চিন্তার চিহ্নমালা ৫ <br /> সন্মাত্রানন্দ

চিন্তার চিহ্নমালা ৫
সন্মাত্রানন্দ

"শ্রবণের এতখানি প্রাকৃতিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আমরা ইদানীং শুনবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছি দেখে দুঃখ জাগে। আমরা এখন সকলেই বলতে শিখেছি। না শুনেই বলে চলা। এক ‘অনুপম বাচনের রীতি’ শিখেছি আমরা। রাম ও লক্ষ্মণকে বিশ্বামিত্র মুনি তাড়কা রাক্ষসী বধ করতে নিয়ে যাওয়ার সময় দুখানা অস্ত্র ব্যবহারের শিক্ষা দিয়েছিলেন। অস্ত্র দুটির নাম ‘বলা’ আর ‘অতিবলা’। সে দুটি অস্ত্র কেমন, বাল্মীকি তা বলেননি। সম্ভবত ‘বল’ বা শক্তি থেকেই অস্ত্রদুটির নামকরণ। কিন্তু মূলের সেই অর্থ সরিয়ে রেখে বাগ্‌ব্যবহার অর্থেই আজকের আমরা যেন ওই দুটি অস্ত্রব্যবহারই শিখে চলেছি সানুরাগে। বলা আর অতিবলা। কথন আর অতিকথন। শুনতে চায় না আর কেউই।"চিন্তার চিহ্নমালা। সন্মাত্রানন্দের কলমে। আজ পঞ্চম পর্ব।

চিন্তার চিহ্নমালা’-র প্রথম পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন —-> প্রথম পর্ব

‘চিন্তার চিহ্নমালা’-র দ্বিতীয় পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন—>
দ্বিতীয় পর্ব

‘চিন্তার চিহ্নমালা’ তৃতীয় পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন —-> তৃতীয় পর্ব

‘চিন্তার চিহ্নমালা’ চতুর্থ পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন —> চতুর্থ পর্ব

শোনা কথা

লেখা-পড়ার থেকে কওয়া-শোনার ঐতিহ্য আমাদের দেশে প্রবলতর এবং প্রাচীনতর। শুধু আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীর সব প্রপিতামহী দেশের ক্ষেত্রেই একথা সত্যি। একজন বলবে আর একজন শুনবে, এই ধারাটি প্রজ্ঞা, দর্শন, বিজ্ঞান, কাব্য ও শিল্পকলার ইতিহাসে সমধিক অর্চিত হয়ে আসছে। আমাদের দেশের মানুষের বিশ্বাস লেখা কথার ওপর যতটা, শোনা কথার ওপর তার চেয়ে কিছু কম নয়। পালি ক্যানন, যেগুলি প্রধানত বুদ্ধোপদেশ, প্রায়ই শুরু হয়েছে ‘এবম্‌ মে সুতম্‌’ দিয়ে। ‘এবং মে শ্রুতম্‌’ যার সংস্কৃত রূপ। এর অর্থ হল, ‘এমনটা আমি শুনেছি।’ শুনেছি কার কাছ থেকে? শাস্তার কাছ থেকে, বুদ্ধের কাছ থেকে। শুনবার পর ভুলে যাইনি। মনে রেখেছি। মনে রেখে আবার উগরে দিচ্ছি তোমাদের কাছে। তোমরাও শোনো। শুনে মনে রেখো। বোলো তোমার পুত্রকন্যাদের, তোমার শিষ্যদের। এইভাবে শত শতযুগ ধরে বয়ে নিয়ে চলো শ্রুতির অঙ্গীকার।

অন্তত এই ব্যাপারটিতে বৌদ্ধরা নিজস্বতা দাবি করতে পারেন না। এই ঐতিহ্য ছিল বৈদিক পরম্পরাতেও। বেদের তাই অন্য নাম ‘শ্রুতি’। গুরু বলেছেন, শিষ্য বা শিষ্যা শুনেছেন। তো প্রথমবার বলেছিলেন কে? এ প্রশ্নের উত্তরে নির্দিষ্টভাবে কোনো ব্যক্তিবিশেষকে চিহ্নিত করা হয়নি। বরং ভাবা হয়েছে, এই জ্ঞান পরম্পরাবাহিত, পরম্পরাই এই জ্ঞানের উৎস। এই যে কোনো ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হল না, তার ফলেই এই জ্ঞান হয়ে উঠেছে নৈর্ব্যক্তিক। তাই বেদকে বলা হয়েছে ‘অপৌরুষেয়’। তা কোনো মানুষের দ্বারা সৃজিত বা নির্মিত নয়। আবিষ্কৃত এবং আবিষ্কারযোগ্য। যেকোনো দেশে যেকোনো কালে যেকোনো মানুষ তাকে পুনরায় আবিষ্কার করতে পারেন। যিনি আবিষ্কার করবেন, সৌভাগ্য তাঁর। বেদের সৌভাগ্য নয় যে, কৃষ্ণ বা রাম বেদনিহিত সত্য আবিষ্কার বা প্রচার করেছেন। কৃষ্ণ বা রামেরই সৌভাগ্য যে, তাঁরা একে খুঁজে পেয়েছেন কালের আস্তর সরিয়ে, প্রচার করেছেন মানুষের ভাষায়।

বেদ ‘অপৌরুষেয়’ অর্থাৎ পুরুষবিশেষের ওপর নির্ভরশীল নয়। ‘পুরুষ’ মানে এখানে পুংলিঙ্গবিশিষ্ট মানুষ মাত্র নয়। পুংলিঙ্গবিশিষ্ট মানুষ হচ্ছে ‘নর’, যার স্ত্রীলিঙ্গে হয় ‘নারী।’ ‘পুরে শেতি ইতি পুরুষঃ’—দেহপুরে যিনি শুয়ে আছেন, তিনি ‘পুরুষ’। সেই অর্থে নরও পুরুষ, নারীও পুরুষ। পরবর্তীকালে ‘পুরুষ’ শব্দের অর্থ যে করা হল male বা পুংলিঙ্গবিশিষ্ট মানুষ, সেই পরিকল্পিত অর্থসংকোচ একটা বামনাই চক্রান্ত। তা না হলে সংস্কৃত ভাষার ব্যাকরণ শাস্ত্রই দেখুন না কেন! First person-উত্তম পুরুষ, Second person-মধ্যম পুরুষ, Third person-প্রথম পুরুষ। পুরুষ মানে সংস্কৃত ভাষায় person। পুরুষ মানে male নয়।

এখন জ্ঞান ব্যক্তিনির্ভর নয় বলেই তা অপৌরুষেয়। এর ফলে রাম বা কৃষ্ণ কোনোকালে কেউ ছিলেন নাকি ছিলেন না, এটা প্রমাণ করাতে বা না-করাতে বেদের কিচ্ছু এসে যায় না। আমাদের আছে এক কথক-পরম্পরা। যাঁরা সমতট থেকে তক্ষশিলা, কাশ্মীর থেকে কাঞ্চী অনাদি কাল হতে কত নদীর ধারে ধারে, কত গ্রামের পথের ধুলায় ধুলায়, কত হাট-মাঠ-ক্ষেত-খেয়া পেরিয়ে চলেছিলেন ঘিয়ের প্রদীপ হাতে নিয়ে, জীর্ণ কুশাসনখানি বিছিয়েছিলেন গ্রামের বুড়ো বটতলায়, গল্প বলেছিলেন, কথা কয়েছিলেন, গান গেয়েছেন। সেসব গল্প-কথা- গান তুলে ধরেছিল এক সমুজ্জ্বল বিদ্যার ঐশ্বর্যকে। যাঁরা শুনেছিলেন সেসব গান-গল্প-কথা, তাঁরা সাধারণ মানুষ। তাই সেই বিদ্যা জনপ্রিয় হয়েছে। জনপ্রিয়তা আর বিদ্যাকৌলীন্য এ দুয়ের মধ্যে তখন কোনো বিরোধ সূচীত হয়নি। যা জনপ্রিয়, তা নিম্ন মানের আর যা উচ্চ মানের, তা সাধারণের জন্য নয়—এমন আত্মম্ভরী ভাবনা সেই প্রজ্ঞাবান কথকেরা তখন পোষণ করেননি। আজকের এই Class আর Mass এর কৃত্রিম বিভাজন, এই intellectual isolation অনেক পরের কালের কথা।

সেসব কথা-গান-গল্প শোনার স্মৃতি মানুষ মনে রেখেছে অনেক দিন। পরে সেসব পরবর্তী প্রজন্মের কাছে উগরে দিতে গিয়েও সেকথা কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মৃতিচারণ করতে মানুষ ভোলেনি। ঈশোপনিষদ-এ পাই—‘ইতি শুশ্রুম ধীরাণাং যে নস্তদ্বিচচক্ষিরে’—যাঁরা আমাদের এসব কথা ব্যাখ্যা করে বলেছিলেন, সেই সব সুধীদের কাছেই এমনটা শুনেছি।

কিন্তু গোল বাঁধল বক্তা-শ্রোতা-বক্তা-শ্রোতা এই শৃঙ্খলটিকে এগিয়ে নিতে গিয়ে। আর সেই গোল মানুষের বিস্মৃতির দুর্বলতা ও সদাসৃজনশীলতার শক্তিকে নিয়েই। শোনা কথা পুনরায় উগরে দিতে গিয়ে বাদ পড়ে যেতে লাগল কিছু মূল্যবান ইশারা। অন্যদিকে মূল আলোচনাটি পুনঃকথনকালে দিনে দিনে ফুলপল্লবপুঞ্জিত হয়ে উঠতে লাগল। যুগের পর যুগ এমন চলতে চলতে ‘সকালেনেহ মহতা যোগো নষ্ট পরন্তপ’ হয়ে দাঁড়াল। বিরাট কালপরিসরে শ্রুতিপরম্পরার মধ্য দিয়ে চলতে চলতে সেই বিদ্যা নষ্ট হয়ে গেল, এমন একটা আক্ষেপ সখা অর্জুনের কাছে শ্রীকৃষ্ণ করেছেন। আক্ষেপ দেখেই ছেড়ে দেওয়ার ছেলে নন শঙ্কর, গীতাভাষ্যে এমন নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণ নির্দেশ করেছেন, ‘দুর্বলান্‌ অজিতেন্দ্রিয়াণ্‌ প্রাপ্য যোগো নষ্ট ভবতি ইতি’—দুর্বল অর্থাৎ যার শরীরে শক্তি নেই, মনে শক্তি নেই, আর অজিতেন্দ্রিয় অর্থাৎ যার জীবনে কোনো ডিসিপ্লিন নেই, এমন অনধিকারী লোকের হাতে পড়ে যোগ বা বিদ্যা বাজারের দুধের মতো, শতকরা দশ ভাগ দুধ আর নব্বই ভাগ জল হয়ে যায়। এ ধরনের ফাতরা লোক পুনঃকথনকালে ভুলে গেল মূল কথা অর্ধেক, গোজামিল দিল বাকি অর্ধেক।

এমন একটা পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে সেকালের শিক্ষিত লোক এবার শ্রোতা বেছে বেছে কথা-গল্প-গান বলা আরম্ভ করল। এই বাছাবাছি প্রথমে বেশ সদর্থকই ছিল, কিন্তু তারপর ঘটল এক বিপর্যয়। ব্রাহ্মণের মনে হল, তাঁর ছেলেই এসব কথা শোনার সবচেয়ে উপযুক্ত, ছেলের থেকে ছেলের ছেলে—এইভাবে এক এক ব্রাহ্মণ বংশের হাতে বেদের এক এক শাখা। তখনও কিন্তু তা শ্রুতি পরম্পরাই। কিন্তু বংশলোপ তো হতেই পারে প্রকৃতির খেয়ালে বা কোনো আকস্মিক দুর্ঘটনায়। এবং তা হতও। এইভাবেই বেদের অনেক শাখা গেল হারিয়ে, সেই সব শাখা রক্ষণের দায়িত্ব ছিল যেসব ব্রাহ্মণ পরিবারের ওপর, তাদের উৎসাদন হয়ে যাওয়ার ফলে।

বোঝা গেল, মুখে বলা আর কানে শোনা দিয়ে আর চলবে না। এল লেখার যুগ। লিখিত জিনিস একদিকে যেমন স্থায়ী, অন্যদিকে তা সৃজনশীলতাকে খর্ব করেও দেয় কিছু মাত্রায়। পুথি থেকে পুথি নকল, নকলের তস্য নকল করা চলল, আর এই নকলনবিশীর ফাঁদে হারিয়ে গেল কথনের অমিতসম্ভব চারুপ্রতিমাটি। হারিয়ে গেল বক্তার ব্যক্তিমায়া, স্বরক্ষেপের কলাকৌশল, হারিয়ে গেল মুগ্ধ হয়ে গল্প শোনার প্রসাদগুণ।

এ ব্যবস্থাটাকে ভাঙার চেষ্টা করেছিলেন বুদ্ধ। প্রথমত, তাঁর শ্রোতারা সর্ব শ্রেণীর, ভাষাটিও সেযুগের মৌখিক ভাষা, ভঙ্গিমাটি গল্প-কথনের। তাঁর দেখাদেখি শত শত যুগ ধরে আবার একবার চারণ-কথকেরা পুরোনো ধারায় ফিরে গেলেন। মহাভারতের গল্প বলতে লাগলেন সুত, পুরাণের কথা অভিনয় করে বলতে লাগলেন কথকঠাকুর, গান গেয়ে আর গল্প কয়ে বেড়াতে লাগলেন কবীর, তুকারাম, তুলসীদাস, নানক, চৈতন্য, লালন, আউল, বাউল, সাঁই।

এভাবে চলতে চলতে একদিন লেখার ভাষাকে মুখের ভাষার কাছে সরিয়ে আনার প্রয়াসও দেখা দিল। কিন্তু সেই প্রয়াসের মধ্যেও আরেক অন্য বিপদ দেখা দিল। ইতোমধ্যে লেখাকে আশ্রয় করে একাকী গভীর চিন্তার অভ্যাস তৈরি হয়েছে। লিখতে লিখতে লেখক ভাবেন, পড়তে পড়তে পাঠক ভেবে চলেন। সেখানে লেখা বা পড়া থামিয়ে খানিক ভাববার অবকাশ আছে। কিন্তু শুনতে শুনতে তো আর বেরসিকের মতো বলা যায় না, ‘ও কথকঠাকুর! একটু থামো গো! এইমাত্র যেটা বললে, সেটা আমি একটু ভেবে লই!’

কথন আর শ্রবণের মধ্যে চিন্তার পর্যাপ্ত অবকাশ না থাকার ফলে শোনা কথার খরিদ্দারেরা একটু অভাবুক হয়ে গেছেন এতদিনে। আর লিখন আর পঠনে সেই চিন্তার সুযোগ থাকায় লেখাপড়া হয়ে গেছে বিদ্বানের করতলগত। লেখার ভাষাকে কথার ভাষায় রূপান্তরিত করার প্রয়াসে বিপদ হল এই, তাতে চিন্তার ঐশ্বর্যের হানি ঘটতে থাকে পদে পদে।

অথচ যতক্ষণ না বিদ্যাসমারোহে সর্বজনের আমন্ত্রণ অবাধ অকুণ্ঠ হয়, ততক্ষণ বিদ্যার মুক্তি নেই। সেই বিদ্যা, যা মুক্তি দেয়। সা বিদ্যা যা বিমুক্তয়ে। এখন বিদ্যাকে মুক্তি দেবে কে লিখিত অক্ষরের শৃঙ্খল থেকে?

পাঠ বা উচ্চারণ বা কথন সব লেখা পরিবহণের উপযুক্ত মাধ্যমও হতে পারে না। অনেক লেখা শুধু চোখ দিয়ে পড়ার জন্যেই। আর বোধ যতই উন্নত হতে থাকে, ততই তা শব্দনির্মোক সরিয়ে দিতে চায়। পরম বোধ ভাষায় প্রকাশ্য নয়। নীরবতাই তার ভাষা। অবচনেনৈব ব্রহ্ম প্রোবাচ ইতি শ্রূয়তে—‘অবচন বা নৈঃশব্দ্যের দ্বারাই ব্রহ্মবিদ্যা ব্যাখ্যা করা যায়, একথা শুনেছি,’ লিখেছেন আচার্য শঙ্কর ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে।

তবুও আমাদের কান তীক্ষ্ণ। বিশেষত বাঙালির। বাংলা ভাষার ধ্বন্যাত্মক অব্যয়গুলিই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। আমরা শুধু শব্দই কানে শুনি না, দৃশ্যও শুনি, স্পর্শও শুনি, স্বাদও শুনি, গন্ধও শুনি, এমনকি মনের শব্দও শুনতে পাই আমরা বাঙালিরা। আমাদের ভাষায় শুধু টিপ্‌ টিপ্‌ করে বৃষ্টিই পড়ে না, কড়্‌ কড়্‌ করে শুধু বাজই পড়ে না বা ঢং ঢং করে ঘণ্টাই শুধু বাজে না, আমাদের জ্যোৎস্না হয়ে ওঠে ফুটফুটে, আমাদের অন্ধকার হয়ে ওঠে মিশমিশে কালো। ঝালে কির্‌ কির্‌ করে আমাদের জিভ, কটকটে হয়ে ওঠে আমের টক। ভুরভুর করে গন্ধ ছড়ায় আমাদের ভুঁইচাঁপা। সিমসিম করে আমাদের গা, ঘিনঘিন করে শরীর ঘেন্নায়, চটচট করে ভেলিগুড়, সিরসির কনকন করে ওঠে শীতকালে আমাদের দাঁত ঠান্ডা জল লেগে। ক্রোধে আমরা রি রি করে উঠি, বন্‌ বন্‌ করে ঘোরে আমাদের মাথা, মট্‌ মট্‌ করি আমরা অহংকারে, এমনকি মিট্‌ মিট্‌ করে আমরা হাসিও। তার মানে, শব্দ ছাড়াও দৃশ্য-স্পর্শ-স্বাদ-ঘ্রাণ এবং মনের নানা বিমূর্ত অবস্থাকেও আমরা ধ্বনি বা আওয়াজে রূপান্তরিত করে থাকি।

এবং শোনা কথার মধ্যে একটা অনিশ্চয়তা আছে, যা আমরা উপভোগ করি। হতেও পারে, নাও পারে। ফলত, জীবনানন্দের ‘শোনা গেল, লাশকাটা ঘরে নিয়ে গেছে তারে’ থেকে শুরু করে মৌসুমী ভৌমিকের ‘আমি শুনেছি সেদিন তুমি সাগরের ঢেউয়ে চেপে নীল জল দিগন্ত ছুঁয়ে এসেছ’ পর্যন্ত সেই এক অনিশ্চয় শ্রবণের ট্র্যাডিশন। এটা আমাদের ভালোই লাগে। অনিশ্চয়তার ফাঁক দিয়ে আমরা অনেক বেশি কল্পনা করতে পারি।

শ্রবণের এতখানি প্রাকৃতিক সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও আমরা ইদানীং শুনবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছি দেখে দুঃখ জাগে। আমরা এখন সকলেই বলতে শিখেছি। না শুনেই বলে চলা। এক ‘অনুপম বাচনের রীতি’ শিখেছি আমরা। রাম ও লক্ষ্মণকে বিশ্বামিত্র মুনি তাড়কা রাক্ষসী বধ করতে নিয়ে যাওয়ার সময় দুখানা অস্ত্র ব্যবহারের শিক্ষা দিয়েছিলেন। অস্ত্র দুটির নাম ‘বলা’ আর ‘অতিবলা’। সে দুটি অস্ত্র কেমন, বাল্মীকি তা বলেননি। সম্ভবত ‘বল’ বা শক্তি থেকেই অস্ত্রদুটির নামকরণ। কিন্তু মূলের সেই অর্থ সরিয়ে রেখে বাগ্‌ব্যবহার অর্থেই আজকের আমরা যেন ওই দুটি অস্ত্রব্যবহারই শিখে চলেছি সানুরাগে। বলা আর অতিবলা। কথন আর অতিকথন। শুনতে চায় না আর কেউই। ক্রমাগত বলতে বলতে আর অতিশয় বলতে বলতে কথন-পারঙ্গম সোনামণি হয়ে উঠছি আমরা দিনকে দিন।

আহা, এমন সোনামণি না হয়ে আমরা দুয়েকজন যদি ‘শোনামণি’ হয়ে উঠতে পারতাম!

(ক্রমশ)

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (18)
  • comment-avatar
    Ruma 5 years

    অসাধারণ।

  • comment-avatar
    Sruti Chakraborty 5 years

    খুব ই ভালো লাগলো।সময়োপযোগী এবং প্রাসঙ্গিক তো বটেই

  • comment-avatar
    Bratati 5 years

    এই লেখা এমন যে পড়ার পর বলা বা অতিবলার ইচ্ছা থাকে না।
    আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই

  • comment-avatar
    Arijit Chakraborty 5 years

    দারুন, মুগ্ধ হয়ে পড়লাম। অনেক গুরু-গম্ভির বিষয়কে এত সহজ ও সাবলিল ভাবে উপস্থাপনা, মহারাজ ছাড়া আর কারোর পক্ষে সহজ সাধ্য না…

    প্রনাম নেবেন, মহজরাজ। 🙏🌷

    • comment-avatar
      Sanmatrananda 5 years

      নমস্কার নেবেন।

  • comment-avatar
    সঞ্চালিকা 5 years

    চিন্তার চিহ্নমালা আমাদের মনোজগতকে প্রসারিত করছে প্রতিটি পর্বে। অপূর্ব সিরিজ চলছে। লেখককে প্রণাম।

    • comment-avatar
      Sanmatrananda 5 years

      প্রাথমিকভাবে আমার নিজেরই মনের সম্প্রসারক এই লেখা। তবে তা যদি অন্যদের উপকারক হয়, আনন্দের কথা। শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানাই।

  • comment-avatar
    পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায় 5 years

    অনেক কিছু শিখলাম।দারুণ লাগছে লেখা।

    • comment-avatar
      Sanmatrananda 5 years

      অনেক ধন্যবাদ।

  • comment-avatar
    Debabrata 5 years

    অসাধারণ! মুগ্ধ হয়ে পড়লাম। প্রণাম নেবেন।

    • comment-avatar
      Sanmatrananda 5 years

      শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা

  • comment-avatar

    অসাধারণ। আগের পর্বগুলো মিস হল।

    • comment-avatar

      আগের সবকটা পর্বের লিংক তো দেওয়া আছে। ক্লিককরুন

  • comment-avatar
    Shawkat Ali 4 years

    ১ থেকে ৭ পর্যন্ত পড়া হল ক্রম ভেঙ্গে। তাতে কোন সমস্যা হয়নি। কারণ প্রতিটা পর্বের বিষয় স্বতন্ত্র। একেকটা পর্ব পড়ছি আর স্তব্ধ হয়ে বসে থাকছি অনেক– অনেকক্ষণ। শুধু বলতে ইচ্ছে হয়, জীবনানন্দের ভাষায়, এতদিন কোথায় ছিলেন?

  • comment-avatar

    “সামান‍্য” এখানে পরিমাণবাচক‌ও হতে পারে।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes