
ফারুখ ফারোখজ়াদের কবিতা
অনুবাদ: সম্রাট লস্কর
বিংশ শতকের ইরানের সাহিত্য ও সংস্কৃতির দুনিয়ায় ফারুখ ফারোখজ়াদ (১৯৩৪ – ১৯৬৭) এক স্বতন্ত্র নাম। তাঁর কবিতার প্রতিবাদী (নারী)স্বর, চলচ্চিত্রের নতুনতর ভাষ্য, ব্যতিক্রমী ব্যক্তিগত যাপন — সব মিলিয়েই ফারোখজ়াদ হয়ে উঠেছিলেন এক বহু আলোচিত ব্যক্তিত্ব, যুগপৎ নন্দিত ও নিন্দিত। মাত্র ৩২ বছরের জীবদ্দশাতেই ফারোখজ়াদ ফার্সি কবিতার জগতে এমন এক আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন যে আধুনিক বিশিষ্ট ফার্সি কবিতার আলোচনা তাঁর কবিতা ছাড়া একেবারেই সম্পূর্ণতা লাভ করে না। দুর্ঘটনায় মৃত্যুর আগেই ফারোখজ়াদের চারটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়ে যায় — আসির (‘বন্দিনী’), দিওয়ার (‘দেওয়াল’), ওশিয়ান (‘বিদ্রোহ’) এবং তাওয়ালোদি দিগর (‘পুনর্জন্ম’)। তাঁর পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ইমান বিয়াভারিম বে আঘাজ়-এ ফসল-এ-সর্দ (‘এসো, বিশ্বাস করি শীতকালের সূচনাতে’) প্রকাশিত হয় ১৯৭৪ সালে, ফারোখজ়াদের অকালমৃত্যুর সাত বছর পরে। প্রথম তিনটি কাব্যগ্রন্থের সূর অনেকটাই ব্যক্তিগত; প্রেম, যৌনকামনা, প্রতিবাদী নারীবাদের সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসনে বাঁধা নিয়মনিষ্ঠ সমাজের সংঘাত এসবই ঘুরে ফিরে এসেছে। পরের দুটি কাব্যগ্রন্থে ফারোখজ়াদ বরং অনেকটাই সরিয়ে রেখেছেন তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত অনুভূতিগুলোকে। ব্যক্তিগত উন্নীত হয়েছে বৃহত্তর সামাজিক সচেতনতায়, কবিতার ভাষা ও কাঠামোতেও এসেছে পরিণতি। এখানে ফারোখজ়াদেরতাওয়ালোদি দিগর কাব্যগ্রন্থ থেকে চারটি কবিতা অনুবাদের চেষ্টা করা হল। সরাসরি ফার্সি থেকে নয়, মূলত মারিয়াম দিলমাঘানির করা ইংরেজি অনুবাদের সহায়তাতেই এই বাংলা অনুবাদগুলি করা হল।
পাখিটা মরে যেতেও পারে …
দুঃখ আসে
আমি নীল হয়ে যাই।
আমি বাইরে বেরিয়ে আসি আর শব্দহীন রাতের মসৃণ খোলসে
আমার শীতল আঙুলগুলো ঘষতে থাকি।
দেখি, যোগাযোগের সব আলো আজ নিভে গেছে,
আমাদের যাতায়াতের পথগুলো সবই বন্ধ হয়ে গেছে।
কেউ আমাকে সূর্যের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে না
কেউ আমাকে নিয়ে যাবে না ঘুঘুদের জটলার কাছে।
ওড়ার কথাটা কিন্তু ভুলে যেও না একেবারেই,
পাখিটা মরে যেতেও পারে…
জুম্মাবার
আমার শব্দহীন জুম্মাবার,
আমার নির্জন জুম্মাবার,
আমার নিজস্ব জুম্মাবার: বিষণ্ণ, যেন
ধুলোমাখা, পরিত্যক্ত গলি।
আমার জুম্মাবার,
অসুস্থতার শীতল দিন, অলস চিন্তার আনাগোনা;
নিষ্ঠুর, অন্তহীন একঘেয়েমির এক আদ্র দিন,
বিষণ্ণতা-পূর্ণ আমার জুম্মাবার,
শোকাতুর হয়ে তাকিয়ে থাকে
আমার ক্ষয়িষ্ণু বিশ্বাস আর
বৃথা আশার দিকে।
ও, আমার জুম্মাবার,
ত্যাগের দিন…
ও, আমার এই ফাঁকা ঘর,
ও, আমার এই আঁধার-ঘর !
এই অস্বচ্ছ দেওয়ালগুলো আমাকে রক্ষা করে যৌবনের আঘাত থেকে
ছাদ ধ্বসে পড়ে, ভেঙে যায় স্বল্পস্থায়ী উজ্জ্বল দিবাস্বপ্ন,
একাকিত্ব, চিন্তা আর দ্বিধার এই স্থান,
রং, রূপ, চিহ্ন, শব্দের এই স্থান,
সবাই আমাকে শোনায় — এক অপরাজেয় শূন্যতার কথা।
রহস্যময়ী নদীর মতন আমার এই জীবন
মিশে যায় ওই নিঃশব্দ, পরিত্যক্ত দিনগুলোতে,
কত না শান্তির সাথে, কতই না গৌরবের সাথে।
রহস্যময়ী নদীর মতন আমার এই জীবন
মিশে যায় ওই ফাঁকা, অন্ধকার ঘরগুলোতে,
কত না শান্তির সাথে, কতই না গৌরবের সাথে।
উপহার
অন্ধকারের এক্কেবারে কিনারা থেকে
আমি তোমার সঙ্গে কথা বলছি—
তোমায় বলছি রাত্রির গভীরতার কথা,
তুমি শুনছ নিখুঁত ছায়ার ঘনত্ব।
প্রিয়তম!
আসতেই যদি হয় আমার কাছে,
একটা মশাল নিয়ে এসো আমার জন্য,
সেটাকে রেখো
আমার ছোটো জানালাটির ধারে।
আমি তখন তাকিয়ে দেখব —
কীভাবে আনন্দিত গলি দিয়ে কোলাহল করে
হেঁটে যায় মানুষের ভিড় !
বাতাস আমাদের বয়ে নিয়ে যাবে, দূরে …
হায়, আমার ওই ছোট্ট রাতে
ঝড়ের চরম অভিসার ছিল
গাছেদের সুখী নিদ্রার সাথে।
হায়, আমার ওই ছোট্ট রাতে
ধ্বংসের জমাট বাধা ভয় গলতে শুরু করে।
শোনো!
ছায়াদের পদধ্বনি …
আমাদের পালাতে হবে।
আমার কাছে এই সুখ বড়োই অস্বস্তিকর,
এতদিন তো মগ্ন ছিলাম নিজস্ব বিষাদে,
ভয় পাই, কোনও বিপদ এসে আচম্বিতে নষ্ট না করে দেয়
এই নির্জন রাতের প্রশান্তি।
শোনো!
ছায়াদের এগিয়ে আসা পায়ের শব্দ …
আমাদের পালাতে হবে, এখনই।
দেখতে পাচ্ছ না?
পতনের ভয়ে আমাদের ছাদটা কেমন কাঁপছে?
আর ছাদের ওপরে, এক বিশাল, কৃষ্ণকায় মেঘ,
হতাশ, শোকাতুর মানুষের ভিড়ের মতোই
থমকে আছে, তীব্র আর্তনাদের প্রতীক্ষায়।
শুনতে পাচ্ছ না?
জানলার শার্সির ওই ধারে রাত এগিয়ে আসছে
পৃথিবীর গতিও ধীর হচ্ছে
মনে হয় যেন কোনও আগন্তুক দৃষ্টি
নজর রাখছে আমাদের ওপর।
শোনো!
ছায়াদের পদধ্বনি …
আমাদের এবার পালাতেই হবে।
তুমি,
যে পাতার সত্তার মতোই গাঢ় সবুজ,
তোমার হাতটা আমার হাতে দাও,
ধরো ভালোবাসার জ্বলন্ত স্মৃতিগুলোকে।
তুমি,
যে পাতার সত্তার মতোই গাঢ় সবুজ,
তোমার ঠোঁট দুটো মিশিয়ে দাও আমার ঠোঁটে,
পুরাতন সুরার নরম স্বাদ খুঁজে নাও তাতে।
আর আমরা যদি ভুলে যাই,
বাতাস আমাদের ঠিক নিয়ে যাবে,
বাতাস আমাদের বয়ে নিয়ে যাবে, দূরে…
*******
অনুবাদক: সম্রাট লস্কর
অসাধারণ লাগল। উপভোগ করলাম প্রতিটি কবিতা। অনুবাদের জন্য একটুও লাবণ্য ক্ষয় হয়নি