
চুক্তিপত্র
রাহুল দাশগুপ্ত
ঝিমোতে ঝিমোতে আধো ঘুমের ভিতর চিড়িয়াখানার বাঘটা আবার সেই বাঘটার স্বপ্ন দেখল। বনের মধ্যে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সেই বাঘটা। ক্ষিপ্র গতিতে শিকারের পিছনে ছুটছে। আর তাকে পাকড়াও করে নিমেষের মধ্যে সাবাড় করে দিচ্ছে। সারা মুখে রক্ত লেগে আছে সেই বাঘটার। জিভ দিয়ে সে আয়েশ করে চেটে নিচ্ছে সেই রক্তকে। অন্ধকারের মধ্যে তার চোখ দুটো আগুনের মতো জ্বলছে। সে তাকিয়েও রয়েছে অন্ধকারের দিকেই। ওই অন্ধকারের ভিতর কিলবিল করছে তার অজস্র শিকার। পাকা শিকারি এই বাঘটা। বনের মধ্যে সবাই তাকে সমীহ করে। ভয় পায়। অন্ধকারের ভিতরেই তার অবাধ স্বাধীনতা। অন্ধকারের ভিতর থেকেই সে যখন ইচ্ছা তুলে নেয় তার পছন্দমতো শিকার।
চিড়িয়াখানার বাঘটা একটা মস্ত হাই তোলে। তারপর পাশ ফিরে শোয়। আগে এই স্বপ্নটা দেখলেই ওর অসম্ভব রাগ হতো। হঠাৎ তার ঝিমোনো ভাব কেটে যেত। আর সে চাঙ্গা হয়ে উঠে দাঁড়াত। প্রচণ্ড জোরে আর্তনাদ করে উঠত সে। সেই চিৎকারে গোটা চিড়িয়াখানাটা যেন কেঁপে উঠত। তারপর ছুটে গিয়ে কামড়ে ধরত খাঁচার লোহার শিকগুলোকে। আর করাতের মতো ধারালো দাঁত দিয়ে সেই শিকগুলোকে টুকরো টুকরো করে দিতে চাইত।
কিন্তু এখন সবকিছুই কেমন যেন বদলে গেছে। এখন স্বপ্নটা দেখলেই চিড়িয়াখানার বাঘটার মস্ত মস্ত হাই ওঠে। তার ঘুমটা আরও যেন জাঁকিয়ে আসে। সে পাশ ফিরে শোয়। ওই বাঘটাকে সে কী কখনও চিনত? কোনওদিন স্বপ্ন দেখতে দেখতে বাঘটাকে তার খুব চেনা মনে হয়। আবার কোনওদিন খুব অচেনা লাগে। চেনা না অচেনা, কোনটা সত্যি কিছুতেই সে বুঝতে পারে না। কিন্তু নিজের মনের সঙ্গেই সে এখন কেমন যেন আপোশ করে নিয়েছে। নিজেকে সে বুঝিয়েছে, ওই বাঘটা নিছক একটা বিভ্রম ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই এখন ও বাঘটাকে অস্বীকার করারই চেষ্টা করে। নিজেকে বোঝায়, ওই বাঘটার আসলে কোনও অস্তিত্বই নেই। এমনকি ও কোনও স্বপ্নও দেখেনি। আর এতেই সে স্বস্তি বোধ করত। আর আরও নিবিড় ঘুমের ভিতর তলিয়ে যেত।
এই চিড়িয়াখানার বাঘটার কথা মাঝেমাঝেই আমার মনে পড়ে। কিছুদিন আগে আমি চিড়িয়াখানায় গেছিলাম। আর তখনই বাঘটাকে আমি দেখতে পাই। বাঘটা একটা লোহার খাঁচার ভিতরে গুটিয়ে, কুঁকড়ে শুয়ে ছিল। আমার খুব ইচ্ছা করছিল, খাঁচার দেওয়াল টপকে ভিতরে লাফ মেরে ঢুকে যাই। তারপর আরও একটা লাফ দিয়ে জলের পরিখাটি পেরিয়ে যাই। তারপর সবুজ ঘাস আর নুড়িপাথরে ঢাকা অনেকটা ফাঁকা জমি পেরিয়ে সোজা চলে যাই ভেতরের সেই গুহার দিকে, যার মুখটা লোহার খাঁচা দিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। ওই খাঁচার গায়ে সবসময় একটা মস্ত তালা লাগানো থাকে। সেই তালাটা খুললে তবেই বাঘটা বেরিয়ে আসতে পারে। নিজের ইচ্ছামতো সামনের চাতালে ঘুরে বেড়াতে পারে। কখনও চাতাল থেকে নেমে এসে পরিখার পাশে এসে দাঁড়াতে পারে। তারপর পরিখা বরাবর দীর্ঘ সময় পায়চারি করতে পারে।
কিন্তু সেদিন বাঘটা খাঁচার ভিতরেই গুটিয়ে, কুঁকড়ে শুয়ে ছিল। আর আমার খুব ইচ্ছা করছিল ওর কাছে যেতে। ওর পাশে গিয়ে বসতে। ওর মাথায়, ঘাড়ে হাত বুলিয়ে দিতে। মনে হচ্ছিল, বাঘটার মধ্যে যেন একটা তীব্র চুম্বক রয়েছে। তীব্র শক্তিতে সে আকর্ষণ করছে আমাকে। আমি যেন একদম সম্মোহিত হয়ে গেছিলাম। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, ওই বাঘটার সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক আছে। নিবিড় কোনও সম্পর্ক। কিন্তু সেই সম্পর্কটাকে আমি যেন কিছুতেই ধরতে পারছি না। ঠিক বুঝতেও পারছি না। কিন্তু আমাকে বুঝতেই হবে। নইলে আমি স্বস্তি বা শান্তি, কোনওটাই পাবো না।
আর ঠিক সেই সময়ই আমার মনে পড়ে গেছিল ডায়াগোনিস্টিক সেন্টারের সেই ঘটনাটা। আমার এক বন্ধু মফঃস্বলের দিকে চাকরি করত। সেদিন সকালেই হঠাৎ আমি তার ফোন পাই। আমার সেই বন্ধুর নাম ছিল, চিরহরিৎ।
সে আমাকে বলল, অনেকদিন পর তোদের শহরে এসেছি। দেখা করবি?
চিরহরিৎকে একসময় আমি খুব পছন্দ করতাম। ও আমার মতোই সিনেমা দেখতে আর বই পড়তে ভালোবাসত। আর আমাদের মধ্যে মনের মিলও খুব ছিল। তাই দ্বিতীয়বার চিন্তা না করেই বলে উঠলাম, হ্যাঁ, করব। তুই কোথায় আছিস?
চিরহরিৎ আমাদের শহরে এসেছে অনেকগুলো ব্লাড টেস্ট করাতে। সে একটা ডায়াগোনিস্টিক সেন্টারের নাম বলে দিল। কোথায় সেই সেন্টারটা, সেটাও বলে দিল। তখন সকাল দশটা বাজে। আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলাম। তারপর চড়া রোদের ভিতরই হাঁটতে শুরু করলাম।
বুঝতে পারছিলাম, আমার সারা শরীর ঘামে ভিজে যাচ্ছে। রাস্তাটা ওয়ান ওয়ে। যাওয়ার সময় হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। ফেরার সময় অটো পাবো। সেটা ভেবেই কিছুটা স্বস্তি বোধ করলাম। দু-একবার ফিরে যাওয়ার চিন্তাও মাথায় এলো। কিন্তু তারপরই চিরহরিৎয়ের মুখটা মনে পড়ে যাচ্ছিল। মনে হলো, কতদিন পর ওর সঙ্গে দেখা হবে। এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা উচিত হবে না।
বড়ো রাস্তা ছেড়ে একটা সরু গলির ভিতর ঢুকলাম। সেই গলিটা এঁকেবেঁকে, সর্পিল গতিতে আরও ভেতরের দিকে চলে গেছে। যতো ভেতরে ঢুকছিলাম, ততোই রোদ কমে আসছিল, আর ছায়া বাড়ছিল। সেই ছায়া সারা শরীরে মেখে আমি এগিয়ে চললাম। আমার সারা শরীর আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল। শরীরের ঘামগুলো কখন শুকিয়ে গেছিল। মৃদু, ফুরফুরে বাতাস বইছিল। শেষপর্যন্ত ডায়াগোনিস্টিক সেন্টারটা খুঁজে পেলাম।
ভেতরে জনা তিরিশ লোক বসে ছিল। বসার জায়গার কোথাও একচুলও ফাঁকা নেই। আমি ঢুকেই চিরহরিৎকে দেখতে পেলাম। সে আমারই অপেক্ষায় বসে ছিল। আমাকে দেখেই উঠে দাঁড়াল। তারপর নিজের জায়গাটা ছেড়ে দিয়ে বলল, বোস্, এখানেই বোস্।
ওকে দেখে খুব ভালো লাগল। বসতে পেরে স্বস্তি বোধ করলাম। তবু ভদ্রতার খাতিরে জানতে চাইলাম, আর তুই?
আমি তো বসেই ছিলাম। চিরহরিৎ বলল। তুই-ই তো এই রোদে তেতেপুড়ে এলি। একটু বোস্।
একটু পরে অবশ্য চিরহরিৎ আমার পাশেই জায়গা পেয়ে গেল। আর তখনই মনের বন্ধ জানলাগুলো যেন একটার পর একটা খুলে যেতে লাগল। অতীতের কত কত স্মৃতি ভেসে আসতে লাগলো। আমরা দুজনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠছিলাম।
কাউন্টারের সামনে বেশ ভিড়। পাশাপাশি কয়েকটা লাইন। পরপর নাম ধরে ডাকা হচ্ছে। যার নাম ডাকা হচ্ছে, সে উঠে গিয়ে লাইনে দাঁড়াচ্ছে। চিরহরিৎ অপেক্ষা করে আছে, কখন ওর নাম ধরে ডাকা হবে। ওকে সঙ্গ দিতে আমার ভালোই লাগছে। তবু তাড়াতাড়ি ওর কাজটা চুকে গেলে আমিও একটু নিশ্চিন্ত হই। অনেক দূর থেকে ও এসেছে।
হঠাৎ একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। কাউন্টারের ভেতর থেকে উঁচু গলায় কেউ ডেকে উঠল, নির্বাণ ভৌমিক।
আমি চমকে উঠলাম। একই অবস্থা হলো চিরহরিৎয়ের। আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে ফিসফিস করে সে বলল, তোর নাম ধরে ডাকছে কেন?
আমিও তো সেটাই ভাবছি! একটু বিরক্ত হয়েই আমি বললাম। কাউন্টারের সামনে থিকথিকে ভিড়। আমি সেদিকে এগিয়ে গেলাম। তারপর বললাম, আমাকে ডাকছেন?
একটি অল্পবয়সী সুন্দরী যুবতী আমার দিকে তাকাল। তারপর বলল, আপনি কী অসুস্থ?
আমি বললাম, মোটেই না।
মেয়েটি মুচকি হাসল। তারপর বলল, ব্লাড টেস্ট করাতে এসেছেন?
নাঃ! আমি আবার বললাম।
তাহলে নিশ্চয়ই আপনাকে ডাকা হয়নি।
কিন্তু আমার নামই নির্বাণ ভৌমিক। একটু জোর দিয়েই আমি বললাম।
তাই নাকি? মেয়েটি হাতের প্রেসক্রিপশনগুলোর দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিল। তারপর নিতান্ত তাচ্ছিল্যের স্বরেই বলল, কই, না তো! ও নামে তো…
আপনারা আমার নাম ধরে ডাকেননি? বিরক্ত হয়ে আমি বললাম।
বললাম তো, না। মেয়েটি কথাটা ছুঁড়ে দিয়েই অন্য দিকে মুখ ফেরাল।
আমি আবার নিজের জায়গায় ফিরে এলাম। চিরহরিৎ আমার দিকে তাকিয়ে আবার ফিসফিস করে বলল, এ যে একদম ভৌতিক কাণ্ড রে!
বললাম, আমিও যে স্পষ্ট শুনলাম…
চিড়িয়াখানার সেই বাঘটা স্বপ্নের আরও গভীরে তলিয়ে যাচ্ছিল। স্বপ্নের ভিতর সে শুনতে পাচ্ছিল একটা অস্পষ্ট গর্জন। বনের সেই বাঘটা গর্জন করছিল। গর্জনটা ক্রমেই বাড়ছিল। চিড়িয়াখানার বাঘটা অস্বস্তিতে বেশ কয়েকবার এপাশ-ওপাশ করল। তারপর তার ঘুম ভেঙে গেল। বনের অস্পষ্ট অন্ধকারে সেই বাঘটাকে সে দেখতে পেল। বাঘটা খোঁড়াচ্ছিল। আর ভীষণ গর্জন করছিল।
চিড়িয়াখানার বাঘটা জানতে চাইল, ওভাবে খোঁড়াচ্ছ কেন?
বনের বাঘটা বলল, ওরা গুলি ছুড়েছে। আমাকে মারতে চেয়েছিল। পারেনি।
ওরা? কাদের কথা বলছ তুমি?
শিকারিদের কথা। ওরা সব শিকারি।
কারা শিকারি? তুমিই তো শিকারি! এই বনে…
ওরা সেটা ভাবে না। ওরা নিজেরাই শিকারি। আর আমাকে ভাবে, শিকার। আমাকে আহত করে দিয়েছে…
বাঘটার ক্ষতস্থান থেকে রক্ত ঝরছিল। বোঝাই যাচ্ছে, খুবই যন্ত্রণা হচ্ছে তার। চিড়িয়াখানার বাঘটা জানতে চাইল, খুব ব্যথা করছে?
খুব। কিন্তু তার চেয়েও বেশি খিদে পেয়েছে। আমি খুব ক্ষুধার্ত। কিন্তু শিকার করার ক্ষমতা আমার নেই। আমি আহত। খিদের জ্বালা আমি আর সহ্য করতে পারছি না। এর চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো ছিল…
বনের বাঘটা চুপ করে যায়। শুধু একটা কাতরানির মতো অস্ফুট শব্দ বেরিয়ে আসতে থাকে তার মুখ দিয়ে। অবিরাম রক্তপাতে আর না খেতে পেয়ে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে সে। শিকারিকে দেখলে এখন আর ভয় জাগে না। সমীহ করতে ইচ্ছা করে না। মনে শুধু করুণা জেগে ওঠে।
চিড়িয়াখানার বাঘটা মনে মনে স্বস্তি বোধ করে। এখন আর সে শিকারি নয়। পুরোপুরি শিকার বনে গেছে। জীবনের সঙ্গে আপোশ-সমঝোতা করে নিয়েছে সে। আর তার ফলও পেয়েছে হাতেনাতে। এখন আর তার কোনও বিপদ নেই। নিরাপত্তার নিশ্চিত বেষ্টনির ভিতর এখন তার বসবাস। দু’বেলা খাবার ঠিক জুটবেই। কেউ হঠাৎ, অন্ধকারের ভিতর থেকে গুলি ছুঁড়ে তাকে আহত করবে, সেই ভয়ও আর নেই। আর কখনও তাকে ক্ষুধার্ত থাকতে হবে না। আর কখনও সে আহত হবে না। নিজের বন্দিত্বের বিনিময়ে এই আশ্বাস আর নির্ভরতা সে অর্জন করে নিতে পেরেছে।
সেদিন আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ। সারা বন জোছনায় থইথই করছে। ঘন ঝোপঝাড়ের আড়াল থেকে সে দেখতে পেল, সামনের ফাঁকা জায়গাটায় একটা মৃত পশু পড়ে আছে। আলোয় ঝলমল করছে গোটা জায়গাটা। চোখের দৃষ্টি একটু থিতু হলে, সে বুঝতে পারল, ওটা একটা গরু। পেটের ভিতর খিদেটা আবার তার চাগিয়ে উঠল। পেটের মধ্যে অবিরাম মোচড় মারছে। যেন ঝড় উঠেছে। তাণ্ডব চালাচ্ছে সেই ঝড়। সাপের কুণ্ডলির মতো পাকিয়ে পাকিয়ে আছড়ে পড়ছে পেটের মধ্যে।
বনের বাঘটা জিগ্যেস করল, আমি এখন কী করব?
চিড়িয়াখানার বাঘটা বলল, এটা কিন্তু একটা ফাঁদও হতে পারে।
ফাঁদ? কী করতে পারে ওরা? আমাকে মেরে ফেলবে? কিন্তু এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে যে মরে যাওয়াও ভালো। অসহ্য ব্যথা করছে আমার। কিন্তু তার চেয়েও তীব্র হয়ে উঠেছে খিদের যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণা আমি আর সহ্য করতে পারছি না।
তাহলে যাও, ওদের ফাঁদে গিয়ে ধরা দাও।
তুমি নিশ্চিত, ওটা আসলে একটা ফাঁদ?
না, আমি নিশ্চিত নই। চিড়িয়াখানার বাঘটা বলল।
ঠিক বলেছো। ওটা ফাঁদ নাও হতে পারে।
কিন্তু আমি ভাবছি, চিড়িয়াখানার বাঘটা চিন্তিত হয়ে বলল, জন্তুটা মারা গেল কীভাবে? তাছাড়া ওকে এই বনের গভীরে কে-ই বা নিয়ে এল? গরু তো এতো ভিতরে ঢোকে না। ওরা তো বনের আশেপাশে সবুজ ঘাসে ঢাকা জমিতে চড়ে বেরায়। ইদানিং সেটাও করছিল না। আর সেটাও তোমারই ভয়ে।
হুম। বনের বাঘটা বলল। এটা একটা কথা বটে! জন্তুটা এখানে এলো কী করে? কে-ই বা ওকে মারল?
কিন্তু তার স্বর জড়িয়ে যাচ্ছিল। খিদের চোটে চোখেও ঝাপসা দেখছিল সে।
তুমি এখন কী করবে? চিড়িয়াখানার বাঘটা জানতে চাইল। কেউ যেন তোমার জন্য খাবার সাজিয়ে রেখে গেছে দেখছি!
হ্যাঁ, আমাকে নিয়ে সে রীতিমতো ভেবেছে। কিন্তু একটা কথা আমাকে বলো…
কী কথা?
এভাবে বেঁচে থাকার কোনও অর্থ হয় কী? না খেতে পেয়ে আমি তো এমনিতেই মরে যাবো…
তা ঠিক।
তাহলে আমি যাই!
একাই যাবে? একা কী ডিনার পার্টি জমে?
কে যাবে আমার সঙ্গে? তাছাড়া…
হ্যাঁ, ওরা তোমার কথা ভেবেই…
বনের বাঘটা খোঁড়াতে খোঁড়াতে সেই মৃত গরুটার দিকে এগিয়ে যায়। জন্তুটার গায়ে প্রথম কামড় বসিয়েই তার খিদে যেন একশো গুণ বেড়ে যায়। সে পাগলের মতো জন্তুটার গা থেকে মাংস খুবলে, ছিড়ে খেতে থাকে। খুব দ্রুত কঙ্কাল বেরিয়ে আসে জন্তুটার। বনের বাঘ নাড়ি-ভুড়ি কিছুই বাদ দেয় না। খাদ্য-অখাদ্য যা কিছু পায়, সবকিছুই গোগ্রাসে গিলতে থাকে। যত তার পেট ভরে যেতে থাকে, ততো তার আশঙ্কা কমে যেতে থাকে। সে নিশ্চিত বোধ করতে থাকে। তার মনে হতে থাকে, আর ভয় নেই, আর ভয় নেই…
আর তখনই সে একটা অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পেল। তীক্ষ একটা যন্ত্রণা অনুভব করল সে। আর তারপরই টলে, গড়িয়ে পড়ে গেল ঠিক মৃত জন্তুটার পাশেই। কয়েক মুহূর্ত ফ্যালফ্যাল করে আকাশের গোল চাঁদের দিকে তাকিয়ে রইল সে। আর তারপরই চাঁদটা ঝাপসা হয়ে এল। সারা শরীর কেমন অবশ হয়ে গেল। চাঁদটাও আবছা হতে হতে শেষপর্যন্ত মিশে গেল নিশ্চিদ্র অন্ধকারে। যন্ত্রণার কোনও অনুভূতিই সে আর টের পাচ্ছিল না। সম্পূর্ণ চেতনা হারানোর আগে পরম স্বস্তিতে একবার সে শুধু বলে উঠতে চেয়েছিল, আঃ!
কিন্তু সেটাই ছিল তার স্বাধীন জীবনের শেষ মুহূর্ত। আর স্বাধীনতা হারানোর ঠিক আগের মুহূর্ত।
জ্ঞান ফেরার পর বাঘটা শুরুতে কিছুই বুঝতে পারল না। সে শুধু একটা মৃদু দুলুনি টের পাচ্ছিল। চোখ খুলে সে ভালো করে তাকাল। আর দেখতে পেল, সে একটা নৌকোর মধ্যে শুয়ে আছে। নৌকোটা রয়েছে একটা বিশাল, চওড়া নদীর তীর ঘেষে আর সেটা মৃদু মৃদু দুলছে। বাঘটা চিত হয়ে হাত-পা ছড়িয়ে শুতে গিয়ে লোহার শিকের গরম স্পর্শে চমকে উঠল। আর তখনই যেন তার হুঁশ ফিরে এলো। সে দেখতে পেলো, একটা মস্ত লোহার খাঁচার ভিতর সে শুয়ে আছে। এবার বাঘটা সারা শরীরে একটা প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে দাঁড়াল। আর তখনই সে কেমন যেন বেকুব বনে গেল। সে দেখল, নদীর তীরে হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সবারই নজর তার দিকে। কেউ তাকে দেখে ভয় পাচ্ছে, কেউ বা মজা। কিন্তু তাদের সবার চোখেই অদ্ভুত একটা কৌতূহল। বাঘটা একটা দ্রষ্টব্য হয়ে উঠেছে। আর নিষ্ক্রিয় হয়ে নিজের এই অসহায় অবস্থা মেনে নেওয়া ছাড়া তার সামনে আর কোনও উপায় নেই। খাঁচার ভিতর ছোট্ট একটা জায়গায় সে বন্দি হয়ে আছে। এই বন্দিত্ব ছাড়া তার জীবনে আর সবই অর্থহীন হয়ে গেছে। এখন তর্জন-গর্জন করেও আর কোনও লাভ নেই।
তবু বাঘটা একবার গর্জন করে উঠল। তার নিজের কানেই এই গর্জন ভয়ানক শোনালো। আর এতে সে মনে মনে খুশিই হলো। তার মনে হল, এখনও সে কিছুই হারায়নি। এখনও তার আত্মমর্যাদাবোধ আগের মতোই আছে! এখনও তার স্বাধীনতা অটুট আছে! এখনও সে বনের বাঘই আছে! এইভাবে তার গলার স্বর তাকে বিভ্রান্ত করল। আর সেই বিভ্রমের জগৎকেই সে বিশ্বাস করে বসল।
আর তখনই চোখে পড়ল, তার ঠিক সামনেই একটা গামলা রাখা আছে। সেই গামলার ভিতর দশ-বারো টুকরো টাটকা মাংস। তাদের গায়ে তখনও রক্ত লেগে আছে। আর এই দৃশ্য দেখামাত্র বাঘটা টের পেল, তার কতটা খিদে পেয়েছে। সে টপাটপ মাংসগুলো কামড়ে, ছিড়ে খেতে শুরু করল। অল্পক্ষণের মধ্যেই পুরো গামলাটা ফাঁকা হয়ে গেল। তখন গামলার গায়ে লেগে থাকা রক্ত সে চেটেপুটে খেতে লাগল। কিন্তু তবু তার খিদে মিটল না। বরং আরও বেড়ে গেল। সে আরও মাংসের টুকরোর জন্য এদিক-ওদিক তাকাতে লাগল। লোহার শিকগুলোকে প্লাস্টিকের খেলনার মতো ভেঙেচুড়ে বেরিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা হলো তার। ইচ্ছে হলো, ছুটে গিয়ে আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোকে কামড়ে, ছিঁড়ে খেয়ে ফেলার। কিন্তু কিছুই করতে পারল না সে। শুধু বসে বসে ঝিমোতে লাগল। আর একটু পরেই আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
ঘুমের ভিতরেই ছেঁড়া ছেঁড়া স্বপ্ন দেখল বাঘটা। কখনও সে দেখল গামলাভর্তি মাংসের টুকরো। কখনও দেখতে পেল, গামলাভর্তি রক্ত, তাতে কয়েকটা মাংসের টুকরো ভাসছে, আর সেই রক্ত উপচে পড়ছে, গড়িয়ে নামছে গামলার গা দিয়ে। কখনও সে দেখল তার সামনেই একটা নধর হরিণ দাঁড়িয়ে আছে। যেন বলতে চাইছে, এসো, আমার ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ো, আমাকে তোমার খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করো। এইভাবে সে শুধু খাবারের স্বপ্নই দেখল। আর যখন আবার তার ঘুম ভাঙলো, সে বুঝতে পারল, তার অসম্ভব খিদে পেয়েছে। আগাগোড়া স্বপ্নের ভিতর এক মুহূর্তের জন্যও এই খিদের অনুভূতি তাকে ছেড়ে যায়নি। ক্ষুধার্ত ছিল বলেই সে একের পর এক খাবারের স্বপ্ন দেখে গেছে।
দিনের আলো ফুরিয়ে গেছে বহু আগেই। চারপাশের ভিড়ও পাতলা হয়ে গেছে। শুধু অল্প কয়েকজন মানুষ আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছে। নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। চাঁদের আলোয় বাঘটা আবার সেই গামলাটাকে দেখতে পেল। গামলাটা আবার ভরে গেছে মাংসের টুকরোয়। সেই টুকরোগুলো ভাসছে রক্তের মধ্যে। কিন্তু আগেরবার রক্তটা অনেক কম ছিল, মাংসের টুকরোর সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। আর এবার যেন রক্তটা বেড়ে গেছে, কিন্তু মাংসের টুকরোর সংখ্যা কমে গেছে। বাঘটা খাবার দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ল। তারপর কামড়ে, ছিঁড়ে, টুকরো টুকরো করে সেগুলোকে খেতে লাগল। গামলার ভেতরে-বাইরে লেগে থাকা রক্ত চাটতে লাগল। নিজের থাবায় লেগে থাকা রক্ত চাটতে লাগল। আর এবার খাওয়ার পর সে আর প্রথমবারের মতো অতো খিদেও টের পেল না। তার মনে হলো, ক্রমেই তার খিদে কমে আসছে। তার পেট শান্ত হয়ে উঠছে। পেটের আগুন একটু একটু করে নিভে আসছে।
কিন্তু বাঘটা আর বেশি ভাবতে পারল না। আবার সে ঝিমোতে লাগল। আর একটু পরেই ঘুমিয়ে পড়ল। তার ঘুম ভাঙল মাঝরাতে। তার মনে হলো, কেউ যেন তার খাঁচার সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে। বাঘটা চোখ মেলে চিড়িয়াখানার বাঘটাকে দেখতে পেল।
চিড়িয়াখানার বাঘটা বলল, তুমি তাহলে শেষপর্যন্ত ফাঁদেই পড়ে গেলে!
কী বলছ তুমি? বনের বাঘটা চমকে উঠল। আমার গলার জোর দেখবে? দেখবে নাকি, এখনও কেমন গর্জন করতে পারি?
তোমার পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিলো কে?
বাঘটা চাঁদের আলোয় লক্ষ্য করল, তার ক্ষতস্থানে কারা যেন ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিয়ে গেছে। সেখানে কোনও যন্ত্রণার অনুভূতিই নেই। সে চাইলে, আগের মতোই অনায়াসে ছুটতে পারে। শিকারের পেছনে ধাওয়া করতে পারে। কিন্তু কোথায় ছুটবে সে? তার চারপাশেই যে লোহার খাঁচা! এখন আর সে ক্ষুধার্ত বা আহত নয়। সে খাবার পেয়েছে। তার ক্ষতস্থানেরও শুশ্রুষা হয়েছে। কিন্তু তার আর কোনও স্বাধীনতাই নেই। চাইলেও, এখন আর সে বনে ফিরে যেতে পারবে না। চাঁদের আলোয়, মুক্ত খোলা জায়গায়, ঝোপঝাড়ের ভিতর দিয়ে, ছোটাছুটি করতে পারবে না। তার বেঁচে থাকাটা অনেক ছোটো হয়ে গেছে।
চিড়িয়াখানার বাঘটা আবার বলে উঠল, ওই ব্যাণ্ডেজের মানে বোঝো?
বনের বাঘটা বেকুবের মতো তাকিয়ে রইল। চিড়িয়াখানার বাঘটা তার অবস্থা দেখে কৌতুক বোধ করল। তারপর ফিসফিস করে বলল, ওরা তোমাকে সভ্য করে তুলতে চাইছে!
কী বলছ তুমি? বনের বাঘটা চমকে উঠল।
ঠিকই বলছি আমি। চিড়িয়াখানার বাঘটা বলল। শিকারকে বাগে পেলেই ওরা তাকে সভ্য করে তোলে। তার পায়ে ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দেয়। তাকে গামলা ভর্তি করে খেতে দেয়। আর তাকে লোহার খাঁচায় বন্দি করে রাখে। একেই বলে, সভ্যতা!
সভ্যতার বিবরণ শুনে বনের বাঘটা শিউরে উঠল। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল সে। তারপর বলল, এই খাঁচাটাই তাহলে শর্ত?
ঠিক বলেছ। চিড়িয়াখানার বাঘটা বলে উঠল। ওরা তোমাকে বেঁচে থাকার অধিকার দিয়েছে। তার বদলে তোমার ওপর ওই একটি শর্ত চাপিয়ে দিয়েছে। তোমার কোনও কথা এখানে চলবে না। কোনও মত চলবে না। তোমাকে বোবা হয়ে থাকতে হবে। সম্পূর্ণ চুপ করে যেতে হবে তোমাকে। একমাত্র তাহলেই তুমি নিশ্চিন্তে বাঁচতে পারবে। খাঁচার ভিতরে, নিরাপদ আশ্রয়ে, নিশ্চিন্তে ও নির্ভাবনায়। শুধু তোমাকে খাঁচার শর্তটিকে মেনে চলতে হবে। এই খাঁচাটিই ওদের সঙ্গে তোমার চুক্তিপত্র। এই চুক্তিপত্রই তোমার বেঁচে থাকার একমাত্র শর্ত।
বনের বাঘটা কথাগুলো শুনে কেমন যেন অবশ বোধ করতে লাগল। সে আবার ঝিমোতে লাগল। আর একটু পরেই আবার ঘুমের ভেতর, স্বপ্নের মধ্যে তলিয়ে গেল সে। কিন্তু কিছুতেই তার ঘুম আসছিল না। একটু পরেই সে ছটফট করতে লাগল। সে জেগে উঠল আর বুঝতে পারল, তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে তার। কিন্তু যন্ত্রণাটা ঠিক কোথায় হচ্ছে, সেটা ধরতে পারল না। একটু পরে তার মনে হল, বুকের ভেতরে অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে তার। কিন্তু কোথাও কোনও রক্তের চিহ্ন নেই। কেউ তার দিকে গুলি ছোঁড়ে নি। আগেরবারের মতো সে আহতও হয়নি। কিন্তু একটু পরেই আবার সে ঝিমোতে লাগল। আর তলিয়ে গেল ঘুমের মধ্যে।
ওই বাঘটার সঙ্গে আমার কোথাও মিল আছে। চিড়িয়াখানায় ঘুরতে গিয়ে কেন তাহলে ওকে আমার এত চেনা মনে হল? কেন মনে হল, বাঘ নয়, খাঁচার ভিতরে আসলে আমি নিজেই শুয়ে আছি?
চিরহরিৎ হঠাৎ জানতে চাইল, সুশান্ত নাকি তোদের অফিসেই কাজ করে।
হ্যাঁ রে। বললাম।
সুশান্তের কথা শুনে তোর মুখটা অমন করুণ হয়ে গেল কেন? চিরহরিৎ জানতে চাইল।
বললাম, ও বিরাট পোস্টে চাকরি করে। অনেক টাকা মাইনে পায়। ম্যানেজমেন্টের অংশ! ওর অনেক গুণগ্রাহী। অনেক অনুরাগী। সবাই ওকে খুব তোষামোদ করে চলে। আর আমি তো একজন সাধারণ কেরানি! কেউ আমাকে পাত্তাই দেয় না।
বলিস কী! চিরহরিৎ অবাক হয়ে বলে। ওর মধ্যে না আছে ট্যালেন্ট, না আছে অরিজিন্যালিটি। অতি মামুলি একটা ছেলে। মেধা আর গভীরতা, কোনওটাই নেই। আর তোর তো এগুলো সবই আছে। চিন্তা করার ক্ষমতা আছে। আর ও তো সারাজীবন শুধু পুঁথি-পড়া বিদ্যেই আওড়ে গেল।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল আমার। বললাম, ও ছিল বিরাট ধনী ঘরের ছেলে। ওর বাবা ওকে বিদেশে পাঠিয়ে দিলেন। ঝরঝরে ইংরাজি বলত। বড়ো চাকরি করত। সেই চাকরি ছেড়ে ও আমাদের অফিসে যোগ দিয়েছে। ওর খাতিরই আলাদা। আর আমার বাবা ছিল গরিব। মা মানসিক রোগী। বাড়িতে অশান্তি লেগেই থাকত। ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করেছি। তবু কোথাও কোনও চাকরি জুটছিল না। আমার হয়ে তদ্বির করার কেউ ছিল না। আমি সিঁধে পথে চেষ্টা করে গেছি। কিন্তু এদেশে কী সিঁধে পথে কিছু হয়? তাই সব জায়গায় জুটেছে শুধু বঞ্চনা, লাঞ্ছনা আর অবিচার। শেষপর্যন্ত এই অফিসের বস যেন প্রায় করুণা করেই আমাকে চাকরিটা দেন। আমি ওই বসের মেয়েকে টিউশনি পড়াতে যেতাম। মেয়ের দুর্দান্ত রেজাল্ট হল। আর উনি আমাকে চাকরিটা অফার করলেন। আমি চাকরিতে যোগ দিলাম। আর তার কয়েকদিন পরই আমাকে নিজের ঘরে ডেকে বসের সে কী অপমান! আসলে উনি আমাকে বুঝিয়ে দিলেন, নেহাৎ করুণা করেই চাকরিটা উনি আমাকে দিয়েছেন। আমি চাকরিটা হয়তো ছেড়েই দিতাম। কিন্তু অভাব আর কৃতজ্ঞতাবোধ, এই দুটোই আমাকে আটকে দিল। আমাকে কে গ্রাহ্য করবে, বল্?
ঠিক সেই সময়ই কাউন্টারের ওপাশ থেকে কে যেন ডেকে উঠল, নির্বাণ ভৌমিক…
চিরহরিৎ আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, ব্যাপার কী বল্ তো? বারবার তোর নাম ধরে ডাকছে কেন? এদিকে কতক্ষণ ধরে আমি বসে আছি..
আমরা দুজনেই উঠে কাউন্টারের সামনে গেলাম। সেই সুন্দরী যুবতী মুচকি হেসে জানতে চাইল, কিছু দরকার?
আমি ফোঁস করে উঠলাম, আমাকে ডাকলেন কেন?
কে ডেকেছে আপনাকে? যুবতীটিও ছোবল মারল। আপনি কী অসুস্থ?
আমার নাম নির্বাণ ভৌমিক। আপনারা নির্বাণ ভৌমিককে ডাকেননি?
যুবতীটি প্রেসক্রিপসনের তাড়ায় একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ও নামে কারো প্রেসক্রিপসন আমার হাতে আসেনি…
তাহলে বারবার আপনারা আমার নাম ধরে ডাকছেন কেন? আমি মরিয়া হয়ে বললাম।
চিরহরিৎ বলল, হ্যাঁ, আমি শুনেছি। একটি পুরুষ কণ্ঠ, ভিড়ের মধ্যে ঠিক দেখতে পাইনি। ও পেশেন্ট নয়, পেশেন্ট হলাম আমি। আমার নাম চিরহরিৎ ঘোষাল। অথচ আপনারা আমাকে ডাকছেনই না…
আমরা তো আর কাউকে বিশেষ সুবিধা দিতে পারি না। যুবতীটিও কঠোর গলায় বলল, আমরা পরপরই ডাকছি, ঠিক যে অর্ডারে প্রেসক্রিপসনগুলো আমার হাতে এসেছে, আপনাকে ঠিক সময়েই ডাকা হবে, আপনার আগে যারা এসেছে…
থাক্, থাক্। চিরহরিৎ বলে উঠল। আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। কিন্তু এটুকু বলে রাখছি, আপনারা আমাদের হেনস্থা করছেন, বারবার নির্বাণ ভৌমিক বলে ডেকে…
কী যা-তা বলছেন আপনি? যুবতীটিও তেড়িয়া হয়ে বলে উঠল, আমি এখানে বসে আছি, সবার চোখের সামনে, ওই নাম ধরে কেউ ডাকলে আমি শুনতে পেতাম না? কে ডাকবে ওই নাম ধরে? কোথা থেকে ডাকবে? কে জানে আপনার নাম? আপনি তো আর সলমন খান বা অক্ষয় কুমার নন…
শেষের দিকে যুবতীটির গলার স্বর কেমন মেদুর হয়ে এল। যেন খুব প্রিয় দুটো নাম সে উচ্চারণ করে ফেলেছে। সেদিকে তাকিয়ে আমি বললাম, তাহলে কী আমরা মিথ্যে বলছি?
যুবতীটিও পাল্টা মেজাজ দেখিয়ে বলে উঠল, আমি কী তাই বলেছি। আমি শুধু বলছি, আপনারা ভুল শুনেছেন…
আমরা দুজনেই?
হতে পারে। হয়তো অন্যমনস্ক ছিলেন। নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। আর হইচইয়ের মধ্যে কী শুনতে কী শুনেছেন…
আমার মনে হয়, আপনি নিজেই অন্যমনস্ক ছিলেন। মানে বলতে চাইছি, কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাই হয়তো…
হতেই পারে না। যুবতীটি মেজাজি স্বরেই বলে উঠল, এই তো এখানে এত লোক আছেন। কেউ শুনতে পেয়েছেন? আপনারাই বলুন না, নির্বাণ ভৌমিক নামে কাউকে এখান থেকে ডাকা হয়েছে?
কেউ কোনও উত্তর দিল না। সবাই কেমন যেন বোবা হয়ে গেছে। শুধু এক ওভারস্মার্ট যুবক চোখের সানগ্লাসটা ওপর দিকে তুলে যুবতীটির দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠল, অন্তত আমি তো শুনিনি ম্যাডাম। নির্বাণ ভৌমিক? নাঃ, এই প্রথম শুনছি। এখানেই তো দাঁড়িয়ে ছিলাম…
আমি দাঁতে দাঁত চেপে বললাম, ফোঁপর-দালাল…
চিরহরিৎ পাশ থেকে বলে উঠল, আরে না না, আশিক-দিওয়ানা…
আমরা নিজেদের জায়গায় ফিরে এলাম। চিরহরিৎ আমার দিকে তাকিয়ে প্রসঙ্গ ঘোরাবার জন্য বলে উঠল, সুশান্ত তোর সঙ্গে কেমন ব্যবহার করে?
ওই, আমি বললাম, বসেরা যেমন করে, মুড অনুযায়ী কখনও হাসে, কখনও চিনতেই পারে না। কিন্তু, একটু নার্ভাস গলাতেই বলে উঠলাম, এটা কী হলো রে? পরপর দু’বার আমার নাম ধরে কে ডাকল ওভাবে?
ছাড় না। চিরহরিৎ বলল, সবকিছুকে অত আমল দিস না। তুই বরাবরই খুব সেনসিটিভ। তুই কী অসুস্থ? এখানে কিছু টেস্ট করাতে এসেছিস? তাহলে ওরা তোকে ডাকবে কেন?
কিন্তু এবার আমার সত্যিই নিজেকে অসুস্থ মনে হল। ভাবলাম, এখান থেকে এবার পালিয়ে যাওয়াই ভালো। ঠিক সেই সময়ই কাউন্টারের ওপাশ থেকে ডাক এল, চিরহরিৎ ঘোষাল…
চিরহরিৎ উঠে দাঁড়াল। আমাকে জড়িয়ে ধরল হঠাৎ। তারপর বলল, এসব ফালতু ব্যাপার নিয়ে বেশি ভাবিস না। তোকে সত্যিই কেমন যেন অসুস্থ দেখাচ্ছে। কী তেজ ছিল তোর! যেমন মেধা, তেমনি প্রতিভা। তুই ছিলি আমাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যা, বাড়িতে গিয়ে রেস্ট নে, যা…
জীবনে কিছুই করতে পারলাম না চিরহরিৎ। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম।
চাকরিটাই তোকে শেষ করে দিচ্ছে। চিরহরিৎ বলল। আমি বুঝতে পেরেছি। ওরা তোকে কোনও সম্মান দেয় না। কিন্তু ওরা কারা? বল তো, আমার রয়েল বেঙ্গল টাইগার, ওরা কারা? বাঘকে যতোই খাঁচার ভিতর রাখা হোক, সে বাঘই থাকে। হাতি গর্তে পড়লেও সে হাতিই থাকে। একটা পোকা, ফড়িং বা আড়শোলা, যতোই বাঘ বা হাতির মতো হাবভাব করে ঘুরে বেড়াক, কোনওদিন বাঘ বা হাতি হতে পারবে না। আসলে হিউমিলিয়েশনটা তুই আর নিতে পারছিস না। কিন্তু অত ভাবিস না। পজিটিভ চিন্তা কর। তোর দিনও একদিন আসবে। আর যদি নাই বা আসে, তাতেই বা ক্ষতি কী? নিজেকে একজন কমোনার হিসাবে ভাব না…
ডায়াগোনিস্টিক সেন্টার থেকে আমি বেরিয়ে এলাম। মনটা খুব বিষণ্ণ হয়ে ছিল। বারবার ওখানে আমার নাম ধরে ডাকছিল কেন? আমি তো অসুস্থ নই! নাকি, আমি সত্যিই অসুস্থ? কেউ নিশ্চয়ই সেটা বুঝতে পেরে গেছিল। কেউ নিশ্চয় আমার ভিতরটা দেখতে পাচ্ছিল। আর আমাকে বারবার ডেকে সতর্ক করতে চাইছিল। কিন্তু সে কে?
অটোতে ওঠার পরই একটি মেয়ে আমার পাশে এসে বসল। পিছনের সিটে সবসময়ই চাপাচাপি হয়। মেয়েটি বসার পরই কনুইয়ের কাছে ওর হাতের কিছুটা অনাবৃত অংশ আমার হাতেরও ওই একই অনাবৃত জায়গায় স্পর্শ করল। মেয়েটি হাত সরিয়ে নিল। আমার কিন্তু ওই সামান্য মুহূর্তটি অসম্ভব ভালো লাগল। মেয়েটিরও কী লাগে নি? আমি একটু অবাকই হলাম। কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করলাম। মেয়েটি আবার নিজের হাত আগের জায়গায় নিয়ে এল। আবার আমরা একে অপরের স্পর্শ টের পেতে লাগলাম। আমি বুঝতে পারলাম, মেয়েটির ভালো লাগতে শুরু করেছে।
পুরো সময়টা আমরা ওইভাবেই বসে রইলাম। মেয়েটি একবারও হাত সরালো না। আমিও সরালাম না। দুজনেই স্থির, অনড় হয়ে বসে রইলাম আর ওই স্পর্শের অনুভূতিটুকুকে জিইয়ে রাখলাম। মেয়েটির পাশে যে মোটা, কালো, ভুড়িওয়ালা লোকটি বসেছিল, সে সরে গেলেও মেয়েটি একইভাবে বসে রইল। আমার হাতে হাত ঠেকিয়ে। অনাবৃত অংশের স্পর্শটিকে বাঁচিয়ে রেখে। একসময় আমরা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে গেলাম। মেয়েটি এখন চলে যাচ্ছে। আমি এখন কী করব? আমি কী ওর পিছন পিছন যাবো? সামান্য একটু স্পর্শ, আর তাতেই কী ভালো লাগছে! ওই স্পর্শ নিছক স্পর্শ ছিল না। ওই স্পর্শ আমার মধ্যে যৌনতার বোধকে আবার ফিরিয়ে এনেছে। আমি বুঝতে পারছিলাম, এখন আমার কী প্রয়োজন!
অনেকগুলো নদী পেরিয়ে আর তারপর অনেকটা রাস্তা দিয়ে গিয়ে, বাঘটা শেষপর্যন্ত পৌছল তার নির্দিষ্ট জায়গায়। অর্থাৎ চিড়িয়াখানায়। এখন আর সে বনের বাঘ নয়। এখন সে চিড়িয়াখানার বাঘ। গোটা রাস্তাটা বাঘটা অসম্ভব ছটফট করছিল। মাঝে মাঝে তীক্ষ্ণ, ধারালো দাঁত দিয়ে খাঁচার লোহার শিকগুলোকে কামড়ে ধরছিল। সে বুঝতে পারছিল, যেখানেই তাকে নিয়ে যাওয়া হোক, সেখানে অন্তত জঙ্গল নেই। আর এই যন্ত্রণাময় অনুভূতিই তার কৌতূহলকে ছাপিয়ে যাচ্ছিল।
চিড়িয়াখানায় পৌঁছনোর পর নিশ্চিন্তেই কাটতে লাগল বাঘটির জীবন। কিন্তু সেই নিশ্চয়তা ক্রমেই যেন অস্বস্তিতে পরিণত হচ্ছিল। সারাদিন কেউ না কেউ তাকে বিরক্ত করতেই থাকে। দিনের বেলায় মানুষের উৎপাত চলতেই থাকে। তাকে দেখে তারা রীতিমতো হইচই বাধিয়ে দেয়। আঙুল দিয়ে দিয়ে তাকে দেখায়। যেন সে বাঘ নয়, নেহাৎ একটা সার্কাসের ক্লাউন। তারা নানারকম অঙ্গভঙ্গি করতে থাকে। মুখ দিয়ে নানারকম আওয়াজ করে। এটা-ওটা ছুঁড়তে থাকে। এখানে সিকিউরিটি গার্ডের ব্যবস্থা খুবই শিথিল। ফলে বাঘটি একদম ব্যতিব্যস্ত বোধ করে।
আর রাতের বেলা বা ঘুমিয়ে থাকলে হয় অন্যরকম সমস্যা। খাঁচার ফাঁক দিয়ে ঢুকে তাকে ঠুকরে যায় কতগুলো ইঁদুর। আর অবিরাম কামড়াতে থাকে নানা ধরনের পোকা। আর মশার যেন কোনও শেষ নেই। সেই সঙ্গে আরশোলা আর টিকটিকি। পারলে গোটা চিড়িয়াখানাটাই দখল করে নেয় ওরা।
মাঝেমাঝে বাঘটা একটা বাঘিনীর স্বপ্ন দেখত। কিন্তু সেই বাঘিনীটিও ছিল ভারি অদ্ভুত। শুধুমাত্র যৌনমিলনের সময় বাঘিনীটি বশে থাকত। আর অন্য সময় ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, আছড়ে, কামড়ে একাকার করে দিতে চাইত বাঘটাকে। বিশেষ করে, বাঘিনীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বাঘটা যখন কোনও দুর্বলতা দেখিয়ে ফেলত। তখন সত্যিই আর রক্ষা থাকত না। বাঘিনীটি সেই সময়গুলোয় অসম্ভব হিংস্র হয়ে উঠত। বাঘটার ওপর নানারকম নিগ্রহ চালিয়ে মজা পেত। বাঘটা কিছুতেই এই অদ্ভুত মনস্তত্বের কারণ খুঁজে পেত না। বাঘিনীটি এমনিতে কিন্তু শান্ত আর চাপা প্রকৃতিরই ছিল। খিদে না পেলে কখনও শিকারে বেরোত না, কারো ক্ষতিও করত না। বাঘটা একসময় এই বাঘিনীটিকে চিনত। তার সঙ্গে অসংখ্যবার যৌনমিলনও হয়েছে তার। কিন্তু চিড়িয়াখানায় আসার পর থেকে বাঘিনীটি শুধুমাত্র স্বপ্নেই আসত।
আরও একটা ব্যাপার হয়েছিল। বাঘটা প্রথমদিকে খুব তর্জন গর্জন করত। নিজের ঢালাও অভিযোগ উজাড় করে শোনাতে চাইত। এটা ওর বরাবরের অভ্যাস। সে জানে, তার গর্জন শুনলে বনের সবাই ভয় পায়। কিন্তু এখানে ব্যাপারটা ঠিক উল্টো। এখানে কেউ ওর গর্জনকে গ্রাহ্যই করে না। বরং বেশি চেঁচামচি করলে লোকে মজা পায়। সবাই যেন ওর অসহায়তাকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করে। ওর গর্জন শোনার জন্য সবাই এখানে উন্মুখ হয়ে থাকে। আর তাতেই দ্রষ্টব্য হিসাবে সে আরও উপভোগ্য হয়ে ওঠে।
বাঘটা এখন বেশিরভাগ সময়ই ঝিমোয়। ভেতরে ভেতরে অসম্ভব অবসাদ বোধ করে সে! চিড়িয়াখানা তাকে অবসন্ন করে দিয়েছে। তার ভেতরের প্রাণশক্তি শুষে নিয়েছে একেবারে। নিজের ভেতরটা এখন কেমন যেন তার ফাঁকা ফাঁকা লাগে। কিছু একটা সেখানে ছিল, যেটা এখন আর নেই।
একদিন অনেক রাতে তার ঘুম ভেঙে গেল। আর সে অবাক হয়ে দেখল, তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে সেই বনের বাঘটি।
বনের বাঘটা বলল, কী গো, তুমি কই?
এই তো আমি। বিষাদ আর অবসাদ মেশানো গলায় চিড়িয়াখানার বাঘটা বলল।
বেশ আছো এখানে, তাই না? পেটের চিন্তা নেই, কিন্তু নিরাপত্তা আছে।
আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করছ? চিড়িয়াখানার বাঘটা জানতে চাইল।
কেন, ওকথা বলছ কেন? বনের বাঘটা কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল।
এখানে আমার কোনও স্বাধীনতা নেই!
ওঃ, আর?
এখানে আমার কোনও একাকিত্ব নেই। নিঃসঙ্গতা নেই। নীরবতা নেই। সবসময় অর্থহীন শব্দ আর ডামাডোল, খোঁচা আর কামড়, আমি আমার মনের প্রশান্তি হারিয়ে ফেলছি…
বনের বাঘটাকে এবার সত্যিই বেশ দুঃখিত মনে হল। সে জানতে চাইল, আর?
আর কী? এখানে আমি রয়েছি একটা ভিখিরির মতো, ওদের করুণায় কোনওমতে টিকে আছি, এখানে আমার কোনও মর্যাদা নেই, সম্মান নেই, যেন আমি একটা উপহাস আর ঠাট্টার পাত্র…
তা ঠিক। বনের বাঘটা বলল। তোমার মধ্যে একটা রাজকীয় ব্যাপার ছিল। তোমার হাবেভাবে, চালচলনে, কণ্ঠস্বরে। আর এ কী অবস্থা হয়েছে তোমার! দড়ির মতো শুকিয়ে গেছো, সারা গায়ে ধুলো মাখা, আর কী বিষন্ন শোনাচ্ছে তোমার গলার স্বর! তোমার এ কী অবস্থা করে ছেড়েছে ওরা!
না, এভাবে আমি বেশিদিন বাঁচব না। ওখানে খেতে পেতাম না, তবু নিজের আত্মমর্যাদা নিয়ে থাকতাম। সবাই আমাকে ভয় পেতো, সমীহ করত, সম্ভ্রম দেখাত। আর এখানে লোকে আমাকে মশা, মাছি, আরশোলার মতোই তুচ্ছজ্ঞান করে।
হ্যাঁ, তাই তো দেখছি। তোমার মধ্যে আগে একটা বাঘ ছিল। সেই বাঘটাকেই আর দেখতে পাচ্ছি না! তোমার ভেতরটাকে ওরা দেউলিয়া করে ছেড়ে দিয়েছে দেখছি! তুমি এখন শুধু বাইরেই বাঘ। ভেতরে ভেতরে একদম নিঃস্ব হয়ে গেছো তুমি!
ঠিক বলেছো। চিড়িয়াখানার বাঘটা বলল। এবার বুঝেছি, আমার ভেতরটা কেন এত ফাঁকা ফাঁকা লাগে…
তুমি নিজের আইডেনটিটি হারিয়ে ফেলছো, বুঝলে? বনের বাঘটা বলল।
এর চেয়ে কী মরে যাওয়াও ভালো নয়? বাঘ যখন আর বাঘ থাকে না, তার সঙ্গে পোকামাকড়ের মতো ব্যবহার করা হয়, তখন আর তার বেঁচে থেকে কী লাভ?
তুমি ফাঁদে পড়ে গেছো। তোমার ভেতরে যে বাঘটা রয়েছে, সেটাকে মেরে, ওরা জিতে যেতে চায়। বাঘের মধ্যে যদি বাঘই না থাকে, তবে আর সেই বাঘের গুরুত্ব কী? ওরা তোমাকে গুরুত্বহীন করে তুলেছে, তোমাকে মর্যাদাহীন করে তুলেছে, সত্যিই কী দুর্দশা হয়েছে তোমার, তোমাকে আমার করুণা করতে ইচ্ছে করছে…
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। আমি ছিলাম শিকারি। আর এখন নিজেই আমি শিকার হয়ে গেছি…
বনের বাঘটা বিষন্ন পায়ে ধীরে ধীরে হেঁটে চলে যায়। কিন্তু চিড়িয়াখানার বাঘটাকে বিপন্ন করে দিয়ে যায়। সে নিজের ভেতরে থাকা বাঘটাকে মরিয়া হয়ে খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোথাও তাকে খুঁজে পায় না। সে গর্জন করে উঠতে চায়। কিন্তু এখন তার গলা দিয়ে শুধু পোকা আর ইঁদুরের মতোই স্বর বেরোয়। কোনও তেজ নেই সেই স্বরে। কেমন একটা অস্পষ্ট, ফাঁপা, মৃদু গুঞ্জনের মতো শোনায় সেই স্বর। তার আচরণ ও হাবভাবও হয়ে ওঠে পোকা, ইঁদুর আর আরশোলাদের মতোই। নিজেকে অসম্ভব আত্মবিশ্বাসহীন লাগে তার। যেন একটা মৃত হৃদয়কে সে বহন করে চলেছে। চিরকালের জন্য বোবা ও নীরব হয়ে গেছে সেই হৃদয়। কোনও চাঞ্চল্য নেই সেই হৃদয়ে। কোনও অস্থিরতা নেই। সেই হৃদয় ঝরা পাতার মতোই শুকিয়ে গেছে, ছিন্ন ডালের মতোই এলিয়ে পড়েছে।
চিড়িয়াখানার বাঘটি একদিন হঠাৎ পরিখার জলের সামনে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। অনেকদিন পর। আকাশে সেদিন পূর্ণিমার চাঁদ। চারপাশ জোৎস্নায় একদম থইথই করছে। দিনের মতোই আলো। এই চিড়িয়াখানায় আসার পর, প্রথম দিকে, হঠাৎ হঠাৎ এমনি করেই সে পরিখার সামনে দাঁড়িয়ে যেত। আর জলের দিকে তাকিয়ে থাকত। আসলে সে নিজেকেই যাচাই করে নিতে চাইত। দেখতে চাইত, এখনও সে কতটা বাঘ আছে! তার নিজের ভেতরই গুপ্তঘাতকের মতো একটা সন্দেহ দানা বাধছিল। তার মনে হচ্ছিল, সে আর বাঘ নেই। একটু একটু করে অন্য কিছু একটায় পরিণত হচ্ছে। তার রূপান্তর ঘটছে।
বাঘটি পরিখার জলের দিকে তাকায়। কিছুটা ভয়ে, আর কিছুটা কৌতূহলে। কেন জানি তার মনে হচ্ছিল, সে ভয়াবহ কিছু একটা দেখবে। সে একটা বাঘকেই দেখতে চাইছিল। কিন্তু তার বদলে সে দেখতে পেল, একটা ইঁদুর। জলের ভিতর থেকে তার দিকেই তাকিয়ে আছে! সে আবার তাকালো। কিন্তু এবার আর সে কোনও ইঁদুরকে দেখতে পেল না। যখনই সে একটু নিশ্চিন্ত বোধ করতে যাচ্ছে, তখনই জলের ভেতরে আস্তে আস্তে ভেসে উঠল একটা ভয়াবহ পোকার ছবি। এতে বাঘটা দারুণ ভয় পেয়ে গেল। কিন্তু চোখ সরিয়ে নিতে পারল না। বেশ কিছুক্ষণ ধরে পোকাটাকে সে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। তার মনে হলো, যেন বিশাল একটা আরশোলা হাত পা ছড়িয়ে, চিত হয়ে শুয়ে আছে। তফাৎ এটাই, তার টিকটিকির মতো একটা লেজ রয়েছে। এরকম অদ্ভুত পোকা বাঘটা আগে কখনও দেখেনি। হঠাৎ দেখলে একটা মস্ত কুমির বলেও কারো হয়তো ভুল হতে পারে….
বাঘটার হঠাৎ একটা দারুণ সন্দেহ হলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে, চাঁদের দিকে তাকিয়ে সে একটা ভয়াবহ গর্জন করে উঠল। সেই গর্জনে গোটা চিড়িয়াখানা কেঁপে উঠল। নিজেকে শুনিয়েই যেন সে বলতে চাইল, তাহলে কী আমি কোনওদিনই বাঘ ছিলাম না? সবটাই আসলে ছিল আমার মনের বিভ্রম?
সেই প্রথম নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সে চূড়ান্ত সন্দেহ করে বসল। আর নিজের অস্তিত্বকে প্রমাণ করার জন্যই যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল পরিখার জলে। আক্রমণ করতে চাইল সেই ভয়াবহ পোকাটিকে। আর পোকাটাও যেন তৈরিই ছিল। সেই মুহূর্তেই মস্ত একটা হাঁ করে পোকাটা গিলে নিল আস্ত বাঘটাকে…