ধারাবাহিক গদ্য <br /> মহিলা কামরা ( ৮ থেকে ১০ পর্ব) <br /> রূপশ্রী ঘোষ

ধারাবাহিক গদ্য
মহিলা কামরা ( ৮ থেকে ১০ পর্ব)
রূপশ্রী ঘোষ

পূর্ব প্রকাশিত পর্বগুলি পাবেন— পূর্ব প্রকাশিত পর্বগুলি পেতে এখানে ক্লিক করুন

মহিলা কামরা ৮

ডায়মন

সকাল আটটা দশ। এ এক অন্য মহিলা কামরা। উঠেই দেখি কামরার একটা দিক পুরো ফাঁকা। ভাবলাম এই দিকের কামরা বুঝি এমনই হয়, তায় আবার এত সকাল। গুছিয়ে জানলার ধারে বসলাম।

একটা স্টেশন এল। হুড়মুড় করে সবাই উঠেই ফাঁকা দিকে ধেয়ে এল। অন্যদিক থেকে অন্যরা চিৎকার করে সাবধান করতে লাগল, “ওদিকে নোংরা, যেও না যেও না।”

আমার টনক নড়ল। চারদিক চনমন করে তাকিয়ে নোংরা খুঁজতে লাগলাম। ট্রেনের মেঝেতে খাবারের প্যাকেট, ঘুগনির বাটি, লেবুর খোসা এসব ছাড়া আশেপাশে কিচ্ছু দেখতে পেলাম না। এ আর কি এমন নোংরা, আমাদের এখানে ট্রেন তো এমনই হয়।

স্বচ্ছ ভারত করতে হবে, স্বচ্ছ ট্রেন তো নয়!
শোনা যাচ্ছে ‘বন্দে ভারত’ নাকি বিদেশের মতো স্বচ্ছ ট্রেন হয়েছে।

তবুও মনে হল, আমি বুঝি নোংরাটা দেখতে পাচ্ছি না। উঠে অন্যদিকে চলেই যাই। গিয়ে দেখলাম ততক্ষণে আর কোনো সিট ফাঁকা নেই। অনেকদূর যাওয়া, তাই ফিরে এসে আগের জায়গাতেই বসলাম।

প্রতিটা স্টেশন আসে, লোকজন ফাঁকা দিকে ধেয়ে আসে, সবাই সাবধান করতে থাকায় আবার ফিরে গিয়ে ওই দিকেই ভিড় করে। আমি একা অমন সাহস করে বসে থাকায় লোকে আমাকে হয়তো পাগলই ভাবছিল। কিচ্ছুক্ষণ পর কেউ আর অন্যদের পাত্তা না দিয়ে আমাকে দেখে ভরসা পেয়ে বসতে এল।

আমার সিট, আমার উল্টোদিকের সিট, ডানদিকের সিট, তার উল্টোদিকের সিট, সব মুহূর্তে ভর্তি হয়ে গেল। পিছনের লম্বা সিট আর তার উল্টোদিকের চারজন করে বসার সিট দুটো যথারীতি ফাঁকা রয়ে গেল। নোংরা নিশ্চয়ই ওখানেই আছে। এদিকের মহিলারা তখন ওইদিকটা রক্ষা করতে লাগল সবাইকে সাবধান করে।

অনেকদূর যাওয়ার পর জানা গেল কেউ একজন পটি করে রেখেছে। তাই নিয়ে রীতিমতো গবেষণা শুরু হয়ে গেল। কেউ বলল, শুকিয়ে ঘুঁটে হয়ে গেছে, কেউ বলল তোদের পেটে নেই? কেউ বলল গন্ধ আসছে, কেউবা বলল এমন করার কি আছে? একি আর তোর আমার মতো ভাল লোকে করেছে? কোনো পাগলেই হয়তো…। একজন গালাগালি দিতে শুরু করে দিল, যারা রাতের ট্রেনে গেছে তাদেরই এইসব কাজ, সকালে তো আর জায়গা পাবে না তাই। ইতিমধ্যে তৃতীয় লিঙ্গের একজন উঠেই কর্কশ গলায় বলতে লাগল, “তোরা পটি করিস না? তোদের পিছনে থাকে না? নিজের মন শুদ্ধ হলেই সব শুদ্ধ। এত বিচার করার কি আছে?”

তারপর আমার পাশে বসা মহিলা তাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার হাতে মোটা মোটা ওগুলো কি গো? শাঁখা?”
সে মুচকি হাসতে হাসতে বলল, “কেন? তোর কি মনে হচ্ছে? প্লাসটিক?”
“না, মানে এত মোটা মোটা শাঁখা দেখা যায় না তো, বেশ সুন্দর লাগছে।”
“সুন্দর তো লাগবেই, এগুলো আমার স্বামী দিয়েছে। তোদের তো সব স্বামী দেয় না আসামী দেয়। তোদেরগুলো সব আসামী আমারটা স্বামী।” বলেই হো হো করে কামরা ফাটিয়ে হাসল।

এদিকে পেয়ারাওলাকে একজন বলতে লাগল, “পুরোনো এক টাকার কয়েনটা বদলে দাও। এই বড়ো কয়েন কেউ নিতে চায় না।”
পেয়ারাওলা বলল, “আমাকে তো তোমাদের মতোই কেউ দিয়েছে, আমি তো নিয়েছি।”
“তাও তুমি পালটে দাও, আমাদের ওদিকে কেউ নিতে চায় না।”
“কি মুশকিল আমি কোনদিকে যাই, এই নাও ছোটো এক টাকা।”

অন্য অনেক মহিলাও বলতে থাকল “হ্যাঁ গো এখন খুব মুশকিল হয়েছে, এই বড়ো এক টাকার কয়েনগুলো কেউ নিতে চাইছে না।”

আমার উল্টোদিকে বসা একজন শুরু করল, “এখানে নেয় না বলছ? বড়ো বাজারের মতো জায়গাতেও নেয় না। ওই শহরে। মাল আনতে যাই তো, খুচরো দিলেই তারা ঝামেলা করে, বলে আমরা ভ্যাট দিয়ে ব্যবসা করি। তোমাদের তো আর ভ্যাট দিতে হয় না। নোট দিতে না পারলে মাল হবে না। পুলিশ দাঁড় করিয়ে রেখে বড়ো বড়ো ব্যবসাদাররা এইসব বলে, পুলিশ যদি তাদের শাস্তি না দেয় আমরা কি করব বল? আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কিছু করার আছে? মুখের উপর তারা খুচরো ফিরিয়ে দেয়, পুলিশ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে তা দেখে।”

একজন নাতনি নিয়ে উঠলেন। তৃতীয় লিঙ্গ ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে আদর করতে থাকলেন। নাতনির ঠাকুমা গদগদ হয়ে বললেন, “ও তোমাকে খুব চেনে, বলে, ঠাকুমা মামার বাড়ির কাছের সেই দিদা যে রোজ সকালে গান করে, সে আজ ট্রেনে উঠেছিল। ওই দিদা খুব ভালো।”

দিদা আদরের মাত্রা বাড়িয়ে একটু পরে নেমে গেলেন।

ঠাকুমার বাড়িতে এই নাতনি কত আদরের তাই সবাই শুনতে লাগল। একদম তোলা কাপড়। নাতনির গায়ে অনেক বড়ো বড়ো ফোস্কা ফোস্কা ঘা হয়েছে। সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইল কি হয়েছে। জানা গেল নারাঙ্গা বলে একটা ঘা হয়েছে। শুনে সবাই বলল নারাঙ্গা ফল বাঁধোনি? নারাঙ্গা গাছের ডাল? ঠাকুমা বললেন, “বেঁধে ছিলাম, আজকালকার ডাক্তার বলেছে, ওসব খুলে ফেলে দেবে, এই মলম আর একটা পাউডার দিচ্ছি লাগাবে। তাই ফেলে দিয়েছি। হাতে শুধু নারাঙ্গা ডালের বালা দুটো রেখেছি।”

পটির গবেষণা তখনও শেষ হয়নি। এক মহিলা বাচ্চা নিয়ে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে, পটির সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে ফাঁকা লম্বা সিটের উল্টোদিকে এক কোণায় গিয়ে বসল।

ওই নারাঙ্গা ফলটার কথা শুনে আমি ছোটোবেলায় ফিরে গেলাম। ওটার সঙ্গে আমি খুবই পরিচিত। ফলটা জলে ভাসে। আমরা ছোটোবেলায় একঝাঁক মিলে যখন পুকুরে চান করতাম, সবাই গোল করে জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে ফলটা নিয়ে খেলতাম। খেলাটা এমন – দুটো দল। একদল দুহাত দিয়ে জল তোলপাড় করে ফলটা ক্রমাগত লুকোনোর চেষ্টা করত, তার মধ্যে থেকেই অন্যদলকে খুঁজে বের করতে হত। সবাই তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ থৈ করে চিৎকার করতে করতে লাফালাফি করে ফল লুকোত, অন্য দলও একই চিৎকার করে খোঁজার চেষ্টা করত।

আমার মন সেই তাতা থৈ থৈ তাতা থৈ থৈ চিৎকারে ডুবে গেল। হঠাৎ সবাই ব্যস্ত হয়ে এদিকে চিৎকার করতে থাকল, “ডায়মন ঢুকছে, ডায়মন ঢুকছে”।

আমিও সম্বিত ফিরে পেয়ে “ডায়মনে” নেমে গেলাম।

লক্ষ্মী

যাদবপুর স্টেশন। যাব বারুইপুর। সামনের মহিলা কামরা। অনেক ভিড় দেখে এক অল্প বয়সী সুন্দরী মহিলা জিজ্ঞেস করলেন – “আচ্ছা, এই কামরায় উঠতে পারব? যা ভিড় দেখছি …”। বললাম, “জানি না। আমিও আজ প্রথম।” একটু এগিয়ে এক মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম – “কোন ট্রেন আসছে?” তিনি উত্তর দিলেন – “লক্ষ্মী।” এ নামটার সঙ্গে আমি পরিচিত। আমার বর যখন ট্রেনে যাতায়াত করে, তখন ফিরে এসে কোনোদিন বলে – আজ লক্ষ্মীতে এলাম, কোনোদিন বা ডায়মণ্ড। প্রথম প্রথম নামগুলো নিয়ে আমরা হাসাহাসি করতাম, এখন সয়ে গেছে।

লক্ষ্মী এল। সবাই ওঠার পর আমিও লক্ষ্মী মেয়ের মতো আস্তে আস্তে উঠলাম। কষ্ট হল না। উঠেই জিজ্ঞেস করলাম, “বারুইপুর কোনদিকে পড়বে?” তাহলে সেদিকেই দাঁড়াব। এক মহিলা বললেন “দেরি আছে, ভিতর দিকে চলে যান।” গেট থেকে একটু এগিয়ে ডান দিকের সিট অব্দি গেলাম। সিটের একদম শুরুতে বসা এক মহিলা আর তাকে ধরে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন আর এক মহিলা। দুজনে পরিচিত। দুজনের খুব গল্প। আমি দাঁড়াতেই সিটে বসা মহিলা বললেন, “পিছনে নিজের ঠেল রাখো।” বললাম — “কী?” তিনি আবার একই কথা বলে বুঝিয়ে দিলেন – “চেপে শক্ত হয়ে দাঁড়াও খুব ঠেলাঠেলি হবে, যেন পড়ে যেও না।” আমি বললাম, “এইরে আমার পিঠে তো একটা সিস্ট হয়েছে, পুরো টনটনে ফোঁড়া। সেটা তো তাহলে আজ ফেটে যাবে!” তিনি শুনে বললেন, “এমনই হয়, তাই বললাম শক্ত হয়ে দাঁড়াও।” আমার হাতে বইয়ের প্যাকেট ছিল, তাঁকেই বললাম — “ধরবেন?” বললেন, “হ্যাঁ, রাখো আমার কোলে।” আমি বইয়ের প্যাকেট, কাঁধের ব্যাগ সব তাঁর কোলে নামিয়ে দিলাম।

একটু ঠিক করে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকালাম। দেখি সিটের পাশে পাশে করিডোরগুলোতে নানান বয়েসের কালো কালো মাথা। নিচে সবাই থরে থরে বসে। কেউ ঘুমোচ্ছে, কেউ ঝিমোচ্ছে, কারো হাত অন্যের মাথায় বিলি কাটছে, কেউ কানে হেডফোন দিয়ে গান শুনছে, কেউ উকুন বাচছে, কেউবা রুটি খাচ্ছে।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “সবাই এমন নিচে বসে কেন?” সেই মহিলা বললেন, “কি করবে, সব ভোরেরবেলা কাজে বেরিয়ে ছিল, সবার বাড়ি কাজ করে এখন ফিরছে। ওরা আর দাঁড়াবার ক্ষমতা রাখে না। তাই এমন করেই সব নিচে বসে পড়ে। আবার তো কাল ভোরে বেরোতে হবে।” বললাম, “হুম।”
তারপর ওই মহিলাকে জিজ্ঞেস করলাম — “আপনি কোথায় নামবেন?” তিনি ‘বারুইপুর’ বলেই তাঁর সামনের মহিলাকে দেখিয়ে বললেন “আমি নামলে, ও বসবে। তুমি বসতে পাবে না।” বললাম, “না না বসার জন্যে জানতে চাইনি। বরং ভালোই হয়েছে আমি আপনার সঙ্গে নেমে যাব। আমি এদিকের কিছু চিনি না।”
তিনি এবার হেসে জানতে চাইলেন আমি কোথায় যাচ্ছি, কেন যাচ্ছি, বাড়ি কোথায়, আবার ফিরব কিনা? বললাম, “হ্যাঁ ফিরব বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি। এই বইগুলো দিয়েই ফিরে পড়ব।” বই শুনে তিনি তাঁর মেয়ের গল্প শুরু করলেন। তাঁর মেয়েও বই পড়তে খুব ভালোবাসে। “এই সেদিন কলেজস্ট্রিট গিয়ে তিন হাজার সাতশো টাকার বই কিনে এনেছি। তিন হাজার সাতশো। বুঝলি?” তারপর আমার দিকে তাকিয়ে – “মেয়ে, আমার মেয়ে কলেজে পড়ে। ফাস্ট ইয়ার। অনার্স।” জানতে চাইলাম কোন কলেজ। উত্তর দিলেন বারাসত কলেজ।

এরমধ্যে এক ফুলওলা উঠল রজনীগন্ধা ফুলের মালা নিয়ে। বসে থাকা মহিলা তার গায়ে হাত দিয়ে বললেন – “ও মনা, দুটো ফুল দে আর পঁচাত্তর টাকা খুচরো দে।” মহিলা আরও কয়েকদিনের হিসেব দেখিয়ে ওই টাকা বলেছেন। দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা অবাক হয়ে বললেন — “একি! অমন করে কথা বলছ কেন?” তিনি বললেন “কেন? বলেছি তো কি হয়েছে? ও তো বাচ্চা ছেলে। তুই থাম দিকিনি।” বলেই আরম্ভ হল কার বাড়িতে কত বড় ঠাকুর আছে তাই নিয়ে আলোচনা। বসে থাকা মহিলা দু হাত দিয়ে দেখিয়ে বললেন – “আমার বাড়িতে একটা এত্ত বড়ো তারামা আছে।” যিনি দাঁড়িয়ে – “আমার বাড়িতে একটা এত্ত বড়ো কালী।” উনিও আবার ভ্রু নাচিয়ে – “আমার বাড়িতে একটা শিবও আছে।” ওই মহিলা বললেন, “তুমি যে ফুলটা কিনলে আমি নিয়ে চলে যাব।” উনি — “তা যাবি তা যাবি, আমি কি করব? নিয়ে গিয়ে কারো না কারো পায়ে তো দিবি? নিজে তো আর গলায় পরবি না? তাহলেই হবে।” বলেই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন – “কি বল তাই না?”

কোলে রাখা বইগুলো একটু গড়িয়ে যাচ্ছিল। তিনি সেগুলো একটু টেনে তুলে নিয়ে শুরু করলেন, “আমার মেয়ের খুব বই পড়ার শখ। যেখানেই যাক, বই দেখতে পেলেই হল। হাত খোঁচায় আর বলে – ওমা ওমা দাও না, কিনে দাও না। আমি বিরক্ত হয়ে বলি – কি? বই কিনে দাও না মা। হাত দিয়ে কিভাবে খোঁচায় সেটা অন্য মহিলার গায়ে করে দেখাতে দেখাতে – আমি বলি তোর কি একটা নেশা নাকি বলত? যেখানেই যাবি শুধু বই।” আবার আমার দিকে তাকিয়ে — “আমার মেয়ে। খুব বইয়ের নেশা। একদম সরস্বতী।”

অন্য মহিলা — “কি বই কেনে?”
— “তা আমি জানি না। ওই ইংরেজি ফিংরেজি কিছু একটা হবে, গল্পের বইও কেনে অনেক। একবার তো মেলায় গিয়ে রান্নার বইও কিনল। আমি খুব বকেছি- এটা কি তোর একটা নেশা নাকি?”
অন্য মহিলা — “তা ভালো তো। বইয়ের নেশা।”
তারপর তিনি খুব হেসে — “আর আমার ছেলে কি করেছে আলমারি থেকে তার বই নামিয়ে এতওও গুলি ভরে রেখেছে! মেয়ে তো দেখতে পেয়েই চিৎকার করে – ওমাআআ… দেখে যাও ভাই কি কি করেছে, বলেই সে কি নাকে কান্না, আঁউমাঁউ করে নাচছে। ওর বাবা বলেছে এবার এক কাজ কর – তোর ছেলে তো ছাগল, ওর দ্বারা কিছু হবে না। ওকে গুলি রাখার জন্যে একটা আলমারি কিনে দে।”

এই শুনতে শুনতেই অনুভব করলাম আমার পায়ে কে যেন একটা পাথর চাপিয়ে দিল। ঘুরে দেখি এক বয়স্ক মহিলা। বললাম — “আমার পায়ে কি চাপালেন একটু তুলুন।” তিনি সরিয়ে রেখে জিজ্ঞেস করলেন ঠিক আছে কিনা। বললাম ‘হ্যাঁ।’ বসে থাকা মহিলা বয়স্ক মহিলাকে খুব উপদেশ দিয়ে আরও ভিতরে চলে যেতে বললেন। তিনি নামবেন জয়নগরে।

ওই মহিলা আবার এক গল্প শুরু করলেন — “এত ভিড়ে একবার আমি নামতে পারছিলাম না। কি করেছি, ওই ধরার হাতলগুলো ধরে ঝুলে ঝুলে একটা থেকে আর একটা ধরেছি। মেঝেতে পা রাখিনি। পুরো পাঁচটা ধরেছি আর লাফ কেটে বেরিয়ে গেছি।”

— “ট্রেনের লোকেরা তোমাকে কিছু বলেনি?”
— “বলেনি!? বলছে বলছে! আমার তো তখন নামতে হবে। সবাই আমাকে গাল দিতে শুরু করেছিল…” বলে গালাগালগুলো তিনি বললেন. শরৎচন্দ্রের সাবলীল ভাষায় মেয়েরা যা তাই, তবে তার আগে তিন অক্ষর জুড়ে যা দাঁড়ায় তা তিনি অবলীলায় বলে গেলেন। “তারা গালাগাল দিচ্ছে আমার তো তখন হাসি পাচ্চে। আমি ভাবছি তোদের মুখ আছে তোরা দে, তোদের গালের ভয়ে কি আমি নামব না? ধ্যার! একদম লাফ কেটে বেরিয়ে গেছি। আমার ছোটোমাসি এখনও সে গল্প বলে। উফ! সেবার তুই যা করেছিলি! বলেই হাসি।”

আমিও সেই ঘটনাটা কল্পনা করার কিছুটা চেষ্টা করলাম। সুবিধে করে উঠতে পারলাম না।

ততক্ষণে মল্লিকপুর এসে গেছে। আমি তাঁর কোল থেকে বইয়ের প্যাকেটটা নিয়ে গেটের সামনে এসে অনেকের পিছনে এ টি এমের লাইনের মতো দাঁড়িয়ে গেলাম। তিনি বারুইপুরের কাছকাছি উঠে এসে আবার এক মহিলাকে খুব ধমক দিলেন। কেন গেটের সামনে? নামবে তো অনেক দূরে। ধমক খেয়ে সে ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করতেই সবাই কেমন নড়ে গেল। নড়ে যেতেই অন্য এক মহিলার নখ ওনার কপালে ভ্রুর ঠিক ওপরে লাগল। লেগে একটু আঁচড়ে ফুলেও গেল। তখন মহিলা নিজের কপালে হাত দিয়ে বললেন — “কেটে গেল নাকি গো? উফ তোমার নখটা যা লাগল।” যাঁর নখে লেগেছে তিনি ওনার কাটা জায়গায় হাত বোলাতে বোলাতে — “না না দিদি কাটেনি, কাটেনি। ওই যে তুমি ভুরু প্লাক করেছ না? ওটায় তোমার গোটা বেরিয়ে গেছে। সবার স্যুট করে না তো ওটা। তোমার তা থেকেই গোটা বেরিয়েছে।” আর যাঁর কেটে গেল তিনি বলতে থাকলেন — “এতক্ষণ ছিল না, মনে হয় তোমার নখ….”। যাঁর নখে এটা হল, তিনি ওনাকে থামিয়ে দিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে শুরু করলেন — “আচ্ছা দিদি ও এখানে দাঁড়িয়ে ছিল তোমার কি এসে যাচ্ছিল? ও ভিড়ে চাপাচাপি হয়ে মরতো মরতো, তোমার কি? এদিকে তো আমরা হুড়োহুড়ি করে পড়ে যাচ্ছিলাম….”

স্টেশন এসে গেল। নামলাম। এদিকের ট্রেনে সবাই নামার অপেক্ষায় কেউ থাকে না। যাদের ওঠার দরকার তারা ঠেলে উঠতেই থাকে দেখলাম। সঙ্গে নানান বাণী – “কারো যেন নামার ইচ্ছে নেই, দেখো কেমন নামার চাল দেখো, ট্রেন যেন ওদের জন্যে দাঁড়িয়েই থাকবে। যেন সব বাপের ট্রেন পেয়েছে …।”

লক্ষ্মী থেকে নেমে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করার চেষ্টা করছি। তখন ওই মহিলা আবার এসে দেখালেন — “এই দেখো আমার মেয়ে।” আমি মুখ তুলে তাকিয়ে প্রথমে অবাক হয়ে তারপর একটা হাসি দিলাম। আর মেয়েটি আরও অবাক হয়ে আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাতে তাকাতে চলে গেল।

১০

মহিলা কামরা তো মহিলা কামরাই। বজবজ হোক বা ডায়মন্ড হারবার, লক্ষ্মীকান্তপুর বা কল্যাণী। আমাদের দেশের সব রাজ্যেরই বোধহয় একই গল্প হবে। আমার রাজ্যের সীমিত অভিজ্ঞতা দিয়ে ‘দিন আনি দিন খাইয়ে’র মতো কিছু কথা সাজালাম। আমার কর্মস্থল বদলায়নি, কিন্তু পথ এখন বদলে গেছে। করোনা মহামারীতে আমি অন্য পথ বেছে নিয়েছি। যেখানে প্রতিদিনের সঙ্গী কলকাতার রাস্তার মিটিং মিছিল এবং ট্রাফিক জ্যামের আপডেট ও সঙ্গে কিছু গান। তবে ওই ট্রেনের নিত্যযাত্রী কলিগদের কাছে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, আমার মতো করোনায় এখন অনেকেরই পথ বদলে গেছে। সবাই আর ওই ট্রেনে জিনিস বিক্রি করে না। তবুও তাদের মধ্যে তপনদা, রাজকুমারদা রয়ে গেছে। ভানুদা লক ডাউনে সাইকেল সারানোর দোকান করেছে। ভানুদা, তপতীদির মতো অনেকেই হয়তো অন্য পেশায় বা অন্য জায়গায় কাজ করে চলেছে। বয়স্ক যাদের কথা লিখেছিলাম তাদের খবর জানি না। করোনায় তো কম বয়েসীদেরও অনেককে হারিয়েছি আমরা।

সমাপ্ত

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (1)
  • comment-avatar
    যশোধরা রায়চৌধুরী 2 years

    কি তরতাজা প্রাণবন্ত গদ্য। মন ভাল করা পাঠ

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes