
স্বপ্ননীল রুদ্রের গুচ্ছ কবিতা
কৃতার্থ
নৈশাহার শেষ হল, আজকের মতো বন্ধ ঝাঁপ
ঠেলে ঠেলে কোনওমতে পার করা গেল শঙ্কাদিন
সামান্য শাকান্ন তবু হাতে এসে রেখেছিল তাপ
তাপের আড়ালে শক্তি— চালক সে, তার কাছে ঋণ
ভোর হতে না হতেই ঝাঁপ তুলে দিন বের করা,
ঝেড়েঝুড়ে সন্তর্পণে করে নেওয়া মরিয়া জরিপ—
কেন্দ্র করে ঘোরা, যেন প্রভুভক্ত কুকুরের নড়া
দুর্ভাগ্য কিংবা সৌভাগ্য, প্রভুর হাতে রয়েছে ছিপ
চুলায় পা গুঁজে লক্ষ্মী আয়োজন করে মিতাহার
কড়াইতে রক্ত ঘামে সুসিদ্ধ হয় আনাজপাতি
হতভাগ্য পাকস্থলি গৃহে অধিষ্ঠান করে আর
নামতার মতো বারবার প্রকাশ্যেই দুষে দিন রাতি
নৈশাহার শেষ হলে কর্ত্রীর বাঁচানো স্বল্প অন্ন
স্বাদবিযুক্ত তবুও সারমেয় মার্জারেরা ধন্য
শীতের চৌকাঠে মা
ভুল করে ভোর ভেবে ডেকে গিয়েছিল শেষরাতে,
কাকভোরে প্রথম বাস, নিয়ে যাবে দূরের শহরে—
আঁকুপাঁকু ভাগ্যখানি সেই শহরের রুক্ষ হাতে
মুষ্টিবদ্ধ, হাঁসফাঁস— শ্বাস নিতে চায় জোরে জোরে
তিনপ্রহরের রাত, চুলা ফুঁকে আগুন ধরায়,
সেদ্ধ ডাল, বড়া ভাজা— শেষে চায়ের জল চাপানো;
অন্ধকারে বিছানায় চায়ে চুমুক কণ্ঠে গড়ায়
উদ্দীপন এসে ডাকে, দেখি চলছে বল চাপানো
কলঙ্ককৃষ্ণ হাঁড়িতে টগবগ ফোটে স্নানের জল,
পিঁড়িতে বড় নীরব, থালা থেকে হাত ওঠে নামে—
সারারাত ঘুমোয়নি, আমি যাব— ছটফটে টলমল
ব্রাক্ষ্মমুহূর্তের আগে প্রস্তুতি শেষ, একটু থামে
অচেনা রুক্ষ শহরে ইন্টারভিউ হাঁটছে দড়িতে
চৌকাঠে মায়ের ‘দুগ্গা দুগ্গা…’ তপ্ত এই তীব্র শীতে
পালক
কারশেডে জবুথবু লতাকীর্ণ ট্রেনের কামরায়
ভূমিষ্ঠ-পরবর্তী আমাকে রেখে গিয়েছিল কেউ—
শেয়ালের সুনিশ্চিত খাদ্য ছিনিয়ে সেই সন্ধ্যায়
অদূরে চোলাই ঠেক থেকে তুলে নিয়েছিল কেউ
পিছে কুকুরের পাল, তাড়া— বাম হাতে বুকে চেপে
ডান হাতে পাথর নিক্ষেপ, বিতাড়ন শেষে জয়;
টলতে টলতে উঠে এসে আমাকে দেখেই কেঁপে
উঠেছিল ওয়াগন ব্রেকার, দেখেছিল তারাময়
রাত ফুটেছে ঘিঞ্জি বস্তির প্রান্তের টালির ঘরে
বন্ধ্যা যুবতীর তলপেটে জেগেছে ঘাস বাহার,
অশ্রুর মতো শিশির দানা ভরে আছে, ঝরে পড়ে
শুকতারা পেরিয়ে সেই নারী মুছে দিচ্ছে হাহাকার
শয্যাকয়েদ পালক পিতা, তার সমস্ত পালক
দেহে জুড়ে উড়ি আজ খাদ্যান্বেষী অমোঘ চালক…
গোপন ঘাসের বন
ঋতু নির্বিশেষে এইখানে মোটাদানা বৃষ্টি ঝরে
জল ফেটে অজস্র চঞ্চল আরও ছোট ছোট দানা
ট্রাম্পোলিনে মত্ত শিশুদের মতন লাফিয়ে পড়ে
গোপন ঘাসের বনে পাতা আর্দ্র হরিৎ বিছানা
বৃষ্টি-বিরতি লগনে ম্রিয়মাণ বর্ষজীবী ঘাস
গোড়ায় প্রতুল বীজ রেখে হলুদাভ হয়ে যায়—
বিশুষ্ক হয়ে ওঠা চাদরে ছড়ায় শেষ নিঃশ্বাস
বেলা বাড়লে সৃষ্ট শূন্যস্থান আবির্ভাব-লগ্ন চায়
লগ্নর ওপরে পুনরায় ভারী হয়ে ওঠা মেঘ—
তোড়জোড়, ব্যগ্র, যেন অনলাইন ডেলিভারি বয়;
ঢাউস ব্যাগে চাপিয়ে জল পায়ে বেঁধে নিয়ে বেগ
এসে ব্যাগ খুলে দাঁড়িয়েছে, এই স্থান জলময়
সময়ে ও অসময়ে হালকা বৃষ্টি ভারী বর্ষণ
গোপন ঘাসের গায়ে লেগে থাকে সুদীর্ঘ শ্রাবণ
পতিত কদম ফুল
দিঘিটির পাড় উঁচু, আনকোরা মেঘের বদান্যতা
এনেছে ঘাসের বাড়বাড়ন্ত, ফাঁকে ফাঁকে জংলি ফুল
দেবদারুর পাহারা বসানো, বাতাস মর্মর-শ্রোতা
ভেজা ঋতু এখনও কিশোরী, তার হাত ভরা ভুল
পাড় ঘেঁষে রোগা পথ, পাশে লাজুক কদম্ব তরু
তলায় বাখারির দোকান, চাটাই বেড়া নির্মাণ—
বুকে কথার পাহাড় জমা দোকানটির চালে সরু
স্নাত কিছু শাখা ঢলে পড়ে ফুল হাতে টানটান
অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে গিয়ে বয়স কিছুটা স্থির,
দু’হাত অস্থির বাঁশ কাটে, বাখারি বানিয়ে যায়—
ভ্যানে চেপে চলে যাবে দরমা, ঘর ওঠাবে নিবিড়
মুক্ত দাওয়ায় মাদুর পেতে বসবে লাঘব সন্ধ্যায়
কদম গাছের নিচে অজ্ঞাত কারণে অবিবাহ
পতিত পুষ্পগুলিতে রেখে দেয় গোপন প্রদাহ…