
ধারাবাহিক উপন্যাস
অজিত সিং বনাম অজিত সিং
তৃষ্ণা বসাক
‘প্রথমে ছিল বঙ্গলক্ষ্মী চানাচুর, তারপর এল আজাদ হিন্দ চানাচুর, তারপর একের পর এক বিপ্লব চানাচুর, সর্বহারা চানাচুর, উন্নততর সর্বহারা চানাচুর, এখন চলছে বিশ্ববাংলা। এখানেই কি ভাবছেন গল্প ফুরিয়ে গেল? এবার আসছে একে ফিফটি সিক্স চানাচুর। নাম যাই হোক, সোল এজেন্ট আমি।’ ‘বেওয়ারিশ’ গল্পের চানাচুরওলা এবার ঢুকে পড়েছে বাংলার শিল্পক্ষেত্র থেকে শিক্ষাজগতের ক্ষমতার অলিন্দে।খুন, যৌনতা, প্রতিশোধ, নিয়তিবাদের রুদ্ধশ্বাস সুড়ঙ্গে সে টের পাচ্ছে- -বহুদিন লাশের ওপর বসে বারবার হিক্কা তুলেছি আমরা -বহুদিন মর্গের ভেতরে শুয়ে চাঁদের মুখাগ্নি করেছি আমরা -অন্ধ মেয়ের মউচাক থেকে স্বপ্নগুলো উড়ে চলে গেছে (জহর সেনমজুমদার) এই সবের মধ্যে বাংলার কি কোন মুখ আছে আদৌ? থাকলে কি একটাই মুখ? না অনেক মুখ, সময়ের বিচিত্র রঙে চোবানো? বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী জুড়ে বাংলার অজস্র মুখের ভাঙ্গাচোরা টুকরো খুঁজে চললেন তৃষ্ণা বসাক, তাঁর নতুন উপন্যাস ‘অজিত সিং বনাম অজিত সিং’-এ । সব কথনই রাজনৈতিক, সেই আপ্তবাক্য মেনে একে কি বলা যাবে রাজনৈতিক থ্রিলার? সিটবেল্ট বাঁধুন হে পাঠক, ঝাঁকুনি লাগতে পারে। আজ থেকে শুরু এই উপন্যাসের প্রথম পর্ব।
প্রথম পর্ব
রুবি কানেক্টর থেকে বিজন সেতুর দিকে যেতে ডানহাতে সিমেন্সের অফিস। তার পাশের গলিতে ছোট ছোট খাবার দোকান, এই দুপুরেও বেশ জমজমাট। লাঞ্চ ব্রেকে সব আই টির ছেলেমেয়েরা এসে খাচ্ছে। ভেতরে বসার জায়গা নেই। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাচ্ছে। অজিত সিং তাকিয়ে দেখল বেশির ভাগই খাচ্ছে দোসা-ইডলি অথবা রুটি-ছোলে, একটা ডিম টোস্টের দোকানও আছে। সেখানে কাচের বয়ামে লাড্ডু, সোনপাপড়ি জাতীয় মিস্টিও আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল অজিত। কাউকে ভাত মাছ খেতে দেখল না সে এই ভরদুপুরে। ভাতের কোন হোটেলও নেই অবশ্য। আর ভাত এরকম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাওয়াও যায় না। কিন্তু এরা ভাত খেতে চাইলে নিশ্চয় তা পাওয়া যেত এখানে। এরা ভাত খেতে চায় না, ভেতো তকমা পাবার ভয়ে নাকি ভাত খেলে কাজ করা যায় না? কিন্তু এরা তো ঠান্ডা ঘরে বসে কাজ করে। বাইরে রোদে জলে ভিজে কাজ করছে যে মিস্ত্রিমজুররা, তারা তো দুপুরে রোজ ভাত খায়, মেট্রো রেলের মাটি খোঁড়া নারী পুরুষেও বসে ভাত খায় দেখেছে অজিত। ওরা তবে কাজ করে কী করে? অজিতের মনে হল, ওপরের দিকে বাঙ্গালি আর তত বাঙালি নেই, যে বাঙ্গালিকে দেখিয়ে তার দাদাজী বিনয় সিং বলত, ওদের মতো বুদ্ধি আর কারো নেই। ওরা ভাত আর মাছ খায় বলেই এত বুদ্ধি নাকি। ছোট্ট অজিত তখন থেকেই চেয়েছে বাঙালিদের মতো হতে। কিন্তু বাঙ্গালিই আর বাঙালি থাকতে চায় না? হায় রে।
পকেট হাতড়ে দেখল সিগারেট শেষ। ভারি মুশকিল। এখানে কি ওর ব্র্যান্ড পাওয়া যাবে? সামনের দোকানটায় গিয়ে জিগ্যেস করল ‘ক্লাসিক আছে?’ ছিল ক্লাসিক। পকেট থেকে একটা হাজার টাকার নোট দিল অজিত। সে নিয়ে কিছু বলল না ছেলেটা। চুপচাপ চেঞ্জ দিয়ে দিল। যার মানে এখানে এই ব্র্যান্ড, হাজার টাকার নোট জলভাত। কিন্তু অজিতের মেন এরিয়া যেখানে, সেই ইউনিভার্সিটি চত্বরে, ক্যান্টিনগুলোতে বহুত ঝামেলা হত হাজার টাকার পাত্তি দিলে। ওখানে এখনো কীরকম কাঁধে ঝোলা, সস্তা চারমিনার, লাল চা, ভেজিটেবেল চপ, পাঁউরুটি ঘুগনির ভূত চেপে আছে। মিটিংগুলোতে কী খারাপ খাওয়ায়, সিঙ্গাড়া চা। একটা দশ টাকার কেকের প্যাকেট। অজিত সিং এসব বদলে দেবে। এইসব গরিব গরিব সেজে থাকার ভেক, এই আলগা আদিখ্যেতা, পেটে কিল মেরে আঁতলেমি! যে জাত নিজেদের খাবার ভুলে গেছে, তাদের আবার বড় বড় কথা!
কিন্তু চন্দন শুয়োরের বাচ্চা এখনো আসছে না কেন? ওর তো ঠিক একটায় ওকে এখান থেকে পিক আপ করার কথা। দেড়টায় ক্রিস্টাল চপস্টিকে লাঞ্চ খাওয়াবে পি কে বি, প্রদীপ্ত কুমার বারিক, ওর অ্যাসিস্টেন্ট থেকে অ্যাসোসিয়েটের জট অজিত সিং ছাড়া কারো সাধ্য ছিল না খুলে দেয়। এইসব কেস কম করেও লাখ দু-এক ছাড়া নেয় না। কিন্তু এই কেসটাতে টাকা নেওয়া যাবে না। কারণ এই পিকেবিকে পার্টির দরকার। পার্টি মানে এখানে সে-ই। পিকেবিকে যদি কাউন্সিলে পাঠাতে পারে, তবে পেছন থেকে কলকাঠি সেই নাড়বে। কিন্তু চন্দন হারামিটা কী করছে এখনো? খিদেয় পেট চুঁই চুইঁ করছে তার। লোকে বলে ওপর দিকে উঠলে খিদে কমে যায় । তার তো দিনদিন খিদে বাড়ছে। আর শালা দাঁড়িয়েও আছে খাবার দোকানগুলোর সামনে। সবাই হাতে প্লেট ধরে গবগব করে খাচ্ছে। ইচ্ছে করলে সেও কিছু নিয়ে খেতে পারে। কিন্তু এখন খেলে খিদে মরে যাবে। ক্রিস্টাল চপস্টিকে ক্র্যাব কারিটা যা করে না! অজিতের জিভ ভিজে উঠল, লাল লাল কাঁকড়াগুলোর কথা ভেবে। আহা কী গার্নিশিং! যদি জানত চন্দন দেরি করবে, তবে দৈনিক কালকেতুর অফিস থেকে একটু দেরি করেই নেমে আসত। এন আর সি নিয়ে একটা লেখা যেন কাল যায়, সে ব্যাপারেই এসেছিল সে। যদিও এটা তার কাজ নয়, তার কাজ শুধু ইউনিভার্সিটি নিয়ে, তবু, দিনদিন তার যোগ্যতার কথা ছড়িয়ে পড়ছে বলে, তাকে এইসব অন্য কাজ টুকটাক করতে হচ্ছে। চাপ বাড়ছে, তবে এই চাপটা মোটের ওপর এনজয়ই করছে সে। কিন্তু এই খিদের চাপটা সে নিতে পারছে না। হারামিটা ফোনও ধরছে না। বললে দাঁত কেলিয়ে বলবে , ‘বাইক চালাচ্ছিলাম’। এই অপদার্থটাকে বাইক বাহিনীর নেতা করেছে পার্টি। আসলে মালটাকে হেব্বি লালু দেখতে। দেখে মনে হবে বাংলা সিরিয়ালের নায়ক। দু একটা খুন করলেও কেউ সন্দেহ করবে না। খুন অবশ্য ওকে করতে হয় না। পারবেই না। এখনো তো বেশিই আনতে হয় তাদের মুলুক থেকে সুপারি। আবার বড় বড় কথা। একটা খিস্তি করতে যাবে , অমনি ফোন বেজে উঠল। হারামিটা ফোন করছে। গলি থেকে দেখতে পেল অজিত। সানগ্লাসটা মাথার ওপর কায়দা করে তুলে বাইক দাঁড় করিয়ে ফোন করছে, আবার হাত নেড়ে ডাকছে ‘ অজিতদা অজিতদা’ এমনি কেউ অজিতদা বললে তার মটকা গরম হয়ে যায়। সে চায় সবাই তাকে সিং সাহেব বলুক, নিদেন পক্ষে সিং। সিং ইজ কিং।
(ক্রমশ)
পড়লাম। যেহেতু প্রথম পর্ব, তাই ভালোমন্দ কিছু বলা যাচ্ছে না।
পড়ছি।
শুরুটা ভালোই।
বেশ ভালই লাগলো। ভাষার সূক্ষ্ম একটা বাঁধুনি ধরা আছে লেখনীতে। পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা সুন্দর ফুটে উঠেছে।
বেশ ভালই লাগলো। ভাষার সূক্ষ্ম একটা বাঁধুনি ধরা আছে লেখনীতে। পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা সুন্দর ফুটে উঠেছে।
শুরু করলাম। প্রত্যাশা নিয়েই।