আর কেউ নেই কিছু নেই সব সূর্য্য ডুবে গেছে
একথা ফেসবুকে লিখে একজন অকালে ঝাঁপ দিল আঁধারে
তার মনে-প্রাণে কেন দিলে না একবিন্দু আলো, একফোঁটা জল?
এসব বিচ্ছেদশোক সুনিপুণ খুঁটে খুঁটে খায় ছাইরঙা নাগরিক কাকের দল
ঝরাপাতার মায়াগন্ধ লেগে থাকে তোমাকে চেনার সমগ্রপথ জুড়ে
আলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া হৃদয়ের ক্ষতচিন্হ কে দেয় মুছে?
হিসেব
আর সবাই-এর মধ্যে এঁটে উঠছে না সবাই
রাষ্ট্রের ভেতর গড়ে উঠছে না দেশ
দেহের ভেতর শরীর জেগে উঠছে না
নদীর ভেতর পারাপার
প্রাণের ভেতর আয়ু
জলের ভেতর জল-ময়ূর
আলোর ভেতর আহ্বান
রসের ভেতর টইটম্বুর
জেগে উঠতে চাইছে মাটি থেকে এক পোড়খাওয়া ঘোড়া
তার সামনের দুটো পা ভীষণ লম্বা
আর পেছনেরগুলো অপেক্ষাকৃত বেশ ছোট
লেজটিও অনুকূল প্রবাহে নাড়তে পারে ভালই
ক্ষমতাশালীদের ক্যালসিয়ামের অভাবজনিত কারণে
ডাক্তার বলেছেন, বেশী বেশী সরলপুঁটিদের খেতে
পুরো দেহ কাঁটাসহ ভাল করে চিবিয়ে চিবিয়ে
এক্কেবারে গিলে-গিলে ফেলতে-ফেলতে
দেখে নিতে যেন কণামাত্র অবশিষ্ট পড়ে না থাকে
এদিকে টগবগিয়ে লেজ নাচিয়ে ঘোড়া ছুটেছে
কিছু মানুষ নাকি পাগল হয়ে সত্যি মারা গিয়েছে
রোদ্দুর নামক অলীক নেশা ঝিলমিল ফুটেছে
তুচ্ছ অস্তিত্বের গায়ে বড্ড বেশী ভুল লেগে আছে
ভয়ানক
যাও ৫৬ বার কেটে আনো ওদের হাত-পা, একে একে সর্বাঙ্গ
কোনও গভীর প্রশ্ন করার আগেই উপড়ে নাও জিহ্বার স্পর্ধা
কিভাবে এত দয়াহীন হয়ে রেখেছ পা বুকের উপর
আমাদের কোনও মুখ নেই, প্রতিবাদ নেই মনের ভেতর
মুছে ফেলো রক্তচিহ্নের মত সব আবছা ছবিগুলো
ওদের সামনে এনে দাঁড় করাও এক অদ্ভুত ঈশ্বরকে
প্রভু ক্ষমা দাও, অন্তত কণামাত্র ক্ষমা দাও এই প্রাণে
কোনও বিচার চাই না, কিছুই ঘটেনি একথা সবাই জানে
ভীড়কে নির্দেশ দাও ওদের ঘিরে ধরে পিষে ফেলতে
সমস্ত স্মৃতি সুনিপুণ মুছে দাও মিথ্যা বলতে বলতে
আমাদের কোনও স্মৃতি নেই, আত্মা নেই, কান্না নেই, রাগ নেই
টুকরো টুকরো করে কেটে বিছিয়ে রাখো পথের দুপাশে
যেভাবে গাছের ডালপালা-কাণ্ড কেটে ফেলে রাখা হয়-
তোমার রাস্তাগুলি আরও একটু প্রশস্থ করার জন্য:
অবনমনের রাস্তারা!
শান্তি
অলিন্দের ভেতর দিয়ে হেঁটে যাই একা
দরজা খুলে দেখি আরও এক দরজা
প্রতিটি প্রবেশের ভেতর আরও এক অনিশ্চিত প্রবেশ
মননের রাস্তার ভেতর গোপন রাস্তার দল
ঘিরে ধরে এক অদ্ভুত শান্তির জলোচ্ছাস,
আহত বুকের উপর ফুটে ওঠে ব্রহ্মপুষ্প
মনের সমুদ্রতীরে বাঁধা অনেক নৌকার ছবি
দেহের নৈরাশ্য জুড়ে ঢেউ তোলে অবন্ধু নোনা-সুনামি
শঙ্খ বাজল, মুহুর্ত কাকে ঠিক কোন অবস্থানে দাঁড় করায়
এর কোনও প্রতিশ্রুতি কিংবা নির্মাণের সমীকরণের কঙ্কাল-
প্রেরণা জাগায় না আদিমতম আকর্ষণ-বিকর্ষণের রহস্য সন্ধানে
শান্তি এল, প্রাচীন শম্বুকের দল জিহ্বা বের করে হেঁটে যায়,
মহাকাশের নিষিদ্ধ বাষ্প পান করার জন্য খুঁজে নেয় বিদ্যুৎগর্ভ
ঘুম এল, মহানিদ্রা মোক্ষবেশে সেজে ওঠে
এক অনন্য ব্যাস্তানুপাতিক অলংকরণে
গোপন প্লুটো
অন্ধকারের হাতে হাত রাখলে উঠে আসতে চায়
এক সর্বাত্মক তত্ত্ব
মহাকাশে অনন্তে ভেসে যায় বায়ুমণ্ডলহীন-
শ্বাসরুদ্ধ গ্রহদের বিষণ্ন স্তন
স্বপ্ন থেকে সুষুপ্তির পথ জুড়ে শুয়ে থাকে
দায়িত্বজ্ঞানহীন শবের দল,
রাত্রি মাটি আঁচড়ে আঁচড়ে উদ্ভ্রান্ত শৃগাল খুঁজে মরে
অন্য ছায়াপথে চন্দ্রমেরুতে লুকানো শান্তিজল
গৃহস্থ কক্ষপথেরা মুহূর্তে ভীষণ বদলে যায়
ধ্যানে আহত দিগন্তের গ্লানির মতো,
জীবনে সূর্য্যকাম তেজ আবর্ত থেকে অনেক দূরে
লুকিয়ে থাকে প্রদক্ষিণরত গোপন প্লুটো