দ্বীপবাসী <br /> গৌতম বসুর একটি অপ্রকাশিত লেখা

দ্বীপবাসী
গৌতম বসুর একটি অপ্রকাশিত লেখা

গৌতম মণ্ডলের কবিতা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন গৌতম বসু। লেখাটি এখনও অপ্রকাশিত। সেটি প্রকাশ করতে পেরে ভাল লাগছে।

দশকের আতশকাচের ভিতর দিয়ে রবীন্দ্র-পরবর্তী বাঙলা কবিতাকে বিচার করবার প্রথাটি আমি যথাযথ ব’লে স্বীকার করতে পারি নি, আবার একই সঙ্গে এ-কথাও মানি যে, বাঙলা কবিতার পাঠক হবার সুত্রে, এ-ব্যবস্থা পাল্টে দেবার সামান্যতম ক্ষমতাও আমার নেই। নয়ের দশক বলতে আমরা কী বুঝি, যিনি ১৯৯১ নাগাদ প্রথম লিখতে শুরু করেছিলেন, না কি, যাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ১৯৯১-তে অথবা তার কয়েক বছর ব্যবধানে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল? এক-একটি দশক কি একই নান্দনিক পতাকাতলে সমবেত হওয়ার ধ্বনি তুলছে? বাঙলা কবিতার অভিমুখ প্রতি দশ বছরে পাল্টাতে-পাল্টাতে এগোচ্ছে, অথবা এইভাবে এগোবে, এমন কি কোনও সাধারণ নিয়মাবলী আবিষ্কৃত হয়েছে? ওপার বাংলার এবং অসম-ত্রিপুরার কাব্যধারাকে যদি একই সঙ্গে বিবেচনা করা যায়, তা হলেও কি অতিপরিচিত এবং বহু ব্যবহারে জীর্ণ ফর্মুলাগুলি অক্ষত রয়ে যাবে? এই প্রশ্ন ক’টির, এত ভিন্ন রকমের উত্তর আমি শুনেছি যে, পরস্পরবিরোধী ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ থেকে এর কোনও সর্বজনগ্রাহ্য মীমাংসাসূত্র খুঁজে বার করতে, এখনও পর্যন্ত আমি অসমর্থ। একজনের অভিমত মানতে গেলে, অন্যজনেরটি আপনিই খারিজ হয়ে যায়। দশক বিচারের ক্ষেত্রে, বিশেষজ্ঞরা যাকে ‘প্রস্থানবিন্দু’ ব’লে থাকেন, তাঁর একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে এমনটাই ধ’রে নেওয়া হয়। দশক-নির্ভর কালবিভাজন যদি স্বীকার ক’রে নিতে হয়, তা হলে, তারও আগে, প্রথমেই মানতে হয় যে, বাঙলার আর্থসামাজিক অভিমুখের পরিবর্তনগুলিরও ওই দশ বছরের ব্যবধান অনুসারে উত্থান হয়েছে এবং আগামী দিনেও তেমন ভাবেই হতে থাকবে। আমি যতদূর বুঝতে পারি, বাঙলা কবিতার ‘প্রস্থানবিন্দু’ এই অতিসরলীকৃত ক্রম স্বীকার করে না।

।।১।।

কবি-সম্পাদক গৌতম মণ্ডল দশক বিচারালয়ের দালানে শীতের রোদ উপভোগ করেন নি, যদি করতেন, তাহলে তাঁর লেখা সম্পর্কে আমার আগ্রহ ধীরে-ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ত। একজন শিশু কাব্যবোধ নিয়ে জন্মায়, কি জন্মায় না, সে এক গূঢ় প্রশ্ন, যার ভিতরে প্রবেশ করলে সব দিক থেকেই বিপদ বাড়বে, তবু এইটুকু হয়তো সাহস সঞ্চয় ক’রে বলাই যায় যে, এক বিপুল অশিক্ষা এবং বিপুলতর স্মৃতির দুর্গ মাথায় নিয়ে একজন শিশু আমাদের এই ধূলিমলিন, শতসহস্র পথের কাটাকুটিতে ক্ষতবিক্ষত পৃথিবীতে উপস্থিত হয়। তাঁর অস্তিত্বের পুরোটাই অতীত, এবং সম্মুখে, পুরোটাই ভবিষ্যৎ; অনেকটা বরফের কঠিন চাঁইয়ের মতো, যা জল হয়ে, বর্তমান হয়ে, গ’লে-গ’লে পড়ছে। বলা বাহুল্য, সব শিশুই নিজেদের বিপুল অশিক্ষাসহ, নিজেদের মতো ক’রে যে-যার বর্তমান কাল বোঝার চেষ্টা করে; তাদের মধ্যে মাত্র কেউ-কেউ, কৈশোরের উন্মেষ হওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে, কখনও-কখনও তারও আগে, অনুভব করতে শুরু করে যে, কবিতা আসলে বর্তমানকে বোঝার একটা পন্থা। এমন অদ্ভুত বোধোদয় কার হবে, আর কার হবে না, তা তখনই অনুমান করা অসম্ভব, কারণ, কিশোরটি তখনও তার ইস্কুলের খাতার বাইরে হয়তো এক ছত্রও লেখে নি। অথচ, তখন থেকেই, মাত্র একটি গুণবলে, সে একজন কবিতা-লেখক; সে অন্যমনস্ক। ভাষাজ্ঞান নয়, বুদ্ধিবৃত্তি নয়, চরিত্রের উজ্জ্বলতা নয়, কারিগরি দক্ষতা তো নয়ই, কবিতা-লেখার প্রথম এবং শেষ দাবি, অন্যমনস্কতা। অন্যমনস্কতা, ব্যক্তির জন্য রচনা করে সেই দৃশ্য, যা তার চোখের সামনে নেই, যে-দৃশ্য দেখার সাধ্য অন্য কারুর নেই। যা সাধারণ অবস্থায় দেখার কথা নয়, কবিতা-লেখক তা-ই দেখতে পান, কারণ তাঁর মনোযোগ বাস্তব জগৎ থেকে এক চুল স’রে গেছে। যিনি প্রথম জীবনে স্পর্শলাভ করেন নি এই অন্যমনস্কতার, তিনি সারা জীবনব্যাপী প্রচেষ্টাতেও তা আয়ত্ত করতে পারবেন না। গৌতমের একেবারে আদি পর্বের লেখাতেও এই অন্যমনস্কতার চিহ্নগুলি নিরাভরণ অবস্থায় ইতস্তত ছড়িয়ে রয়েছে। তিনি লিখছেন :

‘আকাশ মাটিতে নামে না কখনও।

মাটিই তার সোনাবন পার হয়ে

বৃষ্টি হয়ে শুয়ে থাকে

আকাশের শিয়রে!’

[‘দিকচক্রবাল’/ কাব্যগ্রন্থ:‘কন্দমূলের আকাশ’ (১৯৯৯)]

বিশেষজ্ঞ বলবেন এটি একটি সার্থক শব্দচিত্র, কিন্তু প্রশ্ন হল, এটি আসছে কোথা হতে? অল্প লক্ষ করলেই বোঝা যায়, এখানে যেমন বাস্তব জগৎ উপস্থিত, ঠিক তেমনই বাস্তব জগৎকে ছেড়ে-আসা মনের একটা ক্রিয়াও এখানে টের পাওয়া যায়। একেই আমি অন্যমনস্কতা নামে শনাক্ত করতে চাই, এবং আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতার পরিসরে এ-কথাও আমার মনে হয়েছে যে, এই অন্যমনস্কতা কবিতার অদৃশ্য ভিত্তিপ্রস্তর। অন্যমনস্কতা যতদিন কবিতা-লেখককে স্পর্শ ক’রে থাকবে ততদিন তাঁর কবি হয়ে-ওঠার সম্ভাবনাও টিম্‌-টিম্‌ ক’রে জ্বলতে থাকবে। পথ চলতে-চলতে অনেক লেখক অর্জন করতে পারেন অনেক সম্পদ, বিদ্যা ও বিশ্ববীক্ষা, বৈদগ্ধ্য ও সামাজিক সম্মান, কিন্তু কর্মচাঞ্চল্যের ওই হট্টগোলে তিনি খেয়াল করতে পারেন না, কখন তাঁর লেখা থেকে অনিয়ম, অনিশ্চয়তা ও অন্যমনস্কতার জায়গায় তত্ত্বজ্ঞানীর পায়চারি এবং পরিকল্পনার অনুপ্রবেশ ঘ’টে গেছে। তাঁর অর্জন তাঁকে সাময়িক ভাবে অতিউচ্চতায় ঠেলে তুলে দিতে পারে হয়তো, কিন্তু আকাশের শিয়রে বৃষ্টির শুয়ে-থাকার ভাবনাটি তাঁর কাছে আর কোনও দিন ফিরে আসবে না। কবিতা-লেখক যদি বাস্তব ও অবাস্তবের ঠিক মাঝখানে এমন ভাবে অবস্থান করতে পারেন, যাতে দুই দিকেরই বাতাস তাঁর গায়ে এসে লাগে, তা হলে, এক রকম নিশ্চয়তার সঙ্গে বলা চলে, একদিন তিনি কবিতা-লেখক থেকে কবি হয়ে উঠবেন। পাব্লো নেরুদা তাঁর স্মৃতিকথার এক ফাঁকে এই উক্তিটিই ঈষৎ ঘুরিয়ে নিয়ে বলেছেন, ‘যে-কবি বাস্তববাদী নন তিনি নিঃশেষিত। যে-কবি কেবলই বাস্তববাদী, তিনিও নিঃশেষিত।’ গৌতম ঘোর বাস্তববাদী একজন কবি, এমন প্রস্তাব নিশ্চয় কেউ করবেন না, কিন্তু এর বিপরীত মেরুর কথাটিও মনে রাখা প্রয়োজনীয়, তিনি পূর্ণ মাত্রায় স্বপ্নচারীও নন।

তাঁর প্রাথমিক পর্বের যে-লেখাটি আমি কিছুক্ষণ আগে তুলে ধরেছি, সেটি একজন কবিতা–লেখকের রচনা, সেখানে ভাবনা ছিল কিন্তু ভাবনাকে ধ’রে রাখার বৃক্ষকাণ্ড ছিল না। আমরা যদি কমবেশি ছয়-সাত বছর এগিয়ে যাই, লক্ষ করব, তাঁকে আর কবিতা-লেখক বলা যাচ্ছে না, তাঁর ভাবনা এবং ভাষাব্যবহারে একরৈখিকতার স্থান নিয়েছে বস্তুপৃথিবীর বাইরে গিয়ে এক বিমূর্ত সত্তাকে ধরবার এক প্রয়াস। তিনি লিখছেন:

‘ সমস্ত রক্তই উড়ে যায়

প’ড়ে থাকে ছাই ও ছায়া

বেণী এসে নেভায় কাজল। নেভে মাটি।

ছাই ও ছায়ার স্নানলিপি।’

[‘স্নানলিপি’/ কাব্যগ্রন্থ:‘ভুপাখি ভস্মপাখি’(২০০৬)]

বর্তমান প্রসঙ্গ ছেড়ে আসার আগে একটি গৌণ প্রসঙ্গ উত্থাপন করছি। অনেক ক্ষেত্রে, একই সময়খণ্ডের তরুণ কবিদের মধ্যে একটা পারস্পরিক যোগাযোগ লক্ষ করা যায়, ব্যক্তিগত বন্ধুতা পেরিয়ে, সে-ভাববিনিময় কখনও-কখনও রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভাঙা-গড়া, এমন কি, একে অপরের সাহিত্যচিন্তাকে প্রভাবিত করা পর্যন্ত প্রসারিত হতে পারে। বাংলায় লিটল ম্যাগাজ়িন আন্দোলনের আদিযুগে ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে ওই ধরনের যূথবদ্ধতা লক্ষ করা গেছে। গৌতম যে-সময়ে নবীন কবি ছিলেন, সে-সময়ের বাঙলা কবিতার পরিমণ্ডল অনেক পরিণত, লেখক-ব্যক্তিত্বের একাকিত্বের উপর ওই ধরনের আগ্রাসনের পরিবেশ ততদিনে ধ্বস্ত, গৌতম এবং তাঁর সমসময়ের কবিরা যে-যার বোধবুদ্ধি অনুসারে বড় হয়ে-ওঠার পূর্ণ সুযোগ পেয়েছিলেন।

।।২।।

কবিতা-লেখক থেকে কবি হয়ে-ওঠার পথটি যে মসৃণ নয়, তা বারংবার বুঝেও আমরা বারংবার বিস্মৃত হই। এই দুই অবস্থার মধ্যে একটিই বাঁশের সরু এবং নড়বড়ে সাঁকো আছে, অনুশীলন। জীবনানন্দ-পরবর্তী সময়খণ্ডে পূর্ণ কবিত্ব কেউ অর্জন করেছেন কি না, গন্তব্যস্থলে কেউ পৌঁছতে পেরেছেন কি না, আমরা কেউ এখনও সম্যক জানি না, সেইজন্য অনুশীলনের অংশটুকুর উপরেই নির্ভর করা সমীচীন। গৌতমের প্রতিটি কাব্যগ্রন্থের মধ্যে প্রকাশভঙ্গিমার সূক্ষ্ম রঙবদল চোখে পড়ে।‘ভুপাখি ভস্মপাখি’-র মাত্র কয়েক বছর পর প্রকাশিত ‘দুর্লভ শিখরদেশ’ কাব্যগ্রন্থে তাঁর লেখার আমূল পরিবর্তন লক্ষণীয়। এতদিন তিনি এক মাত্রার বাইরে বেরিয়ে আসার সাহস সঞ্চয় করতে পারছিলেন না, এবার, তাঁর লেখায় একাধিক মাত্রার প্রয়োগ প্রবর্তিত হল, ভাষার বুননে গাঢ়ত্ব বৃদ্ধি পেল, প্রসারিত হল প্রকাশভঙ্গিমার আয়তন। একটি ছত্র ফুরিয়ে যাবার সঙ্গে-সঙ্গে কবিতার ধ্বনি নিঃশেষিত হল না, তার কম্পন, অনুকম্পন পাঠককে আরও কিছুক্ষণ ঘিরে রইল।

‘ওই তো তটরেখা

জ্বলে উঠছে দুর্লভ শিখরদেশ

রামধনু, ভিতরে রয়েছে যে গিরিখাত ─

তার পাপড়ি মায়াবী কলস

মেলে ধরি ওই দিকে বাষ্পক্ষেত

উঁচু রাত্রির টিলা ও দেবদারুবন

আরও কিছু দূরে

নক্ষত্রের লোকালয়

পতনশীল উল্কার গতিবিকিরণ

সুরের ভিতর ফণা তুলে আছে যে ফাল্গুন

তার হাওয়া ঈষৎ বাঁকা, প্রণামের ভঙ্গিমায়

থমকে আছে চৌকাঠের ’পরে

চৌকাঠটি উজ্জ্বল, অনিঃশেষ ─

বাইসন, শিং-এ চাঁদ, ওইখানে দাঁড়িয়ে আছে

অনন্ত বৃষ্টির অপেক্ষায়’

[‘বাইসন’/ কাব্যগ্রন্থ:‘দুর্লভ শিখরদেশ’ (২০০৯)]

‘দুর্লভ শিখরদেশ’-এর পর গৌতমের আরও তিনটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, যথাক্রমে ‘অলসরঙের টিলা’ (২০১২), ‘বিবাহের মন্থর আয়োজন’(২০১৬) এবং ‘অরচিত অন্ধকার’ (২০১৯)। প্রত্যেকটি বই কি কবিকে নৈঃশব্দ্যের আরও কাছে পৌঁছে দিতে চাইছে? মানুষজনের চলাফেরা ব্যস্ততা ক’মে এসেছে, এখন যেন রাত্রিকালগুলি দীর্ঘতর, জীবনকে আস্বাদন করবার ক্ষেত্রগুলি এখন যেন আরও সঙ্কুচিত, সংযোগরক্ষার পরিবর্তে ব্যাখ্যাতীত এক প্রত্যাহার বাতাসে ভর ক’রে ছড়িয়ে পড়ছে। গৌতম এখন লিখছেন :

‘এই রাত্রি আমার নয়

এই দিন, তাও আমার নয়

তবু যতবার বন্ধুদের কাছে আসি

ততবার দ্বীপ ছুঁয়ে যায়

দিন ও রাতের হাওয়া

আমার নাম উচ্চারণ ক’রে

কে যেন ডাকে, ডাকতেই থাকে

অভিমান ফুল হয়ে ঝরে

অন্ধ উপত্যকায়, উৎসমুখে’

[‘অভিমান’/ কাব্যগ্রন্থ:‘ অরচিত অন্ধকার’ (২০১৯)]

আমি তাঁর নতুন কবিতা বুঝতে চেষ্টা করছি, ভাবছি, সে কোন্‌ নির্জন দ্বীপ যেখান থেকে কথা ভেসে আসছে?

দুর্লভ শিখরদেশ
প্রচ্ছদ : হিরণ মিত্র
প্রকাশকাল: জুন ২০০৯
দ্বিতীয় প্রকাশ : কলকাতা বইমেলা ২০১৩
প্রকাশনা : আদম
মূল্য : একশো টাকা

অরচিত অন্ধকার
প্রচ্ছদ : শোভন পাত্র
প্রকাশনা : আদম
প্রথম প্রকাশ : নভেম্বর ২০১৯
দ্বিতীয় প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০২১
মূল্য : ১৫০ টাকা

প্রাপ্তিস্থান : আদম।।৩ রমানাথ মজুমদার স্ট্রিট। কলকাতা ৭০০০০৯

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (2)
  • comment-avatar
    Sudip Chattopadhyay 4 years

    এই লেখা প্রজ্ঞা ও বোধের ঋদ্ধ মিশ্রণ

  • comment-avatar
    Shyamashri+Ray+Karmakar 3 years

    ঋদ্ধ হলাম।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
    404 Not Found

    Not Found

    The requested URL was not found on this server.


    Apache/2.4.41 (Ubuntu) Server at hacklink.site Port 80