
পাবলোর ডায়েরি – সরালের ডানা, চিরঘুমের রঙ
সম্রাট সরকার
“দিনেরবেলায় বিছানার কোণে যে অন্ধকার ধরে আছে তার আশ্রয় আমার চাই। উপুড় করা জলের গ্লাসের ওপর যে হেলানো রোদ্দুর, হেমন্তের বিকেলের রোদ্দুর, তার সংকলন আমার স্মৃতি। ঝিঁঝিঁর একটানা ডাকের মধ্যে যে প্রচেষ্টা আছে তার উদ্যম আমার চাই। ঘুড়ি হারানো বালকের যে চোখের জল, তোমার মধ্যে আমার ভবিষ্যৎ রেখো। একটি পাখির না’ফোটা ডিমের যে হাহাকার, যে সম্ভবনা, তার হিম আমার চিরঘুমের রঙ।“
বাবা এই সব লিখেছে আমার প্রোজেক্টের খাতায়। পুরো পাতাটা নষ্ট। এইরকম ভাবে বহু খাতার পাতা আমার নষ্ট হয়েছে। যখন লেখা পায় তখন খেয়াল থাকেনা। আমার মার্কশিট, মায়ের পে-স্লিপ, দাদানের গ্যাসের বই, ঠাম্মার ব্রতকথা কিচ্ছু বাদ রাখেনি। আমার ক্লাস ফাইভের মার্কশিটের পেছনে লিখেছিল –
“একশো’য় নব্বই/ বাকি আর দশ কই/ সেই নিয়ে তর্ক/ মা আর অর্ক’য়”।
অর্ক আমার বন্ধু। সেবার নাইনটি পার্সেন্ট পেয়েছিল। মার্কশিট সই করে জমা দিতে মা আর আমি স্কুলে গেছি। অর্ক চাইল মার্কশিট। উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখল কাকিমা। রেজাল্টের দিনই কাকিমা অর্ককে ভয়ঙ্কর বকছিল। নাম্বার কম হওয়ার জন্যে। বাবা কোথাও থেকে খেয়াল করেছিল। আর আজ চোখে বাধল বাবার ওই কবিতা। ব্যাস,কাকিমা রেগে টং। অর্ককে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন। বাড়ি এসে মা হেসেই অস্থির। আমিও নব্বই ক’রে পেয়েছি। কিছুই হইনি। বাবার কথায় সব নম্বরগুলো ‘নবতিপর বৃদ্ধের মত ধুঁকছে’। মার্কশিটে কবিতার চোটে অর্কর কপালে কি ছিল তা অর্ক বলেনি। কিন্তু তারপর থেকে স্কুলে আর কাকিমা কোনোদিন ওকে বকেনি।
এখন আমি সাইকেল চলাচ্ছি। আর এখন বিকেল, মানে একটু বেশি বিকেল। সন্ধ্যে বললে হবে না। সামনে বাবা বড় সাইকেলটা চালাচ্ছে। আমি আর বাবা। আগে বাবার সাইকেলে বসতাম। এখন আমারও একটা সাইকেল আছে। আমার সাইকেলটা লালা-সাদা রঙের। জেঠু দিয়েছে। টায়ারের ওপর সাদা রঙের ঢাকনা। ঢাকনাটা টায়ারের ওপর উঠে শেষ। ঢাকনার শেষ থেকে টায়ার জোরে বেড়িয়ে আসছে। টায়ারের খাঁজকাটাগুলো ভালো করে দেখলে দেখা যাচ্ছে আর ঘোলা চোখে দেখলে হারিয়ে যাচ্ছে। কালো পিচের রাস্তায় আমার সাইকেলের সামনের টায়ারটা ঘুরেই চলেছে, ঘুরেই চলেছে। আজকেও তেমন কোনো ম্যাজিক হল না। রোজ ভাবি আজ নতুন কোনো রাস্তায় বাবা নিয়ে যাবে। বেশ কিছুদিন নতুন নতুন রাস্তা দিয়ে এলাম। যখন নতুন সাইকেল চালানো শিখলাম। কোন রাস্তায় বাবা নিয়ে যায় ঠিক নেই। হঠাৎ দেখি বাড়ির সামনে চলে এসেছি। তারপর সব নতুন রাস্তা ফুরিয়ে গেলো। বাবা বলে যে পুরনোকে নতুন করে দেখতে হয়, তাহলেই নতুন। আমাদের গ্রামে যে বয়সা বিল আছে সেখানে নাকি রোজ বিকেলে কে যেন ইরেজার দিয়ে বিকেলটা মুছে সন্ধ্যে লিখে দেন। তারপর সন্ধ্যে নামে। পশ্চিম আকাশে রোজ দেখা যায়। সেই কবে থেকে গাজিতলার পেছনে নাকি সূর্য ডুবে যায়। কিন্তু রোজ নতুন লাগে। এখন আমি বয়সা বিলের পাশ দিয়েই সাইকেল চালাচ্ছি। আজ একটা মজা করবো ভেবেছি। আমি না পকেটে সেই ইরেজারটা এনেছি। যেটা তুরাজ পেন্সিল দিয়ে ফুটো করে দিয়েছিলো। ওটা আর কাজে লাগবে না। আজকে আমি ইরেজার দিয়ে বিকেলটা কে মুছে দেবো। তারপর সন্ধ্যে লিখে দেবো। সেই লোকটা তো রোজই মোছে। এখন নাকি বর্ষাকাল শেষের দিকে। মেঘের ফাঁক দিয়ে সূর্যটা এক্ষুনি গাজিতলার বাগানে নেমে যাবে। সাইকেলটা থামাই। চলন্ত সাইকেল থেকে বিকেল মুছবো কি করে! আবার সন্ধ্যে লিখতে হবে। চলন্ত সাইকেল থেকে কি লেখা যায়? লেখা নড়ে গেলে ঠিক মত সন্ধ্যে যদি না নামে। সাইকেল থেকে নেমে পড়ি। এইবার ইরেজারটা দিয়ে মুছবো। কিন্তু পেন্সিল তো আনিনি। কি দিয়ে সন্ধ্যে লিখবো? রাস্তা থেকে ইঁট কুড়াই। লাল ইঁট দিয়ে ভালো হবে। গাজিতলার তেঁতুলগাছটার ওপর দিয়ে সবে সন্ধ্যে লেখা শুরু করেছি, দেখি বাবা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে। যেখানে সেখানে লেখা কি তবে আমারও পেল?
যেখানে সেখানে লেখা পাবে না কেন! সবাই যদি লেখে দেখাদেখি আমারও লেখা আসে। মরা-যমুনার বাঁশঝাড়ে সিন্ধুভাষা লেখা। খুব জটিল। একমাত্র পাঠক সাঁঝবেলার শালিকের দল। কাদামাঠের পিঠে লেখা সাদাবকের সন্ধান। সব অক্ষরগুলো তিনমুখো। বর্ণমালা জুড়ে একটাই অক্ষর। বেগুনগাছের পাতায় লেখা পোকার খিদে। বাবা এইসব বোঝায়। কিছু বুঝি কিছু বুঝি না।
আর সেদিন বাবাও বুঝতে পারছে না দুটো সরাল কেন বারবার আমাদের পুরনো বাড়ি, ক্লাবঘরের মাঠ আর কুঁজোঠাম্মার বাড়ির ওপর দিয়ে একটানা উড়ে যাচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে আর কিচকিচ করে ডেকে চলেছে। আসলে চক্কর কাটছে। দূর্গাপুজোর প্যান্ডেল তৈরি হচ্ছে। আমাদের গ্রামে সব লরি প্যান্ডেল। অত হিজিবিজি নয়। বাবা আর আমি কুঁজোঠাম্মাকে দেখতে এসেছি। ঠাম্মা ছয়দিন হল খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। মাটিতে শুয়ে। গায়ে একফালি কাপড়। কাপড়ের নিচে যেন কঙ্কাল রাখা রয়েছে। সবাই বলে ঠাম্মা বহুদিন একশো পার করেছে। কিছু বুড়োমানুষ এসেছে দেখতে। বাবা মাথার কাছে বসে কিছু বলছে। কিন্তু ঠাম্মার চোখ বোঁজা। সব কথার একটাই উত্তর। “আমাকে পুড়াবিনি। বিলের ধারে পুঁইতি দিবি”। মৃত্যুর পর পোড়াতে নিষেধ করছে। বয়সা বিলের মাটিতে গর্ত করে পুঁতে দিতে বলছে। ওদিকে মাথার ওপর সরাল একটানা ডাকছে। বাবা দুবার ওপর দিকে তাকাল। বাঁদিকে রাস্তার ওপারে আমাদের পুরনো বাড়ি। বাবা কখনো চোখ তুলে সেদিকে তাকায় না। পুরনো বাড়ি ছেড়ে আসা বাবার জীবনে বড় আঘাত। তাই আর ঘুরে দেখেনি কোনোদিন। আর আমি ভাবছি কুঁজোঠাম্মা তল্লার প্রজাপতির মত ‘না ফেরার দেশে’ যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। চিরঘুমের দেশ। ঠাম্মার সে চিরঘুমের রঙ কী? ওপরের সরালের না ফোটা ডিমের হাহাকার?
মাথা নিচু করে বাবা ক্লাবের মাঠেরদিকে চলে গেল। মুখে কথা নেই। ঠাকুরদালানে ঠাকুর তৈরি হচ্ছে। আমি একবার উঁকি দিয়ে দেখলাম। বাবা বিলের রাস্তা ধরবে কি ধরবে না, ইতস্তত করছে। মাথার ওপরে সরালের হাহাকার যে! দেবাশিসকাকু হঠাৎ বাবার হাত ধরল। বাবার ছোটবেলার বন্ধু। হাত ধরে বাড়ি নিয়ে গেল।
বাড়ি যেতেই অবাক কান্ড। দেবাশিসকাকুর মুরগির খাঁচা আছে। সেখানে প্রচন্ড লাফালাফি করছে সাতখানা সরালের বাচ্চা। গত পরশু সন্ধ্যেবেলা হঠাৎ কাকু দেখে উঠোনে এক সরাল বাবা-মা সাতখানা বাচ্চা নিয়ে হাজির। সামনে বাবা-মা আর পেছনে বাচ্চারা। লাইন দিয়ে ঢুকে পড়েছে। সবার চিৎকার শুরু। ভয় পেয়ে বাচ্চাগুলো বারান্দার ধানের বস্তা’র খাঁজে লুকোয়। আর সরাল বাবা-মা উড়ে নারকেলগাছে। সেই থেকে দেবাশিসকাকু ওদের মুরগির খাঁচায় রেখেছে। আর বাবা-মা সারাদিন রাত মাথার ওপর হাহাকার করতে থাকে। বয়সা বিল তো খুব কাছে। বিলের পাশের গাছগুলোতে সরালদের অনেক বাসা। বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে প্রায়ই চলে আসে গ্রামের ভেতরে। আমি আগে কোনোদিন সরালের বাচ্চা হাতে নিয়ে দেখিনি। নিজেই খাঁচার দরজা খুলে দিলাম। পিলপিল করে সবকটা বেরিয়ে এল। কে কোন দিকে যাবি ঠিক নেই। গায়ে সাদাকালো ছোপ। ডানা দুটো ছোট্ট। ইঁটে হোঁচট খেয়ে পড়ছে। ভ্রূক্ষেপ নেই। আমি নিচু হয়ে তেড়ে যাই। কি মজা! বাবার মুখে অনেক্ষণ পরে হাসি। ইশারায় আরো ঘাঁটতে বলছে। দুটোকে ধরেছি। কি গরম ওদের গা’। হাতের মুঠো থেকে বেরনোর জন্য মাথা ঘোরাচ্ছে। পা দিয়ে আঙুলে ঘষছে। সবাইকে গুনে খাঁচায় ঢোকাতে সন্ধ্যে অন্ধকার হয়ে গেল। ওপরে বাবা-মায়ের বৃথা চিৎকার। ভয়ে নামতে পারছে না। সারারাত নাকি এই করে। দেবাশিসকাকু ঠিক করেছে কাল বিলের জলে ছেড়ে দিয়ে আসবে। তারপর যা হয় হবে। এখানে কিছুই খাচ্ছে না। সেই সাথে ওপর থেকে ঝরে পড়ছে হাহাকার।
বাড়ি এসে পড়ায় মনই বসল না। কাল সকালে বাচ্চাগুলোকে দেবাশিসকাকু বিলের জলে দিয়ে আসবে। আর কুঁজোঠাম্মা? কাল সকালের নতুন সূর্যের আলো কি দেখতে পাবে? রাত্রে ঘুমের মধ্যে এক স্বপ্ন দেখলাম। ভোরবেলার আলোয় কুঁজোঠাম্মা বিলের ঘাসের মধ্যে শুয়ে আছে। বিলের মাঝে রাত্রের কুয়াশা তখনও কাটেনি। গায়ের ওপর শিশিরের অজস্র বিন্দু। মুখের ওপর একগাছা পাকাচুলের গোছ। তার ওপর জলফড়িং বসেছে। বন্ধ চোখের পাতার ওপর উঠে এসেছে একটা সোনা ব্যাঙ। গায়ের সবুজ ছেঁড়া শাড়ি কচুরিপানার সাথে মিশে গেছে। বিলের মাঝে চিরঘুমে শুয়ে কুঁজোঠাম্মা। টুপটাপ শিশির পড়ছে। গলার খাঁজে একটু জল জমেছে। একটা পা কাদার মধ্যে আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে। কঙ্কালসার হাত দুটো নিজেই কলমিলতা হয়ে গেছে। ওই হাতেই ঠাম্মা কলমিশাক তুলত বিলে। একটু একটু জলের ঢেউ পেটের ওপর উঠে আসছে। বিলের মধ্যে বিল হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে কুঁজোঠাম্মা। বুক, পেট আর তেমন দেখা যাচ্ছে না। সেখানে লতাপাতা, কদামাটি আর শামুকের দল। সরালের বাচ্চাগুলো দিব্য খেয়ে বেড়াচ্ছে সেসব। আর নিমেষে বড় হয়ে উড়ে যাচ্ছে আকাশে। তাদের ডানায় ভোরের শিশির। নতুন সূর্যের আলো। আমি বিলের ধারে বসে দেখছি এসব। আর পাশে বাবা লিখে চলেছে….
“সরালের ডানায় যে শিশির বিন্দু তার স্বাদ মৃত্যুজল। তাদের বাবা-মায়ের যে বিগত হাহাকার তার শব্দে কলমিলতা জেগে ওঠে। তাদের অভিভাবক এই যে বাঁওড়, তার হাড়ে মজ্জায় শতায়ুর চিরঘুমের রঙ”।
খুব খুব ভালো লেখা। অনেক শুভেচ্ছা জানাই।
ভালোবাসা জানবেন রাজদীপদা।