যখন দেখি ভুবনখানি
চৈতালী চট্টোপাধ্যায়
সেই তো আমি চাই– সাধনা যে শেষ হবে মোর সে ভাবনা তো নাই।। ফলের তরে নয় তো খোঁজা, কে বইবে সে বিষম বোঝা– যেই ফলে ফল ধুলায় ফেলে আবার ফুল ফুটাই ॥ এমনি ক'রে মোর জীবনে অসীম ব্যাকুলতা, নিত্য নূতন সাধনাতে নিত্যনূতন ব্যথা! পেলেই সে তো ফুরিয়ে ফেলি, আবার আমি দু হাত মেলি– নিত্য দেওয়া ফুরায় না যে, নিত্য নেওয়া তাই ॥ রবিপক্ষ। লিখলেন চৈতালী চট্টোপাধ্যায়।
পেট থেকে পড়েই রবীন্দ্রনাথ চিনেছি,বলি যদি,আতিশয্য হবে না। কেননা এক্ষেত্রে,পেট থেকে পড়েই’ বাক্যবন্ধে পুরে রাখা আছে চৈতন্যের সামান্য আভাস। ঠিক যে সময়, আমি প্রথম হার্মোনিয়মের রিড টিপে টিপে গান বাজাতে শিখব। গাইতে শিখব।মা শেখাবেন, সমুখে শান্তি পারাবার। এখনও মনে আছে, শুরুতে সা রে গা…! তারপর তো আরও অজস্র রবীন্দ্রগান ঘিরে নেবে আমার ছোটবেলা, আমার পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণের উদযাপন। তারপর,
একটু -বাসি-হয়ে-যাওয়া-চাঁপাফুলরঙের মলাটে আসতে শুরু করেছে তিনখণ্ডে গীতবিতান, শিশু, ছিন্নপত্র।ক্লাস থ্রি, না না,ক্লাস ফোরে উঠেছি আর যেহেতু বাড়িতে বইপড়া নিয়ে কোনো সেন্সরশিপ ছিল না, অনায়াসে হাতে টেনে নিয়েছি দিদিকে উপহার-দেয়া ওর প্রেমিকের,বই,তিথিডোর। আরেকরকম আলোয় চিনছি রবীন্দ্রনাথকে।মালকোষে বাঁধা তাঁর গান কেউ একজন গাইছে রাত্রিবেলা, বৃষ্টি থেমে যাবার পর,কেউ শুনছে ভরা আবেশে, পুরোপুরি ধরতে পারছি না। কিন্তু মূর্ছনা লেগে গেছে।আজও লেগে আছে।
ক্লাস সেভেন,এইট…।আধ্যাত্মিকতা জাগেনি, কিন্তু নশ্বরতাবোধ পেড়ে ফেলেছে পুঁচকে আমিকে। শঙ্খ ঘোষের জার্নাল তো তার ঢের পরে। যেখানে পড়ব, মুহূর্তেই মুহূর্তের শেষ। তবু আমি এক মুহুর্তের হ্যাঁ পরমুহূর্তেই না হয়ে যাওয়ার কান্নায় ভুগছি।সেসময় এই গান এল।
সেই তো আমি চাই–
সাধনা যে শেষ হবে মোর সে ভাবনা
তো নাই।।
ফলের তরে নয় তো খোঁজা, কে বইবে সে বিষম বোঝা–
যেই ফলে ফল ধুলায় ফেলে আবার ফুল ফুটাই ॥
এমনি ক’রে মোর জীবনে অসীম ব্যাকুলতা,
নিত্য নূতন সাধনাতে নিত্যনূতন ব্যথা!
পেলেই সে তো ফুরিয়ে ফেলি, আবার আমি দু হাত মেলি–
নিত্য দেওয়া ফুরায় না যে, নিত্য
নেওয়া তাই ॥
পেলেই ফুরিয়ে ফেলার পরও যে দু’হাত মেলে রাখা যায়, তবু অনন্ত জেগে থাকে নিত্য দেওয়া আর নিত্য নেওয়ার রহস্যময় মাধুর্যে,এটা ওই অল্পবয়সে ছুঁতে পারতাম না বটে, কিন্তু অবোধ দর্শন ও শ্রবণ নিয়ে, কেঁপে উঠতাম এই গান পড়তে আর শুনতে বসে।
বন্দনাদি লাইব্রেরিরুমে বসে আমাকে এই গানটা লিখে দিয়েছিলেন,অকারণ স্নেহে। ওঁর ভালো-লাগা-গান, ওঁর আহ্লাদি ছাত্রীকে।ব্যাস্! সেই যে ঢুকে পড়লাম গানের মধ্যে। কিংবা,বলা ভালো, গান আমার সর্বস্ব গিলে নিল। কবে থেকে যেন, আমার আত্মকথা হয়ে রইল এই গান!
বিভিন্ন সময় কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলেছি, আজও বলি,ইটস্ ওল ইন দ্য ট্রিপ,সে তো এই পংক্তিরই অনুবাদ –সাধনা যে শেষ হবে মোর সে ভাবনা তো নাই…!চলেছি, আর রক্তাক্ত হতে হতে ভেবেছি–নিত্য নূতন ব্যথা…!চলেছি,আর অপসৃয়মান বিরহের দিকে চেয়ে মনে-মনে গেয়ে গেছি–যেই ফলে ফল ধূলায় ফেলে আবার ফুল ফুটাই…!চলেছি, আর আমার কোথাও নোঙর না ফেলতে পারা জীবন, প্রাণপণ, কুয়াশাচ্ছন্ন কোনো আস্তিক্যের দিকে চেয়ে গেয়ে ওঠে,নিত্য দেওয়া ফুরায় না যে নিত্য নেওয়া তাই…!
এ গান আমার আজও আত্মধ্বংসমুখি প্রবণতায় রক্ষাকবচ। ওয়াটার ওফ ইন্ডিয়ার মতো, আমার না-থাকা শিকড়ে সে ক্রমাগত জলসিঞ্চন করে থাকে।
ভালো লাগল লেখাটা
সুন্দর লেখা।