অজিত সিং বনাম অজিত সিং <br /> পঁয়তাল্লিশতম পর্ব

অজিত সিং বনাম অজিত সিং
পঁয়তাল্লিশতম পর্ব

৪৫

বিদিশা, তুই লিখেছিস, আমি কেন কিছু করছি না। লিখেছিস খুব ছোট কিছুও তো করতে পারি। বারবার বলেছিস, দিনরাত ঘরে থাকা খুব খারাপ, কনফিডেন্স নষ্ট হয়ে যায়। এরপর বয়স বাড়বে, তখন একা একা বেরোতে পারব না। কিন্তু তখন কে আমাকে সঙ্গে নিয়ে বেরোবে? আমার আর কেউ নেই রে বিদিশা।
তোকে বলেছি কি প্রদীপ্ত চলে যাচ্ছে? না, না আমাদের কোন ডিভোর্স হচ্ছে না। ও লিয়েন নিয়ে উৎকল ইউনিভার্সিটি যাচ্ছে, পি এইচ ডি করতে। ও এখন স্পষ্টই বলছে, আমিই ওর উন্নতির পথ আটকে রেখেছি এতকাল। আমার কথা ভেবেই ও এদের সঙ্গে সহজ হতে পারেনি, আমার জন্যেই ওর পি এইচ ডি, প্রোমোশন কিচ্ছু হতে পারেনি। আমি ওকে কিচ্ছু দিতে পারিনি, কিচ্ছু না। না শারীরিক সুখ, না সন্তান, না সংসার, না সমৃদ্ধি। প্রদীপ্ত স্পষ্টই বলল ‘এনাফ ইজ এনাফ।আমাকে অ্যাট লিস্ট পি এইচ ডিটা করে আসতে দাও, আর বাধা দিও না। এখানে তোমার কোন অসুবিধে হবে না। ব্যাংকে গিয়ে টাকা তুলতে যদি না পারো, আমি মাঝেমাঝেই এসে হাতে টাকা দিয়ে যাব। মাছওলা, সবজিওলা ঠিক করে দিয়ে যাব, যারা বাড়িতে এসে সব দিয়ে যাবে। যা যা বিল অনলাইনে দেওয়া সম্ভব দেব, শুধু দু একটা, এই গ্যাস, পেপার হাতে ক্যাশে দিতে হবে। এইটুকুই তোমাকে করতে হবে’
আরও কত কী বলে যাচ্ছিল জানিস।আমার মাথায় শুধু ওই কথাটা ঘুরছিল, আমাকে পি এইচ ডিটা করে আসতে দাও, আর বাধা দিও না। বিলিভ মি বিদিশা, আমি কোনদিন ওকে বাধা দিইনি, বরং মোটিভেট করেছি, ফিল্ড বেছে তার ওপর পড়াশোনা করে সিনপসিস লিখে দিয়েছি কতবার, তারপর তো আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম। ওই ইন্টারভিউটা, ওই ইন্টারভিউটা আমি দিতে চাইনি বিশ্বাস কর , আমি জানতাম আমার হবে না এবারেও, সাতবার কেন সাত লক্ষবার দিলেও, প্রতিবার বেস্ট হলেও হবে না, কারণ ওই গ্যাং অব ফোর, ওরা আমাকে ঢুকতে দেবে না।আগে ভাবতাম আমার দুটো কারণে হয়নি। এক আমার কোন পলিটিকাল ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, দুই দে কুড নট ড্র্যাগ মি টু বেড, কলিগের স্ত্রী তো আফটার অল, কিন্তু আজ আমি রিয়েলাইজ করেছি আই ওয়াজ রঙ। নট ফুললি রঙ, পারশিয়ালি কারেক্ট বলতে পারিস, ও দুটোও নিশ্চয় কারণ, কিন্তু গৌণ কারণ। আসল কারণ কী জানিস?
বিদিশা পালটা জিগ্যেস করল না তো, কী রে আসল কারণ? বিদিশা কি আদৌ ইন্টারেস্টেড নয় ওর বিষয়ে? অতীত খুঁড়ে ওকে বার করার জন্য বিরক্ত? নাকি বিদিশাই ওকে খুঁজে বার করেছে? কে এই বিদিশা? সত্যি সত্যি চেনে নাকি এই নামের কোন মেয়েকে?

দোলন আবার লিখতে শুরু করে ‘আসল কারণটা হল ইটজ দা এজ অফ মিডিওক্রেসি। মনে আছে, বহুদিন আগে তুই বলেছিলি ম্যামথদের দিন শেষ, এখন মানুষ সব দিকেই খুব ছোট হয়ে গেছে। আর সেই ছোট ছোট মানুষের মধ্যে যদি বড় কেউ আসে, যোগ্য কেউ, বাকিরা তাঁদের সঙ্গে কমফোর্টেবল ফিল করে না। আমি ওদের সাইজে নই, এক্স এল কি ডাবল এক্স এল, সেটা হয়েও যদি আমাকে ওদের কথায় নাচানো যেত, ইস্তাহার লেখানো, মিছিলে গান গাওয়ানো, আশীর্বাণী লেখানো, যে কোন ইস্যুতে সমর্থন দেওয়া- এগুলো করানো যেত, তবে আমি ফিট করে যেতাম। কিন্তু আমাকে দিয়ে ওসব হবে না , ওরা জানে, তাই নৈবেদ্যের চালকলার ওপর যে দু একটা সন্দেশ থাকে শোভা বর্ধনের জন্যে, সেখানেও আমার ঠাঁই হল না। তোরও হত না, তোর তো আরও হত না। তোর যে এত দিক আছে, তুই তো মাল্টিট্যালেন্টেড, লিখিস, নাটক করিস, এত সব ওরা ট্যাকল করতে পারত না।
তুই একবার বলেছিলি উত্তরের জানলা খোলা বারণ, অচলায়তন নাটক বোধহয়, আজ বুঝতে পারছি রে।
কত কি বলতিস তুই, ইকো ফেমিনিজম, সাইবার ফেমিনিজম, আমি ভাবতাম ভালো মেয়েদের জন্যে এসব নয়, আমার এসব পড়ার দরকার নেই। স্বাভাবিক ভাবেই আমি একটা স্বর্গের মতো জীবন পাব, যেখানে যোগ্যতাই শেষ কথা, নারী পুরুষের কোন বিভাজন নেই। আমার যা অর্জন করার তা আমি অমনি পাব। এইসব বিপ্লব, জিন্দাবাদ, থিওরি এসব ফালতু, কিছু লোকের টাইমপাস ছাড়া কিছু নয়। আজ বুঝতে পারি, রাজনীতি শিক্ষার জীবনে কতটা দরকার আছে। তা আসলে চোখ খুলে দেয়।আমি এত পড়াশোনা করেছি, এত ভালো রেজাল্ট আমার, আজ মনে হয় সব সার্টিফিকেট ছিঁড়ে ফেলি। কিন্তু না, ভাগ্যিস ছিঁড়ি নি। এগুলো এখনো কাজে লাগবে আমার। আসলে কী জানিস, এত কিছু জানলেও নিজের অধিকার কী করে অর্জন করতে হয়, সেটাই শিখিনি।
যাক সেসব, কোন কথায় কোথায় চলে এলাম। বলছিলাম অসুস্থ হবার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমি প্রদীপ্তর জন্যেই ভেবেছি। যেদিন ইন্টারভিউ ছিল, শেষ ইন্টারভিউ, একদম ইচ্ছে ছিল না যাবার, প্রদীপ্তকে বলেছিলাম ‘প্লিজ জোর করো না, আমার একদম ইচ্ছে করছে না। আমার ফিলিংস বলছে আমার হবে না।’
প্রদীপ্ত জোর করল আমাকে। বলল ‘যাও তুমি, তোমার হয়ে যাবে। যেতেই হবে তোমাকে।’ তখন মনে হয়েছিল ও খুব কনসার্নড আমার ব্যাপারে। এখনো অবশ্য তাই মনে হয়। কিন্তু এও মনে হয় ম্যারিটাল রেপের মতোই তো ছিল এটা। এই জোর করাটা। অন্যদিকে সেই ওভাল টেবিলে অতগুলো লোক, আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে, আমাকে ছিঁড়ে খুঁড়ে খাচ্ছে, কত রাতে ঘুম ভেঙে গেছে স্বপ্ন দেখে যে আমার বুকের ওপর ওরা চড়ে বসেছে, আমাকে রেপ করছে, রেপ!
তবু ভালবাসা তো ছিল। আসলে ধ্রুবক বলে তো কিছু হয় না। আমরা বোকার মতো ভাবি। ভালবাসা শিফট হয়ে যায়। খুব স্বাভাবিক সেটা। আমি তো মানুষের পর্যায়ে ছিলাম না। ওর কোন চাহিদা মেটাতে পারিনি। ওর কাছে একটা বোঝা হয়ে গেছিলাম। ও আর কত টানত আমাকে? কিন্তু এটা ও মিথ্যে কথা বলছে। এটা বলার ওর দরকার ছিল না। আমি একটু নিজের ছন্দে যখনি ফিরেছি, বলেছি, রিপিটেডলি বলেছি পি এইচ ডি টা করে নাও, আমার জন্যে আটকে থেকো না। তাতে ওরাই জিতে যাবে। ওদের জিততে দেব না আমরা। কিন্তু প্রদীপ্ত শোনেনি, বারবার বলেছে, এটাই আমার প্রতিবাদ। তোমার মতো অ্যাকাডেমিক রেকর্ডস যার, সে ঢুকতে পারল না, সেখানে আমি পি এইচ ডি করা মানে ওদের অন্যায়টাকে মেনে নেওয়া।
আমি বলেছি তুমি তো আর ওদের কাছে কাজ করতে যাচ্ছ না। এটা তো চোরের ওপর রাগ করে মাটিতে ভাত খাওয়া হয়ে গেল।তুমি পি এইচ ডি না করলে ওদের কি যায় আসে? বরং তোমার গায়ে অপদার্থর তকমা সাঁটাতে সুবিধে হয়ে গেল।
তুই ভাবছিস, আমি তো আমার মধ্যেই ছিলাম না এতগুলো বছর, তবে কীভাবে বললাম এইসব কথা? বলেছি বিদিশা, বলেছি। এক এক রাতে আমি ছটফট করে জেগে উঠতাম, সেডেটিভও দমিয়ে দিতে পারত না আমার ছটফটানি, তখন আমি যখন জেগে দেখতাম, আমার পাশে শুয়ে প্রদীপ্ত অকাতরে ঘুমোচ্ছে, মাথা গরম হয়ে যেত আমার। ওকে ঝাঁকাতাম দুহাতে, প্রদীপ্ত উঠে বসত ধড়মড় করে, বলত কী হয়েছে দোলন? ঠিক আছ তো তুমি? আমি ওকে বলতাম তখন এইসব কথা। খুব অবাক আর বিরক্ত হত ও। রেগে যেত, ওকে সেসময় খুব অসহায় লাগত আমার। মনে হত, আমি তো বাড়িতে আছি, ওর আড়ালে বসে আছি, ওকে তো সামনে থেকে লড়তে হচ্ছে। চক্রব্যুহে আটকানো অভিমন্যুর মতো অবস্থা ওর। তবু আমি বলতাম ওকে, তারপর চিৎকার করে কাঁদতাম, তারপর ঘুমিয়ে পড়তাম। ঘুম থেকে উঠে আমার আর কিচ্ছু মনে থাকত না, কিচ্ছু না।
কিন্তু কি অদ্ভুত দেখ, আমার আজকাল সব মনে পড়ে যাচ্ছে। যেদিন তোর মেলটা পেলাম, সেদিন থেকে সব একটু একটু করে মনে পড়ছে। মনে হচ্ছে জীবন এভাবে কেন নষ্ট করছি আমি? আমি তো কখনো চাইনি প্রদীপ্তর জীবন এইভাবে নষ্ট হয়ে যাক। তবে ও কেন দোষারোপ করল আমাকে? বলল আমি ওকে আটকে রেখেছি এতদিন? আসলে কী জানিস? ওর একটা গিলটি ফিলিং হচ্ছে। উৎকল ইউনিভার্সিটিতে চলে যাচ্ছে আমাকে এখানে ফেলে। তাই আমাকে আক্রমণ করে ক্লিন চিট পেতে চাইছে।
যাকগে, যা খুশি করুক ও। আমি এখন ওসব ভাবতে চাই না। আমি একটা কাজের মধ্যে ঢুকতে চাই।
কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না। এই বইগুলো পুড়িয়ে দিতে ইচ্ছে হয়েছিল। কোন কাজে লাগল আমার? তারপর ভাবলাম, থাক ওরা। আমি তো একটা পরিস্থিতির শিকার। তাতে বইগুলোর কি দোষ? আমি এখন কী করছি জানিস? ফ্রি হ্যান্ড শুরু করেছি। আর রোজ খানিকটা হাঁটতে বেরোই। অচেনা রাস্তায় হাঁটি এলোমেলো। আজকাল মনে হয় তুই কাছাকাছি থাকলে খুব ভাল হত। আমরা একসঙ্গে থাকতে পারতাম। থাকগে। যা হয়নি তা ভেবে কি লাভ?
সেদিন কী হল জানিস? হাঁটতে হাঁটতে আমি একটা বন্ধ ল্যাবরেটরিতে ঢুকে পড়েছিলাম।রাস্তার ওপারে। আনোয়ার শা রোডের অটো ধরব বলে তোর সঙ্গে আগে কতবার হেঁটেছি ওর সামনে দিয়ে। কোনদিন খেয়াল করিনি। সেদিন কী হল, ভীষণ টানল আমাকে। ওই যে নির্জন পরিত্যক্ত বাড়িটা, নিঃসঙ্গ মেশিনঘর, বন্ধ থাকা মেশিনগুলো আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। আগে ডাকেনি তো। আমার কী মনে হয় জানিস বিদিশা, জীবনে সব ডাক সবসময় আসে না। সবকিছুর একটা সময় থাকে।এত বছর ওই বাড়িটার পাশ দিয়ে হেঁটে গেছি, কখনো কিছু ইচ্ছে হয়নি, এখন কেন হল? আসলে আগে তো আমি ছিলাম একজন ব্যস্ত কেরিয়ার সর্বস্ব মানুষ। এরকম কিছুর দিকে তাকানোর সময় আমার ছিল না। আর আজ আমি ওই ল্যাবরেটরিটা, ওই মেশিনগুলোর মতোই পরিত্যক্ত। সেটা ওরা বুঝতে পেরেছে, বুঝলি, ওই মেশিনগুলো।
তুই কী ভাবছিস, এই যে বলছি মেশিনগুলো ডাক পাঠাচ্ছে, সব কিছুর একটা সময় আছে, এর মানে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে? তোর মনে আছে, তোকে নিয়ে গেছিলাম বাবাঠাকুরের কাছে? কিছু কিছু মানুষের সেন্সিটিভিটি খুব তীব্র হয় রে, তাঁদের কথা কিছু কিছু মিলে যায়, কারণ জীবনটাকে তাঁরা খুব গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। তোকে কী বলেছিলেন মনে আছে? প্রচণ্ড শক্তি আছে তোর মধ্যে। সেদিন বুঝিনি। আজ বুঝতে পারছি। নইলে একদম অন্য একটা স্ট্রিমে সুইচ করে গিয়ে কিছু করা, কজন পারে? তাও আবার এদেশে নয়, বিদেশে গিয়ে।
আমার মা খুব বিশ্বাস করতেন এগুলো। মা–ই। আমাদের জোর করতেন অনেক কিছু পরার জন্য। আংটি, গ্রহ রত্ন। বাবা পরতেন না । বলতেন অল বুলশিট। আমার শরীরে যা নেই, মেধা, শ্রম, তা বাইরে থেকে পাথর আমাকে দিতে পারে না। স্ক্যানিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপি করে দেখি তো পাথর গুলোর ক্ষমতা কত?

সেই বাবা-ই, আমি যখন অসুস্থ হলাম, একটা পাথর ধারণ করেছিল, সে সময় তো আমি কিছুই জানতাম না, এক আত্মীয় সেদিন ফোন করে বলল, বলল ‘তোর জন্যে ওরা কী না করেছে, যে মানুষটা গ্রহ রত্নে বিশ্বাস করত না, সে পাথর পর্যন্ত পরেছিল, শুধু তুই ভালো হয়ে উঠবি বলে। তারপর তো মরেই গেল দুজনে।’ এমনভাবে বলল যেন বাবা মার মৃত্যুর জন্যে আমিই দায়ী। আমার এতদিন কিছু মনে হয়নি জানিস। অনুভূতিটা কেমন অসাড় হয়ে গেছিল। বাবা নেই, মা নেই – মনেই হত না, কষ্ট তো দূরের কথা। হঠাৎ আমি জেগে উঠলাম আর জেগে উঠে দেখলাম এই বিরাট পৃথিবীতে আমি কত একা। কেউ নেই আমার। সারাজীবন যে বইগুলো আমাকে আশ্রয় দিয়েছে, যাদের মধ্যে মুখ গুঁজে আমি নিজেকে খুব নিরাপদ ভেবেছি, তারা যেন আমাকে উপহাস করছিল। তাই আমি ঠিক করলাম, যতটা আমার শরীরে দেয়, হেঁটে হেঁটে এই শহরটা দেখব। আমার নতুন বই এগুলো। তো হাঁটতে হাঁটতে আমি একদিন দেখলাম সেই ল্যাবরেটরির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। গেটটা ঝুলে পড়েছে, টপকে ভেতরে যাওয়াই যায়।আমি ভেতরে ঢুকে পড়লাম ভূতগ্রস্তের মতো। বাঁদিকে একটা ছোট একতলা বাড়ি। দেখে মনে হচ্ছে এটা ছিল অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং। আমি সেদিকে গেলাম না। সামনে যে মস্ত বাড়িটা, উঁচু ছাদ, থরে থরে মেশিনপত্র সাজানো, সেটাই আমাকে টানছিল। আমি তার চৌকাঠে দাঁড়িয়ে কেমন যেন হয়ে গেলাম। আমি আমার ইন্ডাস্ট্রির অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝতে পারছিলাম মেশিনগুলো কোনটাই অকেজো নয়, অথচ তাদের স্ক্র্যাপ করে ফেলা হয়েছে।আমি ভেতরে ঢুকে এক একটা মেশিনের গায়ে পরম মমতায় হাত বোলাতে লাগলাম। আমার ন্যাশনাল ইন্ডিয়া প্রেসের শপ ফ্লোর মনে পড়ছিল। শপ ফ্লোরে কাজ করার খুব ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আমি করতে পারিনি, কারণ ওই পরিবেশে আমি মানাতে পারিনি। ওখানে ছিলাম আমি একমাত্র মেয়ে। আমার দিকে অদ্ভুত একটা দৃষ্টিতে তাকাত সবাই, যেন আমি একটা অন্য গ্রহ থেকে এসেছি। ভীষণ মাচো আর হিংস্র পরিবেশ। সবাই যে এরকম তা নয়, কেউ কেউ খুব সম্মান করত, কেউ মা বলে কথা বলত, খুব স্নেহ দেখাত। যেন ফাদার ফিগার। কিন্তু ওই যে একটা ফিলিং অব আদারনেস ছিলই। বুঝতে পারতাম, আমি আলাদা, এদের মতো কেউ নই। এখানে আমাকে কোনদিনই অ্যাট হোম ফিল করতে দেওয়া হবে না। করবই বা কী করে? অত বড় প্রেস, সেখানে কোন লেডিস টয়লেট ছিল না। ম্যানেজমেন্ট স্টাফেদের টয়লেট, মোটামুটি পরিচ্ছন্ন, সেটাই ইউজ করতাম, কিন্তু সেখানে পিরিয়ডের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন ফেলব কোথায়? কোন ওয়েস্ট বিন তো নেই। কারণ এতদিন দরকার পড়েনি। ছেলেরাই ইউজ করে এসেছে, তাদের ওসব লাগেনি। ওয়েস্ট বিন -র জন্যে আমাকে রিকিউজিশন করতে হবে। আমি খুব সহজ ভাবেই সেই রিকিউজিশন পাঠালাম আর তারপর পারচেজ ম্যানেজার আমাকে ডেকে পাঠালেন। কেন লাগবে, কী বৃত্তান্ত জানতে। কথা বলার সময় তাঁর চোখে মুখে কেমন একটা হাসির ঝিলিক ফুটে উঠল, সেটাতেই টনক নড়ল আমার। আমি বুঝতে পারলাম আমাকে চাটা হচ্ছে। আমাকে মলেস্ট করা হচ্ছে। কিন্তু আমি তো কোনদিন প্রতিবাদের পন্থা নিয়ে ভাবিনি। আমার বয়সও তখন বছর বাইশ। সেটা অবশ্য কোন অজুহাত নয়। গ্রেটা থুনবার্গ কী করেছে? মালালা? আমি পারলাম না। রিকিউজিশনটা ছিঁড়ে ফেললাম, ভয় হল কেউ না জানতে পারে। জানতে পারলে কী লজ্জার ব্যাপার হবে সেটা! অথচ এখন তো আন্দোলনের বিষয় হয়ে উঠেছে আমাদের সেই লুকিয়ে রাখা স্যানিটারি ন্যাপকিন। আমি পারিনি। আর তাই চুপিচুপি নিজের পয়সায় একটা ওয়েস্টবিন কিনে টয়লেটে রাখলাম। সাতশ পুরুষ অধ্যুষিত পরিবেশে একা মেয়ে আমি পারিনি। কিন্তু আজও কি পারব না? নিশ্চয় পারব। হঠাৎ দেখি দুটো মেশিনের মাঝখানের একটুখানি প্যাসেজ, সেখানে একজন ঘুমোচ্ছে খবরের কাগজ পেতে। তার পাশে একটা বই, চমকে উঠি, আবার, আবার মার্কেজ। মেলাঙ্কোলি হোরস।আমার আপাদমস্তক কেঁপে ওঠে। এই তো কদিন আগে কোথায় যেন দেখলাম মার্কেজের বই পড়ে আছে। চট করে মনে পড়ে না। তারপর বুঝতে পারলাম যে সামনাসামনি নয়, টিভিতে দেখেছি কদিন আগে।মৃত্যুর আগে যেমন ভেসে ওঠে সমগ্র অতীত, তেমনই করে আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা শান্ত জল, নির্জন সবুজ, বুকো বলে এক উঠতি মাফিয়ার খুনের খবর দেখাচ্ছিল টিভিতে।সেই অকুস্থলে পড়ে ছিল বইটা, লাভ ইন দা টাইম অফ কলেরা। আজ আবার মার্কেজ! আবার কি খুন হতে চলেছে একটা? আমি আর ওখানে থাকতে সাহস পেলাম না। বেরিয়ে এলাম। বেরোনোর সময় তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে হুমড়ি খেলাম একটা মেশিনে। সেই শব্দে লোকটার ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে আমার দিকে তাকাল। আমি কী দেখলাম জানিস? শান্ত সমাহিত , যেন কোন যোগীর চোখ, যেন আমার ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই।
তবু আমি ভয় পাই। দ্রুত বেরিয়ে আসি ওখান থেকে। ওই বইটা যেন আমাকে ইঙ্গিত দেয়, আরও আরও খুন হবে এখানে।
গেটের বাইরে বেরিয়ে এসে একটু দম নেব বলে দাঁড়াই। আমার সারা শরীর কাঁপছে এই আচমকা উত্তেজনার ধাক্কায়। আমার শরীর, মন কোনটাই যে এখনো খুব মজবুত নয় সেটা ভুলে গেছি। থরথর করে কাঁপছি। দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়াতে চাই। আর তখনই দেখি দেওয়ালে একটা অদ্ভুত পোস্টার।বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসের দিন আসন্ন।বাঁচতে হলে চাই অরিষ্টনেমি যজ্ঞ। যোগাযোগ করুন ভবানী শাস্ত্রীর সঙ্গে।
খুব অদ্ভুত লাগে। আসন্ন মানে কি? যা আসছে, খুব কাছে এসে গেছে, তাই তো? কিন্তু ধ্বংস তো অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে আমি জানি। আর কে বেশি জানে আমার থেকে? কিন্তু এই অদ্ভুত পোস্টারের মানে কী? কে এই ভবানী শাস্ত্রী?
আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে। আর পাশ থেকে কে যেন বলে ‘ডোন্ট বদার টু নো, জাস্ট ফাক অফ’। চমকে উঠে দেখি একটা মেয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে।
ওকে দেখে আমার প্রথমেই যেটা হয়, সেটা হচ্ছে হীনমন্যতা। আমি তো পরে আছি সেই কবেকার ফ্যাশনের ফ্রক সালোয়ার একটা। এইটাই আমার ঠিকঠাক হয় এখন, তখন টাইট হত। সেইটাই পরে আছি। এর থেকে শাড়ি পরলে অনেক ট্রেন্ডি থাকা যেত। কিন্তু শাড়ি তো আগেও বেশি ম্যানেজ করতে পারতাম না, এখন তো আরো পারি না। আমার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটার ক্রপড টি শার্ট, তালি মারা জিনস, চুলের কাট, কানে একটা স্লিক দুল, সব কিছুই লেটেস্ট শুধু না, ওর শরীরের প্রতিটা ইঞ্চি থেকে চুঁইয়ে পড়ছে আত্মবিশ্বাস।আমি ওকে দেখেই যাচ্ছিলাম। নিজেকে আমার রিপ ভ্যান উইংকলের মতো মনে হচ্ছিল। পৃথিবীটা কত বদলে গেল, বুঝতেই পারিনি।
মেয়েটা সিগারেট শেষ করে হাত বাড়িয়ে দিল। বলল ‘এখানে বেশিক্ষণ দাঁড়াবেন না। ইউ মে ইনভাইট ডেঞ্জার’
বিপদ! বিপদের কথায় আমার ঠোঁটে একটা হালকা হাসি ফুটে উঠল, সেটা মেয়েটার দৃষ্টি এড়াল না।
‘ইয়েস বিপদ। অবশ্য বিপদের ধারণাটা সবার সমান নয়। ধরা যাক, আপনাকে রেপ করা হয়নি, শুধু স্ট্রিপ অফ করা হয়েছে, তাহলে আপনি কী ভাববেন? উইল ইউ ফিল আউট্রেজিয়াস? উইল ইউ ফিল হিউমিলিয়েটেড? অর উইল ইউ জাস্ট ইগনোর ইট ? ভাববেন এরকম তো কতই হয়! বাংলা থেকে গুজরাট পর্যন্ত, কাটা মুণ্ডু শুধু ধড়ের সঙ্গে মিলতে পারে না। বলতে পারে না মা ভাত দাও’
কী যেন ছিল মেয়েটার বলার ভঙ্গিতে, একটা অদ্ভুত দৃঢ়তা, আত্মবিশ্বাস, আমি কেঁপে উঠলাম, বুঝলি। আমি ওর হাত চেপে বললাম ‘তুমি কে?তুমি কে বলো আমাকে’
মেয়েটা আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে বলল ‘আমরা কেউ না। হারিয়ে যাওয়া মানুষ। তবে এইসব হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা দানা বাঁধছে। মিসিং পার্সনস পার্টি। একদিন এরা সব দখল করে নেবে’

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (1)
  • comment-avatar
    Joy Sinha 4 years

    খুব ভালো লাগলো পড়ে। প্রতিটা পর্বই অসাধারণ। অন্তহীন শুভেচ্ছা রইল এই ধারাবাহিকটির প্রতি ❤️

  • demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes