মণিশংকর বিশ্বাস-এর কবিতা
~অ্যালজোলাম~
হেরে যাওয়ার থেকে
ইচ্ছে করে হেরে যাওয়া যে বেশি ভালো
তোমার প্রত্যাখ্যান আমাকে শিখিয়েছিল, রূপা নন্দী,
আমার ছোট্ট রূপালী নদী…
~রূপা নন্দী~
সন্ধ্যার ক্ষীণ আলোয় দাঁড়িয়ে
হঠাতই মনে পড়ে যেতে পারে
এই অল্প আলো, এই দুর্বোধ্য আলোর উৎসও
এক প্রবল মহিমান্বিত সূর্য
তোমার অভাবও যেরকম তুমি
~মাধবী~
সব কিছুরই একটা দুর্দান্ত দিক থাকে
এই যেমন তোমাকে ভালোবেসে
এতদূর চলে গেছি যে
এখান থেকে আর ফিরে আসা যায় না
বেদনার ফুলের দিকে অপলক চেয়ে থাকি স্থির
বেদনার ফল আসা বাকি আছে আজও
~শিল্পী~
আজ সাবওয়ে থেকে বেরোবার মুখে দেখলাম এক পথশিল্পী গিটার বাজিয়ে গান গাইছেন। সামনে গিটারের খোলা বাক্স, তার ভিতরে ছড়ানো ছিটোনো কিছু কয়েন, অল্প কিছু কাগজের নোট। না-দাঁড়িয়ে যেতে যেতে যেটুকু শুনলাম, কী যে অপূর্ব গান ও গায়কী! অন্য দিন হলে নিশ্চয়ই আমিও ছুড়ে দিতাম সামান্য অর্থমূল্য, কিন্তু আজ দেরি হয়ে গেছে! ভাবলাম, থাক না এখন। অতঃপর অত কিছু না ভেবেই হাঁটতে থাকলাম গন্তব্যের দিকে।
অর্থাৎ দিতে পারতাম কিছু একটা কিন্তু দিলাম না। না, এর ভিতর গভীর কোনো ভাবনা বা যুক্তিশৃঙ্খলা নেই, মনস্তত্ত্ব নেই।
কী জানি এই যে সোমলতাকে পাইনি আমি, এও হয়তো এমনই। জগত-সংসারের এতে কোনো উদ্দেশ্য ছিল না, ছিল না কোনো গোপন অভিসন্ধি।
শুধু মাঝখান থেকে আমি নষ্ট হয়ে গেছি, এইটুকুই যা।
~হিপোক্র্যাটিক ওথ~
যেদিন চলে গেল— কী অসম্ভব কষ্ট পাচ্ছিল বাবা!
যন্ত্রণায় বেঁকে যাচ্ছিল চশমার কাঁচ, কপালের রামধনু
ডাক্তাররা অপেক্ষা করছিলেন ওঁর মৃত্যুর—
ঠিক যেভাবে রিসার্চ ফেলো অপেক্ষা করে রিসার্চ গাইডের জন্য
ডাক্তারদের নৈতিকতা বাধা দিচ্ছিল—
ভেইনের ভিতর ছোট্ট একটা টর্নেডো ঢুকিয়ে বাবাকে মেরে ফেলতে
ডাক্তারদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ, বাবাকে প্রায় ২২ ঘণ্টা
মৃত্যু-যন্ত্রণার সঙ্গে লড়তে পরোক্ষভাবে উৎসাহ দিয়েছিল।
মা অবশ্য পরে বলেছিল, “যাবার আগে এত কষ্ট পেল তোর বাবা!
সব পাপ ধুয়ে গেল!”
ডাক্তাররা তাহলে পাপও ধুইয়ে দেন কখনো কখনো! আমি পরে ভাবছিলাম…
~চেহারা~
ধরা যাক আমি মৃত্যুর কথা ভাবছি।
ঠিক তখনই এল মৃত্যু
খালি পা, গোঁফদাড়িহীন
মুখের দিকে তাকালে বুকের ভিতর টুপটাপ হিম ঝরে যায়
বা শাদা শাড়ি পরা এক মহিলা, সবুজ পাথরের চোখ…
কী অদ্ভুত আর বিচ্ছিরি একটা ব্যাপার হবে না!
কাউকে বলে যেতে পারব না কেমন দেখতে তাকে
নরক
ছেলেটিকে, মেয়েটি বলেছিল, “এভাবে চললে তো মরে যাব আমি!”
এখানে এই ‘যাব’ ক্রিয়াপদটিকে আমি আক্ষরিক অর্থে ভেবে দেখি।
দেখি, বাক্যের বাইরে থেকে।
এভাবে বাইরে থেকে না দেখলে, শুনেছি কিছুই দেখা হয় না।
সত্যকে জানা হয় না।
সত্য আমার মামার নাম। এক পাতাখোর বন্ধুরও নাম।
এইসব হ্যালুসিনেটিক মানুষদের প্রসঙ্গ অন্য কোনো দিন।
কিন্তু সেই থেকে আমি ভাবছি, অন্তর্চেতনায় হলেও
মেয়েটি কি মরে গিয়ে অন্য কোথাও যেতে চেয়েছিল?
আর এ থেকে আরেকটা চিন্তাও মাথায় ভিতর পাক খায়
আমি যদি মৃত্যুর পরেও কোথাও না পৌঁছাতে পারি!
শুধু উত্তুঙ্গ গিট পড়ে যাওয়া বিশাল এক পাজামা পরে
অন্ধকার লবণহ্রদের মধ্যে হাবুডুবু খাই—
জীবন এখনো কিছুটা বাকি আছে ভেবে!
সব কবিতাই ভালো লাগা কবিতা।
মণিশংকর বিশ্বাসের কবিতা সম্পূর্ণ নতুন এক ঝলক হাওয়ার মত, যে হাওয়ায় ঘাম শুকিয়ে আসেনা, যে হাওয়া অন্তর্বাহী আশঙ্কার মত ঝড়ের সম্ভাব্য সূচকও নয়…তবু তীব্র এক ভেঙে ফেলতে চাওয়ার নিরিখে এযাবৎ পাঠ অভিজ্ঞতার বন্দীত্ব আবিষ্কার করি। আর কি আশ্চর্য, এই আবিষ্কার পুলকিত করে কারণ কবিতার গা থেকে পুরনো পালকেরা ঝরে যাচ্ছে…অথচ নিঃসীম উড়ালের শর্ত নির্বাধ হয়ে ওঠার নিবিড় মাতন প্রতিটি লসিকাগ্রন্থি জুড়ে জ্বেলে যাচ্ছে আলো, এ আলোর নাম নেই, খোলা খামে আসা চিঠিটির মত উপেক্ষিত আহুতিকে প্রার্থিত করেছে অসংযমী আত্মগরিমায়…ছোঁয়াচেরও কত রকম হয়!
যে ভাষ্যে কবিতা নির্মিত হল, তা তথাকথিত পাঠক্রম বহির্ভূত। তবু খোলামাঠে ছুটে যাওয়া চপল কিশোরীর মত এক বিশুদ্ধ রাগ উৎসারিত হল, আর তাকে ধারণ করতে উদগ্রীব বাদ্যযন্ত্রদের একঘরে করে কবিতা সরণী দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আপনভোলা একজন, যাঁর কোন স্তুতির মোহ নেই, সে শুধু কান পেতে শুনেছে হৃদয়, হৃদয়ের ক্কাথ থেকে রাঙিয়েছে শব্দের মাপ, তারপর…তারপর টাঙিয়েছে আকাশে আকাশে…বিধিনিষেধের পরোয়া করেনি বলে তার মধ্যে বিন্দুমাত্র হীনমন্যতা নেই…
বাংলা কবিতার নোয়ার নৌকোয় আর জায়গা নেই বলে বিলাপ করেছে যাঁরা, তাঁদের বিদ্ধ করে উত্তপ্ত শলাকামুখে গেঁথে গেল প্রাণের আরক! নাও এবারে নতুন সাজে সেজে ওঠো দেখি, সেঁকে ওঠো দেখি…