বিস্ফোরণের জন্মদিন <br /> ঊর্ণনাভ

বিস্ফোরণের জন্মদিন
ঊর্ণনাভ

'হারবার্টকাকা, পুজোর ঘর, ডায়রি... কাকা... ডায়রি কালীর ফটোর পিছনে... ডায়রি।' হারবার্ট হিতাহিতজ্ঞানশূন্য, হাসপাতাল এবং শ্মশানের অগণিত পুলিশ দেখে সে ভুলে গেছে এসব কথা বিনুই তাকে জানিয়েছে আগে। মদের নেশায় ফেড হয়ে যাওয়ার আগে তার কী উচিত ছিল না আত্মবিশ্লেষণের, আদৌও কী সে মৃতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারেছে সে? নাকি সবই মায়া? প্রশ্ন অনেক উত্তর কেবল একটি রেজর ব্লেড। পিতৃ-মাতৃহীন হারবার্ট নিজস্ব কল্পনা-বোধ-উপলব্ধি-স্বপ্ন দিয়ে একটা জগৎ রচনা করেছিল, সেখানে পরী ছিল, লেডি ডাক্তারের স্বপ্ন ছিল, বুকিও আসত। মখমোলায়েম ঘাসফুলেল মাঠে হূরি পরীদের খেলা বা বাবলা গাছে কাতলা মাছের খেলা বুকের মধ্যে টুনুক টুনুক ঘন্টা দুলে উঠত। তাকে ঘিরে থাকত অজস্র ভূত — এই কথাগুলো সে বোঝাতে চেয়েছিল অন্ধকারের যুক্তিবাদী লোকেদের। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যারা অসুস্থ পরিবেশের ভিতর একটা হারবার্টের জন্ম দেয়, মির‍্যাকেল হিলারে বসায় তারপর অ্যাবনরমাল ঘোষণা করে টুঁটি চেপে ধরে। ঠিক চৌরাস্তার ট্রাফিক হাবলদারটা যেভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষটাকে চোর সাব্যস্ত করে তেমনি আগুনে আঁচানো বিনুর রক্তমাখা শিকলগুলো হারবার্টকেও পাকিয়ে পাকিয়ে ধরে। বাটপাখি বলে তেড়ে আসে। বুজরুকি! বাঞ্চোতের বাচ্চারা কবে জানবে...

সাতাশ বছর পার করে হয়রানির এই রাত্রে আমি যাকে চিৎকার পড়তে শুরু করলাম তাঁর নাম নবারুণ ভট্টাচার্য। হারবার্টের নবারুণ ভট্টাচার্য। হারবার্ট সরকার। যার র‍্যাম্বলিং দু’টো হাত, অ্যাবসার্ড উদ্ধত একটা দৈত্য কলকাতার ঔপনিবেশিক ভূতে জর্জরিত চোর চিটিংবাজদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নির্ভয় নিঃসংশয়; শানিত তরবারির মত অবাধ্য। গভীর রাতের এই চিল ছাদে যার কবিতায় শোনা গেল — কোনো ঝামেলায় নাই, ঘর থেকে বেরোচ্ছি না, কাউকে ফুসলাচ্ছিনা, স্বপ্ন পেয়ে কারবার খুলেছি আর শালাদের জ্বালা ধরছে খুব। জ্বালা ধরারই কথা, যেখানে স্তাবকের জন্ম নেওয়ার কথা ছিল সেখানে জন্ম নিয়েছে আস্ত একখান শব্দের বাঘ। আটের দশকের র‍্যাশনালিস্ট কেতাদুরস্তরা যাকে অ্যারেস্টের কথা বললে তার একটাই উত্তর শোনা যায় — না! পুলিশ আসবে না! আমি স্বপ্নে পেয়েছিলুম। বিনুকে পুলিশ মেরেছিল! গুলি করে!… আমি মিথ্যে বলিনি। ভূত আছে। ভূত থাকবে। সত্যিই তো ভূত ছিল আছে এবং থাকবে।

তারপর — সাঁওতালদি, ব্যাণ্ডেল একে একে নিভে গেলে / নিরীহ মানুষটি অন্ধকারে পা ফেলে/ হেঁটে যায় মাঠ গাছ নদী/ সারারাত ধরে তারা খসে। মানুষটি দাঁড়িয়ে থাকে সেই স্বচ্ছ আঁধারে বসে। মোহনার সাঁতারের নুন মেখে ডোরাকাটা বাঘ যেমন হাঁ করে তাকিয়ে থাকে কুমিরের হাই তোলা ঘুমচেখে — হারবার্ট তাকিয়ে থাকে! সাদা খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তোবড়ানো ভাঙাচোরা গাল। ছাদের অ্যান্টেনা দুমড়েমুচড়ে ছুঁড়ে দেয় আকাশের দিকে। অন্ধকারের কালোবাজারি করতে যেসব নক্তচর রাতের আকাশটাকে কুটে কুটে খাচ্ছে এক মুহূর্তে যেন একখানা দেশলাই মেরে সবটুকু জ্বালিয়ে নস্যাৎ করে দিতে চায় কবিতার শব্দ দিয়ে। পরলৈকিক মনন দিয়ে। তাকে আমি চিনি অথবা চিনিনা। বারোবছর বয়স থেকে অলেখ্য দূরত্ব বজায় রেখেও যার পিতার নাম আমি বারংবার ভুলবশত উচ্চারণ করেছি — নবারুণ ভট্টাচার্য। কী এক বেপরোয়া সন্তান উপহার দিয়েছেন এ পৃথিবীকে। আমাদের গায়ের চামড়া হয়তো তত বেশি কালো নয় যতখানি কালশিটে তার শব্দের কালো। প্রচণ্ড ক্ষোভে পুড়ে যাচ্ছে হাতের সিগারেট। দৈনিক মনোপলির অপপ্রচারে যাকে আড়াল রাখা হয়েছিল ফ্যাসিস্ট জ্যোৎস্না দিয়ে আজ তার সর্বাঙ্গ পুড়ে যাচ্ছে, দাউ দাউ করে জ্বলছে কবিতার খাতা — ‘আমার এ কুষ্ঠরোগ সারানো কি কলকাতা শহরের কাজ যার হাইড্রেন্ট নেই।’

বিনুর মৃত্যুর পর যে হারবার্ট মাল্টিস্টোরেড বিল্ডিংয়ের নীচে চাপা পড়ে যাচ্ছে আচমকা তাকে যেন দেখা গেল ছাদের কিনারে ন্যাপথলিন চাঁদ হাতে নিয়ে মাও-সে-তুং পড়ে শোনাতে। যে বিনু একদিন তার সমস্ত প্রেতবিশ্বাসকে অস্বীকার করে অ্যাপলিটিক্যাল ভূত-চিন্তা উপলব্ধি থেকে টেনে বের করে আনতে চেয়েছিল নকশালদের রাজনৈতিক আন্দোলনের সময়পর্বে। আজ এই ছাদে বিছানার তলায় লুকোনো ডিনামাইট স্টিকগুলো হারবার্টকে কাটাকুটি করছে ভীষণ ভাবে । পায়ের কাছে পড়ে আছে মায়ের বিদ্যুৎপিষ্ট নিথর দেহ ভেজা কাপড়ের তার ছিঁড়ে লক্ষ হাজার পায়রা উড়ে গেছে সার্কাসের ভুতুড়ে তাঁবুর ভিতর। একা নির্জন চিল ছাদ। বস্তুত, এই ছাদই ছিল তার স্বপ্ন মুক্তির জগৎ, এখান থেকে দেখা যেত হাওড়া ব্রীজ ভিক্টোরিয়ার চূড়া। রাস্তার ঘন গাছের ছায়ার তলা দিয়ে একসময় দোতলা বাস যেত তার পরিবর্তে হাঙরের মত পেট ফুলিয়ে ছুটে আসে উন্মত্ত সব যানবাহন। চোখের উপর আকাশটা ঢেকে গেছে চারপাশে যেন দেওয়াল তুলে দিয়েছে কেউ। এই দমবন্ধ পরিবেশ যার তুলনা ইতিহাসের কোথাও নেই। বিনু নেই। বুকি নেই। আছে শুধু প্রেত কঙ্কাল আর বাটপাখির ফরফরানি। তবু মাঝে মধ্যে বুকির কথা মনে এলে হারবার্ট উঠে আসত এই ছাদে। অন্ধকারে খুঁজে পেত বুকির হাত, কোথাও কাঁপছে —

‘বিকেল ফুরিয়ে গেলে যখন ছায়া ছায়া হতে থাকে, একটা দুটো করে আলো জ্বলে, উনুনের ধোঁয়া নদীর মতো ভেসে যায়, তারও একটু পরে ঐ ছাদটাকে আর ফাঁকা বলে মনে হয় না। হয়তো ওই অস্পষ্ট অবুঝের মধ্যে বুকে দাঁড়িয়ে আছে, হাসছে, হাত নাড়ছে। চোখ কচলে দেখলে ঠিক যেন মনে হয় তাই।’

সে ছাদটুকুও আর নেই সেখানে উঠেছে হালদারদের দোতলা । সবখানে নেই নেই হাহাকারের ভূত জর্জরিত বুজরুকির গোলকধাঁধায় ডুবে যাচ্ছে হারবার্ট। হাসপাতালের বেডে শুয়ে যে শিকলগুলো বিনুকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে রেখেছিল সব যেন অসংলগ্ন খুলে পড়ছে — বিনুর মৃত্যুর পর এই প্রথম বিনু। বিনু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে। বিনু কিছু বলছে। বিনু একটু এগিয়ে আসে। বিনু হাসছে। বিনুর কথাগুলো কাচের এপারে ইকো হচ্ছে অনেক দূরের ভেসে আসা মাইকের গানের সঙ্গে —

— ‘হারবার্টকাকা, পুজোর ঘর, ডায়রি… কাকা… ডায়রি কালীর ফটোর পিছনে… ডায়রি।’ হারবার্ট হিতাহিতজ্ঞানশূন্য, হাসপাতাল এবং শ্মশানের অগণিত পুলিশ দেখে সে ভুলে গেছে এসব কথা বিনুই তাকে জানিয়েছে আগে। মদের নেশায় ফেড হয়ে যাওয়ার আগে তার কী উচিত ছিল না আত্মবিশ্লেষণের, আদৌও কী সে মৃতের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পারেছে সে? নাকি সবই মায়া? প্রশ্ন অনেক উত্তর কেবল একটি রেজর ব্লেড। পিতৃ-মাতৃহীন হারবার্ট নিজস্ব কল্পনা-বোধ-উপলব্ধি-স্বপ্ন দিয়ে একটা জগৎ রচনা করেছিল, সেখানে পরী ছিল, লেডি ডাক্তারের স্বপ্ন ছিল, বুকিও আসত। মখমোলায়েম ঘাসফুলেল মাঠে হূরি পরীদের খেলা বা বাবলা গাছে কাতলা মাছের খেলা বুকের মধ্যে টুনুক টুনুক ঘন্টা দুলে উঠত। তাকে ঘিরে থাকত অজস্র ভূত — এই কথাগুলো সে বোঝাতে চেয়েছিল অন্ধকারের যুক্তিবাদী লোকেদের। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য যারা অসুস্থ পরিবেশের ভিতর একটা হারবার্টের জন্ম দেয়, মির‍্যাকেল হিলারে বসায় তারপর অ্যাবনরমাল ঘোষণা করে টুঁটি চেপে ধরে। ঠিক চৌরাস্তার ট্রাফিক হাবলদারটা যেভাবে মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষটাকে চোর সাব্যস্ত করে তেমনি আগুনে আঁচানো বিনুর রক্তমাখা শিকলগুলো হারবার্টকেও পাকিয়ে পাকিয়ে ধরে। বাটপাখি বলে তেড়ে আসে। বুজরুকি! বাঞ্চোতের বাচ্চারা কবে জানবে —

— ইন্দ্রিয়ারাম দেহাত্মাবাদীদিগের মন পরলোক বুঝিতে অক্ষম। পরলোক কেন, -ইহলোকেরও অনেক সূক্ষ্ম বিষয় বুঝিতে অক্ষম। ইহাদের মনে – শরীর, ইন্দ্রিয় ও ভোগ্য বিষয় লইয়াই সর্বদা ব্যতিব্যস্ত ও ব্যসক্ত অবস্থায় অবস্থান করে; সেই কারণে ইহাদের মনে পরলোক বিষয়ক প্রমাদজনিত নির্মল সত্যজ্ঞান জন্মে না। মন যে বিষয়ে একাগ্র হয়, সে বিষয় তাহাদের নিকট ফূর্তি পায় এবং যে বিষয়ে একাগ্র না হয়, সে বিষয় ফূর্তি পায় না।

হারবাট প্রতিবাদ জানায়। প্রতিবাদ জানানোর সবচেয়ে সহজ পথ আত্মহত্যা। হাতের শিরা কেটে নীল আকাশের মাঝখানে শুন্যে ঝুলতে থাকে হারবার্ট-এর কাটা হাত, রক্তে লাল। নিশানের মতো ভাসছে তার সুইসাইড নোট —

‘চৌবাচ্চার তেলাপিয়া গঙ্গাসাগরে চলল।
দোবেড়ের চ্যাং দেকবি? দোবেড়ের চ্যাং
দেখাব? ক্যাট ব্যাট ওয়াটার ডগ ফিশ।’

শবদেহটা চুল্লিতে ঢোকানো মাত্রই ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণে ঝলসে গেল চারদিক। বিনু মারা গিয়েও জানিয়ে দিয়ে গেল বিপ্লবের আগুন শীতের নিহিত তাপের ভিতরেও সামান্য ফুলকির জোরে জ্বালিয়ে দিতে পারে সাম্রাজ্যবাদের রাজপাট।

— কখন, কীভাবে বিস্ফোরণ ঘটবে এবং তা কে ঘটাবে সে সম্বন্ধে জানতে রাষ্ট্রযন্ত্রের এখনও বাকি আছে।

চিত্রঋণ — ছবিটি নবারুণ ভট্টাচার্যের। ছবি ঋণ — রীণা চক্রবর্তী ( নবারুণ ভট্টাচার্যের মাসি)

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes