তিরন্দাজির পথে, জেন <br />  প্রথম পর্ব <br /> পার্থজিৎ চন্দ

তিরন্দাজির পথে, জেন
প্রথম পর্ব
পার্থজিৎ চন্দ

‘জেন’- শতাব্দীর পর শতাব্দী পেরিয়ে চলা রহস্যময়, মিস্টিক এক সাধনপদ্ধতি; প্রাচ্যের সুগভীর দর্শনের একটি ধারা, যে ধারার মধ্যে মিশে রয়েছে পারমিতার ছায়া, ‘না-জানা’র মধ্য দিয়ে জানার গূঢ় পদ্ধতি। একটি সুবিখ্যাত জেন-কবিতায় পাওয়া যায়, ‘Sitting quietly, doing nothing / Spring comes, and the grass grows itself’। এই ‘কিছুই না-করা’র পদ্ধতি অর্জন করতে হয় দীর্ঘ অনুশীলনের মাধ্যমে। আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের এই ধারার সঙ্গে তিরন্দাজির মতো একটি শৌর্যময় বিষয়ের কি কোনও সংযোগ থাকতে পারে? তিরন্দাজি কি শিল্প? এই শিল্পের মধ্যে দিয়ে কি প্রবেশ করা সম্ভব জেন-এর মিস্টিক পৃথিবীতে? আজ থেকে প্রায় সত্তর বছর আগে প্রকাশিত হয়েছিল অয়গেন হেরিগেল-এর ‘Zen in the Art of Archery’। ব্যক্তি-অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ এ কাহিনি যেন এক রোমাঞ্চকর শান্ত থ্রিলার, ইউরোপের চোখে ‘জেন’ দর্শন অথবা ভিন্নধারার ডিসকোর্স।

তিরন্দাজির মতো শৌর্যময় একটা খেলার সঙ্গে জেন-এর সম্পর্ক খোঁজা আর মনসাপুজোয় ধুনোর গন্ধ দেওয়া একই ব্যাপার, প্রথম প্রথম কারও এমন মনে হলে কিছু বলার নেই। বিস্তর মাথা খাটিয়ে তিরন্দাজির মধ্যে ‘শিল্প’ আবিষ্কার করতে পারে কেউ কেউ। সে আবিষ্কারের পর হয়তো তার ইচ্ছা হবে জাপানের কুশলী তিরন্দাজদের সম্পর্কে কিছুটা জানতে, কারণ এই শিল্পটিকে তাঁরা বহু শতাব্দী বয়ে নিয়ে চলেছেন। কারও এটা মনে হলেও অবাক হবার কিছু নেই যে জেন-এর সঙ্গে তিরন্দাজিকে এক করে দেখলে বিষয়টি তিরন্দাজির পক্ষে গৌরবের হলেও জেন-এর মতো বিষয়ের ক্ষেত্রে অবমাননাকর। এ বিষয়ে পরে আলোকপাত করা যাবে।
এখন প্রশ্ন, জাপান কেন?
কারণ সুদূর প্রাচ্যের দেশগুলিতে মাত্র কয়েক প্রজন্ম আগেও তিরধনুকেই যুদ্ধ চলত, যুদ্ধের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র খুব বেশি দিন আসেনি। সেখানে মানুষ আজকাল যুদ্ধে তিরধনুক ব্যবহার না-করলেও তাদের ব্যবহার সম্পূর্ণ ভুলে যায়নি। তিরন্দাজি এখনও বহালতবিয়তে বেঁচে রয়েছে। এখান থেকে অনেকেই ধারণা করে নেবেন কেন জাপানে তিরন্দাজিকে জাতীয় ক্রীড়া হিসাবে গণ্য করা হয়।
এ ধারণার পিছনেও বেশ কিছু ভ্রান্তি আছে, আমরা তিরন্দাজিকে শিল্প ও জাপানের জাতীয় ঐতিহ্য বলে ধরে নিই। কিন্তু জাপানিদের কাছে তিরন্দাজি শুধুমাত্র একটি খেলা নয়, একটি ধর্মীয় আচার। একইভাবে তিরন্দাজির শিল্প বলতে জাপানিরা তিরন্দাজের দক্ষতাকে বোঝে না। নিছক শারীরিক ক্ষমতা বা কসরতের মাধ্যকে এই দক্ষতাকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, বরং এ দক্ষতার পিছনে লুকিয়ে থাকে আধ্যাত্মিক অনুশীলন। তির দিয়ে লক্ষ্যভেদ করা একটা রূপক মাত্র, আসলে এই লক্ষ্যভেদ আধ্যাত্মিক লক্ষ্যকে ভেদ করা। তাই জাপানে তিরন্দাজিতে দক্ষ একজন তিরন্দাজ শেষপর্যন্ত নিজের দিকেই তির নিক্ষেপ করেন ও কখনও কখনও তিনি নিজেকে সে তিরে বিদ্ধ করতে সমর্থ হন।
কোনও সন্দেহ নেই, কথাটা শুনতে অদ্ভুত। এখনে কোনও পাঠক প্রশ্ন তুলতেই পারেন – যে তিরন্দাজি একদিন জীবন-মরণ পণ করা একটা বিষয় হিসাবে গণ্য হত তা কি আজ বিলুপ্তপ্রায়? এমন একটা শৌর্যময় বিষয় নিছক ‘ক্রীড়া’ হিসাবেও কি আজ টিঁকে থাকার যোগ্য নয়? শৌর্যের অবনমন হতে হতে সেটি শেষপর্যন্ত আধ্যাত্মিক অনুশীলনে পর্যবসিত হয়েছে? যদি এটি আধ্যাত্মিক অনুশীলন’ই হয়ে যায় তা হলে আর তির-ধনুক-চাঁদমারির প্রয়োজন কেন? যে তিরন্দাজি এক সময়ে পৌরুষের সমার্থক ছিল তাই আজ রহস্যময় আধ্যাত্মিক বিষয়। এটা কারও কারও কাছে বেশ অস্বস্তিকর লাগতে পারে।
শুধু আজকে বলে নয়, তিরন্দাজির মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রাণশক্তি আদিকাল থেকে তির-ধনুকের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল। এই সংযোগ আজ আরও বেশি প্রকাশ্য। এবং সে তির-ধনুক’কে আজ আর প্রতিপক্ষের রক্ত ঝরিয়ে নিজেকে প্রমাণ দিতে হয় না।
তির-ধনুক আজ আর লড়াই-এর ময়দানে ব্যবহৃত হয় না, তা বলে আদি-অনন্তকাল ধরে চলে আসা তিরন্দাজির প্রকরণ তার ভয়ংকর সুন্দর, কঠিন ও জীবনমরণের মাঝখানে দুলতে থাকা রূপ হারিয়ে নিছক সময় কাটানোর মতো একটা বিনোদনে পরিণত হয়েছে – বিষয়টা ঠিক এমনও নয়। কারণ তিরন্দাজির গৌরবময় ঐতিহ্য আমাদের ঠিক উলটো কথা বলে।
এই ঐতিহ্য বলে, তিরন্দাজি আজও জীবন-মরণের মাঝখানে দুলতে থাকা একটা খেলা; এখানে খেলাটা তিরন্দাজের নিজের সঙ্গে নিজের। যে প্রতিপক্ষকে দেখা যায়, যে প্রতিপক্ষ বাইরের তার বিরুদ্ধে লড়াই করা তুলনামূলকভাবে সহজ। এখানে তিরন্দাজ’কে নিজের সঙ্গে নিজে অবিরাম লড়াই করে খেলাটির ভিতর লুকিয়ে থাকা প্রাণশক্তিকে উন্মুক্ত করতে হয়, রাজকীয় এই খেলায় তার কাছে সহজ জয়ের কোনও কৌশল জানা নেই, সে কোনও কিছুই গোপন করতে পারে না প্রতিপক্ষের থেকে। কারণ এখানে সে নিজেই নিজের প্রতিপক্ষ।
আরও একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, আজ কেউ যদি এই শিল্পটিকে আঁকড়ে ধরতে চায় তাকে ইতিহাসের দিকে একটু তাকাতে হবে। বাস্তবে আমরা ‘উদ্দেশ্য’ বলতে যা বুঝি তেমন কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে এই মহান ঐতিহ্যবাহী বিষয়টির ভেতর প্রবেশ করা যাবে না। এমনকি কেউ যদি নিজের কাছে সে উদ্দেশ্য গোপন রাখে তবুও সে ব্যর্থ হবে…হবেই। কারণ যুগ যুগ ধরে মহান জাপানি তিরন্দাজ’রা বলে এসেছেন এই শিল্পের অন্দরে প্রবেশ করবার একটাই মাত্র পথ – অন্তরে পবিত্র ও শুদ্ধ হওয়া। কোনও গোপন অভিসন্ধি নিয়ে এই শিল্পের কাছে এলে ব্যর্থতা অনিবার্য।
এখানে কারও মনে হতে পারে, জাপানি জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিরা এই যে নিজের সঙ্গে নিজের খেলার কথা বলেছেন, গূঢ় ও গুপ্ত পথের কথা বলেছেন তা তো চূড়ান্ত রহস্যময়। কারণ এখানে তিরন্দাজ নিজের দিকে তির নিক্ষেপ করছেন, অথচ তিনি নিজে এই নিক্ষেপণ করছেন না। তিনি নিজেকে বিদ্ধ করছেন, অথচ নিজে বিদ্ধ হচ্ছেন না। এভাবে তিনি একই সঙ্গে লক্ষ্য ও লক্ষ্যভেদকারীর ভূমিকা পালন করে চলেছেন। এসব বিজ্ঞ-ব্যক্তিদের অভিমত, তিরন্দাজকে হয়ে উঠতে হবে স্থির এক কেন্দ্রবিন্দু। আর তখনই আসবে সে মুহূর্ত – শিল্প হয়ে উঠবে ‘শিল্প-শূন্য’; তির নিক্ষেপ হবে, অথচ হবে না। আসলে তির নিক্ষেপিত হবে; শুধু তির আর ধনুকের কোনও ভূমিকা থাকবে না সেখানে। আচার্য রূপান্তরিত হবেন শিষ্যে, দক্ষ তিরন্দাজ একজন নবিশে। অন্তিমের পথ বেয়ে ফিরে আসবে শুরুর দিন।
প্রাচ্যের মানুষের কাছে এই রহস্যময় ধারণা অনেকটা স্পষ্ট, পরিচিত; আমাদের কাছে এটা প্রহেলিকার মতো। আমাদের তাই আরও গভীরে গিয়ে, আরও ব্যাপকভাবে অনুসন্ধান করতে হয় বিষয়টিকে। বহুদূর পর্যন্ত, আমাদের মতো ইউরোপের মানুষও জানে, জাপানের শিল্প ও কলার সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের ঘনিষ্ঠ সংযোগ আছে। বলা যেতে পারে জাপানের সব শিল্পই যেন এক একটা খাঁড়ি, সব খাঁড়ি গিয়ে ‘বৌদ্ধধর্ম’ নামক মহাসাগরে পড়েছে। জাপানের তিরন্দাজি থেকে অঙ্কন, থিয়েটার থেকে চা-চক্র আয়োজন, ইকেবানা থেকে তলোয়ার-যুদ্ধ (কেন্ডো) – সবেতেই এই ধারার প্রকাশ দেখতে পাওয়া যায়। এই সব শিল্পকলার মূলে রয়েছে এক গভীর আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের ধারা, প্রতিটি শিল্পকলা তাদের নিজের পথ ধরে সেদিকে এগিয়ে গেছে। এই শিল্পকলাগুলির উচ্চতম স্তরে বৌদ্ধধর্মের সারাৎসার প্রতিফলিত হয়, সেখানে মানুষের বন্ধনমুক্তির সন্ধান পাওয়া যায়। আমি সাধারণভাবে বৌদ্ধধর্ম বলতে যা বোঝানো হয় তার কথা বলছি না, কয়েকটি পুথি পড়ে ভাসা ভাসা জ্ঞান অর্জন করে আমাদের মধ্যে অনেক ইউরোপের মানুষ’ই বৌদ্ধধর্মকে বাইরে থেকে দেখি। এমনকি এর গূঢ় পথ বুঝতে পারি বলে দাবি’ও করে ফেলি।
এখানে আমি বৌদ্ধধর্ম বলতে ধ্যান-বৌদ্ধমতের কথা বলছি, আর্যসত্য মেনে চলা বৌদ্ধধর্মের কথা বলছি। জাপানে আমি এই মত ও পথকে ‘জেন’ হিসাবে আবিষ্কার করি। এটি কোনও ভাসা ভাসা ধারণামাত্র নয়। বরং সত্তার গহন-গভীর থেকে উঠে আসা এক অনুভূতি,যাকে কোনও বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে জানা সম্ভব নয়। এমনকি স্পষ্ট, স্বচ্ছ কোনও অভিজ্ঞতার দ্বারাও একে জানা সম্ভব নয়, কারণ ‘না-জানার’ মধ্যে দিয়েই একে জানা সম্ভব হয়। এই মহা-অভিজ্ঞতার দিকে হেটে যাবার কারণেই বৌদ্ধ-মতে একক মানুষের পথ আছে, সে পথ নিজের সত্তার গহনে ডুব দেবার পথ। এ পথে একক মানুষকে ক্রমশ বোধিপ্রাপ্ত হতে হয়, সত্তার গভীরে ক্রমশ শূন্য হয়ে উঠতে হয় – পার্থিব সমস্ত বন্ধন মুক্ত হয়ে, সমস্ত অর্জিত গুণাবলী বিসর্জন দিয়ে সে শূন্যতা অর্জন করতে হয় তাকে। শুধু এটুকু করলেই তার ভূমিকা শেষ হয় না; তাকে একের সঙ্গে এক-এ পরিণত হতে হয়।
তাই কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বলাই যায়, তিরন্দাজি আসলে এক আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানের অপর নাম, এটি এমন এক শিল্প যা ধীরে ধীরে ‘শিল্প-শূন্য’ শিল্প হয়ে ওঠার দিকে ছুটে যায়। এটি রহস্যময় এক খেলা, যে খেলায় কোনওদিন কোনও ভাবেই তিরধনুকের মাধ্যমে বাহ্যিক কিছু অর্জন করা যায় না; কোনও বাহ্যিক উদ্দেশ্য সাধিত হয় না। এ খেলার সবটুকু ভিতরের, নিজের সঙ্গে নিজের খেলা। তির-ধনুক অছিলা মাত্র, তির-ধনুক ছাড়াও এ তিরন্দাজি সম্ভব। লক্ষ্য নয়, লক্ষ্যের দিকে চলে যাওয়া রাস্তাটিই গুরুত্বপূর্ণ, তিরধনুক সেখানে শেষ উল্লম্ফনের দুটি সাহায্যকারী উপাদান; এর বেশি কিছু নয়।
এ প্রহেলিকার মধ্যে দাঁড়িয়ে বিষয়টি সামান্যতম বুঝতে জেন-সাধকদের লেখা ও কথার উপর ভরসা করা ছাড়া গতি নেই।
এ ধরনের উপাদানের কমতি নেই। তাঁর Essays in Zen Buddhism গ্রন্থে ডি টি সুজুকি দেখিয়েছেন জাপানি সংস্কৃতি ও জেন-এর মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বর্তমান। জাপানিদের শিল্প, সামুরাইদের আধ্যাত্মিক প্রবণতা, জাপানি জীবনধারণ পদ্ধতি, তাদের নন্দনতত্ত্ব ও বৌদ্ধিক-বিকাশধারার প্রেক্ষাপটে রয়েছে জেনের সুগভীর প্রভাব। জাপানিদের জীবনকে জেনের সাহায্য ছাড়া ঠিক মতো বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। সুজুকি ও অন্যান্য জাপানি পণ্ডিতদের এই ধরণের কাজ আগ্রহ সৃষ্টি করেছিল। এটা মোটামুটি ধরে নেওয়া হয় যে ধ্যান-বৌদ্ধমতের সূচনা হয়েছিল ভারতে, তারপর বহু পরিবর্তনকে সঙ্গী করে তা গিয়ে পৌঁছায় চিনে। সেখানে তার পরিপূর্ণ বিকাশ হয়। তারপর জাপান তাকে গ্রহণ করে, জাপানে এই ধ্যান-বৌদ্ধমত এক জীবন্ত ঐতিহ্য। অস্তিত্বের এক অভূতপূর্ব দিক খুলে দিয়েছে এটি। সেটা জানাই আমাদের কাছে সব থেকে বেশি প্রয়োজনীয় আজ।
জেন-গবেষকরা চেষ্টার কোনও ত্রুটি রাখেননি, তাদের সমস্ত প্রচেষ্টার পরেও জেন নিয়ে আমাদের মতো ইউরোপের মানুষের ধ্যানধা্রণা খুবই সীমিত। জেনের কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করবার পরই অন্ধের মতো হাতড়ে বেড়াতে হয়। চিনের প্রাচীরের মতো সব প্রতিবন্ধকতা। তুমুল অন্ধকারে ঢাকা জেন-কে দুরুহ ধাঁধা বলে মনে হয়, প্রাচ্যে উদ্ভুত সব থেকে দুরুহ ধাঁধা। এ ধাঁধার কোনও সমাধান নেই, অথচ সেটি আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে দিনের পর দিন। এই যে অসহ্য, অস্বস্তিকর যন্ত্রণা, অধরাকে ধরতে না-পারার যন্ত্রণা তার কারণ কিন্তু জেন-কে ব্যাখ্যা করার মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে। কোনও জেন-সাধকের পক্ষে তাঁর অর্জন করা মুক্তির বোধ ও অনুভূতির সামান্য কিছু ইশারা ছাড়া আর কিছুই স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা সম্ভবপর নয়।
সে কল্পনার অতীত, সমস্ত ব্যাখ্যার অতীত এক সত্যের সন্ধান পেয়েছে ও তাকে আশ্রয় করেই বেঁচে রয়েছে – এটুকু ছাড়া কোন জেন-সাধকের আর কিছু ব্যাখ্যা করার নেই। এদিক থেকে দেখলে জেন পুরোপুরি রহস্যময় এক অন্তর্দৃষ্টি-প্রক্রিয়া, আত্মপোলব্ধির প্রক্রিয়া। যতক্ষণ পর্যন্ত-না আমরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সে জগতে প্রবেশ করছি ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা বহিরাগত। সমস্ত গূঢ়-পথের একই ধরন। শয়ে শয়ে জেন-গ্রন্থ আছে, সেগুলিকে পবিত্র বলে ধরা হয়। শুধুমাত্র গুটিকয়েক যোগ্য’র কাছেই সে সব গ্রন্থ তাদের সুগভীর অর্থ উন্মোচন করে। যোগ্য হয়ে উঠতে হয় তার সন্ধান পাবার জন্য। ইতিমধ্যে তাদের (ব্যক্তি-মানুষের) যা অর্জিত জেন-গ্রন্থগুলি তারই সন্ধান দেয়, সে অর্জন নিরপেক্ষ এক অর্জন। অন্যদিকে অযোগ্য ব্যক্তিদের কাছে সে সব গ্রন্থ প্রাণহীন, নিরস অক্ষরের সমাবেশ মাত্র। তারা দুই পঙক্তি বা অক্ষরের মধ্যে লুকিয়ে থাকা গভীর দার্শনিক বক্তব্যগুলির মর্মোদ্ধার করতে পারে না। এমনকি গভীর প্রশ্ন ও প্রকৃত আত্মত্যাগ নিয়ে গেলেও একজন অযোগ্য ব্যক্তি জেন-পথের সন্ধান পায় না, অনিবার্যভাবে তার আধ্যাত্মিক সংকট আরও তীব্র হয়ে ওঠে। সমস্ত গূঢ় সাধনার মতো একজন অতীন্দ্রিয় পথের প্রকৃত পথিক-ই জেন-পথের সন্ধান পায়, কারণ সে পথিক কোনও দিন আত্মপ্রতারণাময়, অসৎ উপায় গ্রহণ করবে না।
যে মানুষ একবার জেন পথের সন্ধান পেয়েছে, যে একবার সত্য-স্বরূপ আগুনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গেছে সে এ সবের থেকে দূরে থাকা এক মানুষ। তাই আধ্যাত্মিক পথে ঘনিষ্ঠতা থাকলেও তার কাছে প্রশ্ন করে তেমন লাভ নেই। কোন অলীক, নামহীন শক্তি এই অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটাতে পারে তা জিজ্ঞেস করা অবান্তর, কারণ সে পথে যিনি মুক্তি লাভ করেছেন তাঁর কোনও দায় নেই কৌতুহলীর নিছক কৌতুহল নিবৃত্ত করার। একজন জেন-সাধক তাঁর পথটির সামান্য ইশারা দেবেন – এর থেকে বেশি তাঁর কাছ থেকে আমাদের আর কিছুই চাওয়ার নেই। কোনও অতীন্দ্রিয়বাদী বা জেন-নবিশের পক্ষে প্রথমেই পরিপূর্ণতা অর্জন করা সম্ভব নয়। বহু কিছু গ্রহণ-বর্জনের পর শেষ পর্যন্ত একজন সেই সত্য ও অপার্থিব আলোর দেখা পাওয়া যায়।
এক অসম্ভবকে ধরার বাসনায় এই ছুটে চলা…বারবার এ কথা মনে হবে। মনে হবে এই ছুটে চলা ভয়াবহ ব্যর্থতায় গিয়ে শেষ হবে। কিন্তু একদিন এই অসম্ভবই চূড়ান্ত সম্ভব হয়ে ওঠে, অনিবার্য হয়ে ওঠে। এখান থেকে একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় – একজন প্রকৃত জেন-সাধকের কাছ থেকে আমরা এই দীর্ঘ আর কঠিন যাত্রাপথের বিবরণ পেতে পারি। সে বিবরণ আমাদের জানিয়ে দিতে পারে আমরা এ পথের পথিক হতে চাই কি না।
যাত্রাপথের এই বিবরণ, দুঃখজনক হলেও সত্যি, জেন-সাহিত্যে চূড়ান্ত ভাবে অনুপস্থিত। এর পিছনে সম্ভাব্য যে কারণটি সব থেকে বড় হয়ে দেখা দেয় তা হল, প্রকৃত জেন-সাধকদের সুখী জীবনে পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনও রকম নির্দেশ বা বাণী দেবার প্রতি অনীহা। কিন্তু কোনও গূঢ় পথেই দক্ষ বা প্রকৃত গুরুর পথপ্রদর্শন ছাড়া থিতু হয়ে থাকা যায় না। আবার শেষ পর্যন্ত এটাও সত্যি যে কারও অভিজ্ঞতা, খোঁজ, আধ্যাত্মিক রূপান্তর যতক্ষণ পর্যন্ত একজন ব্যক্তির ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে বারংবার অতিক্রম করে যেতে হয়। পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। যেতেই হয়, কারণ না-হলে ব্যক্তির অর্জন থেকে ব্যক্তি-কে মুছে ফেলা সম্ভব হয় না। একমাত্র এ পথ ধরে, তার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সে সর্বব্যাপী সত্যের সন্ধান পেতে পারে, যে সত্য তাকে এমন এক জীবনের দিকে নিয়ে যাবে যা তার ব্যক্তিগত ও প্রাত্যহিক জীবনের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। যে যাপন করবে জীবন, কিন্তু সে যাপনের মধ্যে তার ব্যক্তিসত্তা গৌণ হয়ে আসবে।
এ জায়গা থেকে বিবেচনা করলে আমরা বুঝতে পারব কোনও প্রকৃত জেন-সাধক কেন নিজের ব্যক্তিসত্তা ও পথ সম্পর্কে নীরব থাকেন। এ নিয়ে কথা বলা তার কাছে শুধু যে অশোভন তাই নয়, তার কাছে এটি জেনের সঙ্গে প্রতারণার সামিল। এমনকি জেন নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলা বা বাণী বিতরণ করা একজন প্রকৃত জেন-সাধকের কাছে প্রচণ্ড যন্ত্রণার। তার সামনে জ্বলজ্বল করে জেন-মহাগুরুদের নীরব সাবধান বাণী; হয়তো সে নিজেও এক সময় এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করেছে। কিন্তু জেন-মহাগুরুরা নীরব থেকেছেন, না-শোনার ভান করে নিশ্চুপ থেকেছেন। যা কিছু সে ছেড়ে এসেছে, যা কিছুর অস্তিত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সে আজ আর অনুভব করে না একজন প্রকৃত জেন-সাধকের পক্ষে সে বিষয়ে কিছু বলা অসম্ভব।
জেন-এর এই রহস্যময়তা, জেন-সাধকদের নীরবতা ইত্যাদির পথে হেঁটে আমিও (আপাত) বৈপরীত্যে ভরা এ দর্শন নিয়ে গুরুগম্ভীর কথা বলে দায় এড়িয়ে যেতেই পারতাম। কিন্তু এ লেখায় আমার উদ্দেশ্য সেটা নয়, আমার উদ্দেশ্য জেন-দর্শনের সেই গভীর অংশে কিছুটা আলো ফেলা; যে শিল্পে জেন তার ছাপ রেখেছে তা মানুষের কাছে কিছুটা ধরা দিক। এখানে স্বীকার করে নেওয়া ভাল এই অক্ষম ‘আলোকসম্পাতের’ সঙ্গে জেন-এর মূল দর্শনের কোনও সম্পর্ক নেই, জেন-এর বিন্দুমাত্র লাভ বা ক্ষতি হবে না এ কারণে। কারণ জেন এসবের থেকে অনেক উপরে। এর ভূমিকা শুধু প্রাথমিকভাবে জানিয়ে দেওয়া, ঘন কুয়াশা-ঘেরা পাঁচিলের ওপারে কিছু একটা রয়েছে। গ্রীষ্মে মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমক যেমন ঝড়ঝঞ্ঝার আভাস দিয়ে যায়, এ লেখাও তেমনই। ওই ইশারাটুকু দিয়ে যাওয়াই উদ্দেশ্য আমার। এক্ষেত্রে তিরন্দাজি যেন জেনের ভেতর প্রবেশ করবার প্রাথমিক একটা ধাপ। একজন শিক্ষার্থী এই খেলাটি শুরু করবার পর দৃষ্টির স্বচ্ছতা অর্জন করবে, নিজে হাতে সে নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকা জগতকে আবিষ্কার করবে। এই খেলাটির কাছে না-এলে সে জগৎ তার কাছে অনাবিষ্কৃত থেকে যেত। তবে শুধু তিরন্দাজি নয়, ইকেবানা থেকে শুরু করে তলোয়ার যুদ্ধ, থিয়েটার থেকে চা-চক্রের আয়োজন – যে কোনও শিল্পের অনুশীলনের মাধ্যমেই জেন-এর অন্দরমহলে প্রবেশ করা সম্ভব।
এখানে তিরন্দাজির যাত্রাপথটিকে তুলে ধরাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য, জেন-এর প্রতি অনুগত একজন ছাত্রকে ঠিক কী কী পর্ব ও বিষয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয় সেটা জানা দরকার। আরও পরিষ্কার করে বললে, এ লেখা আসলে আমার জাপানে অবস্থানকালে এক জেন-মহাগুরুর কাছ থেকে পাওয়া নির্দেশনামা ও শিক্ষাপ্রণালীর লিখিত রূপ। দীর্ঘ ছয়-বছর তিনি আমাকে শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাই এ লেখা আমার ব্যক্তি-অভিজ্ঞতার ফসল। জেন-এর প্রাথমিক ধাপেও দুষ্প্রবেশ্যতা ছেয়ে রয়েছে, ক্রমশ নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হয় প্রহেলিকার মতো সে জগতে প্রবেশ করবার জন্য। কত বাধা যে অতিক্রম করতে হয়েছে, আগের বহু ধারণাকে ঝেড়ে ফেলে দিতে হয়েছে। তবেই সে সুবিশাল ঐতিহ্যপূর্ণ জগতের ভেতরে কিছুটা প্রবেশাধীকার মিলেছে।
জেন-এর কথা বলতে গিয়ে ‘ব্যক্তি-আমি’র কথা বারবার এসে যাওয়া সঙ্গত নয়। কিন্তু যে লক্ষ্য আমি নিজের সামনে রেখেছিলাম সেখানে পৌঁছাতে গেলে ব্যক্তি-আমি কিছুটা ছায়া ফেলে যাবেই। এ লেখায় আমি শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। আমি সচেতনভাবেই তিরন্দাজি শিক্ষার স্থান-কাল আর গুরুজিকে নিয়ে বেশি কিছু লিখব না। এই সংযম বজায় রাখা সহজ নয়, কিন্তু আমার মুখ্য উদ্দেশ্য তিরন্দাজির পথ ধরে জেন-এর অন্দরে প্রবেশ করার পথটিকে কিছুটা চিনিয়ে দেওয়া। সেই দীর্ঘ ছয়-বছরের কঠোর অনুশীলনের দিকে তাকিয়ে আজ মনে হয় জেন-এর পথে হাতে-কলমে তিরন্দাজি চর্চা করা তুলনায় সহজ। অনেক বেশি কঠিন তার পিছনে লুকিয়ে থাকা তত্ত্বটিকে লিপিবদ্ধ করা। আমাদের সমস্ত অর্জন নিয়ে পৌঁছে যেতে হবে সেই দিগন্তের কাচ্ছাকাছি, যার ওপারে জেন-সাধকদের পৃথিবী। সেখানে তাঁরা প্রতিদিন সূর্যের নীচে এসে বসেন, বসেন গাছের ছায়ায়।

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (1)
  • comment-avatar
    Simita Mukherjee 4 years

    Interesting …

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes