মেরু-নিশীথের নাবিকেরা
অষ্টম পর্ব
পার্থজিৎ চন্দ
"কবিতাটি পড়তে পড়তে মনে হয় ‘কবি’ শব্দটি আসলে কী দ্যোতনা বহন করে সে বিষয়ে সবিশেষ সচেতন ছিলেন জীবনানন্দ। যে জীবন নিরাপদ, যে জীবনে হাঙরের ঢেউয়ে লুটোপুটি খায়নি কোনওদিন সে জীবনকে কবির জীবন হিসাবে গণ্য করতে চাননি তিনি। কবিতাটিতে ‘দাঁত নেই’ শব্দ-দুটির সামনে স্থির হয়ে ছিলাম। শব্দ দুটি যে শুধু লোলচর্ম, অনুভূতিহীন এক মানুষের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলছে তাই নয়, শব্দ দুটি যেন জানিয়ে দিচ্ছে জীবনের টুঁটি টিপে প্রাণপণ বেঁচে থাকার সংগ্রাম ও বিস্ময় হারিয়ে ফেলেছে সে মাংস-কৃমি খুঁটে খাওয়া মানুষটি।"
যে ভার বস্তুপুঞ্জের, অবলীলার
‘সৃষ্টির নাড়ির ’পরে হাত রেখে টের পাওয়া যায়
অসম্ভব বেদনার সাথে মিশে র’য়ে গেছে অমোঘ আমোদ;
তবু তারা করে নাকো পরস্পরের ঋণশোধ।’
‘আবহমান’ কবিতাটির শেষ তিনটি পঙক্তির কাছে এসে দাঁড়ালে পরিঘাতনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়; অসম্ভব বেদনার সঙ্গে অমোঘ আমোদের সম্পর্কটিকে আবিষ্কার করতে গেলে সৃষ্টির নাড়ির উপর হাত রাখতে হবে। বিনশ্বর এ জীবনে দুটি ঘটনাই ঘটে যাচ্ছে, জীবনানন্দ মন্দ্রিত স্বরে সেটি আমাদের সামনে উন্মোচিত করলেন। এবং শেষ পর্যন্ত জানিয়ে দিলেন তারা কেউ’ই কারো ঋণশোধ করে না। অর্থাৎ তারা পৃথক পৃথক অস্তিত্ব বজায় রেখে চলে, চলে সমান্তরাল দুটি সরলরেখার মতো। কোথাও যেন এমন ইঙ্গিত’ও রয়েছে- এই বেদনা ও অমোঘ আমোদ আসলে একই বিষয়ের দুটি রূপভেদ। কোনও অনুচ্চ আমোদের কথা এখানে বললেন না জীবনানন্দ; তিনি বললেন এমন এক আমোদের কথা যা সমকক্ষ হয়ে উঠছে অসম্ভব বেদনার। জীবনের শাশ্বতিক বোধের সঙ্গে এ আমোদের কোনও বিরোধ নেই।
এ আমোদের কাছাকাছি অনেক সময়ে বিরাজ করতে থাকে শ্লেষ, গূঢ় কথন। তীর্যক কথন সব সময়ে যে শিল্প’কে সমৃদ্ধ ও সার্থক করে তা নয়। বরং অধিকাংশ ক্ষেত্রে উঁচু মানের শিল্প শ্লেষ ও বিদ্রুপ’কে বেশি দূর পর্যন্ত প্রবেশাধিকার দেয় না। কারণ শিল্পের মধ্যে আনন্দ-বেদনার যে জগৎ রয়েছে তা নীচুমানের শ্লেষ ও বিদ্রুপকে ধারণ করতে অক্ষম।
কিন্তু শিল্প কি তার তাৎক্ষণিকের আবেদনে এ পথ পরিগ্রহণ করে না? সে যে ভয়াবহভাবে ব্যর্থ হয় সব সময়ে তাও নয়। জীবনানন্দের দুটি কবিতার নিরিখে বিষয়টিকে দেখে নেওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে। একটি কবিতা অধিক পরিচিত, কবিতাটির নাম ‘সমারূঢ়’। ‘সাতটি তারার তিমির’-এর এই কবিতাটি শুরু হয়েছে এভাবে, ‘বরং নিজেই তুমি লেখো নাকো একটি কবিতা-।’ ছায়পিণ্ড যে উত্তর দেবে না তা যেন কিছুটা নির্ধারিতই হয়ে আছে। এই নিরুত্তর ভঙ্গিমা কবিকে জানিয়ে দিচ্ছে, ‘বুঝিলাম সে তো কবি নয়- সে যে আরূঢ় ভণিতাঃ।’
মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটে ‘অধ্যাপকের’ যে হাজার টাকা আয় হয় তার সঙ্গে শিল্পের কোনও সংযোগ নেই।
এখানে লক্ষ করার জীবনানন্দ তাঁর পৃথিবী থেকে চরমতম ক্ষোভে যেন বহুদূরে সরে এসেছেন, হয়ে উঠেছেন তীব্র আক্রমণাত্মক। শিল্পের সন্ত্রাস থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করে যারা শিল্পকে বিচার-বিশ্লেষণ করে গেলেন তাদের প্রতি তিনি ছুড়ে দিলেন একরাশ বিদ্রুপ।
কবিতাটি পড়তে পড়তে মনে হয় ‘কবি’ শব্দটি আসলে কী দ্যোতনা বহন করে সে বিষয়ে সবিশেষ সচেতন ছিলেন জীবনানন্দ। যে জীবন নিরাপদ, যে জীবনে হাঙরের ঢেউয়ে লুটোপুটি খায়নি কোনওদিন সে জীবনকে কবির জীবন হিসাবে গণ্য করতে চাননি তিনি। কবিতাটিতে ‘দাঁত নেই’ শব্দ-দুটির সামনে স্থির হয়ে ছিলাম। শব্দ দুটি যে শুধু লোলচর্ম, অনুভূতিহীন এক মানুষের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলছে তাই নয়, শব্দ দুটি যেন জানিয়ে দিচ্ছে জীবনের টুঁটি টিপে প্রাণপণ বেঁচে থাকার সংগ্রাম ও বিস্ময় হারিয়ে ফেলেছে সে মাংস-কৃমি খুঁটে খাওয়া মানুষটি।
এই কবিতাটির পাশাপাশি আরেকটি কবিতার দিকে চলে যাওয়া যাক, কবিতাটির নাম ‘কবি’।
এখানে শ্লেষ আরও তীব্র, আরও সরাসরি কথা বলছেন জীবনানন্দ। যদিও কবিতার মান অনুসারে এ কবিতাটি ‘সমারূঢ়’র সমকক্ষ নয় বলেই আমার ধারণা। এ ধারণায় উপনীত হবার কারণ কী সে সম্পর্কে পরে আসা যাবে, আপাতত কবিতাটির দিকে একবার তাকিয়ে নেওয়া যাক।
কবিতাটি শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে, মাত্র আট-লাইন পড়লেই বোঝা যায় যে কবিকে দেখে এলেন জীবনানন্দ তিনি আর কেউ নন – তিনি ‘জীবনানন্দ’ই। জীবনানন্দের অল্টার-ইগো খেলা করছে সারা কবিতাটি জুড়ে,
‘কবিকে দেখে এলাম
দেখে এলাম কবিকে
আনন্দের কবিতা একাদিক্রমে লিখে চলেছে
তবুও পয়সা রোজকার করবার দরকার আছে তার
কেউ উইল ক’রে কিছু রেখে যায়নি।
চাকরি নেই
ব্যাবসার মারপ্যাঁচ বোঝে না সে
‘শেয়ার মার্কেটে নামলে কেমন হয়’, জিজ্ঞেস করল আমাকে
হায়, আমাকে!’
-এই কবিতাটি আমার কাছে জীবনানন্দের কবিতার নিরিখে এক বিস্ময়, কারণ এর থেকে বেশি শ্লেষ ও বিদ্রুপ আমি তাঁর অন্য কোনও কবিতায় এখনও পর্যন্ত লক্ষ করিনি।
তৃতীয় পঙক্তি থেকে শুরু হয়েছিল তার ধারাপাত।
প্রবল দারিদ্র্যের মধ্যে বসে একজন কবি একাদিক্রমে লিখে চলেছে আনন্দের কবিতা। এরপর একে একে আছড়ে পড়তে থাকে আরও সম্ভাবনার কথা, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যের আটলান্টিকে যেন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে ভেসে উঠতে চাইছেন একজন কবি, প্রতিটি সম্ভাবনাকে ছুঁয়ে দেখতে চাইছেন। চাইছেন কোনও অদৃশ্য আলাদিনের চাবিকাঠিতে খুলে যাক ভাগ্যের দরজা,
‘লাইফ ইনশিওরেন্সের এজেন্সি নিলে হয় না’, শুধায়
‘লটারির টিকিট কিনলে কেমন হয়? ডার্বি নয়- আইরিশ সুইপ
নয়- গোয়ার কিংবা বউবাজারের?’- এই বলে
শীতের সকালে চামসে চাদরখানা ভালো করে জড়িয়ে নেয় গায়’
-এখানেও দেখার আইরিশ সুইপ বা ডার্বি’র মধ্যে যে স্বীকৃত লটারির পদ্ধতি আছে সেদিকে গেলেন না জীবনানন্দ। বদলে তিনি গোয়া ও বউবাজারের ধূসর, ফাটকা পদ্ধতিতে চলা লটারির উল্লেখ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে সে কবির জীবনে ছায়া ফেলল প্রবল অনিশ্চয়তার মধ্যে ফাটকা-পদ্ধতিতে বেঁচে থাকার ছায়া। ‘সমারূঢ়’র মধ্যে শ্লেষের পরিশীলন ছিল। এখানে যেন জীবনানন্দ আরও মরিয়া, জীবনের গ্লানির মধ্যে বাঁচতে বাঁচতে তুচ্ছ হয়ে আসছে শাশ্বতিক নান্দনিকতা; বরং সেটিকে আক্রমণ করা, রেডিকিউল করাই তাঁর প্রাথমিক উদ্দেশ্য,
‘মাজনহীন হলদে দাঁত কেলিয়ে একবার হাসে
মাইনাস এইট লেন্সের ভিতর আধমরা চুনো মাছের মতো দুটো চোখ;
বেঁচে আছে! না মরে?’
-কিন্তু তিনি জীবনানন্দ, এক শৃঙ্গ থেকে আরেক শৃঙ্গে আমাদের হাত ধরে নিয়ে যাবার সময়ে অনিবার্যভাবে উপহার দেবেন অলৌকিক কিছু দৃশ্য, তিনি লিখলেন,
‘মরুশ্বেত দুটো চুনোমাছ চোখের বদলে কাজ করছে যেন
মরণোন্মুখ ট্যাংরা’
-এসবের পাশাপাশি আরেকটি ঘটনাও ঘটে যাচ্ছে কবিতটিতে, সেটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আশ্চর্য সব ‘উপাদান’, তাদের মধ্যে আপাত সংযোগ নেই; কবিতায় তারা অনাবশ্যক ভার আনয়ন করতেই পারত। কিন্তু তিনি জীবনানন্দ, তিনি আশ্চর্য ট্র্যাপিজের খেলা দেখাবেন এবং আমরা বুঝতেও পারব না যে তিনি খেলা দেখিয়ে চলেছেন,
‘হয়তো প্রফিল্যাকটিক টুথব্রাশও কিনতে পারত
আর ফরহান টুথপেস্ট
দাঁত ও মাড়ি সুন্দর, শক্ত হত তার
হ্যালিটোসিস থাকতো না
থাকতো না ডিসপেপসিয়া
পেটের গ্যাস
স্টেপটোকোকাস’
-বিশেষ ধরণের টুথব্রাশের সঙ্গে তিনি উল্লেখ করলেন বিশেষ ব্র্যান্ডের টুথপেস্টের। সঙ্গে সঙ্গে তিনি শ্বাসের দুর্গন্ধজনিত রোগের উল্লেখ করলেন (হ্যালিটোসিস)। এবং স্টেপটোককাসের কথাও উল্লেখ করতে ভুললেন না। এরপর আবার আছড়ে পড়ল বিদ্রুপ, খুব শান্ত স্বরে,
‘কিন্তু থাকঃ- কবিতার সঙ্গে এসবের কি সম্পর্ক
বিশেষত আনন্দের কবিতার সঙ্গে-’
-গা ছমছম করে ওঠে যখন তিনি লেখেন,
‘কবিকে দেখে আমরা কি করব?
পড়ব তার আনন্দের কবিতা- কবিতার বই
আর্ট পেপারে আর্ট প্রেসে ছাপা হয়
অনির্বচনীয় কভার
কখনো বা অন্ধকারিক, নাক্ষত্রিক, কখনো বা প্রান্তরের বটের গুঁড়ির ফাঁকে
জ্যোৎস্নার মতো- জ্যোৎস্নার প্রেতাত্মার মত;’
-জীবনানন্দ কি এখানে শিল্প ও শিল্পীর অভিযাত্রার মধ্যে ঘনিয়ে ওঠা দূরত্বের দিকেও প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন? শিল্পী কি সিস্টেমের দ্বারা পরিচালিত হয়ে আনন্দের কবিতা লিখতে ভয়াবহভাবে নিয়তিতাড়িত? কবিতাটির শেষ চারটি পঙক্তির দিকে যাওয়া যাক এবার,
‘যাক- এসো আমরা তার কবিতা পড়ি
অজস্র আশাপ্রদ কবিতা
টইটুম্বুর জীবনের স্লটমেশিনে তৈরি
এক একটা গোল্ডফ্লেক সিগারেটের মতো’।
-এই কল্প-আশাপ্রদ কবিতা অতি-অবশ্যই জীবনের প্রতি প্রতারণা। অসাড় রক্তমাংসহীন পদ্ধতিতে উৎপাদিত হয়ে যাওয়া কবিতা। কবির কাছে সমাজের চাওয়া এই অশ্লীল বিষয়টিকে জীবনানন্দ বিদ্রুপ করলেন চূড়ান্তভাবে। ‘সমারূঢ়’ কবিতাটির ভিতর শিল্পের যে হয়ে-ওঠা আছে এই কবিতাটি সে নিরিখে দূর্বলতর। কিন্তু এটিও জীবনানন্দের একটি প্রকাশ, যে প্রকাশ প্রকাশের মধ্যে লুকিয়ে থাকে মরণোন্মুখ ট্যাংরার আর্তনাদ।
২
জীবনানন্দের এক একটি কবিতার দিকে তাকিয়ে বসে থাকি দিনের পর দিন; এক একটি শব্দের ভেতর জাফরি-কাটা আলো এসে পড়ে। মুহূর্তের জন্য মনে হয় তাঁকে আবিষ্কার করা গেল, পর মুহূর্তেই সে হারিয়ে যায়। এ এক অনন্ত খেলা।
জীবনানন্দের অগ্রন্থিত কবিতার মধ্যে ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামে একটি দীর্ঘ কবিতা রয়ে গেছে।
কবিতায় একটি ক্রিয়াপদের ভূমিকা শেষ না-করে পরপর ক্রিয়াপদের আনয়ন ঘটালে নিশ্চিত ব্যর্থতার কবর খোঁড়া হয়। অন্তত আমাদের মতো পাঠকের তাই ধারণা। শুধুমাত্র এ ধারণাটিকে কীভাবে যে একজন কবি নস্যাৎ করে দিতে পারেন তার অনুপম নিদর্শন হয়ে থাকতে পারে এ কবিতাটি। শুধু তাই নয়, একজন অতি-শক্তিশালী কবির হাতে একটি মাত্র শব্দ তার অমোঘ আয়ুধ হয়ে উঠতে পারে; এখানেও তার অন্যথা ঘটেনি।
কবিতাটি শুরু হয়েছিল এভাবে,
‘তারপর তুমি এলে
এ পৃথিবী সলের মতন তোমার প্রতীক্ষা করে বসেছিল
সলের মতন দীর্ণ ক্ষুব্ধ এই দানব পৃথিবী’
-কবিতাটি বহুবার পড়েছি, একটি শব্দ চোখ এড়িয়ে গেছে। তার ব্যঞ্জনা ধরতে ব্যর্থ হয়েছি ভয়াবহভাবে। অবশেষে একদিন আবিষ্কার করেছি শব্দটিকে, ঘুরে বেড়িয়েছি শব্দটির চারপাশে।
কবিতাটি শুরু হয়েছে অতর্কিতে, তারপর তিনি এলেন। অর্থাৎ তার আগে বহু কিছু ঘটে গেছে; কিন্তু সেসবই হয়তো তাঁর আসার নিরিখে তুচ্ছ। এখানে তাঁর আসাটিই সব থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
কিন্তু একটি শব্দ- সেই একটি শব্দ যা জীবনানন্দের কবিতার ভেতর থেকে উঠে এসে বিঁধে যায় সেটির আগমন ঘটেছিল তৃতীয় পঙক্তি’তে। শব্দটি হল ‘সল’। এই একটি মাত্র শব্দে জীবনানন্দ পুরাণকে ধরে রাখলেন; রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে যুক্ত করে দিলেন এমন অনেকগুলি বিষয় যা অকল্পনীয়।
সল নামে দু’জন রোমান সূর্য দেবতা ছিলেন’ একজন সল ইন্ডিজেস, অপরজন সল ইনিভিক্টস।
সল ইন্ডিজেস তেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন না। কিন্তু সল ইনভিক্টস রাজনৈতিক ক্ষমতাকে কেন্দ্রিভূত করেন। তিনি সাম্রাজ্যকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে যান।
সল শব্দটির সূত্র ধরে এখান পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া যায়; কিন্তু এ বিশ্লেষণও সম্পূর্ণ নয়। কবিতাটির শেষের দিকে এসে আমাদের এদিকে আরেকবার চোখ ফেরাতে হবে।
জীবনানন্দ এ কবিতায় কীভাবে ক্রিয়াপদগুলিকে ব্যবহার করছেন দেখে নেওয়া যাক একবার,
‘ঝলমল আলম্বিত চোগা পরে প্রবল উষ্ণীষ শিরে রেখে দিয়ে
কঠিন অসির ‘পরে ভর ক’রে,
অসীমের অনাবৃত হলঘরে ক্ষণিকের দম্ভ ভুলে ক্যাম্পের নিষ্ঠুর ধাতব বাদ্য
ইশারায় স্তব্ধ করে দিয়ে
চোখ বুঁজে আধোমুখে
এ পৃথিবী মুহূর্তের কাজ তার ভুলে গিয়েছিল’
-এক বিশালকে ধারণ করার জন্য, তার আগমনের পথ প্রস্তুত করার জন্য নিজেকে তৈরি করছে পৃথিবী। তাঁর আসার মুহূর্তে ‘ক্যাম্পের নিঠুর বাদ্য’ স্তব্ধ হয়ে যাওয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। যে গান ধাতুর তার বিপ্রতীপে অন্য এক গানের মহাবিশ্ব গড়ে তুলবেন তিনি, এমন ইশারা ছড়িয়ে রাখলেন জীবনানন্দ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘তারপর তুমি এলে’ রূপান্তরিত হয়ে যায় ‘তুমি এলে’-তে।
এখানে এসে খ্রিষ্টীয় ‘সিন’এর ছায়া পড়ে জীবনানন্দের এ কবিতায়,
‘আমাদের উপভোগ লালসার এত শক্তি সমুদ্রের মতো এক ব্যথারেও বহিতে পারে যে, বহিতেছে;
আমরা জানি না তাহা
আমাদের অসুর পৃথিবী জানেনিকো।’
-রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিতে যাকে মোহান্ধতা বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যে আত্মপ্রবঞ্চনাময় মতো যান্ত্রিক উপভোগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে বারবার তার দিকে তাকিয়েই কথাগুলি বললেন জীবনানন্দ।উপভোগ লালসার শক্তি ক্রমাগত অসাড় করে দিচ্ছে আমাদের, ব্যথাবোধ লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথ কি সেই লুপ্ত হয়ে যাওয়া ব্যথা-জাগানিয়া?
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘দুঃখ যদি না পাবে তো দুঃখ তোমার ঘুচবে কবে?
বিষকে বিষের দাহ দিয়ে দহন করে মারতে হবে’।।
– সৃষ্টির মূলে রয়ে যাওয়া দ্বেষের কথা লিখেছিলেন জীবনানন্দ এক সময়ে; এখানে এসে, রবীন্দ্রনাথের কাছে এসে তিনি সৃষ্টির সুন্দর-সংলগ্ন হয়ে ওঠার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু সৃষ্টির মধ্যে অবিমিশ্র সুন্দরের ছায়া তিনি দেখতে পেলেন না; তিনি জানিয়ে দিলেন সৃষ্টি সুন্দরের দিকে চলে, তবে তার পিছনের পথে রয়ে যায় বহু শিল্পীত সন্ত্রাস।
পারাপারহীন বেদনার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে কোটি কোটি হাহাকার,
‘মুহূর্তে মুহূর্তে যেই বেদনারা এশীরীয় সৈন্যদের মতো বর্শা তুলে নেচে ওঠে
তারা পরাজিত হয়’
-এ সত্য, জীবনানন্দের ভাষার বলতে গেলে বলতে হয় ‘তবু শেষ সত্য নয়।’ সে সন্ধান যেন দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, এবং জীবনানন্দ লিখছেন,
‘সৃষ্টি চলে তাই সুন্দরের দিকে
ক্ষমা প্রেম স্থিরতার পানে
নক্ষত্রের শান্তির উদ্দেশে’
– রবীন্দ্রনাথ ‘রক্তকরবী’তে লিখছেন, ‘পৃথিবীর তলায় পিণ্ড পিণ্ড পাথর লোহা সোনা, সেইখানে রয়েছে জোরের মূর্তি। উপরের তলায় একটুখানি কাঁচা মাটিতে ঘাস উঠছে, ফুল ফুটছে- সেইখানে রয়েছে জাদুর খেলা। দুর্গমের থেকে হিরে আনি, মানিক আনি, সহজের থেকে ঐ প্রাণের জাদুটুকু কেড়ে আনতে পারি নে’ (নেপথ্যে)
কী আশ্চর্য, রবীন্দ্রনাথের প্রতি নিবেদিত কবিতাটিতে ঠিক সেই সুরটিকেই ধরলেন জীবনানন্দ, লিখলেন,
‘সবচেয়ে আধুনিক বিজয়ের সাম্রাজ্যের থাম ভেঙে সুন্দর পাবে না তুমি কিছু
সেখানে সহিষ্ণুতা নাই- ক্ষমা নাই- প্রেম নাই
কোনোদিন ব্যথা ছিল নাকো’- ছিল নাকো’ ব্যথা বোধ।
তাহাদের শক্তি ছিল- ব্যথিত ঘাসের কীট যেই শক্তি জানে, ছিল তাহা।’
-এবং রবীন্দ্রনাথের গানের দিকে চেয়ে তিনি লিখছেন,
‘তুমি এই পৃথিবীরে তোমার গানের সূতা দিয়ে আকাশের অন্য এক নক্ষত্রের সাথে বেঁধে দিয়ে চলে গেছ’
-এই পঙক্তিটির দিকে তাকালে দেখতে পাওয়া যায়, আকাশের তারায় তারায় গানের সুর বেঁধে দিয়ে চলেছেন রবীন্দ্রনাথ। বস্তুত রবীন্দ্রগানের মহাবিস্তার’কে এভাবে সার্থকভাবে ফুটিয়ে তোলার নমুনা খুব বেশি নেই।
ধাতুসংগীতের থেকে বহুদূরে ফুটে ওঠা রবীন্দ্রনাথের গানের দিকে চেয়ে রয়েছেন জীবনানন্দ।
এ কবিতাটিতে দু’বার ‘সল’এর উল্লেখ আছে, দ্বিতীয়বার তিনি লিখছেন,
‘যেমন শুনেছি সল ডেভিডের গান’
-ডেভিড সংগীতে পারদর্শী, শুধু তাই নয় তিনি অসীম সাহসী। বহু গুণের সমাহার তাঁর, সঙ্গে ছিল বেথসেবার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক। রাজা সল ডেভিড’কে পছন্দ করতেন, সলের হাত ধরে তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করতেন। কিন্তু ধীরে ধীরে ব্যক্তিত্বের সংঘাত বাঁধতে শুরু করে। সল গোপনে ডেভিড’কে হত্যা করবার পরিকল্পনা করেন। জীবনানন্দ সল ও ডেভিড শব্দ দু’টিকে পাশাপাশি ব্যবহার করলেন, লিখলেন,
‘অবনত রূঢ় বিদ্ধ ভ্রূকুটিপীড়িত মুখে কোন এক দৈত্যসম্রাটের মতো
আমাদের পৃথিবী- শতাব্দী তাহা শুনিয়াছে
যেমন শুনেছে সল ডেভিডের গান
একদিন’
-স্মরণে রাখা দরকার কবিতার তৃতীয় পঙক্তি’তে জীবনানন্দ লিখেছিলেন, ‘সলের মতন দীর্ণ ক্ষুব্ধ এই দানব পৃথিবী।’ সে দানব পৃথিবীর দিকে নেমে আসছে রবীন্দ্রনাথের গান। সে গান কি একই রকম ‘দানবীয়’ শক্তির অধিকারী? যদি না হয়,যদি তার ভেতর ঘনিয়ে না-থাকে সে বিপুল শক্তি তা হলে কীভাবে সে ‘বিষকে বিষের দাহ দিয়ে দহন করে’ মারতে সমর্থ হবে!
রবীন্দ্র-সৃষ্টির মধ্যে যারা শুধু প্রথাগত সুন্দরের প্রতিমূর্তি আবিষ্কার করলেন, যারা তাঁর টেম্পেস্টগুলিকে ধারণ করতে পারলেন না, তাদের একবার এই কবিতাটির কাছে ফিরে আসা উচিৎ। যে বিপদজনক খাঁড়ি পেরিয়ে চলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, সুন্দরের কাছে পৌঁছাতে গিয়ে কত ডুবোপাহাড়ে ধাক্কা খেয়েছে তাঁর ‘তরী’ তার সন্ধান জীবনানন্দ ছাড়া এমন অনুপমভাবে আর কে দেবেন!
আর একটি বিষয়, বউবাজারের সাট্টার পৃথিবী থেকে সল-এর কাহিনি পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন জীবনানন্দ। বিপুল বিপুল বস্তুপুঞ্জ ও ধারণাপুঞ্জ’কে কবিতায় এনে বসিয়েছেন অবলীলায়। তারপর দক্ষ শল্য-চিকিৎসকের মতো সিজারের দাগগুলি মুছে দিয়েছেন।
এই মুছে দেওয়াটাই বড় কবির মৌল-লক্ষণ। যারা কবিতার থেকে অতিরিক্ততার উপাদান বর্জন করার কথা বলেন তার ‘হয়তো’ অংশত ঠিক বলেন। বাকি অংশটি অধিকার করে আছেন জীবনানন্দ; অতিরিক্ত’কে অনিবার্য করে তোলাই তাঁর পৃথিবী।
খুবই মৌলিক অবলোকন। পার্থজিৎকে অনেক ধন্যবাদ আর শুভেচ্ছা!
অসামান্য একটি লেখা। পার্থজিৎ চন্দাকেও তাঁর লেখর মধ্য দিয়েই একটু একটু করে চিনছি…
দুই কবির মনোজগতেরএ মিল না থাকলে এমন লেখা, লেখা যায় না।
শুভেচ্ছা নিরন্তর।
অসামান্য একটি লেখা। পার্থজিৎ চন্দাকেও তাঁর লেখর মধ্য দিয়েই একটু একটু করে চিনছি…
দুই কবির মনোজগতের গভীর মিল না থাকলে এমন লেখা, লেখা যায় না।
শুভেচ্ছা নিরন্তর।
অসামান্য একটি লেখা। পার্থজিৎ চন্দাকেও তাঁর লেখার মধ্য দিয়েই একটু একটু করে চিনছি…
দুই কবির মনোজগতের গভীর মিল না থাকলে এমন লেখা, লেখা যায় না।
শুভেচ্ছা নিরন্তর।