রাহুল দাশগুপ্ত-র গল্প ‘তিনটে কথা’

রাহুল দাশগুপ্ত-র গল্প ‘তিনটে কথা’

ঘটনাটা আমি শুনেছিলাম সমুদ্রতীরের সেই ছোট্ট শহরটায় বেড়াতে গিয়ে। সেখানে আমি পৌঁছেছিলাম ভোরবেলায়। সেটা ছিল চমৎকার রোদ ঝলমলে একটা দিন। হোটেলের ঘরে ব্যাগপত্র রেখেই আমি স্নান করব বলে বেরিয়ে পড়েছিলাম। সমুদ্রের একটার পর একটা ঢেউ, ফেনা, অবিরাম তেড়ে আসা দেখে আমি তখন মনে মনে অস্থির হয়ে উঠেছি। সেই ঢেউয়ে গা ভাসানোর জন্য আর একটুও অপেক্ষা করতে রাজি নই।
হোটেলের পেছনদিকের ছোট্ট লোহার গেটটা খুলে কয়েক ধাপ সিঁড়ি নেমে আমি তখন হনহন করে সমুদ্রের দিকে হেঁটে চলেছি। সকাল প্রায় ন’টা। অফ সিজন। ধু-ধু করছে বেলাভূমি। লোকজন নেই বললেই চলে। পায়ের নিচে ঝকঝক করছে বালি, তখনই একটু একটু তপ্ত।
সেই সময় মনে হলো, কে যেন আমাকে পিছন থেকে ডাকছে! আমি ঘাড় ঘোরাতেই দেখতে পেলাম, হোটেলের ম্যানেজারকে। আমারই বয়সই এক যুবক। চেহারাটা একটু মোটার দিকে। সে প্রায় দৌড়ে আসছে। আর প্রবলভাবে হাঁফাচ্ছে।
আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। সে এসে পৌঁছনো পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। সে সামনে দাঁড়িয়েও কিছুক্ষণ কোনও কথাই বলতে পারল না। আমি তাকে সময় দিলাম। যদিও তাতে আমার বিরক্তি আরও বেড়ে গেল।
অবশেষে সে কথা বলল। আর সমুদ্রের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, একটু সাবধানে স্নান করবেন।
কেন? ভুরু কুঁচকে আমি জানতে চাইলাম।
সে আবার আঙুল তুলে দেখালো। তারপর বলল, এখানে খুব চোরাস্রোত। ওই যে দেখছেন, খুব বেশি দূরে নয়, ওখান থেকে কিছুদিন আগে একজন স্নান করতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি…
সেদিনই ব্রেক ফাস্ট করতে করতে ম্যানেজারের মুখে ঘটনাটা আমি শুনলাম।

সে ছিল আপনারই মতো এক যুবক। অবশ্য আপনার চেয়ে ঢের বেশি রূপবান। আর একটু বোধহয় অবসাদগ্রস্ত। তার চোখ দুটো ছিল বিষন্ন আর সুন্দর। সপ্তাহ দুয়েকের ছুটি কাটাতে সে এখানে এসেছিল। উঠেছিল হােটেলের সবচেয়ে দামি সিঙ্গল বেডের ঘরটায়। আর বলেছিল, তার এক বন্ধুর আসার কথা। সে আসবে দশ দিনের মাথায়। তখন সে তার বন্ধুকে নিয়ে একটা ডাবল বেডের রুমে চলে যাবে।
সে এরকমই এক ভোরে এখানে এসে পৌঁছেছিল। তারপর আপনারই মতো বেরিয়ে পড়েছিল সমুদ্রে স্নান করবে বলে। সে-ও সমুদ্র খুব পছন্দ করতো। ব্রেক ফাস্টের সময় আমাকে সে বলেছিল, বছর পাঁচেক আগে আমি একবার এখানে এসেছিলাম। এই হােটেলেই উঠেছিলাম। তখন আপনাকে দেখতে পাইনি…
আমি বলেছিলাম, আমি এখানে রয়েছি সবে বছর দুয়েক হলো…
ও, সেইজন্যই।
সে চুপ করে গেছিল হঠাৎ। তারপর আবার তার বিষণ্ণ ও সুন্দর চোখ দুটি মেলে বলেছিল, সেবার সঙ্গে আমার স্ত্রী ছিল। আমরা সমুদ্রের ধার দিয়ে হাঁটছিলাম। হঠাৎ কী হলো জানেন, একটা জোঁক, হ্যাঁ, আমি চেঁচিয়ে উঠলাম আর আমার স্ত্রী পাগলের মতো হাঁটু গেড়ে বসে জোঁকটাকে ঝাড়তে লাগলো, জোঁকটা আমার প্যান্ট থেকে খসে পড়েছিল অনেক আগেই, কিন্তু সে কিছুতেই থামছিল না, আর যখন থামল তখন সে প্রবলভাবে হাঁফাচ্ছিল।
একটু চুপ থেকে যুবকটি বলল, এরপর বেশ কিছুক্ষণ আমরা চুপচাপ হাঁটলাম। একসময় নীরবতা ভঙ্গ করে আমার স্ত্রী বলে উঠেছিল, তোমার জন্য মাঝেমাঝেই আমার খুব মনখারাপ লাগে। কেন বলো তো? এই তো সেদিন…
যুবকটি থামার পর আমি আর থাকতে না পেরে বলে উঠেছিলাম, আপনার স্ত্রী আপনাকে খুবই ভালোবাসতেন, তাই না?
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে যুবকটি বলে উঠেছিল, খুবই। ওরকম খাঁটি, আশ্চর্য ভালোবাসা পাওয়ার সুযোগ খুব কম মানুষের জীবনেই ঘটে!
ম্যানেজার একটু থামল। তারপর বলল, সেদিন সারাদিন যুবকটি সমুদ্রের ধারে বসেই কাটিয়ে দিল। কখনও সে হাঁটছিল, কখনও চুপচাপ বালিতে বসে আঁকিবুকি কাটছিল, অথবা একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল অবিরাম ঢেউয়ের দিকে। দুপুরে খেতে আসার সময়টুকু ছাড়া এভাবেই তার কেটে গেছিল।
যুবতীটির সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল রাতে খাবারের সময়। ডাইনিং রুমে। অসামান্য সুন্দরী। সঙ্গে তার কন্যা। বছর চারেক বয়স। বাচ্চাটি তার মাকে চুমু খেয়ে খেয়ে দেখাচ্ছিল, সে কত রকমভাবে চুমু খেতে পারে! মায়ের দু’গালে, কপালে, চুলে, নাকে, কানে, ঠোটে, গলায় চুমু খেয়ে সে শেষ করেছিল দু-চোখের পাতায়। প্রতিবার সে চুমু খাচ্ছিল, আর গভীর আবেশে যুবতীর চোখ দুটো যেন বুজে আসছিল।
যুবকটি গভীর সঙ্কোচে তাদের উল্টোদিকের সােফায় বসতে চেয়েছিল, আর বসার সময় একবার চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল, উপায় নেই বলেই বাধ্য হয়ে সে ওখানে এসে বসেছে, উপায় থাকলে আলবৎ বসতো না, ঘরে আর একটিও সিট খালি নেই!
যুবতীটির হাবভাব শান্ত প্রকৃতির। কিন্তু কথা বলার সময় বোঝা যায়, তার ভেতরে ঝড় লুকিয়ে আছে। খুব তেজি স্বভাবের। হঠাৎ সে গাম্ভীর্য ভেঙে জোরে জোরে হেসে ওঠে। কথা বলতে বলতে চোখের দৃষ্টি দিয়ে বিদ্ধ করে। আর সাদামাটা কথাকেও ক্ষুরধার করে তুলতে জানে। সে কথা বলে যুক্তি আর অত্যন্ত বিচক্ষণতা মিশিয়ে। অপ্রয়োজনে একটি শব্দও যেন সে খরচ করতে রাজি নয়। সে কাজ করে অত্যন্ত গুছিয়ে। খুব দ্রুত, অথচ তাড়াহুড়াের ছাপ থাকে তাতে।
যুবতীটি এসেছে ইংল্যাণ্ড থেকে। মেয়েকে নিয়ে সে একাই এসেছে। স্বামী আসবে দিন দশেক বাদে। দিন পনেরো তারা থাকবে এখানে। তারপর আরও দিন পনেরো অন্যত্র থেকে আবার ইংল্যাণ্ডে ফিরে যাবে। নিজের পরিচয় দিয়ে সে জানতে চেয়েছিল, আর আপনি?
যুবকটির সুন্দর দুচোখে আবার বিষন্নতার ছায়া নেমে এসেছিল। সে বলেছিল, বছর তিনেক আগে হঠাৎ তার স্ত্রীবিয়োগের কথা। তখন তার জীবনটাই ছিল অন্যরকম। সেই জীবনে সিনেমা ছিল, কবিতা ছিল, গান ছিল, স্বপ্ন ছিল, ভবিষ্যৎ ছিল। স্ত্রীর মৃত্যুর পর গত তিন বছর ধরে সে শুধু মন দিয়ে ব্যবসা করে গেছে। অর্থচিন্তা ছাড়া আর কিছুই করেনি। যে বন্ধুর সঙ্গে মিলে ব্যবসাকে সে বাড়িয়ে গেছে, দিন দশেক পরেই তার আসার কথা। মানুষ হিসাবে সে নিতান্ত কেজো গোছের। স্বার্থপর আর উচ্চাকাঙ্খী। অর্থ ছাড়া, ধনী হওয়া ছাড়া, জীবনে ক্ষমতা ও আরাম ভোগ করা ছাড়া আর কোনও বাসনা তার নেই।
এই জীবনে অবশেষে ক্লান্ত বোধ করছে যুবকটি। তাই সপ্তাহ দুয়েকের ছুটি নিয়ে সে নির্জনতা কাটাতে এসেছে এই ছোট্ট সমুদ্র-শহরে।
এক নাগাড়ে কথাগুলি বলে যুবকটি থামল। মেয়েটির দিকে তাকালো সে। সেই চোখ দুটি ছবির মতো। উষ্ণ ও সহৃদয়। সাহস পেয়ে যুবকটি বলল, আমি সত্যিই এরকম ছিলাম না, জানেন! বরং এটাই জানতাম, আমার হৃদয়টি সরল, উদার আর বন্ধুবৎসল। মানুষের প্রতি কী আন্তরিকই না ছিলাম আমি! সেই হৃদয়টিকে এখন আর কোথাও খুঁজে পাই না…
সেই রাতে যুবকটি মেয়েটির স্বপ্ন দেখল। সে দেখল, মেয়েটি সম্পূর্ণ একা সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে আছে। কেউ নেই তার পাশে। তার ফর্সা কপালে ছোট্ট একটা লাল টিপ। আর সেই টিপের ঠিক নিচেই গভীর ও সংবেদনশীল দুটি চোখ। মেয়েটি তার দিকেই তাকিয়ে আছে। অথবা পুরোপুরি হয়তো তাকিয়েও নেই। মাথাটা সামনের দিকে সামান্য ঝুঁকে আছে।
পরদিন থেকে যুবকটিকে প্রায়ই মেয়েটির সঙ্গে ঘুরতে দেখা যেতে লাগল। সময়ের ব্যাপারে মেয়েটি খুবই সতর্ক। এক মিনিটও এদিক-ওদিক হওয়ার জো নেই। বাঙালি মেয়েদের মধ্যে এই গুন খুব বিরল।
ওরা দু’জনে সমুদ্রের ধার দিয়ে হাঁটত। একদিনেই যুবকটি সম্পূর্ণ পাল্টে গেছিল। সে কথায় কথায় হেসে উঠছিল। নানা মজার মজার কথা বলছিল। আর তার কথা শুনে মেয়েটি অর্ধেক বয়েসের এক কিশোরীর মতোই খিলখিল করে হেসে উঠছিল। যুবকটি যেন ফিরে গেছিল, তিন বছর আগের দিনগুলোয়।
আর মেয়েটিকে দেখে যদিও বাইরে থেকে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না, তবু তার ভেতরেও যে কিছু একটা চলছে সেটা ঠিকই টের পাওয়া যাচ্ছিল। তাকে খুব খুশি দেখাচ্ছিল। কথায় কথায় সে হাসছিল। অনেক সময় যুবকটি অবাক হয়ে এমনও ভাবছিল, সে তো তেমন চমকে দেওয়ার মতো সরস কিছু বলে নি। তবুও মেয়েটি অত হাসছে কেন?
কখনও মেয়েটি অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছিল যুবকের দিকে। আর যখন চুপ করে যাচ্ছিল, সেটাও খুব অর্থপূর্ণভাবে। সে অত্যন্ত রুচিশীল পােশাক পরেছিল। আর সেজেছিল অত্যন্ত নিপুণভাবে। তবু কেন জানি মনে হচ্ছিল, বিশেষ কোনও কারণেই সে এরকম সাজসজ্জা করেছে। যুবকটি স্বপ্নে যেমন দেখেছিল, তাকে ঠিক সেরকমই দেখাচ্ছিল!
এভাবে দিন দুয়েক কেটে গেল। তৃতীয়দিন রাতে খেতে বসে যুবকটি বিষণ্ণ হয়ে জানাল, একটা খবর আছে।
মেয়েটি কৌতূহলী হয়ে তাকালো।
যুবকটি বলল, আমাকে হয়তো কালই ফিরে যেতে হবে। আমার বন্ধু ফোন করেছিল…
মেয়েটির মুখে অন্ধকার নেমে এলো। তারপর একদম চুপ করে গেল সে।
রাতে সে ইন্টারকমে ফোন করল। তারপর বলল, কাল আপনি সত্যিই ফিরে যাচ্ছেন?
যুবকটি হালকা সুরে বলল, না, আমি আছি।
মেয়েটি হঠাৎ বলল, আমার কিন্তু খুব মন খারাপ হয়ে গেছিল।
মেয়েটির গলার স্বর শুনে যুবকটি চমকে গেল। শান্ত ও দৃঢ় স্বভাবের বলেই মেয়েটিকে তার মনে হয়েছে। তার মধ্যেও থাকতে পারে আত্মসমর্পণের এমন সােহাগ মাখানো কণ্ঠস্বর? হয়তো স্বভাবের এই কোমল দিকটাকে সহজে সে প্রকাশ করতে চায় না।
তবু পরীক্ষা নেওয়ার জন্যই যুবকটি যেন বলল, আপনি সত্যি কথা বলছেন না।
মেয়েটি ফোঁস করে ওঠে, আত্মরক্ষার প্রয়োজনটুকু ছাড়া আমি সাধারণত মিথ্যা কথা বলি না…
সেদিন রাতে যুবকটির আর ঘুমই এলো না। মেয়েটির ওই ফেঁস করে ওঠার ভঙ্গিটি তার বড় ভালো লেগেছে। তার উপর চমক্কার ও মূল্যবান ওই কথাটি। আত্মরক্ষার প্রয়োজনটুকু ছাড়া…
পরদিন আবার ওরা সমুদ্রের ধার দিয়ে হাঁটতে বেরোল। এরকম সময় মেয়েটি তার বাচ্চাকে পাশের ঘরে রেখে আসে। সেই ঘরে এক মধ্যবয়সী দম্পতি থাকে। মহিলাটি অসুস্থ। ঘর থেকে বেরোয় না। পুরুষটিকেও বিশেষ একটা বাইরে বেরোতে দেখা যায় না। কিন্তু ওদের একটা ফুটফুটে ছেলে আছে। এই বাচ্চা দুটি একসঙ্গে খেলে। মেয়েটি বলে, বাধ্য হয়েই ওকে আমি রেখে আসি, জানেন। ভদ্রমহিলা বড় খিটখিটে।
তাহলে রেখে আসেন কেন?
মেয়েটি চুপ করে থাকে। তারপর বলে, বাচ্চা দুটোর মধ্যে খুব ভালোবাসা হয়ে গেছে। এরপর তো আর কোনও কথা চলে না।
যুবকটি এখন সুযােগ পেলেই মেয়েটিকে টুকটাক উপহার দেয়। মেয়েটি নীরবে গ্রহণ করে। মেয়েটি জানে, যুবকটি কেন উপহার দেয়। যুবকটিও জানে, সে কিছু দিলে মেয়েটি কখনও না বলবে না।
একদিনই শুধু মেয়েটি বলেছিল, কেন?
জানি না। যুবকটি লজ্জা পেয়েছিল খুব।
কী জানেন না? মেয়েটি হাঁপাচ্ছিল।
শুধু জানি, ভালো লাগে। যত তুচ্ছই হােক, আপনাকে কিছু দিতে আমার ভালো লাগে। এই ভালো লাগাটাকে আমি হারাতে চাই না…
সেদিন মেয়েটিকে সর্বাঙ্গে ভিজে জল থেকে উঠে আসতে দেখে যুবকটি নিজের নোটবুকে লিখেছিল, ‘কিছু কিছু মানুষকে চোখে দেখাটাই একটা ডিলাইট। হা। আজ তাকে দেখলাম সমুদ্রে স্নান করে উঠে আসতে। আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম। জলে নামিনি তখনও। হঠাৎ মনে হলো, চারপাশের একঘেয়েমির মধ্যে আচমকা যেন আলো ছড়িয়ে পড়ল। অন্যরকম একটা আলো। এটাই ডিলাইট। খুব মানুষই পারে এই আহ্লাদের অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে। সে এটা পারে। যতবার তাকে দেখি, বিশেষ করে যদি হঠাৎ দেখি, মনে হয়, আমার স্নায়ুগুলো অবশ হয়ে আসছে। শুধু ডিলাইট, আর কিছু নেই।
তাদের দুজনের রুচি আর জীবন-যাপনে ছিল অনেক তফাৎ। কিন্তু একটা মিলও ছিল। দুজনেই সিনেমা দেখতে খুব ভালোবাসত। যুবকটি রোজ মেয়েটিকে একটা করে সিডি দিতো। ব্যাগ ভর্তি সিডি নিয়ে এসেছে সে। ভেবেছিল ঘুরে-বেরিয়ে আর সিনেমা দেখেই সময়টা কাটাবে। কিন্তু এখন তার একটাই লক্ষ্য, বহুবার দেখা তার প্রিয় সিনেমাগুলো মেয়েটি অন্তত একবার দেখুক…
মেয়েটি মৃদু হেসে সিনেমাগুলি নেয়। যুবকটি সারা রাত অস্থির হয়ে থাকে। ঘরময় পায়চারি করে কাটায়। তারপর পরদিন ভোরে প্রথম দেখা হলেই জানতে চায়, দেখেছেন?
মেয়েটি মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। কিন্তু আর কিছু বলে না।
একদিন যুবকটি তাকে একটি বইও পড়তে দেয়। আন্তন চেকভের ‘আ লেডি উইথ আ ডগ অ্যাণ্ড আদার স্টোরিজ’। মেয়েটি পড়ে। যুবকটি বই পড়ে দাগ দিয়ে দিয়ে। মেয়েটি বিশেষ ভাবে সেই দাগ দেওয়া জায়গাগুলি পড়ে। যুবকটিকে যেন সে আবিষ্কার করে ওই দাগ দেওয়া জায়গাগুলিতে। কিন্তু মুখে কিছুই বলে না।
যুবকটি জানে, ওই সিনেমাগুলি, ওই বইটি, এই সবই আসলে একেকটা গােপন চিঠি। ইশারায় ভরা মেয়েটিকে লেখা তার একের পর এক স্বীকারোক্তি। কিন্তু মুখ ফুটে সে কিছুই বলে না। সে জানে, তার হয়ে ওই সিনেমা বা বইটিই যা বলার বলে দিচ্ছে মেয়েটিকে। মেয়েটিও জানে, যুবকটি তাকে কিছু বলতে চায়। সিনেমাগুলি দেখতে দেখতে বা বইটি পড়তে পড়তে সে যুবকটির সেই না বলা কথাগুলি শুনতে পায়।
কখনও তার খুব লজ্জা হয়। কখনও বা সে তেজি ঘােড়ার মতোই চনমনে হয়ে ওঠে। যুবকটির বলিষ্ঠ দেহ তখন তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে যায়। সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দেখে নেয়, বাচ্চাটি ঘুমিয়ে পড়েছে কী না! তারপর একটা একটা করে নিজের সমস্ত পোশাক খোলে। আর মুগ্ধ হয়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে। ফিসফিস করে বলে ওঠে, এটাই তো স্বাভাবিক! হ্যাঁ, এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছুই নেই!
নিজের সৌন্দর্যে তখন সে অভিভূত হয়ে যায়। যুবকটির সমস্ত আচরণের অর্থ তখন সে স্পষ্ট বুঝতে পারে। এভাবে দেখতে দেখতে সাতদিন কেটে যায়। অষ্টম দিনে তারা দুজনে মিলে একটা গাড়ি ভাড়া করে। তারপর দূরের পাহাড়টায় বেড়াতে যায়। মেয়েটি আগেই উঠে বসে। গাড়িতে উঠতে গিয়ে যুবকটি দেখে, ভেতর থেকে লক করা। সে কাঁচের জানলায় টোকা মারে। মেয়েটি দরজা খুলে দেয়।
সিটে বসে যুবকটি কৌতুক করে বলে, মনে হচ্ছে, আপনি চান না, আমি এখানে বসি…! পাশে’ কথাটা ইচ্ছে করেই সে উচ্চারণ করে না।
মেয়েটি সপাটে জবাব দেয়, কিন্তু আপনি যে নাছোড়…
যুবকটি উচ্চস্বরে হেসে ওঠে। মেয়েটির এই খোঁচাগুলি ওর বড় প্রিয়।
মেয়েটি বলে, কাল রাতে স্বপ্ন দেখলাম, আপনি একটা সুসংবাদ পেয়েছেন। তাই খুব খুশি। সত্যি নাকি?
যুবকটি সত্যিই একটা সুসংবাদ পেয়েছিল গতকাল। সে একটু চমকেই উঠল। তারপর বলল, আপনি জানলেন কী করে?
সবাই বলছে। মেয়েটি রহস্য করে বলে।
যুবকটি এবার বুঝে ফেলে। তারপর কৌতুক করে ওঠে, আমি সুসংবাদ পেলে আপনি এত দুঃখ পান কেন?
মেয়েটি হেসে ওঠে। একটু পরে ব্যাগ থেকে বার করে আনে একটা ছবি। একটি মেয়ের মুখ। পেনসিলে আঁকা। তারপর বলে, আমার মেয়ের বয় ফ্রেণ্ড এটা এঁকেছে! পাশের ঘরের ওই মহিলার বাচ্চাটি। অদ্ভুত ছেলেটি। ক্লাস থ্রিতে পড়ে। একদম পড়াশুনো করতে চায় না। কিন্তু সারাদিন ছবি আঁকে। আর তখন দুনিয়ার সবকিছু ভুলে যায়।
ছবিটি দেখতে দেখতে যুবকটির অসম্ভব ঈর্ষা হয়। সে বলে ওঠে, এটা তো আপনি…
দূর, আমি হতে যাব কেন?
যুবকটি করুণভাবে হাসে। তারপর বলে, আপনি সব জানেন। পুঁচকেটা দেখছি আপনাকে দারুণ ভালোবেসে ফেলেছে…
মেয়েটি মুখ ঘুরিয়ে জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকায়।
হঠাৎ যুবকটির মনে একটা অদম্য কৌতুহল জেগে ওঠে। সে বলে ওঠে, আপনি জীবনে খুব সুখী, তাই না?
আপনার কী মনে হয়? মেয়েটি জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করে।
মনে হয়, খুব সুখী।
মেয়েটি চুপ করে যায়। যুবকটির অন্তর দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। সে ধরে নেয়, মেয়েটি সত্যিই সুখী। হয়তো অন্য কোনও উত্তর পেলে সে একটু স্বস্তি পেত। কিন্তু মেয়েটি যে বড় বেশি সুখী! তার জীবনে কোনও দুঃখবোধই নেই। অন্তত তার জন্য সে কী একটুও দুঃখ পেতে পারতো না? তার এই ভয়ানক একাকীত্বের জন্য?
আমি ওকে অসুখী করে তুলবো। যুবকটি মনে মনে ভাবে।
হঠাৎ মেয়েটি বলে ওঠে, আপনাকে প্রথম দেখে আমার খুব সরল বলে মনে হয়েছিল…
যুবকটি চমকে ওঠে। মেয়েটি ওকে সন্দেহ করেছে। মনে মনে ভাবে, তাহলে কী একটু হলেও মেয়েটি ওকে নিয়ে ভেবেছে? ওর সারল্যকে সন্দেহ করেছে এবং মনে মনে দুঃখ পেয়েছে?
অর্থাৎ ওর মনে সে দুঃখের জন্ম দিতে পেরেছে? দুঃখই তো স্থায়ী! সুখ তো চোখের পলকমাত্র!
ফেরার পথে অন্ধকার হয়ে আসে। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়তে শুরু করে। যুবকটির ইচ্ছা করে পাশে বসা মেয়েটির হাতের ওপর হাত রাখতে। কেন জানি মনে হয়, এরকম করলে মেয়েটি হাত সরিয়ে নেবে। এদিকে মেয়েটিও ঠিক বুঝে উঠতে পারে না যুবকটি ওর হাতে হাত রাখলে সে কী করবে? তার অস্বস্তি হয়। মনে হয়, তখন কী হবে তার?
সারা রাস্তা অস্বস্তি নিয়েই মেয়েটি বসে থাকে। আর ঘামতে থাকে প্রবলভাবে। এতে তার অস্বস্তি আরও বেড়ে যায়। কেন জানি মনে হয়, সে ঘর্মাক্ত হলে যুবকটির মুগ্ধতা আরও বেড়ে যায়।
যুবকটি কিন্তু কিছুই করে না। শুধু সে যেন সমস্ত শব্দ হারিয়ে ফেলে। সুন্দরী আর ছটফটে মেয়েদেরই তার পছন্দ। আর দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দরী নারী একাকি, নিভৃতে এখন তার পাশে বসে আছে। আড়চোখে সে মাঝেমাঝে মেয়েটির দিকে তাকায়। কিন্তু তৎক্ষণাৎ আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়। নীরবতা, ক্রমে আরও বেশি নীরবতার মধ্যে ডুবে যায় দু’জনে।
পরদিন সকালে যুবকের বন্ধুটি চলে আসে। একটু আগেই ওরা দু’জনে সমুদ্রের ধার দিয়ে হেঁটে ফিরেছে। কিন্তু বন্ধুটি আসার পরই হঠাৎ দু’জনে যেন দু’দিকে ছিটকে যায়। আলোচনা অন্য দিকে মোড় নেয়। যুবকটি যেন এতদিন একটা স্বপ্নের জগতে ছিল। বন্ধুটি তাকে প্রবলভাবে ঝাঁকাতে থাকে!
মাঝেমাঝে মেয়েটিকে সে দূর থেকে দেখে। একবার মেয়েটি তাকে হাত নেড়েও ডাকে। তারপর কানের কাছে। ঠোট এনে ফিসফিস করে বলে, আজ বিকেলে আমার স্বামীও আসছেন। বেশ কাটল কয়েকদিন, তাই না?
যুবকটির মন আবার দুঃখে ভরে ওঠে। পাশের ঘরের মহিলাকে তাদের দিকে আসতে দেখে সে তাড়াতাড়ি উঠে যায়।
যাওয়ার আগে হঠাৎ একটা কথা তার মনে পড়ে। মেয়েটি সকালে উঠতে পারে না। তাই সে যুবকটিকে বলেছিল, ভোরে উঠে রোজ একটা মিসড কল দিতে। সেই আওয়াজ শুনেই গত কয়েকদিন ধরে রোজ ভোরে সে উঠেছে। তারপর দুজনে মিলে সমুদ্রের ধার দিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে। রোজ রাতে শুতে যাওয়ার আগে মেয়েটি মনে করিয়ে দিতো, কাল ভোরে, মনে আছে তো?
যুবকটি মৃদু হাসতো। মেয়েটি বলতো, আমি জানি, আপনি কিছুই ভোলেন না। হ্যাঁ, সবকিছুই আপনার মনে থাকে।
যুবকটি জানত, মেয়েটি তার মিসড কলের প্রতীক্ষায় থাকে। কাল সকাল থেকে আর থাকবে না। তাহলে এমন একটা সকাল আসার দরকারটাই বা কী?
সেই সকালেই ঘরের ড্রয়ার থেকে বন্ধুটি একটি কাগজ খুঁজে পায়। সেই কাগজে একটা কবিতা লেখা। কবিতাটি এইরকম:

তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে মনে হয়।
তোমাকেই ভালোবাসি, তোমাকেই, আর কেউ নয়।

তোমার মুখের দিকে তাকালে বদলে যায় সব
নিমেষে জাদুর মতো, কী জানি কেমন করে হয়

তোমাকে ছাড়াই আমি বেশ থাকি, জমে ওঠে কথা
প্রতিটি দিনের কত না-বলা নিবিড় নীরবতা

তোমার চোখেও থাকে ইশারার গুঢ় আঁকিবুকি
আমি সেই পাণ্ডুলিপি নিয়ে ফিরি, মন দিয়ে পড়ি

তোমাকে কতটা পাই, তবু সে না পাওয়ার থেকে বেশি
তুমি যত দূরে থাকো, ততো থাকো আরও কাছাকাছি

তোমাকে দেখি না তবু তোমার কথাই ভেবে যাই
ফিসফিস করে বলি, ‘তোমাকেই শুধু পেতে চাই’।

তোমার প্রতিটি কথা, চোখের চাহনি, হাসিমুখ
বারবার ফিরে আসে, আর তাতে কী দারুণ সুখ!

তুমি আছো কত দূরে, তবুও নিজের মতো লাগে
আমার কিছুটা মিশে যেতে থাকে তোমার ভেতরে…

বন্ধুটি ভুরু কুঁচকে দারুণ বিরক্তি নিয়ে জানতে চায়, এটা কী? একটা কবিতা। বহুদিন পরে লিখেছি। মনে হচ্ছে, হাবুডুবু। তারপরই সে চেঁচিয়ে ওঠে, তুই জানিস না কোনও মেয়েকে মাথায় তুললে কী হয়? বিশেষ করে, যখন সে বুঝে ফেলে?
কী হয়?
যুবকটি শান্ত গলায় জানতে চায়।
খেলা করে, শুধু খেলা করে। তুই কী সবার চোখে করুণা আর উপহাসের পাত্র হয়ে উঠতে চাস? পরে নর্দমায় মাখামাখি হয়ে পড়ে থাকলেও ও তোর দিকে ফিরেও তাকাবে না। আর তোদের মতো লোকেদের সেটাই উচিত প্রাপ্য। একটু থেমে সে যােগ করে, তুই-ই তো আমাকে বলেছিলি, একজন লেখক, কী যেন নাম… আঃ, কিছুতেই মনে পড়ছে না…
ইভান তুর্গেনেভ?
হ্যাঁ হ্যাঁ, ওইরকমই কিছু একটা হবে, কী একটা লেখায় যেন বলেছিলেন, কোনও মেয়েকে অন্তত তোমার কড়ে আঙুলের ডগার ওপর আধিপত্য করতে দেবার চেয়ে সদর রাস্তার ওপর ইট-পাথর ভাঙাও ভালো…
যুবকটি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, আমার শুধু মনে হয়, কেন জানি না, ওর আমাকে খুব দরকার…
দরকার? কিসের দরকার? মুখ ফুটে বলেছে নাকি? ফুর্তি করার লোক চাই? দিব্যি থাকে এরা। আর তোদের মতো লোকেরা যতসব আজগুবি কল্পনা করে এদের হাসি-মজার খােরাক হয়ে উঠিস। যত সব ভাবোচ্ছ্বাস। ঠিক আগের মতো…
ও বলেছে, আমি যে কথাগুলি বলি, নিজের খেয়ালেই বলি, সেগুলো নাকি ওকে খুব সাহায্য করে, অনেক কিছু বুঝতে পারে ও, অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে ওঠে ওর কাছে। যুবকটি প্রায় ফিসফিস করে ওঠে।
বন্ধুটি ঝাঝিয়ে ওঠে, ওসব মনভোলানো কথা মেয়েরা ভালোই পারে। বিশেষ করে একবার যদি বুঝে যায়, পুরুষটি ভাবুক প্রকৃতির আর ফাদে পড়বার জন্য পা বাড়িয়েই আছে। এসব মেয়েরা কোনওদিন নিজের পান থেকে চুন খসতে দেবে না, অথচ তোর গায়ের শেষ সুতোটুকুও খুলে নেবে…
যুবকটি যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। আচ্ছন্নের মতো সে বলে যায়, তাছাড়া আমার মনে হয়, কেন জানি না, ইচ্ছা করেই যেন সে এটা যােগ করে, হয়তো বা আত্মরক্ষার জন্যই, নারীত্বের সব রহস্যই ওর মধ্যে মজুত আছে…
তাহলে তো আর কিছুই বাকি নেই….বন্ধুটি বলে।
যুবকটি মৃদুস্বরে বলে যায়, তাছাড়া সব মেয়ে একরকম হয় না। সবাই ফাঁদ পেতেও বসে নেই। আমার মনে হয়, অন্তত সবটা শুনলে তুই বুঝতে পারতিস, আমাকে ফাঁদে ফেলার মতো ফালতু ব্যাপারে জড়ানোর চেয়ে ঢের বেশি আত্মসম্মানবোধ মেয়েটির আছে…
বন্ধুটি এবার ফেটে পড়ে, তুই তোর স্ত্রীকে ভালোবাসতি না?
ভালোবাসতাম মানে? এখনও বাসি।
তাহলে এসব কী?
এটাও…যুবকটি থেমে যায়। তারপর বলে, দু’টো দু’রকম ভালোবাসা। আমার কথা নয়। দি ইডিয়ট। ফিওদর দস্তয়েভস্কি।
বন্ধুটি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
তারপর বেলার দিকে আকণ্ঠ মদ গিলে বন্ধুটি সমুদ্রে নামে। তার পা দুটো টলতে থাকে। কে যেন একজন বন্ধুটিকে দেখিয়ে বলে ওঠে, এখন ভরা জোয়ার। লোকটির কোনও হুঁশই নেই!
বন্ধুটির পিছন পিছন যুবকটিও এগোতে থাকে। হঠাৎ কে যেন তাকে পিছন থেকে ডাকে। যুবকটি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে, মেয়েটি দাঁড়িয়ে। দৌড়ে দৌড়ে এসেছে সে। যুবকটি এগিয়ে যায় মেয়েটির দিকে। প্রবল জোরে হাওয়া দিচ্ছে। যুবকটি জানতে চায়, কিছু বলবেন?
হ্যাঁ, আপনাকে কিছু বলার আছে।
আমাকে? যুবকটি অবাক হয়।
মেয়েটি আবার বলে, আসলে একটা কথা…
একটু ভেবে সে আবার বলে, ঠিক একটাও নয়, দু’টো…
আবার সে একটু ভাবে। তারপর বলে, না, এইবার ঠিক মনে পড়েছে। তিনটে কথা। আমি আপনাকে ঠিক তিনটে কথা বলতে চাই…
বলুন না…
মেয়েটি একটু ভাবে। তারপর বলে, না, বরং স্নান করে ফিরে আসুন। আপনার বন্ধুর অবস্থা আমার ভালো লাগছে না। ওকে সামলান আগে।
ঠিক আছে, কিন্তু স্নান করে আসার পর আর এক মুহূর্তও আমার তর সইবে না। আপনি তখন কোথায় থাকবেন? কোথায় আপনাকে খুঁজে পাবো?
মেয়েটি রহস্য করে বলে, আমায় খোঁজার দরকার নেই। আমিই আপনাকে খুঁজে নেবো।
আর ঠিক তখনই, কেন জানি, যুবকটির মনে হয়, এ মেয়ে নিজেকে বিলিয়ে দিতে জানে…। আর তারপরই নিজের মনেই হাসতে হাসতে সে ভাবে, বন্ধুটি শুনলে নির্ঘাত বলত, ভাবোচ্ছ্বাস!
যুবকটি ফিরে যায়। আর তখনই সে দেখতে পায়, বন্ধুটি প্রবল স্রোতের মধ্যে টলে পড়ে গিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। দু’হাত তুলে কোনোক্রমে নিজেকে বাঁচাতে চাইছে।
হঠাৎ যুবকটির মনে হলো, তার এই বন্ধুটি সাঁতার জানে না। কিন্তু এ মরে গেলেই বা ক্ষতি কী? এই লোকটি তার জীবন বিষিয়ে দিয়েছে। বরং এ মরে গেলে একটা বিষাক্ত ও দুর্গন্ধময় জীবন থেকে সে রেহাই পাবে।
হঠাৎ বন্ধুটি ডুবে গেল জলের তলায়। ও কী তলিয়ে গেল? যুবকটি চমৎকার সাঁতার জানে। দ্রুত সে সাঁতার কেটে এগিয়ে গেল বন্ধুটি যেখানে হাবুডুবু খাচ্ছিল, সেদিকে। তার মনে পড়ে গেছে, মেয়েটিকে সে বলেছিল, আসলে সে একজন উদার, আন্তরিক ও বন্ধুবৎসল স্বভাবের মানুষ। বন্ধুটিকে বাঁচাতেই হবে, নইলে মেয়েটির কাছে সে মিথ্যেবাদী হয়ে যাবে না? তাছাড়া…
হ্যাঁ, যুবকটির আরও মনে হল, স্ত্রী-বিয়োগের পর থেকে নিজেকে সে ক্রমাগত ঠকিয়ে গেছে। একটা মিথ্যা জীবনকে আশ্রয় করে বাঁচতে চেয়েছে। কিন্তু এই জীবনটাকে ঘৃণাও করে এসেছে। তার একটা সত্যিকারের জীবন ছিল, যাকে সে ভালোবাসতো। গত কয়েকদিন ধরে সেই জীবনটা আবার তার কাছে ফিরে এসেছিল। মেয়েটি তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিল।
না, আর সে নিজেকে ঠকাতে পারবে না। সে ফিরতে চায়। কিন্তু কোথায় ফিরবে সে? মেয়েটির রয়েছে এক পরিপূর্ণ সুখী জীবন। তার কী রয়েছে? শুন্যতা, একাকীত্ব, মৃত্যু…হো হো করে হেসে উঠতে ইচ্ছে করে যুবকের।
তাছাড়া, না, হঠাৎ সে ভাবে, যদি মরতেই হয়, ওকে আমি অসুখী করে যাবো। তুচ্ছ, সামান্য একটু দুঃখ, মাঝেমাঝে পিঁপড়ের কামড়ের মতোই মনে হবে, তবু তো একটা কামড়, তুচ্ছ, মামুলী একটু জ্বালা…তাও কী হবে?
হঠাৎ সে সংশয়ে পড়ে যায়। তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। দূরে যেন দেখতে পায়, মেয়েটি খুব মনোযোগ দিয়ে ঠোটে লিপস্টিক লাগাচ্ছে। এ কী বিভ্রম, না সত্যি? সে ঠিক বুঝতে পারে না।
হঠাৎ যুবকটি দেখতে পায়, একটি শাড়ি ভেসে যাচ্ছে। এই শাড়িটাকে সে চেনে। মেয়েটিকে সে বেশ কয়েকবার শাড়ি পরে দেখেছে। নানা রঙের শাড়ি। মেয়েটি যখন যে পোশাক পরে, যে রঙের পোশাক পরে, সেটাই তার ছিপছিপে শরীর, মাখনের মতো গায়ের রং আর বিস্ময়কর সৌন্দর্যের সঙ্গে চমৎকার মানিয়ে যায়।
কিন্তু এই শাড়িটিকে বিশেষ কারণে তার মনে আছে। গত পরশু সন্ধ্যায় ওদের হোটেলে একটা গানবাজনার আসর বসেছিল। সেই আসরে মেয়েটি এই শাড়িটিই পরে বসেছিল। একা। ওকে দেখে নিজের পাশে হাত নেড়ে ডেকেছিল। হালকা ক্রিম রঙের শাড়ি। মেয়েটির ভেতরের আভিজাত্য আর মর্যাদাবোধ যেন প্রকট হয়ে উঠেছিল।
সেই চেনা শাড়িটিকেই একা একা ভেসে যেতে দেখল যুবক। মেয়েটি কোথাও নেই। হঠাৎ নিজেকে শুনিয়েই যেন সে বলে উঠল, ধ্যাৎ, আমার যে এখনও তিনটে কথা শোনা বাকি। ওই তিনটে কথা না শুনে মরবার কোনও মানে হয়?
এদিকে বালির মধ্যে মেয়েটির পা ক্রমেই ডেবে যাচ্ছিল। সে দেখতে পাচ্ছিল, যুবকটি ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছে। তার মনে হল, সে ভুল দেখছে। দু’হাত দিয়ে সে নিজের চোখ ঢাকার চেষ্টা করল। আর সেই চোখ দুটো ছিল আশ্চর্যরকম শুকনো…

গল্পটা শেষ করে ম্যানেজার বলল, এই ঘটনাটা নিয়ে সে সময় বেশ হইচই হয়েছিল। যুবকটি চমক্কার সাঁতার জানতো। সবাই তাকে সাঁতার কাটতে দেখেছে। তবু নিজেকে সে বাঁচাতে পারেনি। নুলিয়ারা পরে দু’জনকেই সমুদ্র থেকে তুলে আনে। বন্ধুটি বেঁচে যায়। পরে সে বলে, যুবকটিই তাকে বাঁচিয়েছে…
আমি বললাম, কিন্তু যুবকটিই তো সাঁতার জানতো। বন্ধুটি নয়…
হ্যাঁ, ম্যানেজার বলল, সেটাই তো ছিল সবার প্রশ্ন…

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (1)
  • comment-avatar
    Shyamashri Ray Karmakar 4 years

    আশ্চর্য-সুন্দর একটি গল্প।খুব ভাল লাগল।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
    404 Not Found

    Not Found

    The requested URL was not found on this server.


    Apache/2.4.41 (Ubuntu) Server at hacklink.site Port 80