অজিত সিং বনাম অজিত সিং <br /> ছেচল্লিশতম পর্ব <br /> তৃষ্ণা বসাক

অজিত সিং বনাম অজিত সিং
ছেচল্লিশতম পর্ব
তৃষ্ণা বসাক

৪৬

ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে রাস্তা পার হয়ে কফি হাউসের দিকে যাবে, তখনই ওর পরিচিত একটা ছেলে, ছোট ফুটপাতের দোকান, এসে বলল ‘আপনার বইটা এসে গেছে স্যার, নেবেন না?’
বইয়ের নামে, দুর্লভ বইয়ের নামে এখনো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সুমনের মুখ। সে অমনি ভুলে গেল, কফিহাউসে কয়েকজন তার অপেক্ষায় থাকবে, তারপর বাড়ি গিয়ে অদিতির সঙ্গে বেরোতে হবে, আজ তাদের অ্যানিভার্সারি, বাইরে খাবে তারা। এখন শহরে কত ঝকঝকে শপিং মল হয়েছে, সেখানে হাজার গুণ দাম দিয়ে খুব সাধারণ খাবার খায় মানুষজন। কেন গলা পেতে দিচ্ছ বহুজাতিকের কাছে? এ প্রশ্নের উত্তর কেউ দেবার প্রয়োজন মনে করে না, কী বোকা লোকটা, এখনো এইসব প্রশ্ন করে যায়? কাঁধে ঝোলা নিয়ে মা বউয়ের হাতের রুটি আলু চচ্চড়ি খেয়ে বিপ্লব খুব মারিয়েছ বাবারা, তোমাদের জন্যেই আমাদের ছেলেমেয়েরা তেঁতুলের ঝোল খাচ্ছে বারোমাস, এ রাজ্যে চাকরি কই? নতুন দিনে তাও তো বনগাঁ বারাসাত ক্যানিং -র ছেলেমেয়েগুলো শপিং মলে কাজ পাচ্ছে, পিৎজা ডেলিভারি দিতে শহর এফোড় ওফোঁড় করে ফেলছে, সহ্য হচ্ছে না বুঝি? সুমনের একটা কথা ভেবে খুব হাসি পেল। বুনো রামনাথের স্ত্রী তেঁতুলপাতার ঝোল রাঁধতেন, সেটাই ছিল বাঙ্গালির প্লেন লিভিং হাই থিংকিং এর চূড়ান্ত উদাহরণ।মিনিমালিটিই ছিল বাঙ্গালির অভিজ্ঞান। আজ সেই বাঙ্গালির ছেলেমেয়েকে দক্ষিণে পড়ে থেকে তেঁতুলের ঝোলই খেতে হচ্ছে!পাপটা ঠিক কাদের? বুনো রামনাথ আর তাঁর স্ত্রীর? যারা বাঙ্গালির মজ্জায় সরল জীবনের আদর্শ ঢুকিয়ে গেছেন, যেখানে গরিব গরিব বেঁচে থাকাই দস্তুর। ছেঁড়া পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলা। না খেয়ে বিপ্লব করা সেইসব মানুষই কি বাঙ্গালির বারোটা বাজিয়ে দিয়ে গেছেন? আর সেই ভুল শোধরাতে গিয়ে বাঙালি আজ টাকার সাধনায় মেতেছে? যারা সমাজের সেরা, তারা তো বিদেশে পালিয়ে বেঁচেছে, যারা পালাতে পারেনি, তারা নিজেদের চারপাশে সংস্কৃতি টংস্কৃতি দিয়ে একটা খোলস বানিয়ে টিকে আছে। নইলে মরে যেত। কারণ বাকিরা তো একটা বিরাট সিন্ডিকেট তৈরি করে ফেলেছে। চাকরি নেই তো খাবে কি? দালালি ছাড়া কোন পেশা নেই।
এই পাঁকের মধ্যে এক একটা শপিং মল পদ্মের মতো ফুটে আছে। কিন্তু একদিন মলের বেসমেন্টে গিয়ে দেখো তো। দম বন্ধ হয়ে আসবে। লেডিস টয়লেটে গিয়ে দেখো, মলের মেয়েগুলো ওখানে বসে বিলাপ করছে। ক্যানিং থেকে , বারাসাত থেকে আসা রোগা ভোগা মেয়েগুলো, টিফিনবাটিতে ভাতের মধ্যে একটু কুমড়োর ঘ্যাঁট বা আলুসেদ্ধ নিয়ে আসা মেয়ে গুলো।
তবু অদিতির সঙ্গে খেতে যেতে হয় সুমনকে।অদিতির জন্য, ছেলের জন্য। অদিতি বলে ‘রনি তোমার ঐ আদর্শের কী বোঝে? ছেলেমানুষ, ওর সব বন্ধুরা এইসব জায়গাতেই টাইম স্পেন্ড করে, টাইম জোনে খেলে প্রতি উইক এন্ডে, আইনক্সে মুভি দেখে, ওকে গল্প করে এসে, বুঝতে পারো না ওর কত খারাপ লাগে’
‘কিন্তু অদিতি, ও তো আমাদের ছেলে, আমি ছোট থেকে ওকে কত ভালো ভালো বই কিনে দিয়েছি, পড়ে না দেখে পড়ে শুনিয়েছি ঘুমের আগে, তোমার স্কুল বাড়ির কাছে, তাছাড়া তুমি তো চাকরিও পেলে ও খানিকটা বড় হয়ে যাবার পর, অনেক সময় দিয়েছি আমরা ওকে। ঐ বন্ধুদের বাবা মা-রা কোন সময় দেয়নি, শুধু মলে নিয়ে যাওয়া ছাড়া। তার ওপর সেখানেও ওদের একা ছেড়ে দিয়ে আসে বাড়ির গাড়ি। ওরা একা একা টাইম জোনে খেলে, একা একা মুভি দেখে।আমি চাই না ও মল কালচারে বড় হয়ে উঠুক। তোমার মনে হয় না এই গ্লসি জায়গাটা রিয়েলিটি থেকে কত দূরে। একটা অলীক জগত। এখানে যেতে যেতে ও বুঝতেই শিখবে না বাইরের ধুলোমাটির পৃথিবীটা সত্যি কেমন’
‘বাবারে বাবা। তোমার এত ভারি ভারি আদর্শ ওর ঘাড়ে চাপিও না। কী দিল তোমাকে আদর্শ? এত বই পড়ে সেই তো কেরানিগিরিই করে চলেছ? পকেটের পয়সা দিয়ে যে পত্রিকা বার করো, কে পড়ে সেসব? তোমরা কেউ বুঝতে পারোনি সময় পালটে গেছে। এখনকার বাচ্চাদের কী আছে যে ওরা মলে যাবে না? না খেলার মাঠ, না গরমের ছুটি কাটানোর জন্যে মামার বাড়ি। আমারই দেখো বাবা মা চলে যাবার পর দাদার সঙ্গে কত দূরত্ব এসে গেল। তোমার মা তো তোমাকে ছাড়া বোঝেন না। নাতিকে নিয়ে যে একটু গল্প করবেন বা হেঁটে আসবেন, তা না। সারাক্ষণ খালি ছেলে আর ছেলে’
এরপর সুমন জানে অদিতির গলা ভারি হয়ে আসবে, চোখে জল আসবে, ও বিলাপ করতে শুরু করবে সুমনের পাল্লায় পড়ে ওর জীবনটাই নষ্ট হয়ে গেছে, কবেকার এক একটা ঘটনা টেনে টেনে আনবে। কোথায় কোন আত্মীয়ের বিয়েতে যথেষ্ট দামি উপহার দেওয়া হয়নি, কবে কোন বন্ধুদের খেতে ডাকতে পারেনি সুমনের উদাসীন ব্যবহারে। সেসব বলা হয়ে গেলে অদিতি আবার ছেলের প্রসঙ্গে চলে যাবে।বলবে ‘রিয়েলিটির কথা বলছিলে না? ওদের স্কুলে প্রতি বছর পুজোর আগে দুস্থ বাচ্চাদের জন্যে নতুন জামাকাপড়, সাবান, খেলনা এইসব কালেকশন করা হয়, জানো না? তুমি আর জানবে কোথা থেকে? অফিসের পর কফি হাউসে বসে বাংলা সংস্কৃতি করে দশটার আগে তো বাড়ি ফেরো না। সেখানে আমার রনিই তো সেইসব কালেক্ট করে ছেলেদের জামা ব্লু র‍্যাপারে, মেয়েদের জামা পিংক র‍্যাপারে মুড়ে টিচারকে জমা করে। আগের বছর সায়েন্স সিটিতে যে প্রাইজ পেল, সে তো এই সোশ্যাল ওয়ার্কের জন্যেই। তুমি যদি সত্যিই কিছু করতে চাইতে, তবে যারা বাচ্চাদের খেলার মাঠ হাপিশ করে মাল্টিস্টোরিড তুলছে, গিয়ে তাদের কলার চেপে দুটো থাপ্পড় লাগাতে। ওইসব শৌখিন দুঃখ আর শৌখিন বিপ্লবেই দেশটার বারোটা বেজে গেছে’
সুমন অবাক হয়ে গেছিল অদিতির বাগ্মিতায়। এই কি সেই অদিতি, যাকে রাস্তার উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে তার হৃৎস্পন্দন থেমে যেত? এর সঙ্গেই অফিস ফেরত কলকাতার যত অলিগলি দিয় অবিশ্রান্ত বকবক করতে করতে সে হেঁটে যেত অবিরাম? কফি হাউসের চিকেন অমলেট আর কফিতেই তারা সুখী ছিল, অন্তত সে তাই ভাবত। এখন ওরা যেখানে খেতে চায়, সেখানে এক কাপ কফির দাম তিনশ টাকা, সিনেমা দেখতে আর পপকর্ন খেতে মিনিমাম একেকজনের পাঁচশ টাকা পড়ে। এইগুলো ছাড়া অদিতি বা অদিতির ছেলে সুখী নয়? সে কি তারমানে একটা গ্রহান্তরের জীব? তাদের সুখ দুঃখ পথ আদর্শ একেবারে আলাদা হয়ে গেছে? এই অদিতির জন্যে সে তো সেই সরষে পিঠের দিকে ভালো করে দেখেনি পর্যন্ত। হঠাৎ তাঁর কথা মনে পড়ে তার বুক থমকে গেল।
মনটা ঠিক তার বশে রইল না সারাদিন ধরে। বহুবছর ধরে খুব সকালে রেডিও শোনা মার অভ্যেস। ভোরের অনুষ্ঠান শুরু হয় মহাপুরুষের বাণী আর রবীন্দ্রনাথ অতুলপ্রসাদ এইসব গান দিয়ে। হয়তো যে খুন করবে বলে ছকছে, সেও এইসব শুনেই দিন শুরু করে। সেখানে আজকে গান বাজছিল ‘তোমার মহাবিশ্বে কিছু হারায় না তো কভু’। আজ সকালে রনিকে স্কুলের জন্যে রেডি করাতে করাতে গানটা শুনল সুমন। শুধু শুনল না, গানটা যেন গুলির মতো ঢুকে এল মনে। হঠাৎ বহু বছর পর তার মনে পড়ল, তীব্রভাবে মনে পড়ল একজনের কথা। কদিনই বা দেখা হয়েছে। যেটুকু দেখা হয়েছে, তার নব্বই ভাগ দিনেই তো সে এড়িয়ে যেতে চেয়েছে, চরম অভদ্রতাই হয়তো করেছে। কিন্তু কি তীব্র ছিল সেই মানুষটার আকর্ষণ। যদি হারিয়ে না যেতেন, তবে তার জীবন অন্য খাতে বইতে পারত, কোথায় ভেসে যেত অদিতি! কারণ ঐ একদিনের কিছুক্ষণ গাড়িতে ওঁর পাশে কাটিয়ে সে বুঝতে পেরেছিল সঙ্গসুখও কত মাদক হতে পারে।
সকালে গানটা শোনার পর মন কত বছর পিছিয়ে গিয়েছিল। নতুন চাকরি পাওয়া, স্বপ্ন দেখার সেই দিনগুলো, বারবার গেট মিটিং যাওয়ার ডাক, আর বারবার তা ফেরানো, আর একবার, মাত্র একবার তাঁর ডাকে সাড়া দেওয়া। সেদিন ফিরে এসে সারা শরীরে ঝিমঝিম ভাব, জ্বরই চলে এল। কে জানত, এটাই এই শহরে তাঁর শেষ দিন। যদি জানত সুমন, কাল উনি এইভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবেন, তবে কোথাও তাঁকে যেতে দিত না। সারারাত বুকে বেঁধে রাখত আষ্টেপৃষ্ঠে। এই কথা ভেবেই উত্তেজনা ছড়াল তার শরীরে। অথচ তার নিজের তো কম বয়স হল না, আর সেই অলোকসামান্যা সুন্দরী, তিনি যদি বেঁচেও থাকেন, এতদিনে প্রৌঢ়া। হায় চিল, সোনালি ডানার চিল। তুমি আর ঘুরে ঘুরে কেঁদো নাকো।সারাদিন ঘুরেফিরে যেন সেই নারীর সঙ্গেই দেখা হল তার। করিডরে কোন মহিলা হেঁটে গেলেই সে চমকে চমকে উঠছিল। এখন সব সরকারি অফিস, বিশ্ব বিদ্যালয়েই সৌন্দর্যায়নের ছোঁয়া। লোকগুলো বদলায়নি, শুধু অফিস ঝাঁ চকচকে হয়েছে, চট করে দেখে মনে হবে প্রাইভেত কম্পানি, কিন্তু কাজ করতে গেলেই সে ভুল ভাঙবে। কলিকাতা যে আছে কলিকাতাতেই তা অচিরে টের পাওয়া যাবে। কিন্তু এত সব পালিশ টালিশের মাঝেও সুমনের অফিস বিন্দুমাত্র বদলায়নি, সেই সাবেকি ঘরে সাবেকি চেয়ার, স্তূপীকৃত ফাইল, বন্ধ না হওয়া আলমারি, টেবিলের ওপর ছাতা, টিফিন বাক্স- এক আছে সব, শুধু কিছু লোক রিটায়ার করেছে আর নতুন লোক এসেছে তার জায়গায়- এইটুকুই।আর সেই করিডর, যেখানে সর্ষেফুল রঙা পিঠকে আস্তে আস্তে দূরে মিলিয়ে যেতে দেখেছিল সুমন, সেটাও একরকম আছে দুপাশের দেওয়ালে যাবতীয় পোস্টার আর পানের পিক সমেত। যদিও ওর পদোন্নতি ঘটেছে এত বছরে। যার মানে ঐ ঘরেই একটু ঘেরা জায়গা, একটু বড় চেয়ার আর চেয়ারের পিঠে একটা তোয়ালে।এই চেয়ার আর তোয়ালেটুকুই এই পোস্টের অর্জন। টেবিলটা সামান্য বড়। তবে এবারও করিডরের মুখোমুখি, মুখ তুললেই করিডর দেখা যায়।আজ সুমন দিনের মধ্যে অজস্রবার করিডরে শতরূপাকে দেখল। বিকেলে একবার কফিহাউসে যাবে, রাস্তা পেরোচ্ছে, পুরনো বইয়ের দোকানের সেই ছেলেটা, নাথু ওর নাম, এসে বলল, স্যার আপনার সেই বইটা এসে গেছে।
বইয়ের নামে এখনো সুমন সব ভুলে যায়। সে ভাবল কফি হাউসে সুনন্দ রা একটু বসুক না, ও চট করে বইটা নিয়ে আসবে। কামিনী রায়ের বোন ডাক্তার যামিনী সেনের লেখা একটা দুষ্প্রাপ্য দিনলিপি। পরের সংখ্যাটা দিনলিপি নিয়ে। এটা দারুণ হবে। ভাবতে ভাবতে নাথুর পেছন পেছন চলে এল সুমন। গলিতে ওদের দোকান। দোকানের সামনে একটা গাড়ি এসে দাঁড়াল তখুনি। দরজা খুলে গেল আর একটা ঝিমঝিম করা গন্ধ খুব চেনা ওকে ঘিরে ফেলল। গাড়ির ভেতরে বোরখায় ঢাকা কে যেন বসে। সুমন শুনতে পেল কে যেন বলছে ‘বহু বছর আগে এই গলি থেকেই আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হিস্ট্রি রিপিটস। উঠে এসো সুমন। দেখো তোমাকে আমি ভুলি নি। তাই নিজেই এসেছি তোমাকে নিতে’
মানুষ হারিয়ে গেলেও কণ্ঠস্বর হারায় না, বুঝতে পারল সুমন।
তার মাথাটা কেমন টলে গেল। আস্তে আস্তে সে ঝুঁকে পড়ছিল সিটে, তার আগেই তাকে ধরে ফেরলেন সেই মহিলা।
মানুষ হারিয়ে গেলেও তার কণ্ঠস্বর যেমন, তেমনই স্পর্শবোধ হারায় না, অবিকল একই থাকে। বহু বছর আগে গাড়ির মধ্যেই কারো বুক ছুঁয়ে গেছিল তার বাহু। সারা শরীর ঝনঝন করে উঠেছিল। আজ এত বছর পরে একইরকম অনুভূতি হল। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল ‘শতরূপা! আপনি বেঁচে আছেন!’
হিজাব সরিয়ে হেসে উঠলেন শতরূপা।সেই আশ্চর্য মুখ, দেবীর মতো চোখ যেন অতলান্ত দেখে নিতে চায়। কত কত বছর হল যেন! প্রায় ২৫ বছর! এতদিনে তো এঁর বলিরেখা ঢাকা এক বৃদ্ধা হয়ে যাওয়া উচিত ছিল। যদিও বিশ্বায়িত পৃথিবীতে বয়স ধীরে বাড়ে, মেয়েদের বিশেষ করে।
হঠাৎ শতরূপা বলেন ‘শোন সুমন, ক্ষমতাবানদের সময় মুছে দিতে হবে।
সময় এসে গেছে।’
সময় এসে গেছে!
মাত্র তিনটি শব্দ, তাতেই চমকে যায় সে। গাড়িতে উঠে পর্যন্ত কোন কথা তার কানে ঢুকছিল না। সে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল। সে এবার সোজা হয়ে বসে শতরূপার হাত ধরে ঝাঁকাল ‘হ্যাঁ, শতরূপা, সময় এসে গেছে’

CATEGORIES
TAGS
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes