চিন্তার চিহ্নমালা ৪  <br /> সন্মাত্রানন্দ

চিন্তার চিহ্নমালা ৪
সন্মাত্রানন্দ

"জিব্রানের ‘ধুলো-ফেনা’ আর আমাদের এই ঔপনিষদ ‘খড়-কুটো’ খুব আলাদা তো নয়! প্রকৃতির আপাত-তুচ্ছ উপাদান বেছে নিয়ে ভালোবাসা প্রাণের পুনর্জন্ম দেয়। কিন্তু মাতৃকুক্ষি থেকে বেরিয়ে এসে দিনে দিনে রক্তমাংসের অবয়বের ভিতর পরিপুষ্ট হতে হতে মানুষ ভুলে যায়, সে আসলে খড়কুটো থেকেই জন্মেছে। রক্তমাংস চিরকাল খড়কুটোকে তুচ্ছ করে। এমনকি অন্য রক্তমাংসের পুতুলদেরও সে খড়কুটোর মতো তুচ্ছ করতে শেখে। যদি কেউ উঠবার সিঁড়িটা ঠিকমতো খুঁজে না পায়, কিংবা সিঁড়ি দিয়ে উঠে কোনো একটা অসমাপ্ত ধুলামলিন ধাপে কেউ ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে, অথবা কী জানি কী ভেবে সিঁড়ি দিয়ে কিছুদূর অবধি উঠে কেউ আবার সিঁড়ি বেয়ে নেমে চলে আসে, নয়তো ছাদে উঠে যাওয়া লোকেদের উপযুক্ত না হয়ে উঠতে পারে যদি কেউ, তবে সেই পরাস্ত পরাহত পরাজিত মানুষকে ‘খড়কুটো’ জ্ঞান করে অন্য সব সফল মানুষ। রক্তের গর্ব! মাংসের অস্মিতা! যেন এই রক্ত-মাংস খড়কুটো থেকে আলাদা কিছু—এমন ভুল ভাবনা থেকে মানুষ প্রকৃতিকে সংহার করে, নিজের বাইরে এবং নিজের ভেতরেও।" চিন্তার চিহ্নমালা-র চতুর্থ পর্ব লিখলেন সন্মাত্রানন্দ।

চিন্তার চিহ্নমালা’-র প্রথম পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন —-> প্রথম পর্ব

‘চিন্তার চিহ্নমালা’-র দ্বিতীয় পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন—>
দ্বিতীয় পর্ব

‘চিন্তার চিহ্নমালা’ তৃতীয় পর্ব পড়ার জন্য ক্লিক করুন —-> তৃতীয় পর্ব

খড়কুটো

‘প্রগাঢ় বসন্তবৈকাল মরিয়া আসিতেছে। আলোকসমুদ্রের প্রান্তদেশে একটি বিষণ্ণ অথচ ঋজু অর্জুনবৃক্ষের কোটরের ভিতর সামান্য খড়কুটা লইয়া একটি ঝিনুকশাদা পালকের মিছরিপাখি একা একা বাসা বাঁধিতেছে…’

এইভাবে শুরু হলেও হতে পারে একটি উপন্যাস। কী নিয়ে সেই উপন্যাস, কে লিখবেন, মিছরিপাখি কাকে বলে, ঝিনুকশাদা বলতে কেমন রঙ বোঝায়, বানানটা ‘শাদা’ হবে নাকি ‘সাদা’, জীবনানন্দ কেন সারা জীবন ‘শাদা’ লিখেছেন, এসব প্রশ্নের থেকে এ মুহূর্তে যেটা আমার চোখ টেনে নিচ্ছে, তা ওই ‘সামান্য খড়কুটো’।

‘খড়কুটো’-র আগে ‘সামান্য’ বিশেষণটা দরকার ছিল কি খুব? আমরা তো চিরকাল ‘খড়কুটো’ কথাটা তুচ্ছার্থেই ব্যবহার করে থাকি। যেন তা খুবই অকিঞ্চিৎকর। কোনোরকম উল্লেখের উপযুক্ত নয়, এমন কিছু বোঝাতেই এর ব্যবহার। কিন্তু এতটা তুচ্ছতা ‘খড়কুটো’-র কি পাওনা ছিল?

খড় আর কুটো। দুটোই প্রাকৃতিক উপাদান। পাখিজীবনের সঙ্গে যার তলে তলে যোগাযোগ। পাখিও অসংশোধনীয়ভাবে প্রাকৃতিক। একটি পাখি সারা দিনমান খুঁটে খুঁটে এই খড়, কুটো জোগাড় করে। ঠোঁটে করে নিয়ে আসে সূর্যের আলো কমে এলে। তারপর বাসা বোনে। থাকার জন্য যত না, ডিম পাড়ার জন্য ততোধিক। কতটা উত্তাপ, কতটা ভালোবাসার স্পর্শ তার ডিমের জন্য দরকারি, পাখি-মা তা জানে। সেই ভালোবাসার পার্থিব আধার এই খড়কুটোর হেলঞ্চনীল বাসা। ক্রমে ক্রমে রোদ পেয়ে সেই নীল হয়ে ওঠে পাকা করমচার মতো সোনালি, লাল এবং শেষে খোড়োহলুদ। খড়কুটোর ভেতর এতগুলো রঙের সম্ভাবনা আছে, স্নেহনীড় বয়নের উপাদান আছে, নতুন একটি প্রাণের জেগে ওঠার অস্ফুট আভাস আছে, আমরা তা ভাবিনি কখনও। পাখিরা ভেবেছে।

কিন্তু শুধু পাখিশরীরই তো নয়, আমাদের মানুষের শরীরও তো ওই খড়কুটো দিয়েই তৈরি। আকাশে যখন মেঘ করে আসে, ‘বৃষ্টি হব হব’ করে, তখন সেই মেঘমলিন ধূলির ভিতরে একটি আসন্নসম্ভব প্রাণকণা এসে মেশে। স্পন্দিত হয়। বৃষ্টি নামে। বৃষ্টিবিন্দুর ভিতরে ধুক-ধুক করা সেই প্রাণ মাটিতে আহিত হয়। শিকড়ের মধ্য দিয়ে মাটির রসের সঙ্গে মিশে প্রাণ প্রবেশ করে খড়ে, কুটোয়, শস্যে, দানায়। শস্য খাদ্য হয়ে পুরুষের শরীরে ঢুকে বিপাক ক্রিয়ায় বীর্যে পরিণত হয়। শস্য খাদ্য হয়ে নারীশরীরে হয় রজঃ। প্রাণের এই দ্বিধাবিভক্ত লীলা পরস্পরকে অবিরত টানে। তারপর তারা দৈবাৎ ঘনিষ্ঠ হলে প্রাণের দুই ধারা এক হয়ে ভ্রুণ হয়ে যায়। ভ্রূণ মাতৃগর্ভে কাঁপে। খড়কুটো মায়ের শরীরের ওম পেয়ে রক্তমাংস হয়ে যায়। এরকমই কিছু কথা একটি পুরোনো কবিতার বইতে আছে। বইটির নাম ছান্দোগ্যোপনিষদ।

লেবাননের কবি কহ্‌লিল জিব্রান তাঁর ‘দ্য প্রফেট’ কাব্যগ্রন্থেও এমনই কিছু কথা লিখেছিলেন বইটির শেষাংশে—‘একটুখানি অপেক্ষা/ তারপর আমার আকাঙ্ক্ষা/ কুড়িয়ে নেবে ধুলো আর ফেনা/ আমাকে ধারণ করবে অন্য এক নারী’ (অনুবাদঃ অজিত মিশ্র)।

জিব্রানের ‘ধুলো-ফেনা’ আর আমাদের এই ঔপনিষদ ‘খড়-কুটো’ খুব আলাদা তো নয়! প্রকৃতির আপাত-তুচ্ছ উপাদান বেছে নিয়ে ভালোবাসা প্রাণের পুনর্জন্ম দেয়। কিন্তু মাতৃকুক্ষি থেকে বেরিয়ে এসে দিনে দিনে রক্তমাংসের অবয়বের ভিতর পরিপুষ্ট হতে হতে মানুষ ভুলে যায়, সে আসলে খড়কুটো থেকেই জন্মেছে। রক্তমাংস চিরকাল খড়কুটোকে তুচ্ছ করে। এমনকি অন্য রক্তমাংসের পুতুলদেরও সে খড়কুটোর মতো তুচ্ছ করতে শেখে। যদি কেউ উঠবার সিঁড়িটা ঠিকমতো খুঁজে না পায়, কিংবা সিঁড়ি দিয়ে উঠে কোনো একটা অসমাপ্ত ধুলামলিন ধাপে কেউ ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে, অথবা কী জানি কী ভেবে সিঁড়ি দিয়ে কিছুদূর অবধি উঠে কেউ আবার সিঁড়ি বেয়ে নেমে চলে আসে, নয়তো ছাদে উঠে যাওয়া লোকেদের উপযুক্ত না হয়ে উঠতে পারে যদি কেউ, তবে সেই পরাস্ত পরাহত পরাজিত মানুষকে ‘খড়কুটো’ জ্ঞান করে অন্য সব সফল মানুষ। রক্তের গর্ব! মাংসের অস্মিতা! যেন এই রক্ত-মাংস খড়কুটো থেকে আলাদা কিছু—এমন ভুল ভাবনা থেকে মানুষ প্রকৃতিকে সংহার করে, নিজের বাইরে এবং নিজের ভেতরেও।

গ্রিক পুরাণের অরিওনের কথা মনে আছে? আর্টেমিসের প্রিয় বন্ধু ছিল সে। তারা দুজনেই দক্ষ শিকারী। একদিন অরিওন আর্টেমিসের কাছে বাকতাল্লা করে বলেছিল, সে নাকি পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকে হত্যা করতে পারঙ্গম। এই কথা শুনেছিলেন ভূমিমাতা গৈয়া। অরিওনের গর্ব চূর্ণ করতে গৈয়া পাঠিয়েছিলেন এক দৈত্যাকার বৃশ্চিককে। সেই বৃশ্চিকের দংশনেই অরিওন মারা যায়। আকাশে নক্ষত্রমণ্ডল হয়ে ফুটে ওঠে অরিওন।

সমস্ত অস্মিতাকে প্রকৃতি ধ্বংস করে দেবে। সকল ক্ষমতায়নকে। খড়কুটোর প্রতি রক্তমাংসের এই তুচ্ছতা-প্রদর্শন, এই দম্ভ—এও ধ্বংস করে দেয় প্রকৃতি নিজ হাতে। ওই জন্যেই মানুষ একদিন মারা যায়। রক্তমাংস ঠান্ডা হয়ে পচে যায়। মাটি হয়ে যায়। সেই মাটির থেকে আবার প্রাণ পেয়ে জেগে ওঠে খড়কুটোরা। সেই খড়কুটো মুখে করে নিয়ে গিয়ে মিছরিপাখি গাছের কোটরে বাসা বাঁধে। পাঞ্চভৌতিক খড়কুটোর সেই বাসা পক্ষীপ্রণীত।

পাখিরা তাহলে এই সত্য কোনোভাবে জেনে গেছে। যেহেতু পাখি রক্তমাংসের বিজ্ঞান দিয়ে, যুক্তি দিয়ে ভাবে না কোনোদিন। সে ভাবে কাদা, জল, মুথা ঘাসের স্বজ্ঞা দিয়ে। তাই পাখি সবসময় খড়কুটোর কাছাকাছি থাকে। সে জানে, খড়কুটো থেকে পাখি জন্ম পেয়ে কিছুদিন ওড়াউড়ি সেরে নিয়ে পুনরায় সে খড়কুটো হবে।

এখন ভাবা যাক, যদি মানুষ পাখির মতই তার নিজের খড়কুটোত্ব মনে রাখত, তাহলে কী হত? নিজের ভেতর তখন সে খড়কুটোকে বাড়তে দিত। সূর্যের আলোর দিকে খড়কুটোর মতো বেড়ে উঠত সে। অন্ধকার প্রহাণ করা তার স্বভাব হত। তার মগজ অন্ধকারের রহস্যভেদে ব্যাপৃত না থেকে আলোকলতার উন্মেষের দিকে আগ্রহী হত। সবিতাকে সে ভালোবাসত, অরিওনকে নয়। এমনটা হলে একদিন ঠিক তার হাতদুটো পাতাকুটোখড়ের সঞ্জীবনী পেয়ে ডানা হয়ে যেত। তখন ডানার উল্লাসে সে উড়ে যেত পারত সবিতৃলোকের দিকে।

পারত শুধু নয়, এখনও পারে। মানুষের সম্ভাবনা কি শেষ হয়ে গেছে বলে মনে করো, সুশোভন? তোমার সুরুচির ছিরিছাঁদ খুলে দেখলে এখনও টের পাবে কতখানি খড়-জল-ঘাস-কুটো তোমার ভেতর রয়ে গ্যাছে। ভেতরের বাসনা, কল্পনা, চিন্তাগুলো এখনও কত বুনো, কত সজীব, তোমার কল্পনাগুলো এখনও কত মিথনিগূঢ় আরণ্যক! জীবনের আরোপিত সমুচ্চতাকে যদি উপেক্ষা করতে পারো, যদি এই খড়-কুটোকে মহার্ঘ বিবেচনা করতে পারো, তবে তোমার ভাষা হয়ে উঠবে এই খড়কুটোর মতোই নির্ভার নিজস্ব। বিকেলের দিকে সামান্য হাওয়া দিলে তখন পলকেই তুমি তোমার রক্তমাংসের পোষাক পৃথিবীর ধুলায় ফেলে রেখে উড়ে যাবে এই মরণীয় সমঝোতার ভুবন ছেড়ে সমুদ্রশঙ্খের সপ্তদ্বীপে, যেখানে তোমার সঙ্গে দেখা হবে প্রজ্ঞাবান পাখিদের। সেই যারা সেন্ট ফ্রান্সিসের বোন। সঙ্ঘ থেকে বহিষ্কৃত ফ্রান্সিস যেসব পাখিবোনেদের তাঁর প্রিয় প্রভুর গল্প বলেছিলেন। তারপর থেকে সেই পাখিবোনেরা কখনও বাসা বাঁধেনি নিজেদের থাকার জন্যে। শুধু কখনও কখনও প্রাণের খেয়ালে নিজেদের ভেতর জমে থাকা আলোর ঝরনাটাকে মুক্তি দিতে গিয়ে তারা যেসব নীল ডিম বুনন করেছে, সেই সব ডিমের সুরক্ষার জন্য বাসার ওম প্রণয়ন করার তাগিদে তারা খড়কুটো দিয়ে নীড় বয়ন করেছে।

কত ভালো হবে, যদি তুমি এই মনুষ্যচরিত আর মনুষ্যরচিত জ্ঞানবিজ্ঞানের কথা ভুলে যাও! যদি খড়কুটোর ধ্যানে মগ্ন হয়ে নিজের তুচ্ছতা বুঝে নিয়ে পাখির ডিম হয়ে জন্মাও কোনো মায়াবী দ্বীপের কোনো মায়াতরুর প্রশাখায় বিধৃত নীড়ের ভেতর! এইসব অর্থহীন আঁতাত, দলবদল, দ্বিচারিতা, স্ববিরোধের জটিল রাজনীতি ছেড়ে ধুলো থেকে বীজ বিনীত ঠোঁটে তুলে নিয়ে যদি ফেলে আসো কুবাইয়ের চরে! তাহলে আকাশের অরিওন নক্ষত্রমণ্ডলী হয়ে নিষ্পলক চোখ মেলে এই দৃশ্যপাপ দেখে চলার জীবন থেকে তোমার মুক্তি হবে। খড়কুটোর মর্মর শুনতে পাও না কি, সুশোভন, পঞ্জরাস্থির ভেতর? শুনতে পাও না কি হাওয়ার ইশারা? প্রথম বৃষ্টির সুগন্ধ? যা তুমি খুঁজছ, তা যে অনির্বচনীয় খড়কুটোর ভেতর শব্দের অহংকার জয় করে নীরবে অনাহত নৈঃশব্দ্যে লীন হয়ে আছে!

(ক্রমশ)

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (11)
  • comment-avatar
    Ruma 3 years

    Darun

  • comment-avatar
    swabarna 3 years

    অপূর্ব।

  • comment-avatar
    পাপড়ি গঙ্গোপাধ্যায় 3 years

    কী ভালো! এই সব চিন্তা সকলের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক। মন পরিশিলীত উন্নত হোক।

    • comment-avatar
      Sanmatrananda 3 years

      ধন্য্যবাদ। একই প্রার্থনা করি।

  • comment-avatar
    sibu mondal 3 years

    চারটি পর্বই পড়ে ফেললাম এক ঘোরের মধ্যে।কী অসামান্য লেখা।শ্রদ্ধা ও প্রণাম নেবেন আমার।

    • comment-avatar
      Sanmatrananda 3 years

      আপনি আমার নমস্কার ও ভালোবাসা নিন।

  • comment-avatar
    স্বাতী 3 years

    নতুনভাবে চিন্তা করতে শেখাচ্ছেন। ধন্যবাদ৷

  • comment-avatar

    “সামান‍্য” এখানে পরিমাণবাচক‌ও তো হতে পারে।

  • comment-avatar

    “সামান‍্য” এখানে পরিমাণবাচক‌ও হতে পারে।

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
    410 Gone

    410 Gone


    openresty