
খোলা তলোয়ারের মতো কাব্যভাষা
অভিজিৎ দাসকর্মকার
জীবনের পাজামা ও গিঁট কবি বিল্বমঙ্গল গোস্বামী প্রকাশক- সমাকৃতি
” একটা মাঝবয়সী বউ, একটি লিকলিকে বাচ্চা
চলে যেতে যেতে কোনোরকমে টিকে যাওয়া একটা চাকরি
একটা ভাঙা গিটার,আর একটা ঢলঢলে পুরোনো পাতলুন
এই আমার কবি জীবন।
সেই পাজামায় মিনিমাম ছত্রিশটা গিঁট। সাঁইত্রিশ
বছর ধরে আমি গিঁট খুলে চলেছি। একটা খুলছি তো
আর একটা লেগে যাচ্ছে। এরকমই এক একটি গিঁটের মাঝে
ছোটো বিজ্ঞাপন, এর মধ্যেই কখনো চুপ করছি কখনও কথা বলছি,
কখনো রাত্রির দুরভাষে বোকামেয়ের সঙ্গে
স্মার্ট কিংবা ন্যাতন্যাতে পঁয়ত্রিশ মিনিট বকমবকম। ”
শুরু হয় কবির কবি জীবন। তার আগে তাঁর নিতান্তই ব্যক্তিগত জীবন, যা তাঁকে আত্মীয়তায় বাঁধে, আবেগঘন করে, পরিচয় দেয়, ঘর ফেরার তাগিদও বলতে পারি আমরা। কতো শুকনো এবং সিক্ত অনুভূতি নিয়ে কবি যাপন করেছেন কবিতার অল্পদিনের জীবন। অথচ কী প্রচণ্ড দৃঢ় লেখনী। বলতে পারি, খোলা তলোয়ারের মতো কোনো রাখঢাক নেই তার কাব্যভাষার। সরল, ঋজু এবং একইসঙ্গে বিদ্রূপাত্মক ব্যঙ্গকৌশল তার চারপাশের এমনকি আমাদের সকলেরই পরিধি জুড়ে কৃত্রিম জীবনযাপনের প্রতি।
কবি বিল্বমঙ্গল গোস্বামীর ” জীবনের পাজামা ও গিঁট ” সমাকৃতি প্রকাশন থেকে ২০০৮ সালে প্রকাশিত। কবি বিল্বমঙ্গল গোস্বামী ২০১২ সালে পরলোক প্রাপ্ত হন। কবিতাকে তিনি ভ্রাম্যমাণ বলতেন, অর্থাৎ আমরা যাকে বর্তমানে কবিতায় Multidimensional বা বহুরৈখিক বলে থাকি। তাঁর লেখায় এক অদৃশ্য বিজ্ঞান বোধের কারুশিল্প লক্ষ্য করা যায়—
” তাহলে স্বীকার করো তোমারও বেদনা আছে। তোমাকেও মাঝে মধ্যে লুকিয়ে কাঁদতে হয় আড়ালে আবডালে। তোমারও মায়ের কথা মনে পড়ে কখনও সখনও নিঃসঙ্গ ছাদের কিনারে৷
আমাকেও রোজ রাতে কষ্ট গিলতে হয়। চোখবুজে ভুলে যেতে হয় কোথায় কোন্ ঘিঞ্জি-গলির ঘরে ছেঁড়া-শাড়ি মা আমার উলকাঁটায় স্বপ্ন বুনছেন দ্বিতীয় পুত্রের শোয়েটারে।
একদিন এ বুনন শেষ হয়ে যাবে। তোমারও শরীর থেকে ঢেউ হবে ফেনা। পুত্রহীন পুত্রবধূহীন ছাদ ঠোঁট কামড়ে হাসবে। তখন তোমারও হাতে পুরানো উলকাঁটা, স্বপ্নহীন শোয়েটার, শীত।
সেদিন তুমিও মা, আমার মায়ের মতোই। ”
কী অবলীলায় কবি বিল্বমঙ্গল গোস্বামী তাঁর মা এবং তাঁর সন্তানের মা-কে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দিলেন, সামান্য সিনট্যাক্স পরিবর্তন করে। আবার যখন —
“সারাজীবন ধরে একটি মাত্র কবিতাই লিখে এসেছেন আপনি— আটা দেড় কিলো, চাল দুকেজি, আলু পাঁচশো গ্ৰাম…। রোজ রোজ সকালে লেখা চিরকূট কবিতা আপনার প্রতিদিন সজীব করেছে প্রাণ, সবুজ করেছে দেহ। এইসব জীবন কবিতা লিখে, এইসব জীবনমুখী কবিতা লিখে লিখে আপনি স্বয়ং আজ কবিতা হয়ে গেছেন। এখন আপনার সামনে জীবন্ত দাঁড়ালে মনে হয় হিমালয়ের নীচে আমি এক ছোট্ট দেবদারু। তাই আপনাকে নিয়ে কিছুই লেখা হল না, আমি অক্ষম। আসলে কবিতা নিয়ে কবিতা লেখা অসম্ভব, কবিতার হিমালয় আঁকা যায় না।” ( বাবাকে নিয়ে লেখা )
কবি বিল্বমঙ্গল গোস্বামী কী অদ্ভুত ভাবে লাইনগুলি লিখে দিয়েছেন, যেখানে বাবার প্রতি ছেলের দৃষ্টিকোণ এক অবিমিশ্র শ্রদ্ধা, সকল সন্তানের জীবনে পিতার গুরুত্ব এমনকি পিতাকে নিয়ে কবিতা লিখতে গিয়ে কবি Calculative হয়ে পড়েছেন, কিসের ক্যালকুলেশন?কবি নিজে তাঁর বাবকে নিয়ে কিছু লিখে উঠতে পারেননি, কারণ তাঁর কাছে তাঁর বাবা নিজেই এক সুদীর্ঘ কবিতা। সুঠাম হিমালয়। এইযে কবি বিল্বমঙ্গল গোস্বামীর তাঁর বাবাকে নিয়ে তাঁর, কবিতা না লিখতে পারার এক তীব্র আকুতি যার মধ্যমণি কবি নিজেই এবং আমার মনে হয়েছে তাঁর পরিধিজুড়ে সুপরিচিত স্থিতিশীল সামষ্টিক পরিবেশ, এমনকী বাবা ও ছেলের গভীর অবর্ননীয় চিত্রকল্পের সেতু ‘ বাবাকে নিয়ে লেখা ‘ কবিতাটিই।
কবি বিল্বমঙ্গল গোস্বামীর কবিতায় আছে প্রেম এবং প্রকৃতির অমোঘ হাসির সাথে প্রেম স্বরূপ প্রেমিকার অন্বেষণ।
” তোমার ফোন মানে দার্জিলিং-এর ঠাণ্ডা বাতাস
তোমার সঙ্গে কথা বলা মানে
টাইগারহিল থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার ভোর
রঙিন আলোতে স্নান… ”
আবার —
” তোমার জন্য একটি কালো মিটমিটে লোক
একটি দাড়িওয়ালা মুখ আর
কিছু অগোছালো চুল
অপেক্ষা করছে। কবে আসছো? ”
কতো অব্যক্ত কথাকে কতো সুন্দরভাবে সাবলীল, সহজ, সরল এবং প্রাসঙ্গিক অক্ষরে প্রকাশ করলেন। যা সহজেই পাঠকের মননে প্রবেশ এবং দীর্ঘকাল যাবৎ বাসা বাঁধতে সমর্থ হতেই পারে। তাই বলতেই পারি কবির পুরোনো দিনগুলির, কোনো জেরক্স কপি নেই। তবু কথা জমে জমে পাথর, কান্না জমে জমে বরফ হয়ে চলেছে।
” বোকা মেয়ে তোর সঙ্গে ঝগড়া করব সারারাত
চুল ধরে চুলের মুঠি ধরে খাট থেকে মেঝেতে নামাবো
স্যাঁতসেঁতে মাটির বিছানা, এঁদোগলি, ভাঙা সিঁড়ি তোকে
শেখাবো সারারাত।
কীভাবে কথা বলতে বলতে চুপ আর
চুপ করে কথা বলা যায় — তার তাল, লয়, মাত্রা
শেখাবো সারারাত। ”
কবি বিল্বমঙ্গলকে আমাদের মননে বাসা দেবার আগেই তার প্রাণপাখী ফুরুৎ করে উড়ে দিলো। তাঁর কবিতায় প্রতিটি Para, Paradox এমনকি Parapsychology বিভিন্ন আঙ্গিকে প্রবাহিত নদী হয়ে ধ্বনিত।
” তোমাকে ভাববো বলে এই যে কলম নিয়ে বসা
এই যে কাগজ পাতা, এই যে সবার মধ্যে একা
এই যে ঠাণ্ডা তরল তোমাকে ভাববো বলে পান
বিছানাকে বলে রাখি, একদা শুকিয়ে যাবে নদী
একদিন সব আলো নিভে যাবে নদীর ওপারে
যেদিন তোমাতে দেব ডুব, তোর কাছে সেরে নেব স্নান। ”
( বিছানাকে বলে রাখি)
Last but not the least, শেষ কিন্তু অন্তত না—
” শোনো, তোমার সঙ্গে কয়েকটা জরুরী কথা আছে।।আমাকে যখন মেঝেতে শুইয়ে রাখবে তখন সাদা কাপড় চাপা দেবে না। আমি সরলভাবে শুয়ে থাকবো মাথা উঁচু করে। প্রয়োজনে দুটো বালিশ দিয়ো। পাশবালিশ দিতে ভুলো না।মাথার পাশে ধূপ জ্বালিও না, খবরদার খেয়াল রেখো, কেউ যেন ভুল করেও ফুল না নিয়ে আসে।যারা আমায় দেখতে আসবে তাদের চোখে যেন বিস্ময় ছাড়া অন্য কিছু না থাকে। একবিন্দু জল গড়িয়ে পড়লে আমার আফশোস হবে। তুমি জানো, একটি মেয়ের একফোঁটা প্রকৃত জলের জন্য আমাকে কত ঘুরে মরতে হয়েছে? চন্দনের ফোঁটা দেবে না। আলতা একদম নয়। আর হ্যাঁ, নাকে যেন তুলো না দেওয়া থাকে; বড্ড বিশ্রী লাগে। সেন্ট দিতে পারো কিন্তু অবশ্যই ফরাসি। আমি বীরের মতো ঘুমবো। সেই সময় ফোন এলে আমাকে ডিসটার্ব করবে না। আমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এনজয় করবো– কার মুখ কতটা ফ্যাকাশে হলো। শোনো, ওরা যেন হরিবোল না বলে। অঞ্জন কিংবা সুমনের গান চালিয়ে দেবে। ওদেরকে বলে দিয়ো ওরা যেন আমায় ন্যাংটো না করে। সারাজীবন এতো বার উলঙ্গ হতে হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। ওই দিনটা অন্তত টিপটপ ফিটফাট থাকতে দিয়ো। হাউমাউ করে কেঁদো না। দরজার পর্দা ধরে চুপি চুপি কাঁদবে সুচিত্রা সেনের মতো। বাঙালি কান্নার মধ্যে একটা শিল্প থাকে। আর একটা কথা, সেই পাগলি মেয়েটি যদি আসে, একমাত্র তাকেই আমার হাত ছুঁতে দেবে। আমার ঠান্ডা হাত এক ঝটকায় উষ্ণ হয়ে যাবে, আর আমি ঢেউ ভাঙতে ভাঙতে পৌঁছে যাব সঠিক ঠিকানায়… ( ইচ্ছাপত্র )
আমার বড্ড পছন্দের কবিতা। কবিতায় কবি নিজের মনের ইচ্ছেকে, সেই ব্যথিত প্রবণতাগুলিকে তির্যক অথবা স্বেচ্ছাচারিতা এমনকি হাস্যরসাত্মক ভাবও বলতে পারা যায়, প্রকাশ করেছেন তাঁর শৈল্পিক কলম দিয়ে। তাই এককথায় স্মার্ট শব্দটিও প্রাসঙ্গিক, কারণ শূন্য দশকে তিনি কবিতাকে বিনির্মাণ শব্দের সাথে রিলেট করার সর্বৈব চেষ্টা করেছেন। নিজের মৃত্যু নামক বিষয়টিকে ইচ্ছাপত্র- কবিতার মাধ্যমে কৃতাঞ্জলি দিয়ে পৌঁছে দিতে চেয়েছেন সেই বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঠিকানায় যেখানে হয়তো বালিশবিহীন ভাবে শুয়ে আছে অহংকারি এক মেয়ে, যাকে কবি তার প্রেম এবং নশ্বর শরীর অনায়াসে দান করতে পারেন।
কবি বিল্বমঙ্গল গোস্বামীর কবিতা পড়তে গিয়ে একটি ডিম লাইট জ্বালাই।আলোকে পরিবেশের গতির থেকে কমিয়ে আনি।স্নায়বিক চাপ আস্তে আস্তে নেমে আসে, যেন হেমন্তের কোনো এক হিমপড়া সন্ধ্যায়,ভিক্টোরিয়ার ঘাসের মাদুরে মুখোমুখি বসবার অবৈধ স্বপ্ন দেখি। কলম নামিয়ে মনে হয়ে সেই অনুভূতি ধরার বাইরে থাকলেও হয়তো ছোঁয়ার বাইরে থাকবে না। ভাবি পাজামার মতো সরল এবং সেইসঙ্গে দুরূহ গিঁটের মতো বিপ্রতীপ আমাদের প্রত্যেকের জীবনযাপনে জেরবার গ্রাফচিত্র—
” সভ্যতার বাদামি তরলে চাঁদ গলে যায়
বেহালার সুরগুলি ঝর্ণা হয়ে কাঁদে ”


এমন একটি সমৃদ্ধ আলোচনা এক অভাবনীয় কালজয়ী কবির কবিতা নিয়ে করা হয়েছে যা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। কবি বিল্বমঙ্গল গোস্বামীর ” জীবনের পাজামা ও গিঁট ” বইটির প্রতিটি কবিতার বহু রৈখিক মোড়কে এত স্বচ্ছ সুন্দর ও নিখুঁত করে পর্যালোচনা করলেন কবি অভিজিৎ সত্যিই পড়ে অভিভূত হলাম। এমন আলোচনার মাধ্যমে কবি বিল্বমঙ্গল গোস্বামীর লেখা আরো বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছানোর প্রয়োজন আজ 🙏