
অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়-এর গল্প
আশা ভোঁসলে
শীতের দুপুর। সোয়েটার খুলে কোমরে বাঁধা কেতের দুপুর। জন্তুকাকার (কবিপ্রদত্ত নাম জন্তু, তাঁর পিতৃদত্ত নাম ঝন্টু) বন্ধ দোকানের পাশ দিয়ে, নিঝুম নাচের স্কুল ফেলে রেখে, ঘুমন্ত বাড়িগুলির শান্তিভঙ্গ করতে করতে শিশুতীর্থের তিনটে ছেলেমেয়ে ফিরছিল। সবচেয়ে উঁচু মাথাটার নাম তাতাই। তার পরিচয় ক্লাস ফোর। বিতর্কসভার বাকি দুটো মেয়ে এক বছরের জুনিয়র। ব্রাউনপেপার ও তুলো দিয়ে তৈরি কুলফি নিয়ে তর্কাতর্কির মাঝে তাতাইয়ের কিছু যুক্তি ছিল। কিন্তু তাদের মধ্যে পাটকাঠির মতো চেহারার চাইনিজকাট কন্যাটি যুক্তি – টুক্তির ধার ধারে না। ‘হাত থাকতে মুখে কেন’ – তে বিশ্বাসী সে অবলীলায় তাতাইকে একধাক্কায় মাটিতে ফেলে দিল। লাল সুরকির রাস্তা থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠছিল তাতাই। তা দেখে আবার ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। দ্বিতীয়বার গা ঝেড়ে উঠেই তাতাই প্রতি -আক্রমণ করল। তার পরে হুটোপুটি মারপিট শেষে তৃতীয়জনের মধ্যস্থতায় সন্ধি না হওয়ায় ‘আড়ি, ভাগ!’ বলে দুই মক্কেল দু’দিকের পথ ধরল। হাঁটু ছড়ে যাবার জ্বালার চেয়েও আড়ির জ্বালা বেশি।
মুখ দেখাদেখি বন্ধ হওয়ার অল্প কিছুদিন পর মফসসলি পাড়ায় ডিসেম্বর ঢুকে এল। চিরকাঙ্ক্ষিত সাজো সাজো রবের ডিসেম্বর। লম্বা বিনুনি, কাজলচোখা, পাড়ার গানের দিদির বিবাহের ডিসেম্বর। চাইনিজকাট কন্যার জিন্দেগি গুলজার হয়ে গেল। সে ব্যক্তিগত জীবনযাপন ভুলে তিনদিন ধরে পাড়ার দিদির বিয়েবাড়িতে আপন ঘাঁটি গেড়ে বসল। মেহেন্দি পরাতে এলে কনের আগে সে নিজের লালচে হাত বাড়িয়ে দেয়। হলুদ কোটার হলুদ খানিক মেখে পাড়া বেরিয়ে আসে। তত্বের মিষ্টিতে হাত চালায়। নতুন শাড়ি কনের আগে নিজেই গায়ে জড়িয়ে বসে থাকে।
এভাবে চলতে চলতে এল বিবাহের সন্ধ্যা। উঠোনে বিবাহমণ্ডপ, ভিড়ে দাঁড়ানো যাচ্ছিল না। ছাদে প্রীতিভোজের ব্যবস্থা। সেখানেও পিলপিলে ভিড়। এইসবের মাঝখানে চাইনিজকাট কন্যাটি দেখল, তার নীল শাড়ি পরিহিতা মা’কে বাবা রুপোলি রাংতা জড়ানো গোলাপ ছুঁড়ে চলে গেল। মা বলল, ‘ঢং!’ এহেন ‘ঢং’ চাইনিজকাটের পছন্দ হল। বরের গাড়ি থেকে খুলে খুলে এনে সে গাদাখানেক গোলাপ জড়ো করে রাখল। কিন্তু মনের মতো লোকজন না পেয়ে তার গোলাপ জোগাড়ের পরিশ্রমই সার! তারপরে কিছুক্ষণ সে বরযাত্রীদের বরাদ্দ টিফিনে খাবলা মারল। অল্প খানিক খেয়ে শক্তি বৃদ্ধি করে আবার যখন উঠোনে এল, দেখল সাদা ধুতি – পাঞ্জাবী পরে তারকদাদু বিয়েবাড়িতে ঢুকলেন। পিছনে তাঁর নাতি। তাতাই!
এত মার খাওয়ার পরেও তার পাড়ার বিয়েবাড়িতে ঢোকার স্পর্ধা পেল তাতাই! চাইনিজকাট কন্যা রাগে উন্মত্ত হল। কমলা রঙের শার্ট ও সাদা ফুল প্যান্ট পরে জুতো – মোজা সমেত খুবই ভদ্র হয়ে বিয়েবাড়িতে এসেছিল তাতাই। ছুটে গিয়ে তার নাকে এক ঘুষি ঝাড়ল চাইনিজকাট। তারক দাদু ‘করো কী! করো কী!’ বলে উঠলেন। বিয়েবাড়িতে মুহূর্তের পজ বাটন পড়ল। তারপর বেগতিক বুঝে পুরোহিতদাদু আরও উচ্চকণ্ঠে মন্ত্র পড়তে লাগলেন। মনোযোগ ঘুরিয়ে চাইনিজকাটকে গণধোলাইয়ের হাত থেকে বাঁচালেন।
সেকালে বিয়ের ভিডিও নামক এক বিচিত্র জিনিস বাজারে চালু হয়েছিল। সেইসব ভিডিওতে কনের ছবিকে কেন্দ্র করে বরের পাসপোর্ট সাইজ ছবি পাঁচভাগ হয়ে ঘুরত, আবহে অদ্ভুত অদ্ভুত গান বাজত, খাওয়ার সময় জোরালো আলো ফেলে খাওয়ার বিষয়ে ক্ষণিকের হাত গুটিয়ে নিতে বাধ্য করা হত ইত্যাদি ইত্যাদি। বড়দিনে ঝাকানাকা এডিট সহযোগে সেই ভিডিও এল। পাড়ার অনেকে মিলে নতুন কেনা ভিসিডিতে সেই ভিডিও দেখতেও এল। পাহাড়ের গায়ে কনের নাম, সমুদ্রের ঢেউয়ে বরের নাম, ঝিনচ্যাক ছবি প্রদক্ষিণ ও ‘আর কত রাত একা…’ মার্কা গান সহযোগে ভিডিওটি ভালই চলছিল। সন্ধেবেলা আসতেই বিবাহের চলমান ছবি ফাইটসিনে পাল্টে গেল। তখন ভরা উঠোনে একলাফে তেড়ে গিয়ে চাইনিজকাট কন্যা একটি ধোপদুরস্ত বালকের নাকে ঘুষি ঝাড়ছে। বালকটি নাক মুখ ধরে বসে পড়ছে। এবং আবহে আশা ভোঁসলে গান ধরেছেন, ‘কত না ভাগ্যে আমার, এ জীবন ধন্য হল…’ সিঁথি, কনে, সিঁদুর কিস্যু নেই দৃশ্যে। তাতাই নামক হতবাক বালক নিজেকে সামলে উঠছে, চাইনিজকাট চার ফুটের কন্যা আবার তেড়ে যাচ্ছে চলন্ত দৃশ্যে। ওদিকে ভ্রূক্ষেপহীন আশা ভোঁসলে গেয়ে চলেছেন, ‘ সিঁথির এই একটু সিঁদুরেএএএএ, সবকিছু বদলে গ্যাল্লোওওওও!’
সেই প্রতিভাবান ভিডিওগ্রাফারকে এলাকায় আর দেখা যায় না। সংরক্ষণ করে রাখবার মতো ভিডিওটির অন্যতম চরিত্র তাতাই অন্য শহরে পড়তে গেছিল। সেখান থেকে তারার দেশে গেল। রিটার্ন টিকিট মেলে না।