
ধারাবাহিক উপন্যাস
মনে রবে কিনা রবে
মোনালিসা ঘোষ
প্রথম পর্ব- প্রথম পর্ব
দুই
চিকুটা একটা জানোয়ার। চিকু মহা ধুরন্ধর এবং বদমাশ হলেও চিকুর সঙ্গে ওর একটা বোঝাপড়া আছে।কিন্ত এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়েও চিকুকে ধারেকাছে কোথাও দেখা গেল না।ঘাপটি মেরে আছে কোথাও। একটা গভীর রাত ঝুলে আছে পাহাড়ের আনাচে- কানাচে। পাথুরে ফাঁকফোকরগুলো তাই তেমন আর ঠাহর করা যাচ্ছে না। পাহাড়ের গা বেয়ে পিচের রাস্তা ধরে ও এগিয়ে যাচ্ছিল, ক্রমশঃ। রাত গভীর হলে শীতও চেপে ধরে পাহাড়ে। ইয়াক লোমের শালটা গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে এসেছে ভুলোমনা । রাতের খাবারের পর। রাতের খাবারে আজ রুটি, অড়রডাল, আর দুরকম সবজির সঙ্গে স্যালাডও ছিল। রুটিতে নিজের হাতে বানানো ঘি লাগিয়ে দিচ্ছিল গুরুং। এদের গরুগুলো এদের বাড়ীতে না থেকে পাহাড়ের কোলে অন্য একটা জায়গায় থাকে।
দিনেরবেলা সব পশু-পাখীদের মতোই সেগুলো খায়-দায় আর জাবর কাটে। সন্ধেবেলাটা ব্যাজার মুখে বসে থাকে খামারের মধ্যে। ল্যাজ দিয়ে মশা তাড়ায়। গরুগুলোর দুধ বড় একটা গামলায় জ্বাল দেবার পর মোটা সর জমিয়ে রাখে চাচী। তাই দিয়ে ঘি
বানায় গুরুং।বড় সরেস সেই ঘি ।
ভুলোমনা মানে ও। সব ভুলে গেছে বলে গুরুং ওকে ভুলোমনা বলে ডাকে। সদ্য আসার পর গুরুং জিজ্ঞেস করেছিল- নাম বল ?
-ওই তো লেখা আছে রেজিস্টারে। দেখে নিও।
-রেজিস্টার তো আমার হাতের কাছে নেই এখন। সে ছিল যখন তোমাকে এখানে রেখে যাওয়া হল। এখন নামটা তো বল।
-তখন দেখে নাওনি কেন? আমি বলতে পারব না।
-আমি তো ছিলাম না রিসেপশনে! নাম বলতে পারবে না কেন?
-জানলে তো বলব।
-যারপরনাই আশ্চর্য হয়েছিল গুরুং।
-নাম জানো না ?
– মনে নেই।
-নামও মনে নেই ? তাহলে আমার সঙ্গে এসো। রেজিস্টার দেখে নিই দুজনেই।
-না মহাশয় । দেখতে চাইলে তুমি যাও একা। ওখানে যে নামটা লেখা আছে, লোকে বলে ওটা আমার নাম। নামটা আমার এত অচেনা , নাম দেখে কি করব ? তার থেকে আপনা- আপনি যখন মনে পড়বে….. তখনই না হয়…
রেজিস্টারে পরে দেখেছিল কিনা জানেনা ভুলোমনা ।শুধু গুরুং বলেছিল, আপনা- আপনিই মনে পড়ুক তবে।এখন তোমাকে কি বলে ডাকি তাহলে ?
-তোমার যা খুশী।
-তুমি তো ভুলো মনা। ভুলো মনা। ভুলোমনা । ও গোলাপী ভুলোমনা আমরা একটু একটু করে তোমাকে সব মনে পড়িয়ে দেব।
ভুলোমনা থেকে যায় ওখানে। মানে, গুরুং ফ্যামিলিতে।গুরুংদের বিশাল পাহাড়ি বাড়ি। তাতে যে কোন পাহাড়ী বাড়ির মতোনই গুচ্ছের জানলা। আর তেল রং দিয়ে হলুদ সবুজ, মেরুন রং-করা। বাড়িটার দেওয়াল সাদা রঙের।তাতে ওরা প্রায় চল্লিশজন থাকে।
চিকুকে খুঁজে পেল না ভুলোমনা। বারদুয়েক শিস দিল। শিস শুনলে চিকুটা আন্দাজ করে নেবে ভুলোমনা, কোথায় আছে। অন্ধকার হাতড়েও বের করে ফেলবে ভুলোমনাকে। অবশ্য অন্ধকার এখন তেমন ঘুটঘুটে নয়।মাঠটাতে তো বাণ ডেকেছে জ্যোৎস্না। সেই জ্যোৎস্নায় নিজের ছায়া দেখল কিছুক্ষণ ভুলোমনা। এপাশ- ওপাশ থেকে নানাভাবে দেখলে ছায়াটা ক্রমাগত বেঁটে হচ্ছে, লম্বা হচ্ছে। কোনো ছায়াটাই প্রকৃত ভুলোমনার হচ্ছে না! হাতের পাতা ফেলে দেখল। আঙুলগুলো প্রয়োজনের থেকে বেশি লম্বা এল। ভুলোমনার স্মৃতিটাও কি এই ছায়ার মত? ইচ্ছেমত লম্বা অথবা বেঁটে হয়ে গেছে? যেগুলো ঘটে গেছে তার বেশ কিছু বেঁটে হতে হতে এত বেঁটে হয়ে গেছে যে, ছোট্ট এইটুকু হয়ে গেছে মাথায় মধ্যে।আবার খামচে খামচে কিছু মনেও পরে ভুলোমনার। আবার এখনকার দিনগুলো নতুন করে ঝকমক করে মনের মধ্যে।
কি করে ভুলে গেল, আর কি কি ভুলে গেছে, এই প্রশ্ন ভুলোমনা নিজেকে প্রায়ই করে। চেনাশোনা পুরনো লোকেদের কাছ থেকে মনে করে নিলেই হয়।কিন্ত সেই পুরনো মানুষগুলোকে বেজায় অচেনা লাগে ভুলোমনার। তারা সারি সারি অনেকগুলো মুখ ছাড়া আর কিছুই না, যারা ভুলোমনার দিকে তাকিয়ে আছে। এখানে সামন্ত ওকে রেখে যাবার আগে ডঃ অমিতাভ ব্যানার্জী বলেছিলেন, যাবতীয় এক্সটারনাল স্টিমুলাস যা থেকে ইরিটেটিভ সিগন্যাল পাচ্ছে, তা থেকে দূরে সরিয়ে ফেলতে হবে। একেবার চোখের আড়ালে।আর ইরিটেটিভ স্টিমুলাস তো সবকিছুই, মানে ভুলোমনার পুরনো জগতে যা ছিল তা সবই। অতএব…
গুরং- এর সাহায্য ছাড়া নাকি সম্ভব নয় ভুলোমনাকে ফিরিয়ে আনা ; অন্ততঃ এমনটাই লিখেছিল সামন্ত ই-মেলে গুরুংকে। গুরুং একজন অত্যন্ত বুদ্ধিমান, উচ্চ- শিক্ষিত, সৎ মানুষ, যা বোঝার চটপট বুঝে নিয়েছে।
ভুলোমনা শুনেছে, সামন্ত খুবই ভালো মানুষ, প্র্যাকটিক্যাল বুদ্ধিসম্পন্ন এবং সে নাকি ভুলোমনার শুভাকাঙ্ক্ষী। শুভাকাঙ্ক্ষীই হবে । সামন্তকে দেখলে বা সামন্তর কথা ভাবলে সেরকমই মনে হয়। বিশেষ করে সামন্ত যখন তিন/চার দিন বাদে বাদে একবার ভুলোমনার মোবাইলে ফোন করে।টাকা পয়সার খবর নেয় আর ভুলোমনার কিছু দরকার কিনা খোঁজখবর করে। অর্থাৎ সামন্তের কিছু একটা দায় আছে ভুলোমনার প্রতি।একটা দায়িত্ববোধ। কিসের দায় আর কিসের দায়িত্ববোধ তা নিয়ে ভুলোমনা মাথা ঘামায় না।ধু…উ…র।সে বেশ আছে।
ফোন করে ইন্দ্রনাথও। ইন্দ্রনাথ চরিত্রটি গোলমেলে। কেন যেন ভুলোমনার মনে হয় সে তেমন ভালো নয়। ভগবানই জানে! ভালো আর মন্দের ধারণাটাও ভুলোমনার মগজ থেকে মুছে সাফ হয়ে যাওয়ার কথা। কি ভালো আর কি মন্দ ! কিন্তু ভুলোমনা ভালোমন্দের টের পায়। গন্ধ শুঁকে। গন্ধ শুঁকে টের পায় অনেককিছু। কোনখানে বিপদ আছে, ভুলোমনা অনুভব করে নিতে পারে। এটা বোধহয় প্রাকৃতিক ব্যাপার। এবং ভুলোমনার পুরানো জীবন অন্তত এখানে থাবা বসাতে পারেনি বরং গুরুংদের সঙ্গে প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকতে এসে প্রকৃতি রোজই একটু একটু করে ভুলোমনার নাক, কান, মুখ, চোখ ত্বক সবকিছুর মধ্য দিয়ে ঢুকে পড়েছে।
এই ব্যাপারে ওকে অনেক সাহায্য করে চিকুও। ধুরন্ধর বদমাশ বলে নাম আছে চিকুর এ তল্লাটে। বাঁচার তাগিদে চিকুকে অনেককিছু করতে হয়। চুরি-চামারি এইসব।তবে সেসব ক্ষ্যামাঘেন্না করে নেওয়া যায়। চরম নিঃশব্দে হাঁটা-চলা করে চিকু, গন্ধ শুঁকে শুঁকে এগিয়ে যেতে পারে। বিপদ বুঝলে হিংস্র হায়না হয়ে উঠতে এক মুহূর্তও সময় নেয় না। তাই ভুলোমনা নিশ্চিন্তে থাকে, চিকুর সঙ্গে।
একদিন আদাড়-পাদাড় পেরিয়ে যেতে যেতে, অনেক দূর চলে গেছিল ভুলোমনা। সেদিন দেবেন্দ্র সঙ্গে ছিল না। ফিরতে সন্ধে নেমেছিল। আর ঘন সন্ধ্যের চোরকাঁটা আর জোঁকের কবল থেকে মুক্তি পেতে প্রাণপাত করতে হচ্ছিল ভুলোমনাকে ঘোর অন্ধকারে একটা লোক সরসরিয়ে নেমে আসছিল পাহাড়ের গা বেয়ে। ভাল কি মন্দ জানা নেই। কারণ তার মুখ দেখার উপায় ছিল না। ভুলোমনা প্রথমে সন্ত্রস্ত হল। কে রে বাবা? তারপর সে আর ভুলোমনা হাঁটতে শুরু করেছিল। ভুলোমনা চোরকাঁটা মাড়িয়ে দুদ্দাড় করে এগোতে চাইছিল, কারণ তার পিঠ বলছিল এইদিকে বিপদ আছে। ভুলোমনার কানদুটো যেন খাড়া হয়ে পেছন পানে উঁচিয়ে ছিল। আর ঘাড়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়বে পড়বে করছিল লোকটা। সেই সময় রাস্তার নুড়িপাথরগুলো পায়ের কাছে সড়সড় করছিল। একইসঙ্গে তারা জানান দিচ্ছিল, তারা বিপদে কাজে লাগলেও লাগতে পারে, যদি কাজে লাগাও। আবার বিপদ বাড়াতেও পারে, চলার পথের অসুবিধার কারণ হয়ে। ভুলোমনা পাথর কুড়োতে চাইল! কিন্তু ভয় হল নীচু হয়ে বসলে লোকটা মওকা পেয়ে যাবে। ভুলোমনা প্রাণপাত চলছিল; চলছিল না ছুটছিল। সেই সময় নিঃশব্দে অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে চিকু। মূর্তিমান যমের মত রুখে দাঁড়ায় লোকটার সামনে। লোকটা হঠাৎ অন্ধকারে সরতে থাকে। কিন্তু চিকু ছিল অন্ধকারের পোকা। অন্ধকারে চিকু ভূতেদেরও খুঁজে বার করতে পারে। লোকটার পেছু ধাওয়া করে চিকু। লোকটাকে গালাগাল দিতে শোনে ভুলোমনা। তারপরে সব চুপচাপ।
চিকু চলে আসে ভুলোমনার পাশে। ভুলোমনার বুকের ধড়ফড় কাটেনি তখনও। গলা শুকিয়ে কাঠ, সে চিকুকে বলে, জল খাব চিকু। চিকু হাঁটতে থাকে। পাশে ভুলোমনাও! ছোট্ট একটা গ্রামের বাড়ির উঠোন থেকে জল খায় ওরা। এরপর ফিরে আসে!।
ভুলোমনা সেদিন চিকুকে বলেছিল, ভিখিরির মত চেয়ো না লোকের কাছে। আর জবরদস্তি ডাকাতিও কোরো না। যারা দেবে, তাদের দেওয়া খাবার খেও। আমিও দেব যতদিন আছি। তবে জানো তো, আমার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। যেদিন আমার সবকিছু মনে পড়ে যাবে। আমাকে চলে যেতে হবে এখান থেকে। তখন তুমি কি করবে বলে দিচ্ছি, আমি! পাহাড়াদারি করে রোজগার করবে।
ভুলোমনার চলে যাবার কথায় হেলদোল দেখা যায়নি চিকুর ।
এখন জ্যোৎস্নারাতে ভুলোমনা চিকুকে পেল না। কিন্তু কেমন একটা বিশ্বাস হল ওর , যে এখুনি যদি কোনো বিপদ আসে তাহলে চিকু ঠিকই টের পাবে। এমন একটা গাঢ় বিশ্বাস কেমন ভেজা ভেজা ঘামের মতন দুধরঙা নির্যাস হয়ে ভুলোমনার গা থেকে বেরিয়ে এসে মিশে গেল জ্যোৎস্নার মধ্যে। একটা বুনো গন্ধ বেরোচ্ছিল তা থেকে। বিশ্বাসের গন্ধ তবে বুনো? এই বিশ্বাসটাই করে উঠতে পারেনি ভুলোমনা ইন্দ্রনাথকে।
সবকিছু দিতে রাজি ছিল ভুলোমনা। বিশ্বাসটা নয়। বিশ্বাসটা দিতে পারল না বলে সবকিছু দেওয়াটাও আর হল না। আসলে, এখানেই ভীষণ মতবিরোধ ছিল। ভুলোমনা কিভাবে কিভাবে যেন বড় হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে শিখেছিল, দেখেশুনে পা ফেলো। থিঙ্ক বিফোর ইউ লিপ। এই সবকিছু নিক্তির ওজনে মেপেজুপে এগোতে চাইছিল সে। এদিকে ইন্দ্রনাথটাতো হাড় ধান্দাবাজ। সে বারবার বলেছিল, বিলিভিং ইস সিয়িং। যা বিশ্বাস করবে, তাই দেখবে। যদি বিশ্বাস করো যে, আমি বিশ্বাসযোগ্য তাহলে তাই দেখতে পাবে। আজ ভুলোমনার মনে হল, এত বিশ্বাসের জোর কি ছিল ? ছিল না বলেই বোধহয়, তার পদ্ধতি ছিল সিয়িং ইস বিলিভিং। যা দেখব, দেখে বুঝব , তাই বিশ্বাস করব। এই বিলিভিং ইস সিয়িং না সিয়িং ইস বিলিভিং –এর জটিল ঝকমারিতে ভুলোমনা আর ইন্দ্রনাথ-এর এর মধ্যে বোঝাপড়াটা আড় হয়ে রইল।
ইন্দ্রনাথ ছিল গোড়ায় গোড়ায় ঘোর রহস্যজনক। এইরকম রহস্যজনক, মানুষজন যারা সবকথাই বলে আধাখ্যাঁচড়া ভাষায় , তাদের বিশ্বাস করা দূরূহ তো বটেই। আর বিশ্বাস করলে ঠকতে হয়। ভুলোমনা হাজারবার ঠকেছিল।
ইন্দ্রনাথ বলত, কাউকে বিশ্বাস করে ঠকাও ভাল। ভুলোমনার ঠকতে ছিল ভীষণ ভয়। ফলে একদিন চ্যাঁচামেচি করে, ভুলোমনা ইন্দ্রনাথকে জানিয়ে দিল যে, আপনি যা যা বলেন, সব আপনার নিজের সুবিধের জন্য। আপনার মত ফিশি লোককে কোন কারণে বিশ্বাস করব ? ইন্দ্রনাথ বলল, ফিশি তা ভাল। ফিশ ভাল লাগে না তোমার? ভুলোমনা বলল, দূর হোন।
দূর হওয়া কি চাট্টিখানি কথা! ইন্দ্রনাথ তো আজও দূর হয়নি।ভুলোমনা স্মৃতিভ্রংশের পরেও স্বপ্নের সুতো ধরে ধরে আবার গুটি গুটি এগিয়ে আসছে ইন্দ্রনাথ। ভুলোমনা কোনোদিনও ইন্দ্রনাথকে বিশ্বাস করবে না।
বিশ্বাস ভঙ্গ হতে পারে জেনেই রয়ে যাবে কাছে।
হাঁটতে হাঁটতে ভুলোমনা গেস্টহাউসে এসে পড়েছিল। ধারেকাছে কাউকে দেখা যাচ্ছিল না।
না দেবেন্দ্র না গুরুং, না অন্য কেউ। রাত এখন প্রায় সাড়ে এগারোটা । পাহাড়ে অনেক রাত ! গেস্ট হাউসের কাছটা সরগরম হয়ে আছে। ঘ্যাঙর ঘ্যাঙর করে একঘেয়ে একটা ব্যাঙের মত কিছু বেজে চলেছে, আর তার সঙ্গে ঢোল। একটা শামিয়ানা খাটানো আছে। সেখানে অষ্টপ্রহর কীর্তন চলছে। খুব বাঁচা গেছে, এই বিতিকিচ্ছিরি সংকীর্তনের আওয়াজ ভুলোমনার ঘর অবধি পৌঁছোয় না।একগাদা মানুষ সেখানে বসে ভয়ঙ্কর রকমের একটা গান গাইছে। সেটা তিব্বতী ভাষায় মন্ত্র পড়ার মত হলেও আদৌ শ্রুতিমধুর নয়। জায়গাটায় এসে পড়ার পর অসম্ভব বিরক্তিকর লাগছিল ভুলোমনার।সে শুনেছে রিমপোচে এসেছেন। ইনি এদেরই ফ্যামিলির কেউ। এরা এঁকে ডাকে ঠাকুরজী বলে। শুনতে লাগে ঠাকুরঝির মত। গুরুং-এর বড়দিদি এক দশাসই আকৃতির প্রখর বুদ্ধিসস্পন্ন দাপুটে গোছের ভদ্রমহিলা, অতিথিদের খাওয়া-দাওয়ার সময় ভীষণ খাতিরদারি করেন , তিনি দুদিন আগে বলেছিলেন ভুলোমনাকে ঠাকুরজী এসে আছেন। যাবে দেখতে ? ভুলোমনা শুনেছিল ঠাকুরঝি। ভুলোমনা ভাবল ঠাকুরঝি তো ননদকে বলে। সেটা আবার এত ঘটা করে জানাচ্ছে কেন? তার ওপর এই ভদ্রমহিলা যাকে সবাই ‘দিদি’ ডাকে সে বিয়ে থা’র পরে বাপের বাড়িতে কেন থাকেন ? তাহলে উনিই তো এই বাড়ির বউদের ঠাকুরঝি । গোলমাল পাকিয়ে যাচ্ছিল ভুলোমনার।ঠাকুরজী সম্পর্কে আগ্রহ জাগেনি তার।
এখন শামিয়ানার কাছে উঁকি মেরে ভুলোমনা ভাবল, কি কাণ্ডখানা হচ্ছে দেখা যাক একবার। উঁকি মেরে দেখল, অনেকে বসে আছে, ঢিলেঢালা ভাব।অস্টপ্রহর সংকীর্তন তো ছাড়া যাবে না মোটেই। তাই কিছু লোক চুইংগাম চিবোনোর মত ঘ্যানঘ্যান করে গেয়েই চলেছে। ঠাকুরজী নেই সেখানে।
তিন
গুরুং ফ্যামিলির গেস্ট হাউসে প্রথম থেকেই গোটা জায়গাটার মদ্যিখানে দাঁড়িয়ে থাকা হেক্সাগন শেপের ঘরখানার দিকে চোখ পড়েছিল ভুলোমনার। মনে হয়েছিল, ওই ঘরটায় থাকতে পারলে বেশ হত। কিন্তু কেন যে গুরুং ভুলোমনার জন্য অন্য ঘর বেছে রেখেছিল কে জানে। ঘরটার তিনটে হেক্সাগনের হাতে তিনখানা কাঁচের জানলা। ঘরের মধ্যে আকাশের চাঁদও ঢুকে পরে বসে থাকে মাঝেমধ্যে। গোটা আকাশটা তখন ঘরের সিলিং হয়ে যায়।
অনেকদিন শুধু-মুদু ঘরটা নিয়ে ভেবে ভেবে ভুলোমনা একদিন দেবেন্দ্রকে জিজ্ঞেস করেই ফেলল। ওই ঘরটা কি বলত? কেউ থাকে না দেখি।
– ও তো হনিমুন স্যুইট। যারা হনিমুন করতে আসে তারা থাকে।
– ও ।
মুহুর্তেই ঘরটার সম্পর্কে সব উৎসাহ হারিয়ে ফেলল ভুলোমনা।কেন যেন একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। তার ও ঘরে থাকা হবে না, তার জন্য নয় ওই ঘর। ঘরটা যেন বিশেষভাবে ইন্দ্রনাথ আর লিপির জন্য রাখা আছে। ওরা সেখানে বসে হয়ত, জীবন কাটানোর উপায় স্বরূপ নানাবিধ কথা বলবে, হুইস্কি খেতে খেতে। এমনিভাবে ওরা প্রয়োজন আর প্রয়োজন মেটানোর দায় হিসাবে একটা বহুশ্রুত বহুচর্চিত প্রেমকে জন্ম দেবে , যে প্রেম সম্পর্কে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে ভুলোমনা।
এমন কি সেদিন ঘটেছিল যে ভুলোমনা চিরকালের মত সেসবকে ভুলে যেতে চেয়ে নিজেকেই নির্বাসনে পাঠিয়ে দিল সেটা খুব ভাল মনে নেই ওর । ব্যাপারটা ভাবতে চেষ্টা করলেই ক্যাও ম্যাও ক্যাও ম্যাও এরকম একটা জবরজং জগঝম্পের শব্দ পায় সে। কিছুই ঠিকঠিক মনে পড়ে না, শুধু অনেক অনেক আওয়াজ ছাড়া। কিন্তু বিষয়টা আজকাল ইন্টারেস্টিং লাগে ভুলোমনার। জানলে যেন বেশ হত। বেশ দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দর্শকের মতো নির্মোহ হয়ে দেখেশুনে নিতে পারত ও।
যদিও যে বা যারা ভুলোমনাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে তারা ঠিক নির্মোহ হবার জন্য নয়, প্রথমে সবকিছু থেকে দূরে নিরবচ্ছিন্ন বিশ্রামের মাধ্যমে তারা তাকে আবার আশা, নিরাশা, হতাশা, পাওয়ার জন্য সংগ্রাম এবং না পাওয়াকে নির্বিবাদে হজম করা এইসব বাগাড়া বাগাড়া যাতে ভুলোমনা রপ্ত করে আবার জীবনের মূলস্রোতে ফিরতে পারে তার কথাই ভেবেছে বোধহয়।
বিশেষ করে ওই সামন্ত নামধারী লোকটা , যাকে সকলে ভাবে ভুলোমনার শুভাকাঙ্ক্ষী আর অ্যালবামে যার ছবি দেখা মাত্রই ভুলোমনা চোখ বুজিয়ে ফেলে এই ভয়ে যে বেশীক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ভুলোমনা যেন লোকটার শরীরের হাড় , মাস, মজ্জা পর্যন্ত দেখে ফেলতে পারে।
দেবেন্দ্রকে বলল ভুলোমনা, আজ বিকেলে কোথায় নিয়ে যাবে? দেবেন্দ্র মহা উৎসাহে বলল, সানসেট পয়েন্টে ।
এই এক ছাতার মাথা সানসেট পয়েন্ট হয়েছে দেবেন্দ্রর। পাহাড়ি জায়গা হলেই বোধহয় সেখানে একটা সানসেট পয়েন্ট থাকতে হবে। আর এই মহা উৎসাহিত দেবেন্দ্রের সানসেট পয়েন্টটাতে গুষ্টির পিন্ডি কিচ্ছু নেই। সেখানে গিয়ে শুধু-মুদু দেবেন্দ্র পাহাড়ে পাহাড়ে একগাদা লাফালাফি করবে।
দেবেন্দ্র যথারীতি অজন্তা হাওয়াই ফটাস ফটাস করে গেছিল সানসেট পয়েন্ট-এ। সেই বিকেলেই পথঘাট মোটামুটি শুনসান। মাঝে মধ্যে গাড়ি যাচ্ছে একটা দুটো, আর কিছু কিছু বাইক। কাছাকাছির মধ্যে যে মণিহারি দোকানটা পরে, সেখানে বসে বাড়ির লোকজন গল্পগুজব করছে । তাদের চুল বাঁধা পরিপাটি করে। জামাকাপড় ফিটফাট। যেন তাদের সারাদিনের কাজকম্ম শেষ। সন্ধ্যে বেলার কাজগুলো মুলতুবি আছে সন্ধ্যেবেলার জন্যই। সন্ধ্যে হলে আবার সকলে মিলে সেঁদিয়ে যাবে, ঘরের মধ্যে। যে দোকানে বসার, সে দোকানে বসে বসে উল বুনবে। বাকীরা ফটাফট লেগে যাবে কাজে। টি.ভি চলবে অনর্গল। ওদের হাতও চলবে অনর্গল। তারপর ঝুপ করে শীত নেমে আসবে। আর ওরাও সেঁধিয়ে যাবে, লেপ-কম্বলের মধ্যে। পাশাপাশি। ঘেঁষাঘেঁষি। পরদিন সকাল থেকে আবার একই কাজে জুতে যাবে সবাই। দিনের পর দিন নিজেদের মধ্যে জড়িয়ে-মড়িয়ে থাকাটা থেকে এরা সবচেয়ে বেশী জীবনীশক্তির রসদ পায়।
দেবেন্দ্র এরকম নয়। ভুলোমনা দেখেছে দেবেন্দ্র সর্বঘটে কাঁঠালি কলার মত, সব জায়গায় দরকার মত কাজ করে যেতে পারে। কাজটা দেবেন্দ্র করে অকাতরেই। কাজটা ওর কাছে কাজ নাকি মজাদার কোন খেলা, এটা তেমন বোঝা যায় না। যেমন, সকাল হলে দেবেন্দ্র, চটি ফটফটিয়ে, বোর্ডারদের ঘরে ঘরে ফ্লাস্কে করে চা আর চায়ের কাপ দিয়ে আসে। এই যাওয়া-আসার পথে ভুলোমনার ঘরে সে একবার না একবার নক করবেই।
– উঠে পড়েছ দি?
– উঁহু এখনো না।
– উঠে পড়ো, এখন কিন্তু উঠে পড়ার সময় ।
– টিং টিং ।
– পাশের ঘরে বেল বাজিয়ে দেবে দেবেন্দ্র। ঘরে ঘরে পৌঁছে দেবে, মিনারেল ওয়াটারের বোতল।
এইরকম একটা হিসেবি ছেলে যে কি করে অঙ্কে কাঁচা হয়! চলতে চলতে ভুলোমনা বলল,
– আচ্ছা, বল দেখি, তোমরা তিন বন্ধু হোটেলে গেছো খেতে।
সঙ্গে সঙ্গে দেবেন্দ্র বলল, হোটেলের রান্না খেতে আমার ভাল লাগে না, হ্যাক থুঃ।
প্রায় হুমড়ি খেয়ে দেবেন্দ্র রাস্তায় পড়ে পড়ে।
ভুলোমনা বলল, আচ্ছা, ধরই না। সত্যিসত্যি তো যাওনি। ধর গেছ।
– আচ্ছা, গেছি।
– আড়াইশো টাকার খাবার অর্ডার করেছ।
– আড়াইশো টাকার খাবার অর্ডার করেছি ? কিন্তু চাচী আমাকে আড়াইশো টাকা দেবে না। সুরেন্দ্রর ভাইয়ার কাছ থেকে চাইতে হবে।
– চাইতে হবে না। শোনোই না।
– আচ্ছা, বল। চাইব না তো খাব কি করে?
– দূর বাবা। সত্যি সত্যি তো যাওনি। মিছিমিছি গেছ। মিছিমিছি খেয়েছ।
– আচ্ছা, মিছিমিছি।
– হ্যাঁ । এবার হয়েছে কি তোমাদের তিনজনের কোনো একজনের কাছে একসঙ্গে আড়াইশো টাকা নেই।
– এ বাবা , টাকা নেই ! তাহলে আমি যাব না ।
– আঃ যাবে, যাবে। দাঁড়াও না, শোনো না বাপু।
অজন্তা হাওয়াই ভর করে এক পাক মারতে মারতে দেবেন্দ্র বলল, আচ্ছা, বল।
– তোমরা তিনজনে তিনটে একশো টাকার নোট বার করে ওয়েটারকে দিলে। একশো, একশো, একশো, তিনশো।
– আচ্ছা, বেশ দিলাম।
– খাবারের দাম দেবার পর ওয়েটারকে তোমরা দিলে কুড়ি টাকা।
– ও.কে ।
– তোমাদের কাছে পড়ে রইল তিরিশ টাকা।
– ও. কে।
– সেই টাকাটা তোমরা দশ-দশ করে তিনজন মিলে নিলে।
– বেশ।
– তাহলে তোমাদের পার হেড খরচ হয়েছে নব্বুই টাকা।
– হ্যাঁ।
– নব্বুই গুন তিন হল গিয়ে দু’শ সত্তর টাকা।
– হ্যাঁ।
– ওয়েটারকে দিয়েছো কুড়ি টাকা মানে দু’শ নব্বুই।
– হ্যাঁ।
– তাহলে দশ টাকাটা কোথায় গেল?
– তাইতো, দশ টাকাটা কোথায় গেল?
– তুমি বল।
– না, তুমি বল।
দেবেন্দ্র খানিকক্ষণ মাথা চুলকোলো । খানিক বিড়বিড় করল।
– দশ টাকা গেল কোথায়?
– আচ্ছা, একদিন সময় দিলাম তোমায়। ভাবো তারপর জানাও।
– দেবেন্দ্র একটা জ্যান্ত কালবোশ মাছের মত জালের মধ্যে খলবল করতে লাগল। বোঝাই যাচ্ছে কাল অবধি ওর পক্ষে অপেক্ষা করাটা ভারী আছে। ফিরেই ও সুরেন্দ্র ভাইয়াকে পাকড়ে জিজ্ঞেস করে ফেলবে। কিন্তু সুরেন্দ্র ভাইয়া মাথায় গাঁট্টা না মেরে তো সলভ্ করে দেবে বলে মনে হয় না। একটা পাহাড়ের ওপর তরতরিয়ে উঠে গেল দেবেন্দ্র।
– দশ টাকাটা কোথায় গেল?
পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে প্রতিধ্বনি হল , গেল গেল- গেল-গেল।
ভুলোমনা চেঁচিয়ে বলল,
– ভাবো।
– ভাবো-ভাবো-ভাবো-ভাবো
– ভেবে ভেবেও পাচ্ছি না।
– পারবে। ভাবো।
– আমার মাথায় অঙ্ক ঢোকে না।
– হিসেব তো ঢোকে। কত কাপ চা, এক বোতল বিসলেরি কি করে হিসেব মেলাও?
প্রতিধ্বনি হল মেলাও মেলাও মেলাও মেলাও। দুনিয়ার হিসেব সবসময় মিলে যায়। পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে প্রকৃতি জানিয়ে দিল সেকথা।
– ওঃ, আমার হয়ে তুমি ভেবে দাও না ভুলোমনা। “ভুলোমনা” শব্দটা আছড়ে আছড়ে পড়তে লাগল শুধু ‘না’ হয়ে। না-না-না-না।
– কেন না?
– আমিও ভাবতে পারি না তোমার মতন।ভাবতে না পেরে পেরে আমি ভুলে গেছি সব। ‘ব’ শব্দটা ফিরে এল ওদের কাছে।
– কেন, ভুলে গেছ , কেন ভাবতে পারো না তুমি? ‘মি’ ফিরে ফিরে এল ।
দু-হাত চোঙের মত করে ভুলোমনা ছুঁড়ে দিল উত্তরটা।
-ডিসোসিয়েটিভ অ্যামনেশিয়া ।
‘ য়া’ শব্দটা পাহাড়ে পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে আর্তনাদের মত শোনালো।
-ডিসোসিয়েটিভ অ্যামনেশিয়া।
দুটো হাত দু-পাশে ছড়িয়ে দিয়ে উর্ধমুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে ভুলোমনা চিৎকার করল,
-ডিসোসিয়েটিভ অ্যামনেশিয়া _হা__হা -হা ।
বুড়ো আঙুলে অজস্তা হাওয়াই টিপে ধরে দেবেন্দ্র তরতরিয়ে নামছিল, পাহাড়ের মাথা থেকে।
-চলো, আমরা বাড়ি যাব। চলো।
-চলো। কিন্তু রিডল্-এর উত্তর আমার চাই।
-তাই হবে। এখন চলো।
তড়িঘড়ি বলল দেবেন্দ্র!
দাবীটা করেই ভুলোমনা অনুভব করল, তার আসলে কিছু চাই না। না রিডল্-এর মানে না অন্য কিছু। তার
কিছু চাইবার নেই। এই খাওয়া-দাওয়া, ঘুমানোর জন্য একটা নিরাপদ জায়গা ছাড়া। এই যে আমার চাই-ই-এই
বোধটাকে ভয় পেতে শুরু করেছে ভুলোমনা। পরক্ষণেই মনে হল, না ঠিক ভয় নয় বোধহয়। এই দাবী-দাওয়াগুলোর অসারতা বুঝতে পেরে গেছে ও।
ফিরে আসতে আসতে ওরা দেখতে পেল, গতকাল থেকে যে নতুন একদল বোর্ডার এসেছে, তারা একটা ঢাউস গাড়ি করে হৈ-চৈ করতে করতে ফিরল কোথা থেকে যেন। ওরা আজ সকালবেলা ডাইনিং হলে
ব্রেকফাস্ট টেবিলে এসেছিল, ভীষণ নাক সিঁটকোতে সিঁটকোতে । ওদের টেবিলে, কাঁসার বাটিতে বাটিতে কে
যেন ডাল রেখে গেছিল। একজন ঢুকে প্রথমেই বলল, ডাল খাব ? অর্থাৎ এই সকাল সকাল ডাল খেতে যাব
কেন ? গুরুং প্রথমে ওদের কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ করল। ভুলোমনা একমনে পুরি ভাজি খাচ্ছিল। আড়চোখে লক্ষ্য করল ওদের। ওদের মুখে একটা ক্ষ্যামাঘেন্নার ভাব গুরুংদের প্রতি। নাক-উঁচু গোছের মানুষ এরা। গুরুংদের যে
পরিমাণ জমি-জমা, ক্ষেত, পশুখামার ইত্যাদি তাতে গুরুংরা এদের কয়েক গুষ্টিকে পুষতে পারে, সেটা সম্ভবত
এরা জানে না। গুরুং খুব চটপট ওদের মর্জি বুঝে খাবার সার্ভ করে দিল। অথচ একবারও বলল না, যে ডালের
কথাটা ওরাই বলেছিল।
গুরুংদের ডাইনিং হলটা একটা মজাদার জায়গা। খেতে বসার সঙ্গে সঙ্গে গোটা কয়েক ছেলে সুরেন্দ্র বা অন্য কেউ এসে আ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। গুরুং এবং তারা চটপট খাবার সার্ভ করে ফেলে। খেতে শুরু করলে গুরুং তাদের তদারকি করে, আর কিছু চাই কিনা ইত্যাদি। এ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকতে
থাকতে ছেলেগুলো চটপট হুকুম তামিল করে। বস্তুতঃ বাসনমাজা, ঘর মোছার মত কাজ ছাড়া বাকী সব কাজই
ওরা নিজেরাই বাড়ির সকলে মিলে করে।একটা পুরোনো আমলের বিশাল জয়েন্ট ফ্যামিলির ধরণে চলে গুরুংদের সবকিছু। আসলেই ওরা জয়েন্ট ফ্যামিলিই বটে, যার কিছু নিয়মকানুন আছে, যা সব সদস্যদের মেনে চলতে হয়। আর পরিবারের মাথা হচ্ছে পিসী । সে যেমন দাপুটে তেমনি ডাকসাইটে। আর পিসীও অতিথিদের যত্ন-আত্তি করেন একজন যথার্থ গৃহকর্তীর মতই। বয়ামে ভরা সব নানাধরণের আচার পিসী তৎবির করে জিজ্ঞেস করেন, এই আচারটা পরোটার সঙ্গে
লাগত ভাল, অমুক আচার দিয়ে ডাল খেলে, খাওয়াটুকু হত ঠিক খাওয়ার মত খাওয়া । গুরুং তখন খুব গর্বের সঙ্গে জানায় যে আচারের মালমশলাগুলো ওদের ফার্মের আর আচারটা বানানোও হয়েছে
বাড়িতে, ঘরোয়া পদ্ধতিতে । ঘি-টা যেমন গরুগুলোর দুধের ওপর পড়া মোটা সর জমিয়ে জমিয়ে বানানো
হয়েছে ঘরেই। সব হোমমেড। গুরুং স্বয়ং দিল্লি থেকে এম.বি.এ করার পর এই ক্ষেতখামার সমেত গোটা
বিজনেসটার তদারক করে। রিসর্টটার পাশেই গুরুংদের নিজস্ব পাহাড়ি বাড়ি। অতএব কাঠের তৈরি। সারা বাড়িভর্তি ছোট ছোট জানলা । আর তাতে রং-বেরং-এর রঙ করা। বোর্ডাররা যখন ডাইনিং হলে হাজির হয়, কি করে কে জানে, বাড়ি থেকে পিসী নিমেষে চলে আসে , তদারকি করতে। একাধারে উনি অতিথিদের মধুর স্বরে
কথা বলেন। আর অণ্যধারে এ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলোকে বকাবকি করেন। গজগজ
করতে থাকেন ওদের নির্বুদ্ধিতার কথা ভেবে। অথচ সুরেন্দ্রই হোক আর দেবেন্দ্রই হোক কি অন্য কেউ, পিসীর
গজগজানিতে তাদের মধ্যে কোন বিশেষ হেলদোল দেখা যায় না। তারা হুকুম পালন করে মাত্র। পিসীর গজগজানির ব্যাপারটা ভাত, ডাল, ভাজির মতই এত স্বাভাবিক তাই নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না । রান্নাঘরেও চাচি মাঝেমধ্যেই
চ্যাঁচামেচি করে, দেবেন্দ্র বা রাজ বা হীর-এর ওপর। কাউকে বকা হলে অন্য কেউ মাথা ঘামায় না, তারা তাদের
মত থাকে। অতএব, ভুলোমনা অনেক লক্ষ্য করে ভেবে দেখেছে, এদের বাড়িতে কে যে কার ছেলে, আর কে
যে কার বাবা অথবা মা কিছুতেই বোঝবার জো নেই! যেকোন একজন বড়-র কাছে যে কোন একজন ছোট
বকুনি খেয়ে যেতে পারে। এই বকুনি খাওয়া আর যারা বকুনি খাচ্ছে তাদের নিরুত্তাপ ভঙ্গি দেখে দেখে দেখে
ভুলোমনার জব্বর লাগে। আগাগোড়া ব্যাপারটাই ভীষণ কনফিউজিং।
এরকম একটা মান্ধাতার আমলের একান্নবর্তী পরিবার আবার কি করে জগতে ফিরে আসতে পারে , নতুন
মোড়কে, কিন্তু পুরনো মূল্যবোধ
, আগাগোড়া ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছিল ভুলোমনা। এদের দেখে আর দেখতে
দেখতে এরকম কথাটা ভুলোমনা প্রায়ই ভাবে। এমনি একান্নবর্তী পরিবার ভুলোমনা কোথায় যেন দেখেছে।
ছবির মত ছায়া ছায়া। কিছুতেই তা মনে পড়ে না। কিন্ত দেখেছে, এটা নিশ্চয় মনে হয়। মেয়েরা সবাই অহোরাত্র
ব্যস্ত। প্রত্যেকটা দিন যেন যজ্ঞি বাড়ি। এই মুটে মাথায় ঝুড়ি ভর্তি করে কাঁচাবাজার আনল। ডাঁই হয়ে থাকা
কাঁচাবাজার তরকারি অনুযায়ী হিসেবনিকেশ করে করে কাটতে বসে গেল কয়েকজন। তিন-চার খানা বঁটিতে কচকচ করে কাটা হয়ে যাচ্ছে কাঁচাবাজার । এটা চচ্চড়ির, এটা ডালনার, এইটা দিয়ে ছেঁচকি মত হবে। ডালে পড়বে
নারকোল কোরা। মাছের ঝোলের জন্য কাটা হচ্ছে ডুমো ডুমো করে আলু আর পটল। হাতবদল হয়ে কাটা সবজি চলে যাচ্ছে, যে রাঁধবে তার হাতে। বাকী সবজি গুছিয়ে তুলে রাখছে কেউ। জলখাবারের লুচি আর আলু ছেঁচকি বানানো রয়েছে। জলখাবারের পর্ব চুকলে রান্না শুরু হবে। দুপুর থেকে শুরু হয় আচার, পাঁপড় বানানোর ধুমধাড়াক্কা। ছাদে কাগজ পেতে পেতে শুঁকোতে দেওয়া হয়েছে পাঁপড় । আচার শুকোচ্ছে গামলায়।শিশি ভর্তি করে ভাঁড়ারে রাখা আছে নিমকি , নাড়ু চিঁড়েভাজা । ছেলেরা সব বিকেলের দিকে সাবড়ে দেবে সেসব। বিরামহীন এক সংসার যজ্ঞের চাকা যেন অবিরত ঘুরে চলেছে ঘড় ঘড় ঘড় ঘড়। ক্রমশঃ সেই ঘড়ঘড়ানির শব্দ ছাপিয়ে আওয়াজ উঠতে থাকে একটা ।
বিদ্রোহ, বিদ্রোহের শব্দ যেন বা ! বিদ্রোহেরও কি কোন শব্দ হয়? আসলে বিদ্রোহটা যে দানা বাঁধছে তার শোরগোল কানে আসে।
মুহূর্তে ভুলোমনার চোখের সামনে ব্যক্তিস্বাধীনতা, যৌধস্বার্থ, কালেকটিভ প্রপার্টি এইসব যত কঠিন কঠিন , কঠিন শব্দরা , বর্ম পরা অবস্থায় হাতে বর্শা নিয়ে এসে দাঁড়ালো।
এদের মধ্যে ঠোকাঠুকি লাগা অবশ্যম্ভাবী বুঝতে পেরে ভীষণ ভয় পেয়ে গেল ভুলোমনা। আর তখনই বাগানের গেটের কাছ থেকে কে যেন চিল-চিৎকার করে কাকে ডাকতে থাকে মিঠুয়া-মিঠুয়া-আ-আ বলে। মুহূর্তে ঘুরে তাকাল ভুলোমনা। তার নাম ধরে তাকে কে ডাকছে? ও তো মোহিনী। তার নাম, তার নামই তো মিঠুয়া। একেকজন একেকরকম ভাবে ডাকত। কেউ বলত
মিঠু, কেউ বলত মিঠি। সামন্ত বলত ,কে জানে সামন্ত কি বলত? তার জীবনের প্রধান শুভাকাঙ্ক্ষী লোকটা সে
কি বলত, আদৌ কিছু বলত কিনা, মনে পড়ছে না ভুলোমনার। অথচ ইন্দ্রনাথ ডাকত মিঠ্ঠুমিয়া বলে। আদরের ডাক।
এই ডাকটা আদরের নাকি আদরের নামে ধান্দাবাজির তাই নিয়ে ঘোর সন্দেহ আছে ভুলোমনার। বরাবরই সে ইন্দ্রনাথকে নিয়ে এই ধরণের একটা সন্দেহের মহা টানাপোড়েনে পড়ে। এখন নিজের নামটা ফিরে পাবার পরও ইন্দ্রনাথের সম্পর্কে সন্দেহের ধোয়াটা পাকিয়ে পাকিয়ে উঠল।
মোহিনী মিলিয়ে যাবার পর সেই বিরাট উঠোনওয়ালা বাড়িটারও লোকজন কোথায় যেন চলে গেল।
বাড়িটাতে তখন টিমটিম করে আলো জ্বলত সন্ধ্যাবেলা বাড়ীটীর মধ্যে থেকে ভেসে আসত শাঁখের আওয়াজ।
গোঙনির মত শুনতে লাগত সেটা। লোকবল হারিয়ে বাড়িটা এমন নিঝ্ঝুম আর অথর্বের মত হয়ে গেল মনে
হল একদিন বাড়িটা ঝুরঝুর করে বালির মত ঝরে পড়বে । বাড়িটার লোকজন সময় হওয়া মাত্রই যে যার মত
জীবন খুঁজতে বেরিয়ে গেছিল। বাড়িটাও যদি ওমনি যেতে পারত, বেঁচে যেত বুড়ো হয়ে যাওয়ার হাত থেকে। কালের হাতের ছোবল খাওয়ার হাত থেকে।
গুরুংদেরও কি এইরকম হবে? হঠাৎ একদিন কে বা কারা একযোগে একসঙ্গে রুখে দাঁড়াবে পিসির বিরুদ্ধে? খুব খারাপ হবে কি তাহলে? নাকি ভালই হবে একরকম ।
হয়ত এরা জানে মহাকাল কখন কালসাপ হয়ে উঠে ছোবল বসায়। তার হাত থেকে বাঁচার ফিকিরও বের করে ফেলেছে সবাই। ভাল আর খারাপের এই ঝুটঝামেলার মধ্যে গোল গোল পাক খেতে লাগল ভুলোমনা। সবকিছু গুলিয়ে গেল তার। একবার তার মনে হল, গুরুংদের এরকম কিছু হবে না। শীতের জায়গায় মানুষরা একা একা থাকতে পারে না। আর তারা মার-মুখো কম হয়। তারা ঘেঁষাঘেঁষি করে বাঁচতে ভালোবাসে ।
ভুলোমনা ভাবছিল, তার জন্য কোন বাঁচাটা ঠিক হবে। একা একা জীবনের সঙ্গে কানামাছি খেলতে খেলতে বাঁচা নাকি যৌথভাবে অনেকের সঙ্গে হড়বকত নানান পাঁচমেশালি বাঁচার মধ্যে ভুলে থেকে বাঁচা।
ভুলোমনার মনে হল, ইতিমধ্যে এই দু ধরণের বাঁচাই সে যেন বেঁচে ফেলেছে। মানে মিঠুয়া নামের যে ভুলোমনা
সে যেন বেঁচে ফেলেছে। সে আর ভুলোমনা একই মানুষ এটুকু ভুলোমনা এখন বুঝতে পারছে। এই দুইরকম বাঁচাই ভুলোমনার মনে দুধরনের মোহজাল বিস্তার করছিল। সেই মোহজালের মধ্যে
ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ল ভুলোমনা। কাঠের বারান্দা বেঞ্চিটার ওপর ঘুমোচ্ছিল সে। কম্বলটা আস্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছিল তাকে। ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে ভুলোমনা ভাবল মানুষগুলো কেন যে, কম্বলের মত হয় না! কম্বলের মধ্যে একবার ঢুকলে আর বেরোতেই ইচ্ছে করে না। সত্যি সত্যি কোন মানুষ যদি
এইরকম কম্বলের মত ভালবাসত ভুলোমনাকে, তাহলে হয়ত ও মিঠুয়াই থেকে যেতে পারত।
অথচ মানুষের ভালবাসার ক্ষেত্রে চূড়ান্ত আবেগের পর কেমন যেন একধরণের একঘেয়েমি, একটা বিচ্ছিন্নতার ভাব গ্রাস করে মনকে। মানুষের ভালবাসা বিরতি চায়, বিরতি দিতে হয় ভালবাসাকে। নয়তো
সারাক্ষণ একটা ভ্যাদভ্যাদে ভালবাসা ভীষণ চটচটে করে তোলে গা হাত পা মন ও মগজকে।
ইন্দ্রনাথের সঙ্গে এরকম একটা চটচটে ব্যাপারের মধ্যে যেতে পারেনি বলেই কোথাও একটা ক্ষীণ সুতো লেগে আছে। ইন্দ্রনাথের ওপর অনেক রাগ, অনেক অভিমান-অভিযোগ সত্ত্বেও সবটা ছিঁড়ে যায়নি এখনও।এক, ভয়ানক রাত এসেছিল একদিন। সারা বাড়ির লোক ঘুমিয়ে গেলে ইন্দ্রনাথের কাছে চুপিচুপি চলে গেছিল ভুলোমনা। রাতবিরেতে।ইন্দ্রনাথ সেদিন রাতে ওদের বাড়িতে থাকতে এসেছিল। সে ছিল মহা ঘোর দুর্যোগের রাত। ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হচ্ছিল সবকিছু। গাছ শেকড়শুদ্ধ উপড়ে পড়েছিল সর্বত্র। ইন্দ্রনাথের গাড়ি খারাপ হয়ে গেছিল। কারণ যেকোন মুহুর্তে গাছ উল্টে তাতে চাপা পড়তে পারত মানুষ এবং বাড়ি ফেরা ছিল বিপজ্জনক।
ঘরে-বাইরে সর্বদাই বিপদ যেন ওত পেতেছিল। সময়টা ইন্দ্রনাথের জন্য ভাল যাচ্ছিল না। সেদিন আকাশ বাতাস আচ্ছন্ন করে সমুদ্রের ঢেউ-এর মত আছাড় খেয়ে পড়ছিল ঝড়। বাইরের সেই ঝড় ইন্দ্রনাথের জীবনেও ভাঙচুর শুরু করে দিয়েছিল। ওমনি একটা ঝড়ে রাস্তাঘাট যখন ওলটপালট জীবনযাত্রা অচল প্রায়, ইন্দ্রনাথ জানাল সে ভুলোমনার বাড়িতে থাকতে চায়। কারণ বাড়ি ফেরা দায়। বেশ কতগুলো আবেগ পরপর খেলা করে গেছিল ভুলোমনার ভেতরে। প্রথমে দোনামনা, তারপর গররাজি ভাব, তারপর, ভয়ে অথবা কি বিপদে পড়া গেল এরকম ধরণের কেমন একটা মিশ্রিত উত্তেজনা, তারপর খানিকটা পরোপকার করার আবেগ এবং সর্বোপরি বিপদগ্রস্ত ইন্দ্রনাথ যে আর কোথাও না গিয়ে তার কাছেই সাহায্য চেয়েছে তার জন্য ইন্দ্রনাথের কাছে নিজেকে কি নাকি ভাবা। অথচ সবকিছু মিলিয়ে দেখে ভুলোমনা আবিষ্কার করেছিল, সে ইন্দ্রনাথকে ভালবাসে,জান-প্রাণ দিয়েই ভালবাসে।
সেই সন্ধে এবং রাতটা শেষমেশ হল বিড়ম্বনাময়। ইন্দ্রনাথের সঙ্গে মোলাকাতগুলো কেন যেন সবসময়ই
বিড়ম্বনাময় হত! দুজনেরই একসঙ্গে সময় কাটানোর আন্তরিক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও কেন যে একটা কালো রঙের
ছায়া ইন্দ্রনাথের মধ্যে থেকে বেরিয়ে ভুলোমনাকে ঘিরে ফেলত কে জানে। অন্ততঃ এরকমই বারবার করে ঘটত বলেই ওর মনে হত।
আসলে সেই রাতে ভুলোমনার ধারণা হয়েছিল যে, সে একটা মহান কর্ম করছে এবং করছে অনেক
অসুবিধে অগ্রাহ্য করে উপরোধে ঢেঁকি গিলে। খাওয়া-দাওয়ার পর ইন্দ্রনাথ গেস্টরুমে ঢুকে পড়ল। বলাই বাহুল্য
এই সময়টা ছিল গল্পগুজব করার সময়। ইন্দ্রনাথ ভুলোমনাকে বলেছিল শরবত বানিয়ে আনতে। পুরোদস্তর
খাওয়া-দাওয়ার পর আবার শরবত খাবার কি দরকার থাকতে পারে, এমনটাই মনে হচ্ছিল ভুলোমনার। আর
ভুলোমনা আশ্চর্য হয়ে গেল দেখে যে, আসলে শরবতটার দরকার ছিল না, দরকার ছিল লিপির সঙ্গে কথা বলার। দরকার ছিল এটা জানানোর যে, গাড়িটা রাখার একটা সুবন্দোবস্ত করা গেছে। আর কিসব জরুরি,দরকারি, কেজো, সাংসারিক কথার মত কথা ছিল যেগুলো বলে নিতে পারলে দু-পক্ষই আশ্বস্ত হত। সেগুলো
বলে নেওয়া গেল। সবটাই পাশের ঘর থেকে ভুলোমনা শুনে ফেলেছিল, যদিও , না শোনাটাই বাঞ্ছনীয় ছিল।
ভুলোমনার মনের মধ্যে কালোকালির পোঁচ পড়ছিল। আর যেহেতু মনটাও ছিল একটা পুরোদস্তুর মানুষ আর
মোটা ব্রাশে মারা কালিটাও তাই, ফলে দুজনের মধ্যে কি যেন সব ছাতার মাথা আদানপ্রদান চলছিল। তা সত্ত্বেও মিঠুয়া শরবত আনল এবং ইন্দ্রনাথ নির্ঘাত একদিন তাকে বুঝবে এই অক্ষম বিশ্বাসে ভর করে ইন্দ্রনাথকে অপার ক্ষমায় ভরিয়ে দিতে চাইল।
মিঠুয়া যেটা বোঝেনি সেটা হল, আসলে ইন্দ্রনাথ কোনদিনই মিঠুয়া যেভাবে চায়, সেভাবে তাকে চাইবে
না। ইন্দ্রনাথ তাকে চাইবে, তবে সেটা তার মত করে। তাতে মিঠুয়ার পোষালে পোষাবে, না পোষালে না পোষাবে । সেটা একান্তভাবেই মিঠুয়ার সমস্যা ।
সেইরাত ক্রমে গভীর হয়ে এলো। ইন্দ্রনাথ অপেক্ষায় ছিল ভুলোমনার আর ভুলোমনা ইন্দ্রনাথের।
অল্পবয়সী সদ্য ফুটে ওঠা তারুণ্যের বশবর্তী ছিল তাদের মন। আর শরীর ছিল বয়স্ক লোকেদের মতন। তাই অধীর অপেক্ষা আর মানসিক দুর্যোগের টানাপোড়েনে ইন্দ্রনাথ ঘুমিয়ে পড়ল। ভুলোমনা ইন্দ্রনাথের কাছে এল, গুটিগুটি। আর ইন্দ্রনাথ নিমেষে ঘুমের ঘোর কাটিয়ে টেনে নিল ভুলোমনাকে। মিঠ্ঠুমিয়া ।
খুব সহজেই ঘুমিয়ে পড়তে পারত ইন্দ্রনাথ। বাস্তব থেকে পালাতে। কারণ, বাস্তবিক জীবনে ইন্দ্রনাথ চাইত
ক্ষমতা, আধিপত্য। এসব চাওয়ার জন্য লিপিকে ওর ভীষণ দরকার ছিল। কারণ, লিপির মধ্যেই ও খুঁজে
পেয়েছিল বাস্তবিকভাবে সেই নারীকে, একজন পুরুষের সফলতার জন্য যে শক্তপোক্ত কাঠামো হয়ে দাঁড়িয়ে যেতে পারবে। আর বিনিময়ে লিপি একটা উড়ন্ত প্রজাপতি হয়ে ইন্দ্রনাথের চারধারে নেচে নেচে ইন্দ্রনাথের সফলতা উপভোগ করবে। ওরা খুব সুন্দরভাবে দুজন দুজনের ঢাক পেটাতে পারত। একজন যদি ডাড্ডা নাকুর,
ডাড্ডা নাকুর বলত তো অপরজন কাঁই নানা, কাঁইনানা শব্দে অন্য মানুষদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলত। এমন
রাজযোটক যোগ খুব কমই হয়।
কিন্তু ভুলোমনাটা ছিল কোন আহাম্মকদের দলের সদস্য যে, যার ইন্দ্রনাথের মধ্যে এক জীবনের চাহিদা
মেটানোর জন্য হাঁচোড়-পাঁচোড় করা মানুষটাকে দেখে অসহায় মনে হত। মনে হত, নিজেরই তৈরি করা জালের জট খুলতে খুলতে সে ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত, আর জটগুলো এমন ছ্যাঁচড়া প্রকৃতির যে একটা জায়গায় খুলতে গেলে আরেকটা জায়গায় জট পড়ে যায়। আর ইন্দ্রনাথের পোড়া কপাল যে, ইন্দ্রনাথ কেবলই ঘোর ঘোর লাল লাল চোখে অবিরত জট ছাড়াতে বাধ্য হত।
ভুলোমনার মনটা একটা অলীক মায়ায় ভরে উঠত। মায়ার মধ্যে ভরা ছিল করুণা। করুণার বশবর্তী হয়ে কাউকে ভালবাসা যায় না। সে ভালবাসায় অনেক ভুল থাকে। এসব ভুলোমনা কোথা থেকে যেন শিখেছিল । আপনি আপনিই । ওই যে জীবন কাটাতে গেলে অনেকগুলো ঘটনাবহুল দিন কাটাতে হয় , সেই রকম সব দিন কাটাতে কাটাতে ভুলোমনা ভালোবাসা বা না-বাসার বা সঠিক কিম্বা বেঠিকভাবে ভালোবাসার একখানা জবরদস্ত তত্ত্ব খাড়া করেছিল , এতশত হয়ত না করলেও চলত ।
অতএব এইসব মর্হাঘ্য ধারণাগুলো বগলদাবা করে নিয়ে ভুলোমনা ভালোবাসতে বসল । তখন হয়তোবা আড়াল থেকে কেউ বলেছিল ট্রেসপাসার্স উইল বি প্রসিকিউটেড । আর ভুলোমনার কান অবধি পৌঁছোয়নি সেকথা । কিন্তু কানে পৌঁছোবেনা তা কি হতে পারে ? কথাগুলো কানের পর্দায় ধাক্কা খেয়েছিল । সেই স্টিমুলাস নিশ্চয় আলোড়ন তুলে স্নায়ুগুলোর মধ্যে দিয়ে পৌঁছেছিল ব্রেনে । কিন্তু ভুলোমনার মন ব্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইন্দ্রনাথেতে আচ্ছন্ন ছিল। তার মন তখন যিশাস ক্রাইস্ট হবার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল , যে কিনা ইন্দ্রনাথকে মুক্তি দেবে । অতএব কথাগুলো মর্মে পৌঁছোয়নি তার ।
(ক্রমশ)


ব্যাকড্রপ সেটিংএ অনবদ্য ডিটেইলিং, অবয়ব খানিক কাফকান, ভাষায় দৈবী পাগলামি।
বাহ্!! বেশ মায়া মায়া.. চলুক।।
মোনালিসা,চমৎকার লিখছো। লেখাটা বহমান নদীর মত বয়ে যাচ্ছে… 👍👍