সেপিয়া রঙের গলি – সপ্তম পর্ব        অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

সেপিয়া রঙের গলি – সপ্তম পর্ব অঙ্কিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

ওয়ায়েল সালেহ-র জন্য…

আমার ঘুমের ভিতর সেইসব বাড়ি। উন্মুক্ত ত্রিভুজ হয়ে আকাশে উঠে যাওয়া বাড়িগুলির মাথায় ময়লা মেঘ। হয়ত সেখানে ধীর লয়ে বেলা বাড়ছে। হয়ত বিপরীতে জল। জলের ওপর দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি। আমার ঘুমের ভিতর ঝিমঝিম শব্দ, অন্যরকম হাওয়া। অবচেতনে সুতোর গায়ে সুতো বসিয়ে কে যেন সেলাই বুনছে।

দু’পাল্লার জানালা কোথায় দেখেছি? মনে করার চেষ্টা করলাম। লাল ইটের ঘরবাড়ি, যেন বা প্রাচীর আমার চোখে সকাল নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই প্রাচীর কি আমার চিরপরিচিত কারাখানা-গলির? অবিন্যস্ত জানালার পাশে ছাদ থেকে নেমে আসা সাজানো নীল গাছটি চেনা। ও কে, যে সকাল হতেই নীরব কাজে ব্যস্ত। এ কোন মন্থর গতিময়তা আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে চলেছে শৈশবে, প্রথম দেখা পৃথিবীতে?

শৈশব? শৈশব সম্ভব নয়। গাঢ় তন্দ্রার ভিতর, তখনও অতল গভীরে তলিয়ে যাইনি, তখনও চেতন-অবচেতনের মাঝে হেমসেলাই পড়ছে, এমন সময় মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছে, এক অকল্পনীয় ভারসাম্যে ১৬৫৭ সালের জলে দাঁড়িয়ে রয়েছি। ডেফট (Delft) শহরের দুনিয়া থেকে আমার দুনিয়া কত দূর?

অনেক দূর। আমি কি ছবি বুঝি? এই কি আমার ছবি বুঝবার বয়স! আমার দেখার বয়স চার, কালো কাঠের দরজাটিকে চিনতে পারি। আলো-ছায়া ঘরের আভাস দুয়ারে সেলাই-ফোঁড়াই নিয়ে আসছে কোনও সাদা থানের স্মৃতি। যেন আমাদের শহরেও আজ ধোঁয়ার মতো আলো, বাড়িগুলির দু’পাল্লার জানালা খোলা, হাওয়ায় গাছ দুলছে, কাজে ব্যস্ত নীরব সংসার। কোথাও কিছু কম পড়েনি, কারাখানা-গলির লাল ইটের প্রাচীর স্বাভাবিক, শুধু কে যেন বলে গেল… ‘কফিন আসছে…’

কোথায় আসছে কফিন? ডেফট (Delft) শহরে কফিনের খবর নেই। অথচ যোহানেস ভেরমেয়ারের আঁকা এই ছবি আমার শহরে কফিন আসার ইতিহাস বলে চলেছে প্রায় পাঁচ শতক ধরে। ঘুমে ডুবে যাওয়ার আগের মুহূর্তে মনে হল শহরে একটি কফিন পৌঁছনোর আগের মুহূর্তটি এঁকে রেখে গেছেন ডাচশিল্পী। এই রাস্তা, এই নীরব লোকালয় আমার চেনা। শান্তভাবের মধ্যে দিয়ে আদতে বলা হচ্ছে যুদ্ধের গল্প। কোথাও একটি যুদ্ধ লেগেছে। বহুদূরে, আঁচ নেই আমার শহরে। তবু একটি কফিন এল শহরে। আমার আত্মীয় কাঁধে করে বয়ে আনল কার্গিল যুদ্ধে শহিদের কফিন। এই ছবির সকাল আর কারখানা-গলির সকাল এক করে দিল একটি অদেখা কফিনের স্মৃতি।

সেই সকালে আমার চারবছর পুরনো দু’টি পা একা একা দৌড়ে গেল এপাড়া-ওপাড়া। চেনা চেনা বাড়িগুলির জানালায় বলে গেল, ‘কফিন এসেছে… জান কফিন এসেছে…’ জানালার ভিতরের ছায়াময়তা বুঝি বা দুলে উঠেছিল, বুঝি বা নির্বিকার ছিল। তবু রাস্তায় রাস্তায় ছুটে কফিনবন্দি মানুষের খবর জানাচ্ছিল এক শিশু। খুঁজে খুঁজে দেখছিল, কোথাও গুনগুনে ভিড়, আর কোথাও কোনও প্রভাব নেই… সে শুনেছিল, দূরে এক যুদ্ধ চলছে।

‘দ্য লিটল স্ট্রিট’-এর নীরবতা ছিঁড়েকুটে গেল। আমার অতল ঘুমে চিড় ধরে গেল। একটি মেয়ের বিকট চিৎকার ভেসে এল। মধ্যরাতের কিছু পরে একটি গলা থেকে রক্ত উঠে আসবার জোরে চেঁচিয়ে উঠল কেউ। কোন বাড়ি থেকে শব্দ আসছে, বোঝা গেল না।

নির্জন হেমন্তের রাত। কোথাও একচুলও শব্দ নেই। আশ্চর্যজনক মায়াময় সময়। প্রতিটি বাড়ির জানালা-দরজা বন্ধ। হলুদ আলোর রাস্তাগুলি জনমানবশূন্য। দূরপাল্লার ট্রেনের শব্দ মাঝে মাঝে আসে। এধারে জল, জলের ধারে বাড়িগুলি নিভে গেছে বহুক্ষণ। জলের ওধারে বহুতলগুলির জানালা অন্ধকার। এই সাদা রাস্তাটা আমার শহরের উত্তর ও দক্ষিণকে যোগ করে রাখে। অন্য শহরের সীমানা থেকে ওধারের নদী পর্যন্ত লেপচাপা রাতে কোথাও কিচ্ছু নেই, শুধু মেয়েটি চিৎকার করে চলেছে।

ভয়ানক কাঁদছে একটি মেয়ে। গলা দিয়ে বেরিয়ে আসছে ক্ষোভ, যন্ত্রণা, তীব্র ক্রোধ, হয়ত অভিমান। সঙ্গে শরীরী ঝটাপটির শব্দ। একটা হাতাহাতি, একটা লড়াই যেমন হয়। সঙ্গী পুরুষকন্ঠটিও সমান চিৎকারে স্থান বজায় রাখছে। অন্য সম্পর্কের চুরমার ভাঙা সময়। যে সকল লড়াই থেকে আর ফিরে আসা যায় না, এ হল তেমন লড়াই। তাদের হুঁশ নেই। কোন ঘর? কোন ঘরে এমন হল ভেবে এ শহরের ঘুমভাঙা মানুষের বুক কাঁপছে।

চিৎকার থামার লক্ষণ নেই, ঘড়িতে দেখলাম রাত একটা বেজে সাতচল্লিশ মিনিট। গলা চিরে গেছে বোধহয়, মেয়েটি পালাতে চাইছে। আমরা, এলাকাবাসীরা একটি মেয়ের ঘর থেকে পালাতে চাওয়ার শব্দ পাচ্ছি। কিন্তু কোন ঘর, কোন ঘর? বিস্ফোরক শব্দে দরজা বন্ধ হল। পুরুষটি দরজা বন্ধ করে চিৎকার করছে। ভাঙা স্বরের মেয়েটি কি হার মানবে? লেপের আরামে রুদ্ধশ্বাস নাটকের মতো প্রহর গুনছি আমি। বুঝতে পারছি, অশান্তির ধার বাড়িগুলিকে জাগিয়ে তুলেছে। অন্ধকারের বদ্ধ সীমানায় কাচের গায়ে ধাক্কা খাচ্ছে চিৎকার। অদ্ভুত এক সময়, যখন বন্দি মানুষেরা আপনিই বুঝে যায়, সবাই জেগে আছে।

চিৎকার থামল। স্বস্তি ও কৌতূহলের দোলায় দুলছে একটা আধোঘুমের শহর। ঠিক তারপরেই হুড়মুড়িয়ে আসবাব ভাঙার শব্দ হল। যেন ঘরের ভিতর চুরমারের ক্রোধ জাহির চলছে। কোন ঘর! কোন ঘর! কেউ জানে না কোন ঘর।

মেয়েটির চিৎকার এখন গোঙানি হয়ে উঠেছে। পুরুষের স্বর আকাশ ভেদ করে ক্ষোভ জানান দিচ্ছে। আমার দরজায় টোকা পড়ল। পরিবার উঠে এসেছে। বন্ধ দরজার এপারে-ওপারে দ্বিধা রয়ে গেল।

-শুনছিস? জেগে আছিস?

-শুনছি।

-খুব চিৎকার আসছে।

-কোন বাড়ি?

-বোঝা যাচ্ছে না।

-বেরোবে? বেরিয়ে দেখবে?

বন্ধ দরজার ওপার নীরব। শীতল হাওয়ায় কথা ভাসিয়ে দিলাম।

-বেরিয়ে দেখতে পারো।

পায়ের শব্দ অন্য ঘরে চলে গেল। অথচ সেই রাতে সবাই জেগেছিল।

ধীরে ধীরে লেপের আরামে মনে হল, চিৎকারটা সয়ে যাচ্ছে। তীব্রতা সামান্য কমেছে। না কমলেও সময়ের নিয়মে গুরুত্ব হারাচ্ছে ঘটনা। পুরুষটির বাক্যবাণ, মেয়েটির উত্তর, গোঙানি, ঝনঝন শব্দ আমার চোখে তন্দ্রা এনে দিচ্ছে। সেই ঘোরে ফিরে এল শিশুটি। সে’ও আমার মতো ছুটছে। লাল ইট দিয়ে ঘেরা শান্ত কারখানা-গলির সাদা পথ বেয়ে সাদা তাবুর দিকে ছুটছে পাঁচ বছরের ওয়ায়েল সালেহ। আশা করে যুদ্ধ থামলে বাড়ি ফিরে যাবে, আর ঘুমোবে।

একটা সময়ে প্রায় রণক্লান্ত মানুষের চিৎকার থেমে গেল। বন্ধ দোকান, ঝিমোনো কেয়ারটেকার, হেমন্তের স্কুলবাড়ি, ফাঁকা পথ, একা একা আলোগুলির মাঝে গাঢ়তম ঘুমের আমেজ ফিরে এল। কোথাও রেল চলে গেল। প্রথম পাখি অকারণে ডেকে উঠল। আমার ঘুমের ভিতর আরও এক ন’বছরের বালক কেঁদে চলল। শিরচ্ছিন্ন দেহ বয়ে নিয়ে গেছে সে। কেঁপে উঠল। রিফিউজি ক্যাম্পের জমিতে রোজ কেঁপে ওঠে সে।

ছাদের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের রোদ মনে আসে। কল্পনা রোমাঞ্চ দেয়। কাল দুপুরে ভেজা চুলের মজলিশে রাতের চিৎকারের গল্প জমবে। কোন ঘরে, কোন ঘরে- কৌতূহলের গ্যাসবেলুন উড়বে জলের ওপরে। সকলে জেগে ওঠার অভিজ্ঞতা জানিয়ে যাবে। আমার চোখে চোখে ঘুরে বেড়াবে ওয়ায়েল সালেহ, আধোস্বরে আমাদের জেগে ওঠা বুঝতে চাইবে।

ঠিক যেন একটা ছবি। নদীর পাড়ে এমন সুন্দর আমার শহর। ফার্স্ট ট্রেন যাওয়ার শব্দ হল। একটা দুটো পাখি ডেকে উঠল। ছবির মতো শহরে ভোর আসছে। আরেকটা দিন তার অভাব, ব্যস্ততা, দারিদ্র, উন্নাসিকতা বয়ে আনছে। এখানে কংক্রিট ভাঙা ধুলোর পাহাড় নেই। এখানে প্রথম ভোর, যারা জেগেছিল তারা ঘুমিয়ে পড়েছে।

আমি আর সেই শিশু ঘুমের ভিতর ছুটতে থাকি। আমার লাল ইটের সাজানো শহর, সেলাইদিদা, গাছবাড়ি সব যুদ্ধের পেটের ভিতর ঢুকে যায়। এখন আমার অবচেতনে সমস্ত শহরটা বেমালুম এক রিফিউজি ক্যাম্প হয়ে আসে। একটু জল, অল্প খাবার, মানুষ ধস্তাধস্তি করে মরে। বেঁচে যাওয়া জীবনটাকে দু’হাতে আগলায়। ওয়ায়েল সালেহ ছুটে বেড়ায়। অবাক চোখে পৃথিবী দ্যাখে। লড়াই থামলে সে ঘুমোবে।

যোহানেস ভেরমেয়ারের আঁকা ছবি যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে অবচেতনে। আমার শহর ছিঁড়ে যাচ্ছে কি? শিশুদের কবর গড়ে প্রতিশোধ চলছে। একটা সকাল আসছে।

যুদ্ধে নষ্ট দেশে পাখি আসে কি? জানি না। গণকবর থেকে দূরে আমরা জেগে আছি। রিফিউজি ক্যাম্পের ধ্বংসস্তূপ আমাকে ভাবিয়ে তোলে। আমি বিছানার ওমে শুয়ে থাকি।

ভোর হয়ে এসেছে। আমার শহরে কত পাখি! কারখানা-গলি থেকে জাবালিয়াহ বহু দূরে।

চিত্রসূত্র- ১) দ্য লিটল স্ট্রিট – যোহানেস ভেরমেয়ার (১৬৫৭-১৬৫৮) ২) এয়ার স্ট্রাইকের পরে জাবালিয়া রিফিউজি ক্যাম্প – উত্তর গাজা

CATEGORIES
Share This

COMMENTS

Wordpress (0)
demon slauer rule 34 lena the plug leak amateurtrheesome.com cumming in milfs mouth mujer haciendo el amor a un hombre, belle delphine of leaked emma watson in porn xxxamat.com big booty in public hidden cam gay sex, sit on face porn g a y f o r i t forcedpornanal.com please screw my wife female celebrity sex tapes
410 Gone

410 Gone


openresty