
নীলাঞ্জন হাজরার কবিতা
১।
আমার স্বর
বারংবার
ভেসে গিয়েছে তোমার
স্নেহঝর্নায়
নিরন্তর
তার প্রপাত-বিচ্ছুরণ থেকে অবলীলায়
আমরা সকলেই
রামধনু-দেখা আর শীতল জলের কুচি
হৃদয়ে ও মুখে
চুরি করে নিয়ে গেছি
হৃদয়ে হৃদয়ে মুখে মুখে
ব্যক্তিগত পর্যটনের তাকে
তাকে তাকে তাকে তাকে
সাজিয়ে রেখেছি
আমরা সকলেই মুগ্ধ দেখেছি
ঝর্নার প্রতিষ্ঠান
ঝর্না কেটেছে পাষাণ
যে সময়ে আমরা দেখেছি অবাক
চঞ্চল কুচোমাছের ঝাঁক
কখনও রঙিন
যে সময়ে আমরা শুনেছি রাত্রিদিন
আহ্বান
কখন যে কোন ঝাঁপে
হয়ে গেছে নদী
বয়ে গেছে বাঁক থেকে বাঁকে বাঁকে, যেখানে দরদী
কবির দিগন্ত তিরতির কাঁপে
গান বন্ধ মধ্যদিনের তাপে
বহমানতার টলটলে মৃদুস্বর
আঃ! কী শীতল—
ঈশ্বর!
ক্ষত ছুঁয়ে ছুঁয়ে কলোকল কলোকল
বয়েছে জ়মজ়ম
সমস্ত ক্ষতের মুখে
সমস্ত ক্ষতের মুখে
সমস্ত ক্ষতের মুখে
পলি মৃদুস্বর—
আহৃদয় ঝুঁকে পড়া মেঘাবৃতম্বরম্
আমরা সকলেই মুগ্ধ দেখেছি
নদীর প্রতিষ্ঠান
পাষাণ
কাটে নদী, গড়ে চলে
নৌকো, খেত ও নগর
চলার মধ্যে চলা
নিরন্তর
বয়ে নিয়ে চলে যায় লাশ
গ্লানি, ভাঙা ঘট, ছেঁড়া মালা
নদী আসে দমকে দমকে
আসতেই থাকে
ফুসফুস থেকে
পরিশুদ্ধ রক্তের মতো
নিশিদিন
স্বর আমার,
ক্রোধ-ছারখার,
ভেসে গিয়েছে বারংবার
এই আমার ফরিয়াদ
বিরামবিহীন
ধমনীশোনিতে
চলার মধ্যে চলা
চলার মধ্যে চলা অবিরত
পাষাণভারবাহী
অশ্রুর মতো
পাঁজরের দাঁড় বেয়ে
বন্দে বন্দে ক্ষয়ে ক্ষয়ে
এসে নিয়ে চলে গেছ
ক্ষত ও আগুন
এই আমার ফরিয়াদ
দিয়ে গেছ
বলার মধ্যে বলা— স্মিত গুনগুন
ফাগুনের ছন্দে বাঁধা নির্ভুল আগুন
সাজদা
বাগান
প্রশান্তির অটল প্রতিষ্ঠান
——
(ব্যক্তিগত ২১ এপ্রিল)
২।
এই গাছটা আমি লাগিয়ে ছিলাম
যা হতেই পারত পূর্বজন্ম
তেমন কোনও দিনে
কিন্তু আমি কোনও দিনই
চাকু দিয়ে
তার ছাল চিরে
নিজের নাম
নিজের নাম+তোমার নাম
হার্ট সাইন-বিদীর্ণ-করে-চলে-যাওয়া তির
আঁকার
কিংবা
হাতের তালু চিরে
করতলরেখা
বদলে ফেলার চেষ্টা করিনি
গাছ আর করতলরেখার
আর্তনাদ
কে কবে শুনেছে
গাছ তো রবীন্দ্রনাথের মতো
নীরবতার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে
আজীবন মুখর থাকেনি
আমরা তাকে সহজেই তাই
কেটে ফেলতে পেরেছি
গায়েব করে দিতে পেরেছি
তার-গুঁড়িভরে-মোছা
হাতের সব রক্তছাপ
রবীন্দ্রনাথের
নিরবধি বাক্যরাশির নীচে
চাপা-দেওয়া, রক্তাক্ত
নীরবতাগুলোও
‘নেই, কোনওখানে নেই আর রক্তের দাগ’
গাছ
করতল
রক্তের দাগ
নীরবতা
কিছুই আর নেই
এই থাকার উল্লসিত ভিড়ে
কী আশ্চর্য!
এই থাকার উল্লসিত ভিড়েও
শনাক্ত করে ফেলতে পেরেছি
সেই গাছ
৩।
যার নীচে
কান্নায় ভেঙে পড়তে পারতো যারা ভালোবাসে
সেই গাছটা কেটে ফেলার পর
তোমার সহসা খেয়াল হল
হাত মুছে ফেলার মতো
আর একটাও গুঁড়ি বাকি নেই
তোমার সৃষ্টিতে
অনন্ত কাহিনিতে ঠাসা এই নক্ষত্ররাজি
শুরু নেই শেষ নেই
অচিন্ত্য ইন্দ্রীয়াতীত বন্ধনে বাঁধা
হা-হা ঘূর্ণির সংখ্যাতীত কত সৌরলোক
ছোরা
চুমু
অকুল অন্ধকারে
সৃষ্টিবুদ্বুদের নিরন্তর বিস্ফোরণ
আদিগন্ত আকণ্ঠ নীরবতা
স্লোগান
পাখির ডাক
চেহারা বদলে বদলে সব
দিব্যি তো থেকে গেছে
শুধু
হাত দুটো মুছে ফেলবার মতো
আর একটাও গুঁড়ি বাকি নেই
তোমার সৃষ্টিতে
৪।
কত কাল হলো
সেই সব পায়ের ছাপ
আমার স্মৃতির অঝোরধারে ভিজেই চলেছে
পশ্চিমরাঢ়ী ধুলোগন্ধী পথে ঝরে যাওয়া
টকটকে পায়ের ছাপ
করাচির দারুণ বিপজ্জনক শেষ রাতে
ক্লিফটন বিচের নির্জন ঢেউয়ের শব্দমাখা
পায়ের ছাপ
শ্রাবণঘন মধ্যদিনে
কল্যাণী কল্যাণী কল্যাণী
কন্ডাকটরের তারস্বরে চকিতে নেমে পড়া
এদিক-ওদিক-তাকান পায়ের ছাপ
ইরানী বাগানে
সাজদা ও হিজাবের আড়াল থেকে
চুরি-করা চুমুর ফোঁটার তড়িৎস্পর্ষী
পায়ের ছাপ
অঝোরধারে ভিজেই চলেছে
এই আটপৌরে পায়ের ছাপেরা
জানবেনা তোমরা ঘুণাক্ষরে কোনওদিন
কোনখানে যায়, ফেরে
যাওয়া আসা করে
ফিসফিস করে
মেঘেদের ফিনকি দিয়ে ছড়িয়ে পড়া
রঙের আনাগোনার গভীর আড়ালে
জানবে না ঘুণাক্ষরেও
সহসা বারুদগন্ধী দমকা বাতাসে
ভয়াবহ বিস্ফোরণের আগে
আমার স্মৃতিতে
৫।
তুমি
সেই আঘাত দিয়ে গড়া
যা ভালোবাসা নামে পরিচিত নয়
তুমি
সেই ভালোবাসা দিয়ে গড়া
যার কোনও জন্মচিহ্ন নেই
তুমি
সেই সব চিহ্ন দিয়ে তিলে তিলে গড়া
যাতে দুনিয়ার প্রত্যেক ভাষায় ঝলসে ওঠে
রুখে দাঁড়ান চোখ


খুব ভালো লেখা