
সোভিয়েতিস্তান : স্বপ্নে দেখা দৃশ্যের মতো
সায়ন রায়
সোভিয়েতিস্তান : এরিকা ফাটল্যান্ড / বাংলা অনুবাদ—প্রসিত দাস / সম্পর্ক /মূল্য : ৩৫০/
১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ে।যে পনেরোটা প্রজাতন্ত্রকে নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা ইউনিয়ন অফ সোশালিস্ট সোভিয়েত রিপাবলিক, তারা যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে বেরিয়ে এসে স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে উঠল।মাস কয়েকের মধ্যে পূর্ব ইউরোপের মানচিত্রে যোগ হল ছটা নতুন দেশ—এস্তোনিয়া, লাটভিয়া,লিথুয়ানিয়া, বেলারুশ, ইউক্রেন ও মলডোভা।দক্ষিণে ককেশাস অঞ্চলে গজিয়ে উঠল তিনটে নতুন দেশ—জর্জিয়া,আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান।পাঁচটি নতুন দেশ তৈরি হল মধ্য এশিয়ায়—কাজাখস্তান,উজবেকিস্তান,তুর্কমেনিস্তান,তাজিকিস্তান ও কিরঘিজস্তান।১৯৯১ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর সরকারিভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ঘটানো হয়।
এরিকা ফাটল্যান্ড-এর জন্ম ১৯৮৩ সালে নরওয়েতে।বর্তমানে বসবাস করেন নরওয়ের রাজধানী অসলোয়।অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক নৃতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করেছেন।২০১৫ সালে নর্স ভাষায় লেখা তার একটি ভ্রমণকাহিনি তাকে রাতারাতি বিখ্যাত করে দেয়।বইটি অনূদিত হয় বারোটি ভাষায়।এর আগেও তার দুটি বই বেরিয়েছিল—’দ্য ভিলেজ অফ অ্যাঞ্জেলস'(২০১১); যা বেসলানের সন্ত্রাসবাদী হামলার সরেজমিন প্রতিবেদন।উটোয়া হত্যাকাণ্ডের প্রভাব সম্পর্কে লিখেছেন ‘দ্য ওয়ার উইদাউট সামার’।এরিকা কথা বলতে পারেন আটটি ভাষায়।নর্স ভাষা ছাড়াও যার মধ্যে রয়েছে—ইংরেজি, ফরাসি, রুশ,ইতালিয়াল,স্প্যানিশ, জার্মান ইত্যাদি।২০১৫ সালে প্রকাশিত বইটির নাম ‘সোভিয়েতিস্তান’; যা সোভিয়েতোত্তর মধ্য এশিয়ার পাঁচটি দেশ ভ্রমণের বৃত্তান্ত। এই পাঁচটি দেশ হল—কাজাখস্তান,তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান,তাজিকিস্তান ও কিরঘিজস্তান।২০১০-১১ সালে তিনি দু-দফায় এই পাঁচটি দেশ ভ্রমণ করেন।যতটা সম্ভব মেলামেশা করেন সেইসব দেশের মানুষের সঙ্গে।যেহেতু এই দেশগুলি বহু বহু বছর সোভিয়েত রিপাবলিকের অংশ ছিল,তার সহায়ক হয়েছিল রুশ ভাষা।এই যাত্রার আগে প্রস্তুতিকালীন সময়ে কয়েকবছর ধরে তিনি রুশ ভাষার চর্চা করেন এবং এই ভাষাটি রপ্ত করেন।তার যাত্রাপথে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে রুশ ভাষা কাজে আসেনি,জনসংযোগের জন্য তিনি সহায়তা নিয়েছেন মধ্যস্থতাকারীর।বলাইবাহুল্য মধ্য এশিয়ার অন্যান্য বেশিরভাগ দেশের মতই এইসব দেশগুলিও স্বৈরশাসকদের দ্বারাই পরিচালিত।তবে তার রকমফের আছে।কোনো কোনো দেশে শাসকের বিরুদ্ধে আড়ালে, আবডালেও মানুষ কথা বলতে চায় না।বললেও গলার স্বর খাদে নিয়ে যান।কোথাও অবস্থাটা স্বাভাবিকের অনেক কাছাকাছি।আমার আলোচ্য বইটি ‘সোভিয়েতিস্তান’—নর্স ভাষা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন কারি ডিকসন।বাংলায় অনুবাদ করেছেন প্রসিত দাস।বাংলা অনুবাদটি এবছর(২০২২) প্রকাশ করেছে সম্পর্ক প্রকাশনী।কারি ডিকশন এরিকা ফাটল্যান্ডের আরেকটি ভ্রমণকাহিনিও ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন যেটা ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়েছে।এই বইটিও অত্যন্ত আকর্ষণীয়। রাশিয়ার বর্ডার জুড়ে যে দেশগুলো রাশিয়াকে ঘিরে আছে সেই চোদ্দটি দেশে ভ্রমণের বৃত্তান্ত। দেশগুলি হল—উত্তর কোরিয়া, চায়না,মঙ্গোলিয়া,কাজাখস্তান, আজারবাইজান, জর্জিয়া, ইউক্রেন,বেলারুশ, লিথুয়ানিয়া,পোল্যান্ড, লাটভিয়া,এস্তোনিয়া,ফিনল্যান্ড,নরওয়ে।
তুরস্কের রাজধানী ইস্তানবুলের আতাতুর্ক বিমানবন্দর থেকে লেখিকার যাত্রা শুরু হয়।গন্তব্য তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশগাবাত।মধ্য এশিয়ার এই দেশগুলির সঙ্গে সরাসরি তুরস্কেরই বিমান যোগাযোগ রয়েছে।তাই তুরস্ক হয়েই এই পথে যাওয়া দস্তুর।এক রাতের বিমান যাত্রায় লেখক পৌঁছান মার্বেল-শহর আশগাবাত।তুর্কমেনিস্তানের অর্থ ‘তুর্কমেন মানুষদের দেশ’।’স্তান’ অনুসর্গটা এসেছে ফারসি ভাষা থেকে,এর অর্থ ‘স্থান’ বা ‘দেশ’।খনিজ তেল ও ভূগর্ভস্থ গ্যাসের ভাণ্ডারে সমৃদ্ধ এই দেশ অত্যন্ত ধনী।কিন্তু মার্বেল সজ্জিত রাজধানী-শহর আশগাবাত-এর যে রোশনাই, দেশের কোনায় কোনায় প্রবাহিত সাধারণ মানুষের জীবনে তার কোনো প্রভাব দেখা যায় না।মনে হয় তা আলাদা দেশ।উজবেকিস্তানের মত তুর্কমেনিস্তানের সরকার এতটা কতৃত্ববাদী ও দুর্নীতিগ্রস্ত যে তাদের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার ক্ষমতাসীন স্বৈরতন্ত্রের তুলনা চলে।এই দুই দেশে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম বলে কোনো কিছুর অস্তিত্ব নেই এবং দেশের রাষ্ট্রপতি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী।এ দেশের হোটেল-রেস্তরাঁ থেকে দোকানপাট সবকিছুই রাষ্ট্রপতির মালিকানায় আর নিয়ন্ত্রণে চলে।দেশে একটাই ব্যাঙ্ক—ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক।তুর্কমেনিস্তানের বাজারের ঝাঁপ বাইরের দুনিয়ার জন্য বন্ধ,তাই সেই বাজারের প্রয়োজনমাফিক এ দেশে জিনিসপত্রের দাম আর মজুরির হার কৃত্রিমভাবে বেঁধে দেওয়া হয়েছে,অর্থাৎ কম রাখা হয়েছে।তুর্কমেনিস্তানে প্রত্যেকটা ক্ষেত্র একেবারে তলার দিক পর্যন্ত রাষ্ট্রের তদারকিতে পরিচালিত হয়।অর্থনীতিও তার মধ্যে পড়ে।বিশ্বায়নী দুনিয়ার নয়া-উদারনীতিবাদী ভাষা এদেশে সম্পূর্ণ অস্তিত্বহীন।তুর্কমেনিস্তানের বর্তমান রাষ্ট্রপতি গার্বাঙ্গুলি বের্দিমুহামেদভ।তিনি দেশের দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি।সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের সময় থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন সাপারমুরাত নিয়াজভ।যিনি উপাধি নিয়েছিলেন ‘তুর্কমেনবাশি'( তুর্কমেনদের নেতা)।এই নামেই তিনি পরিচিত। তুর্কমেনবাশি নামে একটি শহরও রয়েছে এই দেশে।সাপারমুরাত নিয়াজভ একজন উদ্ভট স্বৈরশাসক হিসেবে গোটা বিশ্বে স্বীকৃতি পেয়েছেন।তার বহু কীর্তির মধ্যে কয়েকটি হল : ক্ষমতায় আসার পরই দেশকে একদলীয় শাসনের দিকে নিয়ে যাওয়া,নিজেকে আজীবনের জন্য রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা,সমস্ত গ্রাম ও শহর থেকে মার্কস-লেলিনের মূর্তি সরিয়ে ফেলে তার জায়গায় নিজের সোনালি রঙা স্যুট-টাই পরিহিত মূর্তি স্থাপন করা।এমনকি সরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের সম্প্রচারের সময় টিভি-পর্দার ডানদিকের কোনায় শোভা পেত রাষ্ট্রপতির মুখ।১৯৯৩ সাল নাগাদ তিনি দেশে প্রচলিত সিরিলিক বর্ণমালাকে বিদায় করে লাতিন বর্ণমালার একটা পরিমার্জিত সংস্করণ চালু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। নতুন বর্ণমালায় পাঠ্যবই ছাপা না থাকায় ছাত্রছাত্রীদের পাঠ্যবই ছাড়াই কয়েকবছর স্কুলে যেতে হত।যত দিন যেতে লাগল তিনি নিজেকে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট ও পয়গম্বর মহম্মদের উত্তরসূরী ভাবতে লাগলেন—তিনি নিজেই স্বয়ং একজন পয়গম্বর। আর এই শতাব্দীর গোড়ায় সেই অলৌকিক ঘটনাটি ঘটলো। দেশবাসী একদিন ঘুম ভেঙে দেখল,দেশে যেখানে যত রাষ্ট্রপতির ছবি ও পোস্টার আছে(এমনকি প্রতিটি স্কুলের প্রতিটি ক্লাসঘরের প্রবেশপথে তার ফ্রেমে বাঁধাই ছবি ঝোলে), সব ছবিতে তার যুবক বয়সের কেশগুচ্ছ ফিরে এসেছে।একটাতেও আর কোনো পাকা চুল দেখা যাচ্ছে না। ২০০২ সালে তিনি সপ্তাহের সমস্ত বার ও বছরের সমস্ত মাসের নাম পালটে ফেলেন।তার যুক্তি ছিল রুশ ভাষা থেকে ধার করা পুরনো নামগুলো তুর্কমেনসুলভ নয়। তার সবচেয়ে বড় কীর্তি দেশবাসীর জন্য তার সেরা অবদান : রুহনামা বা আত্মার পুস্তক। এটি তার একগুচ্ছ ভাষণের সঙ্কলন। দু-খণ্ডে প্রকাশিত এই বইয়ে তুর্কমেনিস্তানের ইতিহাসের সারসংক্ষেপ, তুর্কমেন রীতিনীতি ও সংস্কৃতির এক ধরনের ব্যবহারিক নির্দেশিকা দেওয়া হয়।অচিরেই এই বইকে পাঠ্যপুস্তক করা হয়।মজার ঘটনা এই : ২০০৫ সালে এ বইয়ের প্রথম খণ্ডটিকে একটা রুশ রকেটে চড়িয়ে মহাকাশে পাঠানো হয়।এক তুর্কমেনি খবরের কাগজে মন্তব্য করা হয়, ‘পৃথিবীর বুকে এ বই কোটি কোটি মানুষের হৃদয় জয় করেছে,এবার সে চলল মহাকাশ জয় করতে।’
দেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি গার্বাঙ্গুলি বের্দিমুহামেদভ কোনো ভাবেই পূর্বতন রাষ্ট্রপতির চেয়ে কম যান না।দেশের সর্বত্রই প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির পাশাপাশি তার ছবি ও মূর্তি ।টানা একুশ বছর দেশ শাসন করার পর ২০০৬ সালে হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে ছেষট্টি বছর বয়সে সাপারমুরাত নিয়াজভ মারা গেলে বের্দিমুহামেদভ রাষ্ট্রপতি হন।তিনি ছিলেন পূর্বতন রাষ্ট্রপতির দন্ত চিকিৎসক। তিনি রাষ্ট্রপতি হবার পর অনেকেই ভেবেছিল দেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চালু হবে।শুরুতে তিনি বেশকিছু জনহিতকর সিদ্ধান্তও নেন।কিন্তু অচিরেই তিনি সমস্ত ক্ষমতার ওপর তার দখল প্রতিষ্ঠা করেন এবং দেশকে হাতের মুঠোয় রাখার রেওয়াজই বজায় রাখেন। এখন আর স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের ‘রুহুনামা’ পড়তে হয় না।তার পরিবর্তে নতুন রাষ্ট্রপতির শৈশব বিষয়ক বই অবশ্যপাঠ্য।
তুর্কমেনিস্তানের বারো আনা জুড়েই কারাকুম মরুভূমি। কারাকুম শব্দের অর্থ কৃষ্ণবর্ণ বালুকা।রাজধানী আশগাবাতের ঝা-চকচকে লোকদেখানো চাকচিক্য পেরিয়ে ভ্রামণিক-লেখিকা পৌঁছে গেছেন বহু বহু পথ পেরিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে।এখানে বাচ্চাদের গায়ে ময়লা,ছেঁড়াখোঁড়া জামা,জুতোহীন পা।সেখানেই লেখিকা পেয়েছেন এই হতদরিদ্র মানুষগুলোর মধ্যে দেশের প্রকৃত প্রাণ-স্পন্দ।স্বাদ নিয়েছেন গাঁজানো উটের দুধে তৈরি খাদ্য।যার পোশাকি নাম ‘চাল’।আশ্রয় পেয়েছেন মধ্য এশিয়ার মার্কামারা সযত্নে তৈরি গোলাকার তাঁবুতে—যার নাম ইয়ুর্ত।প্রতিটি দেশ ভ্রমণের পর্বকে লেখিকা কয়েকটি পরিচ্ছেদে ভাগ করেছেন।প্রত্যেকটি পরিচ্ছেদের রয়েছে আলাদা শিরোনাম। যেমন বইটি শুরুই হচ্ছে ‘নরকের দোরগোড়ায়’ পরিচ্ছেদটি দিয়ে।মরুভূমির মাঝে রয়েছে এক জ্বলন্ত গহ্বর, যার দৈর্ঘ্য ষাট মিটার,গভীরতা বিশ মিটার।স্থানীয় মানুষেরা এই জায়গাটিকে বলে ‘দোজখের দরজা’।এই গহ্বরের জন্ম হয়েছিল ১৯৭১ সালে দুর্ঘটনাক্রমে।সোভিয়েত ইউনিয়নের ভূতত্ত্ববিদরা এখানে প্রাকৃতিক গ্যাসের বিরাট ভাণ্ডার খুঁজে পেয়েছিলেন। ভূগর্ভ থেকে গ্যাস নিষ্কাশনের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেল।কিন্তু এরই মধ্যে ঘটল দুর্ঘটনা। গ্যাস নিষ্কাশনের যান্ত্রিক রিগ কাঠামোর নীচে ধরণী দ্বিধা হয়ে গেল।খুলে গেল ভুগর্ভের মুখ।স্থগিত করে দেওয়া হল কাজকর্ম। ইঞ্জিনিয়াররা বিদায় নিলেন।ভাবা হয়েছিল কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এই গ্যাস বায়ুমণ্ডলে মিশে যাবে।কিন্তু তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এই গহ্বর সরোষে প্রজ্জ্বলিত। আগ্রহীরা ইউটিউবে তুর্কমেনিস্তানের এই স্থানটি দেখে নিতে পারেন।
তুর্কমেনিস্তানের কাস্পিয়ান সাগরতীরবর্তী শহর তুর্কমেনবাশি থেকে দীর্ঘপথ গাড়িতে পাড়ি দিয়ে নির্জন, জনহীন সীমান্তের চেকপোস্টে নাজেহাল হয়ে যাবার মত চেকিং ও ফর্মালিটি পেরিয়ে লিখিকা ঢোকেন কাজাখস্তানে।গন্তব্য কাজাকিস্তানের নিকটবর্তী শহর আকতাউ।আকতাউ থেকে ট্রান্স-সাইবেরিয়ান রেলপথের অভিজ্ঞতা লাভের জন্য লেখিকা নিকটবর্তী শহর অ্যারাল-এ পৌঁছান দীর্ঘ ছত্রিশ ঘন্টা ট্রেনযাত্রা করে।যাত্রাপথটি ক্লান্তিকর। বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্য একঘেয়ে। শুকনো আর খুদে ঘাসের জঙ্গলে ভরা স্তেপভূমি। কাজাখস্তানের আয়তন গোটা পশ্চিম ইউরোপের থেকে বেশি।কিন্তু দেশের বেশিরভাগ অংশই জনবসতিহীন তৃণভূমি আর মরুভূমি।লেখিকার অ্যারাল যাত্রার উদ্দেশ্য মানুষের তৈরি বৃহত্তম প্রাকৃতিক বিপর্যয়গুলোর মধ্যে একটার পরিণতি প্রত্যক্ষ করা।অ্যারাল শহরটা গড়ে উঠেছিল অ্যারাল সাগরের তীরে।১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত মৎস-শিল্পের তা ছিল গুরুত্বপূর্ণ বন্দর-শহর।কিন্তু এরপর থেকেই অ্যারাল সাগর ক্রমশ শুকিয়ে যেতে শুরু করে।অ্যারাল সাগর তার সেরা সময়ে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম আভ্যন্তরীণ সমুদ্র ছিল।অ্যারাল সাগরের জলের মূল উৎস ছিল দুটো নদী—আমু দরিয়া আর সির দরিয়া।পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে সোভিয়েত সরকার যুক্তরাষ্ট্রকে তুলো চাষে স্বয়ম্ভর করে তোলার চেষ্টা করেন।তুলোখেতের বিরাট বিরাট সেচের খালগুলোতে জলের যোগান দেওয়ার জন্য তারা এই দুটো নদীর খাত ঘুরিয়ে দেয়।পরিণতি : অ্যারাল সাগরের জলস্তর নেমে আসতে থাকে এবং তা জলাশয়ে পরিণত হয়।১৯৮৭ সালে এই জলাশয় দুভাগে ভাগ হয়ে যায়।উত্তর অ্যারাল সাগর বা খুদে অ্যারাল,যেটা কাজাখস্তানে।আর দক্ষিণ অ্যারাল সাগর বা বড় অ্যারাল,যা এখন উজবেকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত।তবে বর্তমানে কাজাখ সরকার এই সাগরকে বাঁচানোর জন্য নানা উদ্যোগ নিয়েছে।বাঁধ নির্মাণ,খাল মেরামত—যাতে সাগরে জলের যোগান বাড়ে।ফলাফল যাবতীয় প্রত্যাশাকে ছাপিয়ে গেছে।এই কয়েক বছরে জলস্তর বেড়েছে কয়েক মিটার।
তুর্কমেনিস্তানের মত কাজাখস্তানেও রয়েছে খনিজ তেল আর প্রাকৃতিক গ্যাসের বিপুল ভাণ্ডার।এই দেশের অর্থনীতি নিঃসন্দেহে গোটা মধ্য এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী।দীর্ঘদিন পর্যন্ত এই দেশকেই এ অঞ্চলের সবথেকে গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে গণ্য করা হত।তুর্কমেনিস্তানে যেখানে আধুনিক জীবনের সবচেয়ে জরুরি উপাদান ইন্টারনেট নিষিদ্ধ, সেখানে এই দেশে এসেই লেখিকা এরিকা ফাটল্যান্ড আবার ইন্টারনেট তথা টুইটার, ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদির সুবিধা ফিরে পান।১৯৯১ সালে গর্বাচভ নুর-সুলতান নাজারবায়েভকে রাষ্ট্রপতি পদে বসিয়েছিলেন।সেই থেকে তিনি রাষ্ট্রপতি পদে আছেন,সরে যাওয়ার কোনো লক্ষ্মণ দেখাচ্ছেন না।প্রতিবছর তিনি আরও বেশি কতৃত্ববাদী ও স্বৈরাচারী হয়ে উঠছেন।দেশে সত্যিকারের কোনো রাজনৈতিক বিরোধীপক্ষ নেই,বাকস্বাধীনতার ওপর সরকারি শমনের খাঁড়া ঝুলছে,গত কয়েকবছরে সরকার বেশকিছু খবরের কাগজ আর ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।এতসব সত্ত্বেও লেখিকার কাজাখস্তানকে তুর্কমেনিস্তানের তুলনায় স্বাধীনতার খাস তালুক মনে হয়েছিল।এই দেশের রাজধানী ‘আসতানা’।নাজারবায়েভ দক্ষিণের ‘আলমতি’ থেকে রাজধানী আসতানায় স্থানান্তর করেন।এ নিয়ে বিতর্ক আছে।আসতানা দক্ষিণের জনবহুল অঞ্চলগুলোর থেকে অনেক দূরে অবস্থিত ও তৃণভূমি পরিবৃত শুধু নয়,এই শহর বিশ্বের দ্বিতীয় শীতলতম জাতীয় রাজধানী, মঙ্গোলিয়ার রাজধানী উলান বোতারের ঠিক পরেই।শীতকালে তাপমাত্রা মাইনাস চল্লিশ ডিগ্রি পর্যন্ত নেমে যায়।তবু কানাঘুষো যা শোনা যায়,আলমতিতে নাজারবায়েভের শত্রুসংখ্যা এত বেশি ছিল যে সেখান থেকে রাজধানীকে উত্তরাঞ্চলে স্থানান্তরিত না-করে তার উপায় ছিল না।লেখিকা লিখেছেন যে নাজারবায়েভের নেতৃত্বের ঢংটিকে সবথেকে ভালোভাবে চিহ্নিত করা যায় প্রজাহিতৈষী স্বৈরাচারের অভীধা দিয়ে।যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তিনি নিজে নেন।সংসদের অস্তিত্ব এই দেশে আনুষঙ্গিক। নাজারবায়েভ বারবার বলেছেন যে কাজাখস্তানকে চলতে দিতে হবে তার নিজের পথে,নিজস্ব গতিতে।রাষ্ট্রপতির মূল অগ্রাধিকার অর্থনৈতিক বৃদ্ধি আর জাতীয় প্রতিষ্ঠান গুলোর অগ্রাধিকার। নাগরিক অধিকার, বাকস্বাধীনতা,গণতন্ত্র অগ্রাধিকার তালিকার শেষের দিকে ঠাঁই পেয়েছে।পুরোদস্তুর গণতন্ত্র হয়ে ওঠার জন্য রাষ্ট্রপতি সাল নির্ধারণ করেছেন ২০৫০।নাজারবায়েভের জন্ম ১৯৪০ সালে, তাই সম্ভবত ২০৫০ সালের আগেই তিনি ইহলোক ত্যাগ করবেন।
কাজাখস্তানে লেখিকার আরেকটি দ্রষ্টব্য-স্থান ছিল সেমিপালাতিনস্ক।ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময় এখানেই সোভিয়েত সরকার তাদের গোপন পরুমাণু অস্ত্র পরীক্ষার কেন্দ্র গড়ে তোলেন।রাতারাতি শহর গড়ে তোলা হয়।গড়ে তোলা হয় মিলিটারি ব্যারাক। সেইসব দিনের পরীক্ষানিরীক্ষার বিষাক্ত ফল আজও ভোগ করেছে এখানকার মানুষজন।ক্ষমতায় এসে নাজারবায়েভ প্রথমেই এই বিতর্কিত পরীক্ষাকেন্দ্রটির ঝাঁপ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন।এই সিদ্ধান্ত তাঁর জনপ্রিয়তার ভিত্তি মজবুত করেছিল।সেমিপালাতিনস্কের(কাজাখ ভাষায় শহরটার নাম সেমেই) সর্বাধিক বিখ্যাত বন্দীর নাম ফিওদোর দস্তয়েভস্কি।১৮৫৪ সালে এই শহরে তিনি পা রাখেন।এর আগে উদারনীতিবাদী পেত্রাশেভস্কি গোষ্ঠীর সদস্য হওয়ার জন্য তাঁকে চার বছর সাইবেরিয়ার ওমস্কের জেলে কাটাতে হয়।এবার তাঁর কারাদণ্ডের বাকি মেয়াদটা তাকে সেমিপালাতিনস্কে সৈনিক হিসেবে কাটাতে হয়।কারাগারের ভয়ঙ্কর জীবন কাটানোর পর সেমিপালাতিনস্কে তাঁর এই নতুন ভূমিকা তাঁর কাছে ছিল জীবনের সবথেকে আনন্দের ক্ষণ।পরবর্তীকালে তিনি লিখেছেন,’আমার চারপাশে টাটকা বাতাস,বুকের মধ্যে স্বাধীনতা’।এই শহরেই দস্তয়েভস্কির বাসস্থানটিকে সংস্কার করে গড়ে উঠেছে দস্তয়েভস্কি সংগ্রহশালা।লেখিকা এই সংগ্রহশালাটি ঘুরে দেখেন ও দস্তয়েভস্কির জীবনের অনেক অজানা তথ্য জানতে পারেন।কাজাখস্তানে এরিকার শেষ গন্তব্য আলমাতি।রাজধানী-শহরের মর্যাদা হারালেও এই শহর এখনও কাজাখস্তানের অর্থনীতির প্রাণকেন্দ্র এবং সম্ভবত মধ্য এশিয়ার সবথেকে বহুজাতিক শহর।শহরের চারিদিকে বরফে মোড়া পাহাড়-চূড়ো।আর শহরের কাছাকাছি, পাহাড়ের ওপর রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত স্কেটিং রিঙ্ক মেদেউ।এখানেই গড়েছে এবং ভেঙেছে স্কেটিংয়ের অজস্র বিশ্বরেকর্ড।কাজাখস্তান সফর সেরে প্রথম দফায় লেখিকা দেশে ফিরে আসেন।
২০১৩ সালে এরিকা আবার যাত্রা শুরু করেন।এবার তার গন্তব্য তাজিকিস্তান, কিরঘিজস্তান হয়ে উজবেকিস্তান।তাজিকিস্তানের শতকরা নব্বই ভাগই পাহাড়।রাজধানী দুশানবে।এই দুশানবের মাটিতেই দাঁড়িয়ে আছে দুনিয়ায় উচ্চতম পতাকা-দণ্ড।১৬৫ মিটার লম্বা।কাজাখ আর তুর্কমেনরা মঙ্গোল আর তুর্কি জনগোষ্ঠীর বংশধর।কিন্তু তাজিকদের গায়ে পারসিক রক্ত।তাজিক ভাষার সঙ্গে ফারসি ভাষার ভীষণ মিল।পার্থক্য শুধু এই, ফারসি ভাষা লেখা হয় আরবি বর্ণমালায়। আর তাজিক ভাষায় এখনও সিরিলিক অক্ষরের চল।তাজিকিস্তানের রাষ্ট্রপতি এমোমালি রহমান।এরিকা লিখেছেন : মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর রাষ্ট্রপতির বাসভবনে কোনও লোক একবার ঢুকে পড়ে গদিয়ান হলে তাকে সেখান থেকে তার নিজের ইচ্ছেয় বের করে আনা দুঃসাধ্য কাজ।রহমানও সেই রীতি মেনে রাষ্ট্রপতির প্রাসাদে গ্যাঁট হয়ে বসে আছেন।একুশ শতক শুরু হওয়ার পর ক্ষমতার ওপর তাঁর দখল আরও আঁটসাঁট হয়েছে।তাঁর ও তাঁর স্ত্রী আজিজমোর সাত মেয়ে,এক ছেলে,তারা প্রত্যেকে রাষ্ট্রযন্ত্রের উচ্চপদে অধিষ্ঠিত।… রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রাত্যহিক কর্মভার সামলানোর পাশাপাশি তিনি ডজন খানেক বই লেখারও সময় করে উঠতে পেরেছেন।তার মধ্যে আছে তাঁর সেরা গ্রন্থ ‘দ্য তাজিকস ইন দ্য মিরর অফ হিস্ট্রি।এ বইতে তিনি তাজিকিস্তানের বর্তমান আমলের সঙ্গে ষষ্ঠ শতকের সাসানিদ সাম্রাজ্যের আমলে তাজিকদের গৌরবময় যুগের বিস্তারিত তুলনা করেছেন।এই বই “তাজিক জাতির উদ্দেশ্যে” রহমানের “আধ্যাত্মিক উপহার”।তাজিকিস্তানের বেশিরভাগ মানুষের মাসিক রোজগার আশি ডলারের কম।দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ অপুষ্টিতে ভোগে। শীতকালে নাগরিকদের পর্যাপ্ত বিদ্যুতের জোগান দেওয়া বা শিশুদের ভয়াবহ সব রোগের টিকা দেওয়ার ক্ষমতা তাজিক রাষ্ট্রের নেই।তা সত্ত্বেও দুশানবের রাস্তায় বিএমডাবলু আর মার্সিডিজ বেনজ-এর ছড়াছড়ি।আর সেসবই মূলত প্রশাসনের বড় কর্তাদের আর রাষ্ট্রপতি রহমানের জ্ঞাতিগুষ্টি আর ইয়ার-বকশিদের।মধ্য এশিয়ার এই দেশগুলির মধ্যে একমাত্র তাজিকিস্তানেরই আলাদা করে রাষ্ট্র-ধর্ম আছে এবং সে ধর্ম হানাফি ধারার সুন্নি ইসলাম।কিন্তু মধ্য এশিয়ার আর পাঁচজন রাষ্ট্রপ্রধানের মতোই রাষ্ট্রপতি এমোমালি রহমানের এ ভয়ও আছে আফগানিস্তান, ইরানের মত ইসলামি মৌলবাদ তাঁর দেশে গেড়ে বসতে পারে।তাই চরমপন্থী ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তিনি স্কুলে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে হিজাব পড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।লম্বা দাড়ি রাখা নিষিদ্ধ। আর শিক্ষকদের গোঁফ-দাড়ি রাখাও নিষিদ্ধ।২০০৭ সালে সরকার দুশানবের পাঁচটা মসজিদের মধ্যে চারটিতেই তালা লাগিয়ে দেয়।তারপর মসজিদের ভোল পালটে ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন নানা কাজে সেগুলো লাগানো নয়।যেমন সোভিয়েত আমলে বিভিন্ন মসজিদ বন্ধ করে দিয়ে প্রাকৃতিক মিউজিয়াম বা অন্য কাজে ব্যবহার করা হত।তাজিকিস্তানে লেখিকা ইয়াঘনব উপত্যকা,তাজিকিস্তানের চতুর্থ বৃহত্তম শহর কুরঘোনতেপ্পা,পামির অঞ্চলের রাজধানী খরোগে ঘুরে সীমান্ত পেরিয়ে ঢোকেন কিরঘিজস্তানে।
তুলনামূলক বিচারে কিরঘিজস্তানই মধ্য এশিয়ার একমাত্র খোলামেলা ও গণতান্ত্রিক দেশ।এখানকার জণগণ দু-দুবার ক্ষমতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে রাষ্ট্রপতিকে গদিছাড়া করেছে।এটাই মধ্য এশিয়ার একমাত্র দেশ যেখানে পশ্চিমি পর্যটকদের আলাদা ভিসা লাগে না।রাজধানী বিশকেক।বিশকেক মধ্য এশিয়ার সবথেকে সবুজ রাজধানী।পার্শ্ববর্তী তিয়ান শান পর্বতমালা থেকে বরফ-গলা জল এ শহরের অজস্র পার্ক আর গাছগুলোর জন্য টাটকা জলের যোগান দেয়।এত গাছপালা থাকার ফলে শহরটাতে একটা ছায়াসুনিবিড় গ্রামের আমেজ আছে।দেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি আলমাজবেক আতামবায়েভ।তার ছবি ও পোস্টারে শহরের দেওয়ালগুলো ভর্তি নয়।বস্তুত অনেকদিন থাকার পরও রাষ্ট্রপতিকে কেমন দেখতে,তা লেখিকা জানতে পারেননি। এখানেই এই দেশটি পার্শ্ববর্তী দেশগুলো থেকে আলাদা।১৯৯০ সালে অনুষ্ঠিত মোটামুটি অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি আসকার আকায়েভ।প্রথমদিকে তিনি গণতন্ত্র ও স্বচ্ছতার রক্ষাকর্তা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছিলেন।কিন্তু সময়ের সঙ্গে তাঁর কথা ও কাজের মধ্যে ফারাক বেড়েছে।দেশের অর্থনীতির হাল খারাপ হয়ে পড়েছিল।তার সঙ্গে ছিল দুর্নীতি।অবশেষে ২০০৫ সালে চতুর্থ মেয়াদের জন্য পুনর্নির্বাচিত হওয়ার জন্য যখন তিনি সংবিধান সংশোধনের চেষ্টা চালালেন,তখন মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল।তারা দখল করে নিল কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ভবন।আকায়েভ ও তাঁর পরিবার মস্কোয় পালাল।সেখানেই তাঁরা রাজনৈতিক আশ্রয় পেল।আকায়েভের উত্তরসূরি কুরমানবেক বাকিয়েভ দুর্নীতির ব্যাপারে পিছিয়ে ছিলেন না।তিনি তার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তাঁর পরিবারের লোকদের বসিয়ে দেন। মানুষের অবস্থার উন্নতি হয়নি।এরপর ২০১০ সালে যখন জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম দ্বিগুণের বেশি বেড়ে গেল,মানুষ পথে নেমে এল।হানা দিল হোয়াইট হাউসে (রাষ্ট্রপতির বাসভবন)।এবার প্রাণ গেল সাতাশি জন মানুষের।পরে রক্ষীদের বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়ার জন্য গদিচ্যুত রাষ্ট্রপতিকে তাঁর অনুপস্থিতিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়।তিনি পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বেলারুশে।এখনও তিনি সেখানেই আছেন।এরপর কিরঘিজস্তানে সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করা হয়।রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ছেঁটে ফেলা হয়।এবার থেকে রাষ্ট্রপতি দেশের সংসদ ও প্রধানমন্ত্রীর কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন।
কিরঘিজস্তানে লেখিকা এক অদ্ভুত সামাজিক রীতির সঙ্গে পরিচিত হন।দুলহন ছিনতাই করে বিয়ে করা।এই রীতির নাম ‘আলা কাছু’।যার অর্থ ‘ছিনিয়ে নাও এবং ভাগো’।এই রীতির শিকার কয়েকজনের সঙ্গে এরিকার কথোপকথন হয়।তার ফলে এরিকা জানতে পারেন তাদের দুর্ভাগ্যের কথা।মেয়েটির ইচ্ছে-অনিচ্ছের কোনও দাম নেই।সামাজিক অসম্মানের ভয়ে মেয়েরাও অনিচ্ছাকৃত ভাবে এই বিয়ে মেনে নিতে বাধ্য হয়।কিরঘিজস্তানে এক-তৃতীয়াংশ বিয়েই এই কায়দায় ঘটে।গ্রাম সমাজে অনুপাতটা পঞ্চাশ শতাংশ।প্রতিবছর গড়ে ১১৮০০ তরুণী অর্থাৎ প্রতিদিন তিরিশটি মেয়ে এই প্রথার শিকার হয়।তবে বর্তমানে কিজ করগন ইন্সটিটিউট নামক এক সংস্থা এই রেওয়াজের ইতি ঘটানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।কিরঘিজস্তানেই এরিকার সাক্ষাৎ হয় ‘ঈগল মানুষ’-এর সঙ্গে।ঈগল মানুষের পোশাকি নাম ‘তালগারবেক’।পোশা ঈগলকে নিয়ে নানারকম শিকারের কসরত দেখানো এদের পেশা।রয়েছে একজনের সঙ্গে আরেকজনের ঈর্ষার সম্পর্ক এবং কে কত বড় ‘তালগারবেক’, তা নিয়ে বারফাট্টাই।নির্বাসিত মেনোনাইট জার্মানদের (প্রোটেস্টান্ট খ্রিষ্টান) গ্রাম রট-ফ্রন্ট, কিংবদন্তিসম আখরোটের জঙ্গলে ভরা গ্রাম ‘আরস্লানব’ ইত্যাদি ঘুরে সীমান্ত পেরিয়ে লেখিকা প্রবেশ করেন উজবেকিস্তানে।
আজ উজবেকিস্তান বিশ্বের ভয়ঙ্করতম স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে একটা। রাষ্ট্রপতি ইসলাম কারিমভ জাতি-দাঙ্গা,ইসলামি মৌলবাদ ও প্রতিবেশী দেশগুলোর টলমলে অবস্থার জুজু দেখিয়ে বজায় রেখেছেন তাঁর বজ্রমুষ্ঠির শাসন।এই রাষ্ট্রের একনম্বর অগ্রাধিকার স্থিতিশীলতা। গণতন্ত্র,মানবাধিকার, অর্থনৈতিক বৃদ্ধি, পরের ব্যাপার। বিশেষ করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে উজবেক সরকার কুখ্যাত।১৯৮৯ সালে গরবাচভ কারিমভকে কমিউনিস্ট পার্টি অফ উজবেকিস্তানের সাধারণ সম্পাদক পদে নিয়োগ করেন।১৯৯১ সালের ৩১শে আগস্ট উজবেকিস্তান স্বাধীনতা ঘোষণা করে।সেই থেকে এখনও তিনিই রাষ্ট্রপতি।বর্তমানে রাষ্ট্রপতির বয়স ছিয়াত্তর। বেশ কিছুকাল ধরেই তাঁর শারীরিক অবস্থা নিয়ে দেশে গুজব। টানা কয়েকদিন তাঁকে দেখা না গেলেই তাঁর স্ট্রোক হল কিনা,তিনি কোমায় চলে গেলেন কিনা,সে বিষয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা মাথা ঘামাতে শুরু করে দেন।সকলেরই চিন্তা তাঁর মৃত্যুর পর কী ঘটবে।এই বইয়ের শেষে এরিকা জানান,২০১৬ সালের ২৯শে আগস্ট দুপুর তিনটে পঁয়ত্রিশ মিনিটে তাসখন্দে কারিমভের মৃত্যু হয়—এই তথ্য মস্কোর নামজাদা সংবাদ সংস্থা ফারগানার।যদিও সরকারি তথ্যানুযায়ী তাঁর মৃত্যু হয়েছে ২০১৬-র ২রা সেপ্টেম্বর রাত আটটা পঞ্চান্ন মিনিটে।এরপর দেশের প্রধানমন্ত্রী শওকত মিরজিওয়েভ রাষ্ট্রপতি হয়েছেন।
উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দ।উল্লেখযোগ্য শহর সমরখন্দ,বুখারা।লেখিকা কিরঘিজস্তানের সীমান্ত পেরিয়ে নিকটবর্তী যে শহরটিতে আসেন তার নাম আন্দিজান।এরপর নানা জায়গা ঘুরে তিনি তাসখন্দ হয়ে দেশে ফেরেন।আন্দিজান মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের জন্মস্থান।শহরের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে বাবর স্কোয়ার।এই জায়গাটিতেই ২০০৪ সালে বিক্ষোভকারীদের ওপর সশস্ত্র সৈনিকেরা নির্বিচারে গুলি করে।সরকারি ভাবে ১৮৭ জনের মৃত্যু হয়।কিন্তু বিদেশি সাংবাদিকদের মতে সংখ্যাটা চারশো থেকে ছশোর মধ্যে।ফারঘানা উপত্যকার ব্যস্ত মফস্বল শহর মারজিলান রেশম উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত—সেই জায়গা ঘুরে ও রেশম উৎপাদনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে,লেখিকা আসেন কারাকালপাকস্তানে।এই অঞ্চল উজবেকিস্তানের মোট আয়তনের এক-তৃতীয়াংশ জায়গা জুড়ে বিস্তৃত।নুকুস হল কারাকালপাকস্তানের রাজধানী।এই নুকুস শহরেই রয়েছে এক আশ্চর্য শিল্পসংগ্রহশালা।যা এক রুশ শিল্পী ইগর সাভিৎস্কি-র সারা জীবনের উদ্যোগ, প্রচেষ্টা ও ভালোবাসার ফল।এই সংগ্রহশালা কেন গুরুত্বপূর্ণ, কেন ইউরোপ ও পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে প্রতিবছর বহু শিল্পরসিক মানুষ মরুভূমি দিয়ে ঘেরা এই কারকালপাকস্তানে উড়ে আসেন, তার বিশদ বর্ণনা লেখিকা দিয়েছেন।রুশ শিল্পী ইগর সাভিৎস্কি প্রাচীন খোয়ারজাম সভ্যতার নানা শিল্পবস্তু সংগ্রহের মধ্যে দিয়ে শুরু করেছিলেন,এরপর ক্রমশই তাঁর কাজের পরিধি বাড়তে থাকে।নিজের শিল্পচর্চা বন্ধ করে দিয়ে তিনি শিল্পসংগ্রহে পুরোদস্তুর লেগে পড়েন।সারা রাশিয়া ঘুরে স্তালিন জমানায় নিষিদ্ধ বহু বহু শিল্পীর স্টুডিও ও তাঁদের বিধবা স্ত্রীদের ফ্ল্যাট থেকে যথাযথ অর্থমূল্য দিয়ে তিনি সংগ্রহ করেন বিপুল সংখ্যক শিল্পসম্ভার।এই সংখ্যাটা এতই বিশাল যে সোভিয়েত বাস্তববাদের বাইরে রাশিয়ার শিল্পীরা কমিউনিস্ট শাসনের আঁটসাঁট নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই কিউবিজম, ডাডাইজম,স্যুররিয়ালিজম, এমনকি প্রতিবাদী নানা চিত্র যে রচনা করেছেন, তা দেখতে শিল্পরসিকদের আসতে হয় এই সুদূর কারকালপাকস্তানে।তুলোচাষের জন্য প্রসিদ্ধ ময়নাক,প্রাচীন শহর খিভা,তৈমুর লঙের নিজ-হাতে তৈরি শহর সমরখন্দ ও বুখারা হয়ে ট্রান্সক্যাস্পিয়ান রেলপথে কারাকুম মরুভূমির বুক চিরে সর্বশেষ স্টেশন উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে এসে পৌঁছান লেখিকা।এটি মধ্য এশিয়ার বৃহত্তম শহর। কুড়ি লক্ষ লোক এই শহরের বাসিন্দা।বিশাল সংসদ ভবন,যার নাম হোয়াইট হাউজ,পেল্লায় সাইজের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক,বিলাসবহুল হোটেলে ভরা এই শহরটিতেও তুর্কমেনিস্তানের রাজধানী আশগাবাতের মত স্বৈরাচারী শাসনের গন্ধ ও ভ্রুকুটি।
এই বইয়েরই এক জায়গায় এরিকা লিখেছেন : আমরা ভ্রমণে বেরোই কেন? বিপুল দূরত্ব অতিক্রম করার এবং দূরবর্তী বিদেশ-বিভুঁইয়ে থাকার সঙ্গে জড়িত হাজার রকমের ঝক্কি পোহাই কেন? এ ব্যাপারে আমার তত্ত্বটা হল, প্রকৃতি আমাদের উপহার দিয়েছে হরেক রকমের ভ্রান্ত ও প্রতারক স্মৃতি। সেই জন্যই আমরা বরাবর নতুন নতুন অভিযানে বেরিয়ে পড়ি।ঘরে ফিরে আসার পর যাবতীয় ঝক্কি মজাদার গল্পগাছায় রূপান্তরিত হয়,কিংবা আমরা সেগুলোর কথা ভুলে যাই।স্মৃতি সরলরেখার পথ ধরে চলে না, সে বরং অনেকটা রেখাচিত্রের মতো, নকশার মতো, সে নকশায় অনেক বিন্দু; তুঙ্গ মুহূর্তের বিন্দু; আর বাকিটা স্রেফ ফাঁকা। আবার স্মৃতি জিনিসটা বিমূর্তও বটে।ভবিষ্যতের অবস্থান থেকে ফিরে তাকালে অতীতের ঝক্কি-ঝামেলাকে প্রায় অবাস্তব বলে মনে হয়, অনেকটা যেন স্বপ্নে দেখা দৃশ্যের মতো।