
অরুণাভ সরকারের কবিতাসংগ্রহ সম্পর্কে দুটি একটি কথা
হিন্দোল ভট্টাচার্য
কবিতাসংগ্রহ/ অরুণাভ সরকার/ প্রচ্ছদ সঞ্জীব চৌধুরী/ ভাষালিপি/২৫০ টাকা
কবি অরুণাভ সরকার সেই বিরল কবিদের মধ্যে পড়েন, যিনি একেবারেই নীরবে প্রায় তিরিশ বছর ধরে কাব্যচর্চা করে গেলেন। অত্যন্ত শক্তিশালী এই কবির কলম বহুপ্রজ নয়, কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই নিজস্ব কাব্য-ব্যক্তিত্ব এবং কাব্যস্বরকে তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন অনেক আগেই। অনেক ক্ষেত্রেই যেটি দেখা যায়, তা হল, কাব্যস্বর এবং কাব্যভাষা খুব কাছের অগ্রজ কবির কাব্যভাষার প্রবল চৌম্বকীয় বলয়ের মধ্যে তার স্থান হারায়। নিজস্ব কাব্যব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার অবকাশ দেয় না। কিন্তু উৎপঁরতলকুমার বসুর মতো একজন কবির ঘনিষ্ঠ একজন কবি হিসেবে দীর্ঘদিন থাকার পরেও, অরুণাভ নিজের কবিতার জগতকে নিজের ভাবনা অনুযায়ীই গড়ে তুলেছেন। তাঁর প্রথম দিকের কবিতাগুলির মধ্যে উৎপল ছিলেন, এখনো উৎপল আছেন প্রচ্ছন্নভাবে, কারণ এই মহান কবিকে এড়িয়ে বাংলা কবিতা লেখাই যায় না। কিন্তু অরুণাভ গড়ে তুলেছেন নিজস্ব এক পরিচয়।
চিরকালই এই কবি অপরিচয়ের আড়ালে থেকেছেন। কিন্তু নিজস্ব কাজ করে গেছেন নিয়মিত ভাবেই। তার উদাহরণ হল, ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত ‘বান্ধবী শ্রীরাধা’-র পর ২০০০ সালে প্রকাশিত হয়েছে ‘ আমাদের গুপ্তবিদ্যা’, এবং ২০০১ সালে প্রকাশিত হয়েছে ‘বিশ্ববিদ্যালয়’। এর পর তিনি নিয়েছেন চার বছরের বিরতি। ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়েছে কচুরিপানার ভেলা। ২০১০ সালে কবিতাসংগ্রহ। তার পর ২০১২ সালে ইনফার্টিলিটি ক্লিনিক এবং ২০১৭ সালে সঙ্গীহীন। ২০২২ সালে প্রকাশ পেয়েছে ‘বিমূর্ততা থেকে দেখি।’ তার পরে এই আলোচ্য কবিতাসংগ্রহ। ২০২৩ সালে। অর্থাৎ তিনি নিয়মিত কবিতার এক ধারাবাহিক চর্চার মধ্যে থাকছেন। ভালো করে দেখলে বোঝা যাবে, তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থই আগের চেয়ে আলাদা। নতুন নতুন বাঁকে তিনি বেঁকে যাচ্ছেন প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই। হয়তো ভাষার তেমন একটা চোখে পড়ার মতো বদল হচ্ছে না, কিন্তু যা হচ্ছে তা হল, ভাবনাজগতে এক বিরাট পরিবর্তন।
অরুণাভ একজন সচেতন কবি। তিনি জানেন কোনটা কবিতা নয়, কবিতার মতো দেখতে। তিনি এও জানেন্, এই গড়পড়তা কবিতাপ্রবাহের যুগে তাঁর এক স্বতন্ত্র স্বর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, যা শুধু ভাষায় আসে না, আসে গভীর ভাবনায়। আমাদের সৌভাগ্য অরুণাভ তথাকথিত স্বভাব কবি নন। তা না হলে সম্ভবত সংবাদপত্রে নিবন্ধ লেখার বিষয় নিয়ে লাইন ভেঙেচুরে কবিতা লিখে ফেলতেন। কিন্তু অরুণাভ একজন কবি। আর এই জায়গাতেই, তাঁর ভাবনাই তাঁকে দিয়েছে এক বিশেষ ধরনের ব্যক্তিত্ব।
উৎসর্গপত্রের প্রথম লাইনেই লেখা থাকে – ” তুমি যা স্পর্শ কর আনু আরও গভীরভাবে তা ধরি, কাব্যময়, হাসপাতালের অলিন্দ ভরে ওঠে রোগীদের ভিড়ে”। বান্ধবী শ্রীরাধা কাব্যগ্রন্থে যেখানে, তিনি লিখছেন- ” মিথ যেখানে স্থায়ী হয়/ বড়ে, কমে, ভেঙে যায়-/মানুষ- দুর্গত।” আবার সেখানেই তিনি লিখছেন, ” বেপরোয়া/ বেপরোয়া আমি/ বেপরোয়া আমি ছুটছি বাড়ির দিকে।” এই অরুণাভই মরমিয়া ভাবনা থেকে একেবারেই অস্তিত্বসংকটের দর্শনে চলে এলেন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থে। যার প্রথম লাইন শুরু হচ্ছে – ” মৃত্যুর থেকেও ভয়ঙ্কর- মৃত্যুভয়”। এই কাব্যগ্রন্থে অরুণাভ আশ্চর্য ভাবে এক আঙ্গিক ব্যবহার করলেন তাঁর কবিতায়। এ যেন এলিয়টের হিপ অফ ব্রোকেন ইমেজেস-এর মতো। ২০০৫ সালের কচুরিপানার ভেলা আমার পাঠে ওঁর শ্রেষ্ঠ একটি কবিতার বই। ঠিক তেমনই, ২০১২ সালের ইনফার্টিলিটি ক্লিনিক- কাব্যগ্রন্থটি তাঁর অস্তিত্ববাদী দর্শনের মধ্যে শূন্যবাদ উঁকি মারছে বুঝতে পারছি। একটা ভয়ঙ্কর ভাঙাচোরার মধ্য দিয়ে তিনি এগিয়ে চলেছেন। আমাদের সকলের বন্ধু নবনীতার মৃত্যুর পর শোকগাথা নয়, কিন্তু অরুণাভ যেন মনে মনে অনেক বেশি নিস্পৃহ হয়ে গেলেন। আর এই নিস্পৃহ নিশ্চেষ্টতা তাঁর কবিতার মধ্যে দিয়ে ফুটে বেরোতে লাগল। বিমূর্ততা থেকে দেখি, সাম্প্রতিক অরুণাভ-র কাব্যভাবনার সঙ্গে কথোপকথনের এক সুযোগ দেয়। এই কাব্যগ্রন্থের ১৪টি কবিতায় বাংলা কবিতার ইতিহাসে চিরকালীন হয়ে থাকবে।
এই কবিতাসংগ্রহে রয়েছে অগ্রন্থিত কবিতাও। একজন আপাদমস্তক কবিকে যদি তাঁর কবিতার মাধ্যমে পড়তে চান, তাহলে অরুণাভ সরকারের কবিতাসংগ্রহ পড়তেই হবে। বাংলা সাহিত্যজগতে কবিতা নিয়ে নানা কিছু চলে। হয়তো অরুণাভ সরকারের এই কবিতাসংগ্রহ তেমন ভবে আলোচনায় আসবে না কারোরই। কিন্তু সবকিছু শব্দ উল্লাস ভিড় সরে গেলে, অরুণাভর কবিতার বইটিকে সঙ্গে নিয়ে একা একা হেঁটে যেতে হবে অনেকদূর।
আপনি শত চেষ্টা করেও অরুণাভর কবিতাকে স্টেশনে ফেলে রেখে পরের স্টেশনের দিকে চলে যেতে পারবেন না।
লেখাটি যদি ভালো লাগে, আবহমানে নিজের ইচ্ছেমতো ফোন পের মাধ্যমে
অবদান রাখতে পারেন, এই কিউ আর কোড স্ক্যান করে। ফোন পে করুন 9051781537
অথবা স্ক্যান করুন পেমেন্টের লিংক
অরুণাভর এই দশক দশক ব্যাপী নির্জন প্রবহমানতা এবং একান্ত নির্লিপ্ত কবিতাশকট আমাদের অকিঞ্চিৎকর যাপনে কিছু অন্যতর প্রশ্রয় নিয়ে আসুক, হিন্দোল ভট্টাচার্য পরিপাটি মিতকথনে আমাদের এটুকুই জানিয়ে দিয়ে গেলেন। অরুণাভর ইচ্ছেগাড়ি হয়তো সাধ হলে কিছুক্ষণ থেমে থাকে। সে পরিসরে ঐ মহাযানকে জ্যোছনার চন্দন দিয়ে বরণ করার দায় থেকেই যায় বাংলার কবিতাযাত্রীদের।