
ডেনিস লেভার্টভ-এর কবিতা
অনুবাদ: সুদেষ্ণা ঘোষ
ডেনিস লেভার্টভ (১৯২৩-১৯৯৭)-এর জন্ম ইংল্যান্ডের এসেক্স-এ, মা ওয়েলশ, বাবা রাশিয়ান ইহুদি, যিনি পরবর্তী সময়ে হয়েছিলেন অ্যাংলিকান যাজক। চারের দশকের শেষে লেভার্টভ চলে আসেন আমেরিকায়। এই পারিবারিক এবং স্থানিক আন্তর্জাতিকতায় ব্যাপ্ত লেভার্টভের কবিতা অন্তরে সব সময় বহন করেছে এক আর্ত ঠান্ডা অন্ধকার, যা তাঁর প্রকৃতি-বেষ্টিত পঙ্ক্তিগুলিকেও করে তুলেছে অতীন্দ্রিয়, রহস্যময়। আর লেভার্টভ নিশ্চয়ই মনে-মননে বহন করেছেন ১২ বছর বয়সে তাঁকে লেখা টি এস এলিয়টের অনুপ্রেরণার চিঠিটি। তাঁর শান্ত, আত্মমগ্ন পঙ্ক্তিগুলোর মধ্যে ছদ্মবেশী ক্রুদ্ধ স্ল্পিন্টার পাঠকের ভাতঘুম জব্দ করবে চিরকাল। মনে রাখতে হবে, লেভার্টভ-এর অ্যাক্টিভিস্ট কণ্ঠস্বর বারবার ভেঙেছে সমস্ত ফ্রন্টিয়ার— ভিয়েতনাম যুদ্ধ, পারমাণবিক বোমা, ল্যাটিন আমেরিকায় উত্তর আমেরিকার চোখরাঙানি... লেভার্টভ চিরকাল সরব হয়েছেন ক্ষমতার নির্লজ্জ ঔদ্ধত্যে, ১৯৬৭ সালে যিনি বলেছিলেন, ‘We are living our whole lives in a state of emergency’।
মে মাসের শেষে, সাড়ে ছ’টার বাস
পাহাড়টা
যেন একটি চাঁদেপাওয়া ফুল
শেষ বিকেলের নীল আলোয়।
বাসটা
কর্কশ গর্জন করছে
প্রত্যেক স্টপে
কেউ একজন নামল,
দিনের কাজ শেষ,
বাড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছে।
গাছেরা প্রথম
সবুজের প্রচুর আনন্দে
শ্বাস চেপে ধরে রেখেছে,
আকাশ
কী শান্ত, মেঘমুক্তও।
পাহাড়টি
নিঃশব্দে
গোপন ইশারায়
চাঁদকে ডাকছে।
ভবিষ্যৎকথন, অনিশ্চিত স্বপ্নের হাত ধরে
সারা রাত ধরে এক অন্ধ মানুষকে আমি
এক অসীম মিউজ়িয়ামের ভিতর দিয়ে নিয়ে চললাম একটাই কারণে
(ভিতরের সেতু, কিংবা সুড়ঙ্গ দিয়ে? কোনওভাবে!)
এভাবে যদি তিনি রাস্তাগুলো এড়িয়ে যেতে পারেন,
সবচেয়ে বিপজ্জনক সরণিগুলো, দ্রুতগামী
বিশৃঙ্খল ট্রাফিকগুলো…আমি ওঁকে রাজি করিয়েছিলাম
আমার এই সঙ্গটুকুর জন্য, অনেক দূরের সব
দরজাগুলো পেরনোর জন্য, যদিও একবারের জন্যই, গোলকধাঁধার করিডরগুলো,
সিঁড়িগুলো, ঝাঁকুনি দেওয়া সিন্দুকগুলো এবং চেয়ার এবং পাথুরে খিলানগুলো
ওঁকে অবাক করছিল যখন আমি প্রত্যেক বাঁকে ওদের কথা বলছিলাম,
এবং ওঁকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আমার পক্ষে কঠিন হয়ে উঠছিল
আগু বা পিছু। যেহেতু তিনি অনুভব করতে পারলেন না,
আমিও তাই বাধাগুলোই দেখলাম শুধু, দেখলাম ছুঁচলো কোণওলা বস্তুগুলো;
একটিও ছবি বা ঢেউতোলা আলমারি বা চুনাপাথরের শহিদমূর্তি নজরই করলাম না।
যাই হোক, আমরা অবশেষে
বেরোলাম শহরের সে জায়গাতেই
যেখানে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিলেন তিনি আর যখন থেকে আমি তাঁর দায়িত্ব নিয়েছিলাম;
তিনি বিদায় জানাতে টুপিটি খুললেন, এবং পাহাড়ের উপর মিলিয়ে গেলেন
লাঠি ঠুকতে-ঠুকতে। আমি দাঁড়িয়ে ওঁকে দেখতে থাকলাম,
দেখতে থাকলাম কীভাবে রাস্তা ওঁকে গিলে নিচ্ছে, অবাক হচ্ছিলাম
কীভাবেই বা ওঁর পক্ষে সম্ভব হত এই যাত্রা,
এবং জেগে ওঠার পর এখনও অবাক হই
আমার মধ্যে কোনটা তিনি এবং কোনটা আমি যে কিনা একটার পর-একটা সুন্দর ঘরের মধ্য দিয়ে ওই দীর্ঘ শর্টকাটে তাঁর সঙ্গী ছিলাম
ওঁর অন্ধত্ব যে সৌন্দর্য আমার কাছ থেকে আড়াল করেছিল
যেন কিছু ছিলই না কখনও।
ক্ষত
আমার গাছটির
একটা গোপন ক্ষত ছিল।
খুব প্রাণঘাতী নয়। এবং গাছটি ছিল তরুণ।
কিন্তু একটা শুকনো ডাল
ঝুলেই থাকত।
পাখিটা
পাতার মধ্যে কী শান্ত হয়েছিল পাখিটা,
একটুও ভয় পায়নি আমায় যেন আমি অদৃশ্য কেউ
কিংবা ওর মতোই নিঃশব্দে ঘোরাফেরা আমারও দখলে।
এক ঝোপ থেকে অন্য ঝোপে
কোনও কিন্তু না করেই সে উড়ে বেড়াচ্ছিল,
পাখার কোনও ঝাপটানি নেই, ঘোরাফেরার কোনও শব্দ নেই।
আমার মনে হচ্ছিল আমি শূন্যে উঠছি,
হালকা হয়ে যাচ্ছি, ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছি।
ও আমাকে হাওয়া বানিয়ে দিয়েছে,
ও আমার ভিতর দিয়ে সোজা উড়ে যেতে পারে।

