
রূপশ্রী ঘোষের কবিতা
প্রাক্তন
একটা তালগাছ
তার নিচে দাঁড়িয়ে আমরা
গায়ে অন্ধকার মেখে
আমি তোমাকে জড়িয়ে বললাম,
এ প্রেম আর টেকানো সম্ভব নয়।
তুমি নির্বিকার
প্রেম ভাঙার সাক্ষী সেই তালগাছ।
জানো, নীলু কাকাদের সেই তালগাছ আর নেই।
তার নিচে রাত সাক্ষী রেখে
কেউ আর অন্ধকার মাখে না।
সেখানে এখন শাক বোনা হয়।
বৈভব
তোমার ছিল বৈভব আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত।
তুমি কমপ্লান হাতে ছাদে নিশ্চিন্ত পায়চারি
আমি সাইকেল ছুটিয়ে প্রাইভেট টিউশন।
তুমি লিখলে,
তোমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ
দুয়ারে দাঁড়িয়ে রব একা, শুভক্ষণ হঠাৎ এলে
তখনই পাব দেখা।
একদিন বৈভব কাছে টেনে নিল নিম্ন মধ্যবিত্তকে।
দুজনের চলার পথ হল একাকার। নাম দিলে প্রেম।
চলো, আমরা দুজন নাম পালটে নিই।
তুমি মেঘ আমি বৃষ্টি।
না, এ বড়ো বস্তাপচা।
তাহলে? তুমি প্রেম আমি ভালোবাসা?
হ্যাঁ, বেশ ভালো।
ভালো? এ তো আরও বস্তাপচা।
না, তবুও চিরন্তন।
প্রেমেও তোমার প্রাচুর্য এতটুকু হলে না অকৃপণ।
রচনা করলে বৃন্দাবন তুমি বাঁশি হাতে রাখালরাজা।
মাঝে এল একরাশ ঘৃণা।
ভালোবাসা হল অবহেলিত।
নিজেকে করল উদাসীন।
ভালোবাসারা অবহেলিত হয়েই ঘর করে।
অঙ্কন
আঁকতে হবে কিছু। সে তো তুমি আছো। আমি নিশ্চিন্ত মন। প্র্যাকটিক্যাল খাতার ধার বেয়ে বয়ে যেত কত লতা পাতা। ফুলও থাকত। স্বপ্নও আঁকতে পারতে তুমি। আঁকতে দিতাম না কেবল সরীসৃপ। একদিন খাতা জুড়ে এঁকে দিলে সাদা সরস্বতী। তোমার বন্ধুরা ভেবে বসল আমাকে। ভাবল তুমি আমাকেই এঁকেছো। ঠাট্টা শুরু করে দিল শ্লোকে।
কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে। দেখেছি তোমার রক্তিম দু’গাল। তবুও তুমি কী শান্ত। আঁকলে সরস্বতী কিন্তু বীণায় কোনদিন তুলতে পারলে না তান। বুক ভরে জমা হল অভিমান। একদিন খাতায় নিজেকে এঁকে দিয়ে বললে, এই দ্যাখ, আজ তোর জন্য আমি এঁকেছি এক মেরুদণ্ডহীন প্রাণী। স্পষ্ট হল নিজের প্রতি প্রবঞ্চনা। আমিই তোর সরীসৃপ। স্বপ্নে তুমিই আসো রোজ।
রচনা
আমি গেলাম তোমার কাছে রচনা লেখাতে। তুমি রচনা করলে আমাকে। তাতে মেশালে আপন মনের মাধুরী। খাতা জুড়ে তোমার অক্ষরের ফুলঝুরি। ফুটে উঠলো ফুলের মতো। খাতার কোণায় আঁকলে সাদাকালো টিভি। নাম দিলে অনিডা। তা থেকে বেরিয়ে এল সিংওলা মুখ। আমার দিকেই তাকিয়ে। অপূর্ব তোমার শিল্পকর্ম। মুগ্ধ হতাম রোজ। এভাবেই চলত রচনা লেখা। একদিন আমার হাতটা ধরে এঁকে দিলে কাটাকুটি খেলা। তৈরি হল ক্ষত চিহ্ন। রচনা লেখাও হল অনেক। কেবল রচিত হল না তোমার আমার গল্প। রয়ে গেল অসমাপ্ত।
অঙ্ক
তুমি বলতে, এ প্লাস বি তার হোল স্করারের ফুর্মূলা বল। আমি ভাবতাম তার কি দরকার? দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকলেই তো অঙ্ক হয়ে যায়। মাথায় ছোট্ট করে গাঁট্টা দিয়ে, এটাও পারবি না? কিছুই কি পড়িস না? এ স্কয়ার প্লাস টু এ বি প্লাস বি স্কয়ার। মনে থাকবে? কখনও দুষ্টু হাসি দিয়ে বা কখনও ফ্যালফ্যাল করে তোমার দিকে তাকিয়ে বোঝাতাম দরকার কী? তুমি রাগ করতে না। খুশিও হতে না। তুমি কী ভাবতে জানি না। হয়তো ভাবতে তুমি কী ব্যর্থ? নাকি আমার যথেষ্ট বুদ্ধি নেই। না, কোনোটাই ঠিক নয়। আমি অঙ্ক ছেড়ে চলে যেতাম রসায়নে, আর তুমি? তুমিও ব্যর্থ নও। ভালোবাসার অঙ্ক আলাদা। ছেড়ে দিয়ে ধরে রাখে। আমিও আজও তোমায় ভালোবাসি। ঠিক যেমনটা তুমিও আমাকে…।
বর্তমান
অনেক গল্প বলতে তুমি। তোমার একটা ডায়েরি ছিল। ডায়েরি থেকে বেরিয়ে আসত মুহুর্তরা। তোমার এক একটা মুহূর্ত। সব শুনতে হত আমাকে। তোমার মুহূর্তের সঙ্গে মিশে যেত আমাদের বুনতে থাকা স্বপ্ন। স্বপ্নের গাছে জল দিয়ে ফোটাতে কত ফুল। রঙিন রঙিন ফুল। তাতে প্রজাপতিও এসে বসত। মুহূর্তগুলো প্রজাপতিকেও মাতিয়ে রাখত। একদিন ঝড় এল। রঙিন ফুল গাছ তছনছ হল। নটে গাছও তো মুড়োয়। গল্পও শেষ হয়। সেভাবেই শেষ হল তোমার মুহূর্ত শোনার গল্প।
তুমি
দুহাত ভরে বকুল ফুল নিয়ে যেতাম তোমার কাছে। তুমি হাত থেকে ফুলগুলো নিয়ে সাজিয়ে দিতে বিছানায়। ভালোবাসার চিহ্নের আকারে। কী ভাবতে জানি না। ওটাই কি ছিল তোমার ফুলশয্যার কল্পনা? কিন্তু কোনোদিন বলোনি, ভালোবাসি। আমিও বলিনি কখনও। অথচ এটাই ছিল আমাদের ভালোবাসা। তোমার কাছে আমি ছিলাম প্রজাপতি। ওই নামই দিয়েছিলে তুমি। তোমার চারপাশেই উড়ে উড়ে বেড়াতাম। মাঝে মাঝে নিজে বকুল ফুলের গন্ধ শুঁকতে। আমার চুলেও পরিয়ে দিতে বকুল। যখন দুহাত ভর্তি বকুল ফুলের মুঠো মেলে ধরতাম তোমার সামনে। কী ভরসা ছিল দুজনে দুজনের উপর। তোমার আদরের ছিল একটা আলাদা ধরন। মিষ্টি সে আদর। নাকটা ধরে চেপে দেওয়া। বকুলের মতো স্বচ্ছ শুভ্রই ছিল আমাদের প্রেম। ভাগ্যিস বকুলে ফুলশয্যা হয় না। তাই আজও বেঁচে আছে সেই প্রেম। সেই অপূর্ব সৌরভে। জানো, আমি আজও বকুলের গন্ধ পাই। ঠিক যেমনটা তোমার সামনে বসেই পেতাম। ওই গন্ধটাই আসলে তুমি।

